আবু তাহের সরফরাজ
গণপিটুনিতে প্রাণ হারানোর ভয়ে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করলো। অনেকেই বলবেন, এটা স্বাধীনতা নয়, সরকার পতন। তাদেরকে অনুরোধ করবো এই ভূখণ্ডের ইতিহাস পড়ে আসতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের ভূমিকা পূর্ব পাকিস্তানে কী রকম ছিল? স্কুলের ইতিহাস বই থেকেই এসব কথা আমরা প্রত্যেকেই জানি। এসব জানতে ইতিহাসের ভারি ভারি বই পড়ার দরকার হয় না। পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করতো পূর্ব পাকিস্তানকে। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা নিজ দেশে বসবাস করেও উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করতো। সরকারি চাকরিতে তাদের কোনো অধিকার ছিল না। এ দেশের সব টাকা নিয়ে যাওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। মোট কথা, তারা আমাদেরকে শোষণ করতো। এই শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি আহ্বান জানান, যার যা আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়তে। ফলে, শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা বিজয় অর্জন করলাম। পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশটির নাম হলো বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করলো বাংলাদেশ। সরকার পতন না বলে স্বাধীনতা কেন বলছি, সেটা সহজেই বোঝা সম্ভব। কেননা, শেখ হাসিনার প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনচিত্র আমাদের চোখের সামনে ছিল। আমরা দেখেছি, সরকারের প্রতিটি সেক্টরে হরিলুটের মতো লুটপাট হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও সচিবালয় থেকে শুরু করে গণভবনের পিয়ন ও সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়িচালক, প্রত্যেকেই কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। গণমাধ্যমে সেসব খবর বারবার প্রচারিত হলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। কোনো দুর্নীতিবাজকে নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হলে সরকার বড়জোর ওই ব্যক্তিকে বদলি করে দিয়েছে। এসব নতুন করে জানার কোনো বিষয় নয়। সকলেই জানেন। আরও জানেন, সরকারপ্রধানসহ মন্ত্রীরা জাতিকে যে কোনো বিষয়ে ভুংভাং বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। সাবলীল উচ্চারণে মিথ্যা কথা বলেছেন। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে দেশের প্রতিটি ইি তে তারা পোষ্যবাহিনী তৈরি করেছেন। যাদের প্রধান জীবিকা ছিল ফুটপাথের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা। সরকারি চাকরির বেলাতেও তারা আওয়ামী লীগকরণ সিস্টেমে নিয়ে আসে। প্রকৃতি অনেক মুক্তিযোদ্ধা সরকারি তালিকায় স্থান পায়নি। অথচ যাদের জন্ম ৭১ সালের পরে তাদের অনেককেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে নিয়মিত ভাতা দেওয়া হয়েছে। সহজেই বোঝা যায়, এখানেও আওয়ামী লীগকরণ। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার চাইছিল, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আরও বেশি আওয়ামী কর্মী অধিষ্ঠিত করতে।
সবমিলিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে এমন একটা পরিস্থিতির ভেতর নিয়ে যায় যেখানে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে একটি বিশেষ ধর্ম। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয় যে, যেন তিনি আওয়ামী ধর্মের নবি! এই দুঃশাসনে জনগণের নাভিশ্বাস উঠে যায়। কিন্তু প্রতিবাদ করলেই ফ্যাসিবাদী থাবা এসে প্রতিবাদকারীকে তুলে নিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যায়, তা কেউ বলতে পারে না। তারা শোষণ করবে, জনগণ শোষিত হবে, এটাই আওয়ামী ধর্মের বিধান। এই বিধানকে কার্যকর করতে তারা নানা আইন প্রণয়ন করে। প্রতিবাদের কোনো পথই তারা খোলা রাখেনি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল তাদের ক্ষমতা নামের লুটপাটের ব্যবসার পুঁজি। তাদের শোষের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই আওয়ামী লীগ প্রতিবাদকারীকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার তকমা লাগিয়ে দেয়। দেশের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। কথায় বলে, চোরের দশদিন গেরস্তের একদিন। কোটাবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলো দেশের শিক্ষার্থীরা। এরপর যা-যা ঘটে গেছে, তার সবই আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে পশ্চিমি হানাদার বাহিনী অতর্কিত ঝাপিয়ে এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর। রক্তের স্রোত গিয়ে মিশে যায় পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনাও দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেশকে পুরোপুরি অন্ধ করে ফেলল। এরপর চালালো গুলি। দেশজুড়ে রক্ত, রক্ত আর রক্ত।
এই যে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে এই পরিস্থিতিতে দেশের কবিদের ভূমিকা কি ছিল? এসময় তিন ধরনের কবি আমাদের চোখে পড়ে।
এক. দীর্ঘদিন সরকারের উচ্ছিষ্ট খেতে খেতে এরা বেশ পুষ্ট হয়ে উঠেছে। এবং নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, জগদ্দল হাসিনাকে কেউ ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবে না। ফলে, ফেসবুকে তারা ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে স্ট্যাটাস দিয়েছে। হাসিনার পাশে থেকে তার হাতকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পরপরই এই কবিসাহেবরা তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভ করে ফেলেছেন।
খ. এই দলটিও দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের নুন খেয়ে আসছে। হাসিনাকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নামে নানা সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। মাসে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা বেতন হিসেবে পকেটে ঢুকিয়েছে। এই দলটি ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দেয়নি। কোথাও মুখ খোলেনি। চুপচাপ ঘরে শুয়ে-বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। এই দলটি আসলে সুবিধাবাদী। ‘যখন যেমন তখন তেমন’ নীতিতে বিশ্বাসী। বর্তমানে ড. ইঊনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। এখন এই সুবিধাবাদী কবিদের কেউ কেউ হাসিনার বিরুদ্ধে একটু-আধটু স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের অবস্থা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করছে। জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠন করবে, এটা আমরা সকলেই নিশ্চিত। সুবিধাবাদী কবিদের দলটি তখন তারেক জিয়ার উচ্ছিষ্ট খেতে মরিয়া হয়ে উঠবে। আসলে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট্য না খেলে যে এসব কবিদের পেটের খিদেই দূর হয় না। সবসময় পেটটা কী রকম যেন খালি খালি লাগে!
গ. এই দলের কবিরা জীবিকার দরকারে কারো তোষামোদি করা ঘেন্না করে। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কিছু খুঁদকুঁড়োর ব্যবস্থা করে কোনোমতে সংসার নির্বাহ করে। এরাই ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক স্ট্যাটাস দিয়ে গেছে ফেসবুকে। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে উৎসাহ দিয়েছে বিভিন্ন পোস্ট লিখে। কেউ কেউ কবিতা লিখেও আন্দোলনের গতিকে বেগবান করতে চেষ্টা করেছে। এরা একবারো ভাবেনি, শেষমেষ যদি হাসিনার পতন না হয় তাহলে তাদের ওপর কী ভয়ানক নির্যাতন নেমে আসবে।
এই হচ্ছে কবিদের অবস্থান। ভয়াবহ এই সময়ে দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা কি ছিল? ওপরে যে তিন শ্রেণির কবিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, গণমাধ্যমও ওই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। বেশিরভাগ গণমাধ্যম দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রেখে সংবাদ পরিবেশন করছিল। আন্দোলনের শেষদিকে তো ১২ দিন ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। সেই সময় গণমাধ্যমের প্রচারণাও বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট খোলার পর দু’একটি গণমাধ্যম ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করার যোগ্যতা দেখাতে পারেনি। কিন্তু নির্ভীক ও মেধাবী সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব তার সম্পাদিক ওয়েব পোর্টাল ‘বাংলা রিভিউ’তে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দাম্ভিকতা ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে, হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকাময় বাংলাদেশকে নিয়ে ওপরে বর্ণিত তৃতীয় দলের কবিরা যেসব কবিতা লিখে ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছেন সেসব কবিতা সাজ্জাদ তার পোর্টালে ছাপিয়ে গেছেন। তিনি বাংলাদেশে থাকেন না। থাকেন নিউ আটলান্টাতে। প্রবাসে বসেই তিনি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। সেসব কবিতায় কী রকম বাংলাদেশের ছবি ফুটে উঠেছে, সেদিকে এবার আমরা চোখ ফেরাবো। কাজী জহিরুল ইসলামের লেখা ‘শহীদ আবু সাঈদ’ কবিতার একটি টুকরো পড়া যাক:
তার প্রসারিত দুই বাহু ছিল একটি উড়ন্ত পায়রার মতো,
বুকে তার অসীম সাহস,
ভালোবাসার বারুদে ঠাসা ছিল সেই বুক,
কী বন্ধু কী অচেনা নিন্দুক
সকলের জন্যে ছিল অবারিত ভালোবাসা,
তার ডান হাতে ছিল একটি প্রতীকী লাঠি,
এই অন্ধ সমাজের হাতে
উদ্দীপ্ত যুবক তুলে দিতে চেয়েছিল ছোট্ট একটি ন্যায়দণ্ড।
আবু সাঈদ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। আন্দোলনের সময় তিনি দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে দাঁড়ান। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সবার আগে এগিয়ে আসে ছাত্রসমাজ। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। তারা পরিবার নিয়ে নীরিহ জীবন কাটাতে চায়। এই সুযোগে সাধারণ মানুষকে শোষণ করে একদল ক্ষমতাবান মানুষ। ছাত্ররা কিন্তু ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ভয় পায় না। কারণ, তাদের শরীরে বইছে তারুণ্যের টগবগে রক্ত। তাদের চোখে জ্বলে জ্ঞানের মশাল। জ্ঞানের আলোয় তারা দেখতে পায় অত্যাচারীর থাবার নিচে অন্ধকারে বাস করছে জাতি। জাতিকে মুক্ত করতে নানা সময়ে ছাত্ররা আন্দোলনে রাজপথে নেমেছে। তাদের রক্তে ভিজে উঠেছে পৃথিবীর বুক। তারাই সাজিয়ে তোলে করে ভবিষ্যতের ভালোবাসার পৃথিবী। সাধারণ মানুষ যে পৃথিবীর আশা করে ছাত্রসমাজ সেই পৃথিবী নির্মাণ করে। ছাত্রদের চোখে সাধারণ মানুষ নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দ্যাখে। সাধারণ মানুষের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই সাঈদ বীরের মতো পুলিশের বুলেটের সামনে বুক পেতে দেন। পুলিশের হাতের বন্দুক ছিল বুলেটে ঠাসা, আর সাঈদের বুক ছিল দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসায় ঠাসা। এই দেশের সকলের প্রতিনিধি হিসেবে ওই মুহূর্তে আমরা সাঈদকে দেখতে পাই। এই দেশে কেউ কেউ তার নিন্দুক ছিল। নানা সময়ে তার ক্ষতি করতে চেষ্টা করেছে। আবার কেউ কেউ তাকে ভালোও বেসেছে। কিন্তু ওই মুহূর্তে সে তার শত্রু ও বন্ধু সকলের পক্ষ থেকেই স্বাধীনতার প্রতিভূ হয়ে পুলিশের বুলেট বুকে ধারণ করে নিয়েছে। যারা সাধারণ মানুষ, প্রতিবাদ করতে ভয় পায় তাদেরকে সাহসী করে তুলতে সাঈদ তাদের হাতে একটি ন্যায়দণ্ড তুলে দিতে চেয়েছেন। সাঈদ সফল হয়েছেন। তার মৃত্যুর পরপরই আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কাতারে এসে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষও।
প্রায় সাড়ে ১৫ বছর সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের সীমাহীন শোষণে কেবল হা-হুতাশ করেছে। সাহস করে প্রতিবাদের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে পারেনি। তাদের প্রতি বার্তা পাই জাকির আবু জাফরের ‘তুমি জাগলে জাগবে বাংলাদেশ’ কবিতায়।
আফসোস করে ছেড়ে দাও কেন সব
প্রতিবাদ আজ কেন এত দুর্লভ!
চারিদিকে লুট, লুণ্ঠন মহামারি
বেদনা ক্লিষ্ট মানুষের আহাজারি!
সম্বলহীন, জীবনের নেই সুখ
ঘাটে ঘাটে ফেও দুর্জন দুর্মুখ!
জনতাকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে জাকির আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বান জরুরি ছিল। ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনে কেবল ঘরে বসে আফসোস করছিল যারা, তাদেরকে ছাত্রদের কাতারে এসে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে এই কবিতায় জাকির উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন। সুদূর আটলান্টাতে থেকেও দেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছেন সাজ্জাদ বিপ্লব। ‘এ মিছিলে আমিও ছিলাম’ কবিতায় তিনি লিখছেন:
এ মিছিলে আমিও ছিলাম
আমিও হেঁটেছি পথে, দিয়েছি স্লোগান
কিন্তু তাড়াতে পারিনি, সেই ডাইনি, ডাকিনী
তবু, থেমে থাকিনি। বসে থাকিনি।
জানি, তুমিও বসে নেই
রান্নাঘর ছেড়ে, সন্তান-সন্ততি ছেড়ে তুমি আজ রাজপথে,
আমার সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে, মিছিলে
ডাকিনীদের কোনো ঘর থাকে না। পরিবার থাকে না। দেশ থাকে না।
তারা মানুষ বোঝে না।
তারা তোমাকে বোঝেনি। আমাকে বোঝেনি। আমাদের কাউকে বোঝেনি।
শুধু রক্ত হাতে বসে থাকে সাধের রঙ্গভবনে।
সাজ্জাদ কবিতার পঙক্তির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি পরিষ্কার উচ্চারণ করছেন, ডাইনির খিদে মেটে রক্তে। আর কিছুতেই সে খিদে মেটাতে পারে না। সাজ্জাদের কথার সত্যতা আমরা চোখের সামনে দেখেছি। আন্দোলন ঘিরে ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে প্রায় চারশোর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও বেশি। অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। খবর পাওয়া যাচ্ছে, এদের কেউ কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে। এত রক্ত ঝরার পরও ডাইনির রক্তপিপাসা মেটেনি। পালিয়ে যাওয়ার কিছু সময় আগেও সেনাপ্রধানসহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কর্তা ব্যক্তিদের বলছিল, আরও বল প্রয়োগ করো। যে কোনো উপায়ে হটিয়ে দাও সবাইকে। কিন্তু কর্তা ব্যক্তিরা তাকে হুঁশিয়ার করে বলে, পরিস্থিতি আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আর মাত্র ৪০ মিনিট পরই হাজার হাজার জনতা গণভবন আক্রমণ করবে। সময় নেই। আপনি পালিয়ে যান।
গণ-অভ্যুত্থানের এই চিত্র ৭১ সালের পর বাংলার মানুষ আর দ্যাখেনি। নতুন প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলাদেশের দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা লাভের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা বলবে আর শিউরে উঠবে। হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকেও একটি অধ্যায় থাকবে এই গণ-অভ্যুত্থান। এই সময়টা নিয়ে দ্বিতীয় দশকের কবি সালেহীন শিপ্রা ‘ত্রস্ত সময়’ কবিতায় লিখেছেন:
হায়েনার হা-মুখের ভেতর
আটকে পড়ে কী দেখতে পায় ত্রস্ত সময়!
গলার দিকে গাঢ় ছায়া
গুম হয়ে যায় পাখিরা ওই লকলকানো অন্ধকারে
জংলাপাশে ব্যক্তিগত রক্তমাখা পালক কিছু
ফের পাওয়া যায়।
ত্রস্ত সময়
দেখতে কি পায় বন্ধ চোখে!
সময়ের রক্তাক্ত চিহ্ন ধারণ করে আছে এই কবিতা। হায়েনার হা-মুখে গোটা বাংলাদেশ গিয়ে খাওয়ার দৃশ্য চিত্রিত হয়ে আছে এই কবিতায়। মৃত্যুর ঘ্রাণ কী রকম? ভেবেছি আমরা কখনো? ‘যেখানে মৃত্যুর ঘ্রাণ’ কবিতায় শাহীন রেজা লিখেছেন:
বাতাস আজ ভারী হয়ে আছে
না সেখানে কাগজি লেবুর ঘ্রাণ নেই
চারদিকে শুধু বারুদ আর মৃত্যুর ছড়াছড়ি
একদিন একাত্তরে তোমার দেহেও এমন ঘ্রাণ ছিল কিনা কিংবা বায়ান্নতে
আমার জানাই হয়নি।
কিন্তু প্রবল জনজোয়ারে রক্তের বৃষ্টির ভেতর ভিজতে ভিজতে শাহীন রেজা এখন জানতে পারলেন মৃত্যুর ঘ্রাণ ঠিক কী রকম। কী রকম সেই ঘ্রাণের অনুভূতি। মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন শাহীন:
এমন মৃত্যু আমরা কি চেয়েছি কেউ
বন্দুকের নলের সামনে আমার স্বজন
তারপর তীব্র চিৎকার
ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তের ফোয়ারা
নাহ, আমি আর সহ্য করতে পারি না
এই কি আমার দেশ
আমার প্রিয় জন্মভূমি
আমি ভাবতেই পারি না।
শাহীন রেজা কেন, আমরা কেউ-ই কি ভাবতে পারছি ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার রক্তের তেষ্টা মেটাবে নিজের দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে? কিন্তু যা ভাবতে পারিনি, তা তো চোখের সামনেই ঘটে যেতে দেখলাম। অবশ্যি এর সবকিছুই এখন ইতিহাস। দেশ মেরামতের কাজ শুরু করেছে ছাত্রসমাজ। আমরা আশাবাদী যে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আর কোনো রক্তখেকো তৈরি হবে না। হাসিনার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে কয়টি কবিতার উদ্ধৃতি ওপরে দেওয়া হলো সমঝদার পাঠকের মনে হবে, কবিতাগুলো স্লোগানসর্বস্ব। এসব কবিতায় শিল্পসৌন্দর্য তেমন একটা নেই। সুতরাং, এগুলো কবিতা কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু সেই প্রশ্ন তোলার আগে ভেবে দেখা দরকার, সময়ের দাবি কী ছিল। হাসিনা যখন পালিয়ে গেল সেই সময় খুব জরুরি জিনিস ছাড়া আর কিছুই নিয়ে যেতে পারেনি। সেই সময় তার হাতে ছিল না। একইভাবে, এই কবিতাগুলো যখন লেখা হচ্ছে তখন সৌন্দর্য, শিল্প, শৈল্পিক কারুকাজ এসব বিষয়-আশয় গোছানোর মতো সময় কবিদের ছিল না। গোটা দেশ অবরুদ্ধ। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। দেশজুড়ে গুলির শব্দ। পটাপট মানুষ মরছে। রক্তের স্রোতে নদী হয়ে উঠছে সোনার বাংলার বুক। এই অবস্থায় প্রতিবাদের ভাষাই হয়ে ওঠে মুখ্য, শিল্প নয়। তবে এও ঠিক যে, কবিতাগুলো শেষপর্যন্ত কবিতাই হয়ে উঠেছে, প্রলাপ নয়। এমনকি, কবিতাগুলোতে কোথাও শিল্পসৌন্দর্যের খামতিও চোখে পড়ে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, কবিতাগুলো বাংলাদেশের দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়ার পরিস্থিতির এক একটি দলিল। প্রত্যেকটি কবিতায় ধরা রয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের ত্যাগ ও বিপ্লবের রক্তাক্ত চিত্রমালা। আগামী প্রজন্মের জন্য এই কবিতাগুলো কেবল কবিতাই নয়, রক্তাক্ত সময়ের ইতিহাস।
চমৎকার! অভিনন্দন 💕💝💖
পুরোটা পড়লাম, অনেক ভালো লাগলো।
ভুল ইতিহাস এবং খাঁটি ইতিহাস ও বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে এই লেখাটির মর্ম উপলব্ধি করতে পারছি। সেই সূত্রেই একে স্বাধীনতা হিসেবেই উল্লেখ করা যথার্থ। স্বাধীনতা সব রকম পীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে নিজ অধিকার রক্ষার পরিবেশ তৈরি করা। সেই লড়াইয়ে জয়লাভ করেছে। তাই এই লেখাটি উপযোগী অনেক ভ্রান্তির দূর করে দেবে বলেই মনে করি।
স্বাধীনতা মানে তো কথা বলতে পারা, কাউকে পরোয়া না- করে কথা বলতে পারা এবং সেই কথার প্রেক্ষিতে কোনো ভয়ের ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি না-হলেই স্বাধীনতা মনে করি তদুপরি আপনি এতোদিন জব্দ করেছেন হরণ করেছেন আমার স্বাধীনতা এবার আমি করবো আপনার স্বাধীনতা লুট,এই ভাবনা নিশ্চয়ই স্বাধীনতা নয়। আওয়ামী সরকার আদতে নিজেদের পাপকর্মে এতো দাম্ভিকতায় পৌঁছে যে চোখ থাকতে অন্ধ আর মন বিকল হয়ে পড়েছিল। আমি মনে করি জ্ঞানে নমনীয় হওয়া ক্ষমতায় মহৎ হৃদয়ে বলিষ্ঠ স্পন্দমান হওয়া উচিত; বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে স্বৈরাচারী হওয়ার স্বাভাবিক ঘটন হয়ে যায়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, আসলে নিজেদের পাপকর্ম আওয়ামী সরকারকে তাড়িয়ে দিয়েছে নিজের পায়ের তলার মাটি থেকে; বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, শিক্ষা নিতে হবে এবং একজন কবি ক্ষমতার লালায়িত হয় না, এটাও জরুরি কথা এই সময়ে; দেখুন প্রিয় বন্ধুর অপকর্মে বারুদমাখা কথা বলতে পারেন একজন কবি….
পুরো দেশটাই একটা আয়নাঘর ছিল। আরশের অধিপতি নিপীড়িত মানুষের আহাজারি শুনেছেন এবং আমাদের রাহুমুক্ত করছেন। চাওয়া একটাই এই বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হোক । নতুন কোন স্বৈরাচারের আর আবির্ভাব না হোক আমাদের শাসন ব্যবস্থায়। বারবার রক্ত দিয়ে স্বৈরাচার উৎখাত করার ইতিহাস আমাদের আছে কিন্তু এর পুনরাবৃত্তি আমরা আর দেখতে চাই নাই। এখন শুধুই শান্তি চাই , এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই দেশটাকে সুখ সমৃদ্ধির পথে। জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে আমরা নতুন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই । আল্লাহ আমজনতার এই মনোবাসনা পূর্ণ করুক। আমিন
লেখাটি দীঘ হলেও সময়োপযোগী। ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। ২৪ এর অর্জনকেও স্বাধীনতা বলাই শ্রেয়।
আমার প্রিয় কবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা এই নাতিদীর্ঘ আলোচনাটি অসাধারণ ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রোদে আলোকিত এ এক দ্বিতীয় স্বাধীনতা।