সালেম সুলেরী
২০২৪-এ বাংলাদেশে থেকে মহা-ইতিহাসের সঙ্গী হ’লাম। আন্দোলনকালে পেশাগতভাবে সাংবাদিকতা করেছি। দেশ-বিদেশের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিলাম সক্রিয়।
বাংলাদেশের আন্দোলন-ইতিহাসের কপালে তিনটি মহাতিলক। ১৯৭১-এ রক্তস্রোতধারার ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ।’ ১৯৯০-এ স্বৈরাচার বিরোধী ‘ছাত্র-জনতা আন্দোলন।’ ২০২৪-এর কোটা সংস্কারে ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান। সৌভাগ্য, একজীবনে তিনটি শীর্ষ ঘটনারই প্রামাণ্য স্বাক্ষী আমি।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবর্ষে সাড়ে ৯ বছরের কিশোর ছিলাম। গরুর গাড়িতে পরিবারের সাথে ভারত পলায়ন। শরণার্থীরূপে সাত মাস অবস্থান, বিজয়লাভ। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের যুদ্ধশেষে স্বাধীনতপ্রাপ্তি। আশির দশকে ‘দৈনিক বাংলা’র বাণীতে স্মৃতিগদ্য লিখেছি। ‘দিনবদলের দিনগুলো’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে।
১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকালে আমি মিডিয়ায় পেশাজীবী। সর্বাধিক সার্কুলেশনের ‘সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে’ নির্বাহী সম্পাদক। ছাত্র-জনতার পক্ষে দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিলো। কবি হিসেবেও গণতন্ত্রপন্থী ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ সংগঠিত করি। ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরশাসনের ঘটনাবহুল পতন হয়।
২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন জুলাই-আগস্টের নিবেদন। পুরোটা সময় বাংলাদেশে, ঢাকায় থেকেছি। নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানায় ‘লিড নিউজ’ করি। একাধিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে প্রামাণ্য প্রতিবেদন। পাশাপাশি শুরু থেকেই লিখেছি বিপ্লবের কবিতা। ‘বাংলা রিভিউ’সহ দেশ-বিদেশের পোর্টাল, সংবাদপত্রে লিখেছি। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ আট জন শহীদ। ‘গায়েবানা জানাজার ডাক’ শিরোনামে প্রথম কবিতা লিখি আমি।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ জাতির এক বৃহত্তর আবেগের নাম। মুক্তিযুদ্ধে, স্বৈরাচার নিপাতে, কোটা-সংস্কারে ছাত্রযোদ্ধারাই মহীরুহ। এই তারুণ্য শক্তির সোপানতলে অভিভাবক, শিক্ষক, জনগণ। ২০২৪-এর গণবিস্ফোরণের ইতিহাস শতাব্দীসেরা। এসময়ে ৫০০ লাশের ভেলায় ভেসেছে বাংলাদেশ। ১৯৮৯-এ চীনের ‘তিয়েন আনমেন চত্বরে’র ছাত্রবিক্ষোভ যেন।
মহা-আন্দোলনের প্রতিপক্ষ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাসীন দল আ’লীগ, সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, সংস্কৃতিসেবীদের একাংশ। ছিলো আজ্ঞাবহ সাংসদ, প্রশাসন, বণিক সম্প্রদায়, পুলিশ-বিজেপি। পরিশেষে মহা-আন্দোলনের বিপরীতে ক্ষমতাসীনের মহাপলায়ন। বঙ্গবন্ধুর জীবিত কন্যাদ্বয় হাসিনা-রেহানার দেশত্যাগ। সতীর্থদেরও গোপন পলায়ন, আত্মগোপন। ৭৬ বছরের প্রাচীন দল আ’লীগ মহাবিপ্লবে ধরাশায়ী।
আন্দোলনের গরম দিনগুলো সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেছি। কী শাহবাগ, কাকরাইল, বেইলিরোড, ফার্মগেট, সংসদভবন, গণভবন। স্মৃতিতে ভালোলাগার পাশাপাশি মন্দও ঠেকেছে অনেককিছু। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙ্গার মহোৎসবে কষ্ট পেয়েছি। ‘শ্রীলংকার ট্রাজেডী’ দেখা গেলো প্রধানমন্ত্রীর ‘গণভবনে’। সংখ্যালঘুদের ওপর কিছু আক্রমণ বিশাল বিজয়কে খাটো করবে।
যাক, বিষয়াবলী লিখছি নিরপেক্ষতার আলো ছড়িয়ে।
২০২৪-এর ৫ আগস্ট’কে বাংলাদেশের ‘নব-বিজয়’ বলা হচ্ছে। আমি এই বিপ্লবের সফল বীরদের শতভাগ শুভেচ্ছা জানাই। পাশাপাশি কোটা-শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, স্বর্গসুখ প্রত্যাশা। তাঁদের প্রতি নিবেদিত প্রথম কবিতাটি :
গায়েবানা জানাজার ডাক 🔸 সালেম সুলেরী
………..
যেন তিতুমীর, ফাঁসি-ক্ষুদিরাম, নূরলদিনের ছায়া,
রফিক সালাম জব্বারও খুন, মাতৃভাষার মায়া।
আত্নাহতির করুণ সিরিজে শিলচর একাদশ,
চাঁটগাঁ‘র প্রীতি, সূর্যসেনের বিপ্লবী রণ-যশ।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আসাদ বা মতিউর
ডক্টর জোহা, শহীদ রুমি বা রক্ত সমুদ্দুর।
স্বৈরাচারের পতন-প্রয়াসে জেহাদ মিলন নূর,
গণতন্ত্রের সত্য পতাকা কতোদূর কতোদূর?
পেশা সুবিধার কোটা-অসুবিধা, দু‘হাজার চব্বিশে,
আন্দোলনের তারুণ্য মুখ মিছিল-নদীতে মিশে।
কোটা বিরোধের ফোরাত নদীতে রক্ত স্রোতের ঘাম,
মোহররমের তাজিয়া মিছিলে ‘বাজিয়া উঠিলো নাম’।
আত্নাহুতির সাঈদের সাথে আসিফ, ফারুক, রাফি,
আছে শা’জাহান, এম আদনান, কিভাবে মেরেছে পাপী,
মরেছে সবুজ, ওয়াসিম-সোমা.. নির্দয় নীলাকাশ,
শোকের আবাস, হতাশার দাশ, প্রাণথেকো ইতিহাস।
জন-অধিকার দেবে কি সাঁতার, তারুণ্যখুন মানা যায়?
স্বদেশ-প্রবাস দাও শুভশ্বাস লাখো গায়েবানা জানাজায়
॥ ১৬ জুলাই ২০২৪