কাজী জহিরুল ইসলাম
বাংলাদেশের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে ভারত বিরোধী স্লোগান ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এখন দুই বাংলার মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। এপার-ওপার দুপাড়ের বাঙালিদের মধ্যে গড়ে ওঠেছে নিবিড় সখ্য। কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তার বাইরেও দুই পাড়ের মানুষের আরো একটি পরিচয় আছে, তারা কেউ বাংলাদেশী, কেউ ভারতীয়। যখন এক দেশের বাঙালি অন্য দেশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় তখন স্বভাবতই দুই বন্ধুর সম্পর্কের মধ্যে শীতলতা তৈরি হয়।
আমার অনেক বন্ধু, ভক্ত আছেন ভারতীয় বাঙালি। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়ত বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গেই আমার ভক্তের সংখ্যা বেশি। তারা প্রায়শই ভারত-বাংলাদেশ ইস্যুতে আমাকে প্রশ্ন করেন, কখনো কখনো ভুলও বোঝেন। আজ আমি তাদের জন্য একটি বিষয় খুব পরিস্কার করে বলতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ চিরকালই ভারতের বাঙালিদের ভালোবেসেছেন, আজও বাসেন, যেমন ভারতের বাঙালিরা ভালোবাসেন বাংলাদেশের মানুষকে। তাহলে কি ঘৃণা নেই? এই যে দৃশ্যমান ঘৃণা, স্লোগান, ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক, এটা কেন? এটি খুব সঙ্গত একটি প্রশ্ন।
হ্যাঁ ঘৃণা আছে। তবে তা ভারতের মানুষের প্রতি নয়। ঘৃণা ভারতের এই মুহুর্তের সরকার প্রধান নরেন্দ্র মোদি ও তার প্রাশসনের প্রতি। ভারত একটি গণতন্ত্রমনা রাষ্ট্র, ১৯৪৭ সালে দেশটি স্বাধীন হবার পর থেকে আজ অবধি ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রেখেছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিক চর্চার ফলে দেশটির অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেছে, পৃথিবীর পঞ্চম অর্থনৈতিক শক্তিও হয়ে উঠেছে। কিন্তু মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের বুকের ওপর একটি অগণতান্ত্রিক সরকারকে জগদ্দল পাথরের মত বসিয়ে রেখেছে। বর্তমান স্বৈরাচারী হাসিনা-সরকার যে শুধুমাত্র ভারত সরকারের মদদেই এখনও পর্যন্ত বসে আছেন/টিকে আছেন, বোধ করি এই বিষয়ে কারোরই দ্বিমত নেই।
বাংলাদেশের মানুষ এই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন করেছে, তারপরও মোদির প্রত্যক্ষ সহায়তায় এখনও এই সরকার টিকে আছে। মন্ত্রয়া গবেষণা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা শান্তি ডি সুজা সম্প্রতি মোদি সরকারের অবস্থান সম্পর্কে ডয়েচে ভেলিকে বলেছেন, “যদিও দেশটিতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ আছে তবুও বাংলাদেশ যেন চীনের পাপেট হয়ে না যায় তা শেখ হাসিনাই নিশ্চিত করতে পারবে। তাই দিল্লির পছন্দ শেখ হাসিনা, যদিও তিনি একজন স্বৈরাচার”।
এবার, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে, বাংলাদেশের ছাত্ররা যখন কোটা-সংস্কার আন্দোলনে নামে তখন স্বৈরাচার হাসিনা-সরকার ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। যুদ্ধ ছাড়া এতো অল্প সময়ে এতো অধিক সংখ্যক নিরস্ত্র মানুষ হত্যা, যা এখন গণহত্যায় রূপ নিয়েছে, গত ১০০ বছরে এই ভুখণ্ডে ঘটেনি বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। পুলিশের গুলিতে অফিশিয়ালি ২৬৯ জন, আন-অফিশিয়ালি নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক দায় শেখ হাসিনার হলেও এর অনেকটা দায় নরেন্দ্র মোদির। বাঙালিরা একটা কথা বলে না ‘খুঁটার জোরে ছাগল কুঁদে’, শেখ হাসিনার খুঁটা যে মোদি এটা তো সকলেরই জানা।
একটা খুব অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলাদেশে ছাত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করার প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে পুরো পৃথিবীর ছাত্রসমাজ। কী এক অদ্ভুত সলিডারিটি। পৃথিবীর যেখানে, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে, তারা মুহূর্তের মধ্যেই বেরিয়ে এসেছে। পৃথিবীর প্রতিটি বড়ো শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে, তারা হত্যাকারীর বিচার চেয়েছে, হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছে। এখন, আস্তে আস্তে, বিশ্বব্যাপী ভিনদেশি ছাত্ররাও প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে, পৃথিবীর নানান দেশের পার্লামেন্টে আলোচনা হচ্ছে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়েছে, বিশ্বমিডিয়া প্রতিদিন এই আন্দোলনের, গণহত্যার খবর প্রচার করছে।
পশ্চিমবঙ্গের ছাত্ররা এমনভাবে রাজপথে নেমে এসে মিছিল করছে, স্লোগান দিচ্ছে, মনে হচ্ছে ওদের নিজের ভাইকে, নিজের বোনকে হাসিনা-সরকার হত্যা করেছে। মোদি যে হাসিনাকে পুষছে তা ভারতীয় ছাত্রদের স্লোগান থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওরা বলছে, “মোদির পোষা হাসিনা/ তোমায় ভালোবাসি না”। দেখুন, ওরা কিন্তু খুব সচেতনভাবেই “পোষা” শব্দটি ব্যবহার করেছে। মানুষ আসলে কী পোষে? আদর করে জীব-জন্তু পোষে, তাই না? কেউ বেড়াল পোষে, কেউ কুকুর পোষে। এই পোষা জন্তুটি যদি কখনো হিংস্র হয়ে ওঠে, মানুষকে কামড়ায় কিংবা খামচায় তাহলে হয় তাকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে অথবা মেরে ফেলে। আমি ছোটোবেলায় এমন অনেক দেখেছি, পোষা কুকুরটি পাগলা হয়ে যাওয়ায়, একে-ওকে কামড়ানোর কারণে, গৃহস্বামী তাকে মেরে ফেলেছে।
“মোদির পোষা হাসিনা” যে পাগল হয়ে গেছে, হিংস্র হয়ে গেছে, তা ওদেরই আরেকটি স্লোগানে ওরা তুলে ধরেছে, ওরা বলছে, “শেখ হাসিনার অনেক গুণ/ পুলিশ দিয়ে করছো খুন”। হিংস্রতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশই তো খুন করা, তা নয় কি? অল্প-স্বল্প হিংস্র যখন ছিল, মানুষকে অ্যারেস্ট করতো, পেটাত, হাত-পা ভেঙে দিত, সেই পর্যন্ত না হয় মোদিজি মেনে নিলেন। কিন্তু এমন চরম হিংস্র জন্তুটিকে মোদি কেন এখনও পুষছেন, আদর-সোহাগ দিচ্ছেন? বাংলাদেশের মানুষ কি খুব ন্যায্য কারণেই মোদির ওপর ক্ষেপে যেতে পারেন না?
এই রাগটাই বাংলাদেশের মানুষ মোদির ওপর দেখাচ্ছে এবং তা প্রায়শই মোদিকে ছাপিয়ে ভারতের ওপর গিয়ে পড়ছে। এখন ভারতের মিডিয়াগুলোও, ছাত্রদের মতো, সততার পরিচয় দিচ্ছে, মোদির এই নগ্ন চেহারা তুলে ধরছে। বাংলাদেশকে গত ১৫ বছরে প্রায় ধ্বংস করে দেবার মূল কারিগড় হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। এবং এর একটি বড়ো নেতিবাচক প্রভাব ভারতের ওপর পড়তে শুরু করেছে। প্রকারান্তরে মোদিজি কিন্তু ভারতেরই একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করলেন। আজ ভারতের মানুষ যদি আঠারো কোটি বাংলাদেশির গালি খায় এর পুরো দায় নরেন্দ্র মোদির, আর কারো নয়। সচেতন এবং গণতন্ত্রমনা ভারতবাসীর দায়িত্ব হলো দেশব্যাপী এই সচেতনতা তৈরি করা যাতে নরেন্দ্র মোদি এই অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য কোনো রকম সহযোগিতা না করেন। ভারতের সংসদে এ-বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। ভারতের সংবাদ মাধ্যম এ-বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ এটিকে খুব ইতিবাচকভাবে দেখছে এবং ভারতের বাক-স্বাধীনতার প্রশংসা করছে। একটি বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে মোদির দায়িত্বহীন অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে ভারত একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী হয়ে উঠবে এটিই বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষের প্রত্যাশা।
আমি কর্মসূত্রে পৃথিবীর নানান দেশে বসবাস করেছি, সর্বত্রই ভারতীয়দের আপনজন মনে হয়েছে, আমাকেও ওরা আপন সহোদরের মতোই ভালোবাসা দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন। ঠিক এই মুহূর্তে আমার যে বন্ধুটির মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে তিনি গুরপ্রিত সিং, একজন গর্বিত ভারতীয়। আমার কর্মস্থলে ভারতীয় সহকর্মীরাই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
আমাদের এই ভ্রাতৃত্বে একেকটা নরেন্দ্র মোদি এসে ফাটল ধরাক, তা আমরা কেউই চাই না।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১ আগস্ট ২০২৪।