spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআরশি নিকেতন : ১৮

লিখেছেন : তৈমুর খান

আরশি নিকেতন : ১৮

তৈমুর খান

১৮

নেশার জন্য আবারও পানীয় কিনতে হলো

কলেজের পার্টটাইম আর টিউশনিই যেন আমার জীবিকা হয়ে উঠল। নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজের অধ্যাপক চৈতন্য বিশ্বাসের বাড়িতে বসে পরীক্ষার খাতা দেখি। সারাদিন কেটে যায় খাতা দেখতে দেখতে। আরও দুজন পার্টটাইম অধ্যাপিকাও খাতা দেখেন। খাতা দেখতে দেখতেই কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারাও প্রেম করে। তাদের উচ্ছল রোমান্সের গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে বড় অসহায় বোধ হয় আমার। ত্রিশোর্ধ্ব জীবনে নেমে আসে একাকিত্ব। দাদার অনেক আগেই মৃত্যু হলেও দাদির মৃত্যু মাত্র দু’বছর হলো। মৃত্যুশয্যায় থাকাকালীনই তাঁর ইচ্ছে ছিল পোত-বউয়ের মুখ দেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আর হয়ে ওঠেনি । কলেজে যোগদান করে প্রথম মাসের বেতনেই দাদিকে মিষ্টি কিনে খাওয়াতে পেরেছিলাম। ওইটুকুই যা সান্ত্বনা। চৈতন্য বিশ্বাস একদিন বললেন, “এবার বিয়ে-থা করে ফেলো।বয়স তো কম হলো না!”
খুব সত্যি কথা। কিন্তু বিয়েটা করব কাকে? মুরারই কলেজ থেকে পরীক্ষা দিতে আসা তানিয়া নামের মেয়েটিকে ভারি পছন্দ হয়েছিল আমার। যেমন তার শরীরের গঠন, তেমনি তার মেধা। হাতের লেখাও ছিল চমৎকার। ভালো আবৃত্তি করতে পারত। কিন্তু ওকে কি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া যাবে? না, তা যাবে না। যেমন ঘরের মেয়েই হোক, আমাদের মতো পার্টটাইমারদের সঙ্গে কেহই বিয়ে দিতে চাইবে না। সুতরাং কথাটি চৈতন্য বাবুর কানে তুলেও চুপ করে গেলাম। শুধু প্রকাশ্যে বললাম, “মেয়ে দেখাদেখি চলছে। খুব শিগগির করে নেবো।”
একই গ্রামের ছেলে সমবয়সী ইয়াকুব আলি একদিন ডেকে বলল, “চল, আমার মামাশ্বশুরের মেয়ে আছে। এ বছরই বিএ পাস করেছে। রংটা একটু চাপা হলেও দেখতে ভালো।”
“মামা শ্বশুর কী করেন?*
“মামাশ্বশুর মাস্টারি করেন। বাড়ির কাছেই একটা জুনিয়র স্কুলে।”
“সেরকম যদি মানুষ হন এবং বিয়ে দেবার ইচ্ছে থাকে তাহলে আগামী রবিবারে যেতে পারি।”
“চিন্তার কোনো কারণ নেই, বিয়ে দেবে মানে, আমি যা বলব তাই হবে!”
সেদিন এই আশ্বাস পেয়েই দুজনে চলে গেছিলাম। ওর মামাশ্বশুরের বাড়ি বলে যথোচিত আপ্যায়নও হয়েছিল। পোলাও -মুরগির মাংস সহযোগে খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ করেই মেয়েটিকে এনে বসানো হয়েছিল আমাদের সামনে। ওর নাকের কাছে একটা তিল এবং বড় বড় চোখ ও মাথার লম্বা চুল সহজেই আকৃষ্ট করেছিল। শ্যামবর্ণা হলেও মার্জিত রুচির পরিচয় ওর মধ্যে ছিল। বাংলা, সংস্কৃত, ইতিহাস নিয়ে বিএ পাস করা মেয়েটিকে দেখামাত্রই আমার সম্মতি জানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু গোল বেঁধেছিল বাড়ি আসার সময়। ওই গ্রামের অর্থাৎ নোনাডাঙার এক বিয়ের ঘটক এসে উপস্থিত হয়ে বলেছিল, “একটা বেকার ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন? আমার হাতে ভালো পাত্র আছে। পড়াশোনা একটু কম অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি, কিন্তু ডাইংহার্নেসে এনভিএফ পুলিশের চাকরিতে জয়েন করেছে।”
তার কথা শুনে মেয়ের বাপ বিগড়ে গেলেন। আমাকে তখন একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলেন:
—পার্ট টাইম করে কত টাকা পাও?
—২০০০ টাকা।
—২০০০-এ সংসার চলবে?
—টিউশন করে পাই ৫০০০। সব মিলে কোনোরকম চলে যায়।
—এর তো কোনো ভবিষ্যৎ নেই! বিয়ে দিলে মেয়ের শখ-আহ্লাদও পূরণ হবে না। পাথারে ভাসিয়ে দেওয়া হবে মেয়েকে!
সঙ্গে থাকা ছেলেটি তখন বলেছিল, “এরকম ছেলে পাবেন? পার্টটাইম করতে করতে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া পিএইচডিও করছে।”
মেয়ের বাপ তখন উত্তরে জানিয়েছিলেন, “এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কত বেকার ছেলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্টটাইমের কোনো মূল্য আছে?”
সত্যি পার্টটাইমের কোনো মূল্য নেই। তাই পোলাও-মাংস খাইয়েও মেয়ের বাপ বিদায় জানিয়েছিলেন। গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসার সময় গ্রামের শেষপ্রান্তে বাঁশঝাড়ের আড়ালে মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তার চোখ দুটিতে অসম্ভব মিনতি ঝরে পড়ছিল। যেন সে কী বলতে চাইছিল, কিন্তু বলার মতো সাহস ছিল না। আমরা অপমানিত হয়ে সেদিন ম্লান ও বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।
এই ঘটনার মাঝখানেক পরেই দোখলবাটি গ্রামের শেখ আনিশ সব শুনে বলেছিল, “চলো, আমার ভাগ্নির সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো। বিএসসি পাশ করে অঙ্গনওয়াড়িতে চাকরি করে। যৎসামান্য বেতন পেলেও তোমাদের দুজনের রোজগারে দিব্যি সংসার চলে যাবে।”
আনিশ খুব ভালো ছেলে। গল্প এবং কবিতা লেখায় তারও হাত ভালো ছিল। একসঙ্গে বহু সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়েছি। একসঙ্গে আড্ডাও দিই রামপুরহাটে। সুতরাং তার কথা হেলাফেলা নয়। সে আমাদের মরমি বন্ধু, দরদি আপনজন। তাই তার সঙ্গে এক বিকেলে রওনা দিলাম তার ভাগ্নির বাড়ি।
আনিশের ভাগ্নি যথেষ্ট সুন্দরী। তাদের সামান্য কৃষি জমি আছে। জমিতে নানা রকম ফসল হয়। তাতেই সংসার চলে যায়। কাঁচাপাকা একটা ছোট্ট বাড়ি। বাড়িতে ছোট্ট একটি ধানের গোলা। সব দেখে শুনে মনটা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমার কথা সবই আনিশ ওদের বলে দিয়েছে। সব শুনে ওরাও রাজি।
—আমি তো পার্টটাইম করি আর টিউশনি পড়াই। মাসে মোটামুটি ৭০০০ টাকা আয় করি। দেখো তোমার যদি সম্মতি থাকে। আশা করি আনিশ এর কাছে সব শুনেছ।
—আমার কিছু বলার নেই। মামা যা করবেন তাই আমিও মেনে নেবো।
—তাহলে ঠিকই আছে। আমার সম্মতি জানিয়ে দিলাম।
সব কথা সম্পন্ন হওয়ার পরও বিধিবাম। দোখলবাটি গ্রামের মোড়ে পানগুমটিতে বসে থাকা দুটো ছেলে ফেরার পথে আমাদের রাস্তা ঘিরে দাঁড়াল। “কী ব্যাপার? এভাবে দাঁড়ালে” কেন?
“আমরা চাই না আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে, তাই আগেই সাবধান করে দিলাম।এ বিয়ে কিছুতেই হবে না। জোর করে বিয়ে দিলে এর ফল ভুগতে হবে।”
কথাক’টি শুনে চমকে উঠলাম। সামান্য দেখতে এসেই এরকম হুমকি?বিয়ে করতে হলে যে কী হবে তা ভাবতেও পারছিলাম না। তবু আনিশ জোরের সঙ্গে বলল, “থানাতে গিয়ে বিয়ে দেবো তবুও এ বিয়ে কী করে আটকায় দেখব!”
আমি কিন্তু মনে মনে ভীষণ ভয় পেলাম। বাড়ি এসে মাকে জানালাম সব কথা। মা বললেন, “না বাবা, এ বিয়ে করা ঠিক হবে না।”
আমিও ভাবলাম আনিশের কথায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিয়ে করতে যাওয়া একেবারেই ভুল হবে। সুতরাং ওই পথ মাড়াব না বলেই সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু আমার এই সিদ্ধান্ত আনিশকে জানানোর আগেই, সবাই জেনে গেল দেখতে যাওয়া মেয়েটি বাজার পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে। তারা বিয়েও করে নিয়েছে।
সব শুনে আমি বড় শান্তি পেলাম। আর কোনোদিনই বিয়ে করব না এরকম একটা ইচ্ছাও মনে মনে পোষণ করলাম।
জীবনে একটা হতাশা ও বিপন্নতা গভীরভাবে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। পাশের গ্রামে টিউশন করে সহপাঠী সুফল নরসুন্দরের বাড়িতে আড্ডা দিতে গিয়ে তখন সুখ-দুঃখের কথা বলতাম। সুফল হাইস্কুলের গণ্ডিই পার হতে পারেনি। জমি আছে বলে ভালো ফসল উৎপাদন করে অবস্থা সচ্ছল করেছে। তাই রাত্রের এক-আধবেলা খাবার তার বাড়িতেই খেয়ে নিই। মাঝে মাঝে সুফল বাংলা মদও সেবন করে। প্রথম প্রথম দুই এক পেগ খেতে খেতে আমিও আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। মদ খেয়ে ঘোর-ঘোর চোখে বেশ আরাম বোধ হয়। দুঃখ-যন্ত্রণার উপশম খুঁজি। একদিন সুফলকেই বলে বসলাম, “বিয়ের জন্য বহু মেয়ে খুঁজছি, কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। মেয়ের পিতারা রাজমিস্ত্রি, মজুর, রিক্সাওয়ালা, চোর-ডাকাতদের সঙ্গেও মেয়ের বিয়ে দিতে চায়; কিন্তু আমার মতো উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবকদের সঙ্গে কিছুতেই বিয়ে দিতে চায় না।”
সুফল বলল, “তোদের জাতের মেয়ের কি অভাব নাকি? আগে তো জানাসনি? কতজনের মেয়েকেই দেখছি আইবুড়ো হয়ে আছে। ওরা কি বিয়ে দেবে না?”
আমি বললাম, “নিশ্চয়ই দেবে, কিন্তু একটু শিক্ষিত, চরিত্র ভালো, মার্জিত রুচির মেয়ে একেবারেই পাচ্ছি না। এই দ্যাখ না, দাদপুরের আজিম সাহেব, বিয়ে দেওয়ার জন্য ঘুরছেন। দু’তিন বিঘা জমিও লিখে দেবেন। কিন্তু ওর মেয়ে কতবার কতজনের সঙ্গে পালিয়েছে। অবৈধ দুটি সন্তানও আছে। তাদের পিতার কোনো খোঁজ নেই। তারপর মান্নান চাচাকে দ্যাখ, ওর মেয়েকে ডিভোর্স দিয়েছে। কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার প্ল্যান করেছিল। শরীরের অর্ধেকটা এখনো পোড়া পোড়া। ওকে বিয়ে করলেও অনেক টাকা-পয়সা, জমি-জিরেত পাওয়া যাবে।
ওরকম মেয়েদের আমি বিয়ে করতে পারব?
সুফল বলল, “না, তা সম্ভব নয়। তাহলে কী করবি ভাবছিস?”
আমি বললাম, “অনেক মেয়ে তো পাচার হয়, বিক্রিও হয়, একটা কিনলে হয় না? প্রায় হাজার দশেক টাকা সংগ্রহ করেছি। এরকম যদি মেয়ে থাকে তাহলে কিনেও বিয়ে করতে পারি!”
সুফল বলল, “খুব ভালো আইডিয়া। আমার শ্বশুরবাড়ির পাশের গাঁয়ে একদিন একজন আমাকে বলেছিল, দু-তিনটে মেয়ে বড় হয়ে আছে, বিয়ে দিতে পারছে না। যে কোনো সম্প্রদায়ের ছেলে যদি থাকে তাহলে বিয়ে দিতে পারে।”
আমি বললাম, “এরকম যদি হয় তো ভালোই। চল, একদিন দেখে আসি।”
তারপর একদিন বিকেলবেলা সাইকেল নিয়েই দুজন রওনা হয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল দশ হাজার টাকা। কোনো রকম জোড়াতালি দেওয়া একটা ঘরে তিন মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। মেয়ের মা বেঁচে নেই। তিন মেয়েরই বয়স হয়েছে। বড়টার তো চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। শরীর হাড়-ঝিরঝিরে। দুই গালেও টোল পড়ে গেছে। মেয়ের বাবা বললেন, “দশ হাজার দিলেই আমি দিয়ে দেবো। তবে বড়টাকেই নিতে হবে। কারণ পরের দুটো প্রায় ঠিক হয়েই আছে।”
আমি সব দেখেশুনে পিছিয়ে গেলাম। এরকম মেয়েকে বিয়ে করা ঠিক হবে না। সুফলেরও ঠিক পছন্দ হলো না। দুজনেই ফিরে এলাম।আসার পথে আবারও নেশার জন্য পানীয় কিনতে হলো।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প