আবু তাহের সরফরাজ
সোঁদা মাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে চেয়ে দেখি, ঝিরঝির হাওয়ায় হাওরের ওপর ছোট-ছোট ঢেউ উঠছে। আবার ভেঙে পড়ছে। বিস্তৃত জলরাশির ওপর পাখা ছড়িয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে কয়েকটি পাখি। হাওরের কোল ঘেঁষে ফসলি ক্ষেত। হাওয়ার দোলায় খেলে যাচ্ছে সবুজের ঢেউ। মুগ্ধ আবেশে আমি বসে আছি। হাতে মহিবুর রহিমের কবিতার বই ‘হাওর বাংলা’। পড়ে যাচ্ছি একটার পর একটা কবিতা। প্রাঞ্জল ভাষায় পরিচিত শব্দের কারুকাজে নির্মিত প্রতিটি কবিতা। সেসব কবিতার ভেতর দিয়ে হাওর ও ঊর্বর মাটির চিত্রময়তা এতটাই নিখুঁতভাবে আঁকা হয়েছে যে, নিজের ঘরে বসেও আমি কল্পনায় হাওর-তীরে গিয়ে বসে আছি। ‘হাওর বাংলা’ কবিতাটা পড়া যাক:
জলে ভেজা রোদে পোড়া অবিচল দুঃখ-সুখ প্রীতি
চোখের তারার মতো মায়াভরা থোকা থোকা গ্রাম
চাঁদের আলোর মতো ঝিম ধরা নীরব প্রকৃতি
যেখানে ঢেউয়ের সুরে খেলা করে ভাটির সুনাম।
আমি তারে স্বপ্ন বলি জলে ভাসা হাওর বাংলা
যেখানে সহাস্যে খেলে অবিরত পানি ও প্রকৃতি
যেখানে হৃদয় জুড়ে স্বপ্ন বুনে বয়ে যাওয়া নদী
বিস্তৃত ধানের মাঠ আদিগন্ত সবুজ সুজলা।
ভাঙনের রেখা ধরে যেতে যেতে বহুদূরে যদি
খুঁজে পাও কোনো গ্রাম ছোট কোনো দ্বীপের মতন
যেখানে দরিদ্র তবু মানুষেরা পরস্পর গভীর স্বজন
যেখানে কালের নদী অন্তরঙ্গ জীবন অবধি।
দুর্বিপাক পার হয়ে আজও তার বুকে জ্বলে আশা
শস্যের সুখের মতো সবুজাভ তার ভালোবাসা।
হাওর অঞ্চলে মানুষের জীবন বেশ সহজ-সরল। প্রকৃতির ঐকতান তারা নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করে বুকের ভেতর। বিস্তৃত জলরাশি, সবুজাভ ফসলি ক্ষেত ও প্রকৃতির প্রাণ-স্পন্দন মিলেমিশে একাত্ম হয়ে ওঠে হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপনে। মহিবুর রহিমের জন্ম কিশোরগঞ্জে। বেড়ে উঠেছেন হাওরের জল-মাটি-কাদায়। হাওরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় তিনি নিশ্বাস নিয়েছেন। দুই চোখ মেলে দেখেছেন হাওরের সৌন্দর্য। এই সময়েই তৈরি হয়ে যায় হাওর-কেন্দ্রিক তার মানসগঠন। হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন সহজ-সরল হলেও তাদেরকে বেঁচে থাকার দরকারে প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে হয়। ভিজতে হয় জলে। আবার কখনো প্রখর রোদে তাদেরকে কাজ করতে হয় ক্ষেত-খামারে। হাওরের তীরে-তীরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে থোকা থোকা গ্রাম। গড়ে উঠেছে লোকবসতি। এই গ্রামগুলো ‘চোখের তারার মতো মায়াভরা’। কী স্নিগ্ধ উপমা! ছোট-ছোট গ্রামগুলো যেন নিবিড়ভাবে মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ে আছে। রাতের আঁধারকে উজ্জ্বল করে চাঁদ ওঠে আকাশে। সেই উজ্জ্বলতার দিকে চেয়ে থাকলে মনে হয়, চাঁদের আলো যেন প্রকৃতির ওপর ঝিম মেরে আছে। এরই মাঝে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতির এই নীরবতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে হাওরের ঢেউ। এই চিত্রময়তা যেন বাস্তব নয়, স্বপ্ন। এই হাওরের বুকেই যেন ভেসে চলেছে বাংলা নামের ভূখণ্ডটি। কবি বলছেন, ভেসে থাকা এই বাংলায় বিরতিহীন খেলে চলেছে পানি ও প্রকৃতি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃতি থেকে পানি কি আলাদা? বিশ্বজগতের সবকিছুই তো প্রকৃতি। প্রকৃতির নানা উপাদান। তাহলে পানি ও প্রকৃতি আলাদাভাবে খেলা করবে কেন? হয়তো কবি বলতে চেয়েছেন, প্রকৃতির আরসব উপাদানের সাথে হাওরের পানির যে আন্তঃসম্পর্ক, সেই সম্পর্ক বোঝাতেই কবি পানি ও প্রকৃতিকে আলাদা করে লিখেছেন। এরপর কবি লিখছেন, ‘বিস্তৃত ধানের মাঠ আদিগন্ত সবুজ সুফলা’। ধানের কখনো মাঠ হয় না। ধানের ক্ষেত হয়। মাঠ সেই ভূমি যে ভূমি শূন্য পড়ে থাকে। শব্দের অর্থগত এসব ভুলগুলো পাঠকের চোখকে স্বস্তি দ্যায় না।
বর্ষা ঋতুতে হাওরের পানির বাড়-বাড়ন্ত হয়। সে সময় ভাঙতে থাকে তীর। ভাঙনের এই রেখা ধরে হাঁটতে থাকলে বহুদূরে হঠাৎ চোখে পড়বে ছোট্ট কোনো দ্বীপের মতো একটি গ্রাম। গ্রামের মানুষগুলো গরিব। অভাবে-অভাবে জর্জরিত। এরপরও এ নিয়ে তাদের ভেতর কোনো খেদ নেই। হাওর অঞ্চলের প্রকৃতির মতোই তাদের অন্তর্করণ উদার। গ্রামের মানুষগুলো আত্মীয়ের মতো একজন আরেকজনের সাথে মিলেমিশে থাকে। আর আশায় বুক বাঁধে। একদিন নিশ্চয়ই সুখের দিন আসবে। শস্যের প্রাচুর্যে ভরে উঠবে তাদের উঠোন।
মহিবুর রহিমের অনেক কবিতায় হাওর ও সেখানকার জনজীবনের আন্তরিক ছবি আমরা দেখতে পাই। মানুষ ও প্রকৃতির যূথবদ্ধ আলিঙ্গন তার কবিতায় এক অনন্য শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় অনুরণিত হয়। ফলে, তার কবিতা থেকে আমরা সোঁদা মাটির ঘ্রাণ পেতে থাকি। এই ঘ্রাণ আমাদের অনুভূতিকে প্রকৃতি আস্বাদনের তৃপ্তি দ্যায়। কবিতার ভেতর দিয়ে মহিবুর জীবনকে নানা আঙ্গিকে নানা প্রকারে দেখতে চেষ্টা করেছেন। মানুষের জীবন বহু বর্ণিল। একইসঙ্গে জটিল। যেন চক্রব্যুহ। সেই ব্যুহ ভেদ করে মহিবুর শিল্পের রশ্মি ফেলেছেন জীবনের ওপর। যা দেখেছেন তাকে ভাষার নির্মিতি দিয়েছেন কবিতায়। সেই ভাষা নদীর ঢেউয়ের মতো সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। এই ভাষার ভেতর দিয়ে মহিবুরের বোধের স্ফূরণ ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের ভেতর। ভাষার সাথে মানুষের সম্পর্ক কি? কী উপায়ে ভাষার ভেতর দিয়ে মানুষের অনুভূতির আত্মপ্রকাশ ঘটে? ‘মাতৃভাষা’ কবিতাটি পড়ে দেখা যাক:
ভাষার মাঝে জড়িয়ে আছে বহু যুগের আশা
জড়িয়ে আছে স্বপ্ন ও সাধ দুঃখ ভালোবাসা
ঘরফগুলো আগলে রাখে মানব মনের সৃষ্টি
যা পারে না চেতনালোক যা পারে না দৃষ্টি।
কত মনের কত আবেগ কল্পনা আর সত্য
মহাকালের সাধনাতে পাওয়া অনেক পথ্য
সব কিছুরই প্রকাশ ঘটে অর্থবোধক শব্দে
যা ঘটেছে নিকট কালে যা ঘটেছে অব্দে।
চেতনলোকের প্রকাশ এবং বিকাশ আনে ভাষা
তারই মায়ায় জমে ওঠে সভ্য হওয়ার আশা
তারই ফ্রেমে বাঁধা পড়ে যুগান্তরের জ্ঞান
লক্ষ কোটি মানব মনের সাধনা আর ধ্যান।
সৃজনলোকের মর্মকথা লুকিয়ে ভাষার বুকে
নদীর মতো বয়ে চলে মনের চেতনলোকে
ভাষা ছাড়া স্বপ্ন কোথায়, কোথায় এত আশা
মানব মনের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ তাই তো মাতৃভাষা।
ব্যাকরণের বাইরেও যে ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করা যায়, ‘মাতৃভাষা’ কবিতার প্রতিটি বাক্য তার উদাহরণ। ভাষার এই সংজ্ঞা নিরুপণ করছেন একজন কবি। সুতরাং, এই সংজ্ঞাকে সাহিত্যের সংজ্ঞা বলা যেতে পারে। হাজার বছর আগের মানুষের চিন্তা আজকের সময়ে আমরা জানতে পারছি ভাষার মাধ্যমে, বই পড়ে। ভাষার ভেতর জড়ানো রয়েছে মানুষের স্বপ্ন ও মনের আকাঙ্ক্ষা। বর্ণ হচ্ছে ভাষা লেখার মাধ্যম। মানুষের অন্তর্জগতে প্রতিমুহূর্তে যেসব অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে সেসব সৃষ্টি ধারণ করে বর্ণ। এই ধারণক্ষমতা মানুষের চেতনালোকের নেই। দৃষ্টিরও নেই। কিন্তু দৃষ্টি কি কোনো কিছু ধারণ করতে পারে? আগলে রাখতে পারে? দৃষ্টি তো দেখার কাজ। দেখার পর যা ঘটে, তার সবটাই মানুষের মস্তিষ্ক ও বোধের ব্যাপার। তাহলে মহিবুর দৃষ্টি শব্দটি ব্যবহার করলেন কেন? করেছেন শব্দের অন্তমিলের দরকারে। শব্দের এই ধরনের ব্যবহার আসলে আরোপিত। জোর করে কবিতার ভেতর বসিয়ে দেয়ার একটি প্রয়াস। এ রকম প্রয়াস মহিবুরের বেশ কিছু কবিতায় পাঠকের চোখে পড়বে। কল্পনা শব্দের সাথে অন্তমিল দিতে তিনি যে জল্পনা শব্দটি বসাবেন, পাঠক এটা আগেভাগেই বুঝে যান। ফলে, পাঠক ছন্দোবদ্ধ শব্দপাঠের আনন্দ তেমন একটা পান না। কবি বলছেন, অর্থবোধক শব্দে ভাষার ভেতর দিয়ে প্রকাশ ঘটে মানুষের আবেগ, কল্পনা ও সত্যের। যুগ-যুগ ধরে সাধনা করে পাওয়া মানুষের জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে ভাষার মধ্য দিয়েই। সাহিত্যের মানদণ্ডে ভাষাকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করতে বিশেষ মেধার দরকার হয়। সেই মেধা যে মহিবুর রহিমের রয়েছে, সন্দেহ নেই।
ইসলামি চেতনা ও ভাবাদর্শের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই মহিবুর রহিমের বেশি কিছু কবিতায়। বাংলা কবিতায় ইসলামি ঐতিহ্যের ধারায় তার এসব কবিতা উল্লেখযোগ্য সংযোজন না হলেও একেবারেই অপাংক্তেয় নয়। হযরত মুহাম্মদকে (স.) নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। এসব কবিতায় বিভিন্ন কবি তাদের অনুভূতির রসে সিক্ত করে রাসূল প্রশস্তি গেয়েছেন। এসব কবিতার শৈলী ও আঙ্গিক ভিন্ন ভিন্ন। যে যত শক্তিমান কবি তার কবিতা তত বেশি শিল্প-সৌন্দর্যে পাঠককে মুগ্ধ করে। মহিবুর রহিমের ‘রাসূলকে (স.) নিবেদিত কবিতা ২’ পড়া যাক:
আমি তাঁর প্রশস্তি লেখি অসীম মুগ্ধতায়
তাঁর মতো বিশ্বস্ত বন্ধু এ পৃথিবীর কোন প্রান্তে নাই
আমার সব শব্দ সঙ্গীত অনুভব তাঁরই দরুদে উৎসারিত
তাঁর প্রেমে নির্ভরতা শাশ্বত সত্যের ঘ্রাণ পাই
আমি তাঁরই প্রশস্তি লেখি বিনম্র শ্রদ্ধায়
তাঁর মতো মানব বাদী যুগ যুগান্তরে নাই
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আর সেই পবিত্রতম ঐশী কোরান
ব্যথাহত মানুষেরে আশ্বাসের বার্তা শোনায়
আমি তাঁরই প্রশস্তি লেখি পুণ্যতর প্রেম বন্দনায়
একমাত্র বিকল্প তিনি মানুষের মুক্তি চেতনায়
সহস্র বছর ব্যর্থ তাঁর সেই দেখানো পথ ছাড়া
এখনো মানুষ তাঁরই পথে এসে মঞ্জিল খুঁজে পায়।
কবিতাটির ভাষাভঙ্গি খুবই সাধারণ। আটপৌরে। সাধারণ কিছু কথার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পুরো কবিতাটি। রাসূলের প্রতি মহিবুরের ভক্তির আকুলতাই এখানে মুখ্য, কবিতার গঠনশৈলী নয়। তবে মহানবির মহত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে মহিবুর যেসব কথা লিখেছেন, সেসব কথা আমাদের ভেতর রাসূল প্রেমে আরও বেশি প্রগাঢ় অনুভূতি সঞ্চারিত করে। আমাদেরকে উজ্জীবিত করে। অনেক কবিই তো কবিতা লিখছেন। কিন্তু কবিতার ভেতর দিয়ে সত্য ও সুন্দরকে সর্বজনীন করে তোলার প্রচেষ্টা খুব কম কবির ভেতরই দেখা যায়। ইসলাম এখন বেশিরভাগ মানুষের কাছে এলার্জি। ইসলামি সংস্কৃতি চর্চা কিংবা শিল্পচর্চা করলে তাকে সাম্প্রদায়িক ও কূপমণ্ডুপ আখ্যা দেয়া হয়। তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এহেন সামাজিক বিরোধিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মহানবির প্রশস্তি প্রকাশ করে কবিতা লিখে মহিবুর আসলে সত্য ও সুন্দরের প্রতি তার একনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে অনেক কবিই বিষয়টি উপেক্ষা করে যান।
আজকের পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই নিজের কাছেই নিজে ভীষণ একা। সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার জটিল আবর্তে সে ঘূর্ণমান। নিজেকে নিয়ে বিব্রত। জীবন চলার পথে মানুষ এখন বিভ্রান্ত। তার সামনে নানা মত ও পথ। কোন মত ও পথ সে গ্রহণ করবে, তা নিয়ে মানুষের ভেতর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। এই প্রেক্ষাপটে মানুষের করণীয় কি? ‘পাঠ করো’ কবিতায় মহিবুর রহিম লিখেছেন:
তুমি হয়তো নদীর ইতিহাস জানো না
তাই তোমার এমন দেউলিয়া আত্মসমপর্ণ
আকাশের পরিসীমা সম্বন্ধেও তোমার ধারণা যুথবদ্ধ
তাই এত ক্ষুদ্রতায় বিপন্ন তোমার মন
শুদ্ধ হরফে তুমি পাঠ করো প্রকৃতিকে
শিখে নাও নির্জনতার নিসর্গ সবক
পাঠ করো একান্ত নিজস্ব সত্তাকে
নদী প্রমত্ত। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রতিমুহূর্তে নদী বয়ে চলেছে। নদীর বয়ে চলা কখনোই থেমে থাকে না। সেই ইতিহাস আধুনিক মানুষ জানে না বলেই নিজের কাছে নিজেকে নিঃস্ব করে সমর্পণ করেছে। মহাকাশের বিস্তৃতি অসীম। প্রতিমুহূর্তে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই সত্য স্মরণে রাখা উচিত জটিল আবর্তে ঘুরতে থাকা মানুষের। মহাবিশ্বের ধারণা মানুষ ভুলে থাকে বলেই তার মন ক্ষুদ্র হতে হতে নিজের অস্তিত্বকে এখন বিপন্ন করে তুলেছে। শুদ্ধ চিত্তে প্রকৃতিকে পাঠক করতে কবি পরামর্শ দিচ্ছেন। শিখে নিতে বলছেন নির্জনতার গহীনে লুকিয়ে থাকা গুঞ্জরন। মানুষ যদি তা করতে পারে তবেই সে পাঠ করতে পারবে নিজস্ব সত্তাকে। আমার আমিকে। মানুষকে নিজের অস্তিত্ববোধে সচেতন করে তুলতে এই যে ক্রমিক পাঠ্যসূচি মহিবুর উল্লেখ করেছেন, এই সূচি আসলে দার্শনিকের উপলব্ধি। কবি মাত্রেই দার্শনিক। দর্শনবোধে তাড়িত না-হলে মহৎ কবিতা লেখা সম্ভব হয় না। ‘পাঠ করো’ কবিতায় মহিবুর রহিম আরও লিখেছেন, ‘তোমার জন্যেই অবারিত সেই প্রসন্ন কিতাব যা প্রত্যহে উত্তীর্ণ এবং আবহমান।’ এই কিতাব যে পবিত্র কোরআন তা বুঝতে আমাদের দেরি হয় না। মানুষের জীবনের একমন কোনো দিক নেই যে বিষয়ে কোরআনে পথ-নির্দেশিকা নেই। মানুষের জীবনে প্রশান্তি পেতে কোরআনের বিধান অনুসরণ করে জীবন-যাপন করা অবশ্য কর্তব্য। কোরআন মানুষকে জটিলতামুক্ত প্রাকৃতিক সরল জীবনের নির্দেশিকা। এ সত্য উপলব্ধি করেই মহিবুর কোরআনকে ‘প্রসন্ন কিতাব’ বলে উল্লেখ করেছেন। কোরআনের পর আল্লাহ আর কোনো ঐশী গ্রন্থ মানুষের বিধান হিসেবে অবতীর্ণ করবেন না। পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত মানুষের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র যতই জটিল ও কুটিল হোক না কেন, কোরআনে সব জটিলতার সরল সমাধান রয়েছে। আর তাই কোরআন প্রতিদিন উত্তীর্ণ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায়। কোরআনের যে জ্ঞান ও বিধান তা সর্বজনীন, শাশ্বত।
বর্তমান যান্ত্রিক জটিল জীবনে মানুষকে সহজ পথের সন্ধান দিয়েছেন মহিবুর রহিম এই কবিতার মাধ্যমে। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা নিয়ে ভাবেন। চিন্তা করেন। এর থেকে মানুষকে স্বস্তি দিতে তিনি উদ্গ্রীব। মানুষের প্রতি এই দরদি মনোভাব মহৎ মানুষের ভেতরই থাকে। সাধারণ মানুষের এসব নিয়ে ভাবার মস্তিষ্ক ও অবসর নেই। বাক্য-বিন্যাসে ও শিল্প-শৈলীতে ‘পাঠ করো’ কবিতাটি অনন্য। কবিতা পাঠের তৃপ্তি পুরোপুরিই পাঠক পেয়ে যায়। শব্দের বুননও চমৎকার। কবিতাটি পড়তে গিয়ে কোথাও পাঠের গতি সামান্য বিঘ্নিত হয় না।
এ পর্যন্ত মহিবুরের আটটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: অতিরিক্ত চোখ, হে অন্ধ তামস, অনাবাদি কবিতা, দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র, মিলেনিয়াম শব্দজট, হৃদয়ে আমার কোনো মন্দা নাই, সবুজ শ্যামল মন এবং হাওর বাংলা। বইগুলো ক্রম-অনুযায়ী পাঠ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি বই আগের বইগুলোর বিষয়, আঙ্গিক ও শিল্পভাষ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। এই ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই বয়েসের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। জীবনবোধ যত গভীর হয়েছে, তত বেশি কবিতার ভেতর জগৎ ও জীবনকে দেখার অন্তর্চক্ষু প্রসারিত হয়েছে মহিবুর রহিমের। নিজের উপলব্ধিকে কবিতার ভেতর সঞ্চারিত করার এই শিল্পযাত্রা আসলে নিজেকেই ছাড়িয়ে যাওয়ার একটি শিল্প-প্রক্রিয়া। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, প্রতিটি কবিতাতেই মহিবুর আসলে নিজের জীবনদর্শনকে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। তবে এই যাত্রায় কবিতাকে তিনি বাতুলতা থেকে মুক্ত রেখেছেন। কল্পনার অসীম স্পেসে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তার অন্তর্লোকের বয়ান। কবিতার শব্দে ও বাক্যে যা পাঠককে জগৎ ও জীবন বিষয়ে ভাবতে শেখায়। উদ্বুদ্ধ করে সত্য ও সুন্দরের প্রতি একনিষ্ঠ হতে।