মুসা আল হাফিজ
সত্য-উত্তর (পোস্ট ট্রুথ) এক গ্রান্ড ন্যারেটিভ :
নালন্দা বিহার নিয়ে তৈরী হয়েছে মহাভাষ্য । যাতে আছে থ্রিল, আবেগ, রহস্য ,ঘৃণা আর অপরায়ন। এই মহাভাষ্যটি ক্রমবর্ধমান হারে বিস্তারকামী এবং সে কারো জন্য অঙ্কণ করে দানবীয় চেহারা , কাউকে দেয় বাস্তবের অধিক অবয়ব। রাজনীতির হাত ধরে এই ভাষ্য উপমহাদেশ জুড়ে কারো দিকে তেড়ে আসছে, কারো মনে সর্বরাহ করছে তেড়ে যাবার উদ্যম। সত্যমূল্য যাই হোক, বহু প্রজন্মের মেধা বিনিয়োগে এই ন্যারেটিভ লাভ করেছে এক ধরণের সত্যের আকার। বস্তুত নালন্দা কেন্দ্রিক এই উত্তেজক ভাষ্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস-রাজনীতির বড় খেলাগুলোর একটি। যে সকল বয়ান ও বিকৃতির উপর স্থানীয়দের বিভাজন, ঘৃণাবিস্তার এবং মুসলিম ইতিহাসের পাশবায়নের প্রকল্পকে সে খাড়া করেছে, তার অন্যতম হচ্ছে বখতিয়ারের নালন্দা ধ্বংসের মিথ। অতিকায় এই মিথ কত প্রবল ও বিস্তৃত, তা সচেতন অনেকের চিন্তায়ও নেই। বস্তুত সে আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বহু কণ্ঠস্বরকেও নিজের অনুগামি ও উপস্থাপকে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে।
ধ্বংসের ভাষ্য :
নালন্দা বিহার ধ্বংস নিয়ে ভীতিকর এক ভাষ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ভাষ্যটি নীহাররঞ্জন রায়ের ( ১৯০৩ – ১৯৮১) “দেখিতে দেখিতে নালন্দা-বিক্রমশীল ওদন্তপুরীর মহাবিহার তুর্ক সেনার তরবারী ও অশ্বক্ষুরে চূর্ণবিচূর্ণ হইল, হাজার হাজার পুঁথি বিনষ্ট হইল, শত শত শ্ৰমণ অসিমুখে বিগতপ্রাণ হইলেন। তাহার পর সর্বভুক্ অগ্নি শেষকৃত্য সম্পন্ন করিল।” এই আবেগ কম্পিত উত্তেজনাপূর্ণ বয়ান আমরা পড়ি রায়ের বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব গ্রন্থে।[1] গ্রন্থটির বেশ নাম-ডাক। ১৯৫০ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয় এই বই। এতে রায় হাজির করলেন তুর্কি মুসলিমদের হাতে নালন্দা, বিক্রমশীল আর ওদন্তপুরী চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া, পুথিবিনাশ, হত্যাযজ্ঞ আর আগুন দিয়ে সব ছাই করার বয়ান ।
শরনাথ ভট্টাচার্য, যাকে আমরা জানি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩ – ১৯৩১) নামে, তিনি আরো গুরুতর অভিযোগ করলেন। তার ভাষায় —
বৌদ্ধরা পুতুল পূজা করিত। সুতরাং মুসলমান আক্রমণের রোকটা বৌদ্ধদের উপরই পড়িয়া গেল। তাহারা বৌদ্ধদের বিহারগুলি সব ভাঙিয়া ফেলিলেন। এক ওদন্তপুরী বিহারেই দুই হাজার আসল ভিক্ষু বধ হইল। বিহারটি ভাঙিয়া ফেলা হইল পাথরের মূর্তিগুলি ভাঙিয়া-চুরিয়া ফেলা হইল পুথিগুলি পোড়াইয়া দেওয়া হইল। বিক্রমশীল বিহারেরও এই দশাই হইয়াছিল। নালন্দা জগদ্দল প্রভৃতি বড়ো বড়ো বিহারের এই দশা হইল। [2]
রায়-হরপ্রসাদ বৌদ্ধ বিহার সমূহ ধ্বংসের জন্য মুসলিমদের দায়ী করেই থামেননি। বৌদ্ধদের বিনাশ, দেশ থেকে উচ্ছেদ, তাদের প্রভাব হারিয়ে যাওয়ার জন্যও দায়ী করেছেন মুসলিমদের। তাদের ভাষ্য এতোটা দৃঢ় যে, মনে হবে প্রমাণ ও বস্তুনিষ্ঠতার উপর তাদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত এবং এর সত্যতা অসংশয়। নালন্দা ধ্বংসে মুসলিম বিজয়কে আসামী বানাবার চেষ্টা আমরা দেখি রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ১৮৮৫ – মে ২৩, ১৯৩০)।[3] কিংবা যদুনাথ সরকারের ( ১৮৭০ –১৯৬৮) ভাষ্যে। [4]
ইতিহাসের পাঠকমাত্রই কবুল করবেন, বাংলার ইতিহাসচর্চায় এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। শুধু শুধু গুরুত্বপূর্ণ দাবিদারের দাবির কারণে ঐতিহাসিক ব্যাপারে যদি সত্য প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে ধরে নিতে হতো বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসে মুসলিমদের দায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ঘটনার আট শতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের বা নিজেদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ইতিহাসবিদকে শুধু দাবি নিয়ে সামনে এলে চলবে না, দলিল নিয়েও আসতে হবে। এই সব খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ দাবির উচ্চারণে যতোটা সোচ্চার, দলিলের প্রশ্নে ততটা দায়সারা। কিন্তু দলিল তো শেষ অবধি থাকতে হয়, তাই ভারি ও বিচিত্র দাবির ফিরিস্তি পেশ করে এর অনুকূলে গৌণতা সহকারে দলিল তারা প্রস্তাব করেছেন। তাদের প্রত্যেকের দলিল মূলত একটি গ্রন্থ; তাবাকাতে নাসিরী। গ্রন্থটির একটি পৃষ্ঠার দুই থেকে আড়াই শত শব্দের একটি প্যারা। এর উপর ভর করে উইল ডুরান্টের (১৮৮৫ – ১৯৮১) মতো বিশ্বখ্যাত লেখকও একই দাবি জানিয়েছেন,ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকায়ও তা উচ্চারিত হয়েছে।
রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮- ১৯৮০) বা এ এল ব্যাসাম (১৯১৪-১৯৮৬) তো বটেই, এমনকি ভারতীয় মনীষী ভিমরাও আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) রমিলা থাপার ( ১৯৩১–) ইরফান হাবিবের (১৯৩১–) মতো ইতিহাসবিদও কবুল করে নিয়েছেন বৌদ্ধ বিহার; নালন্দা মুসলমানরা ধ্বংস করেছেন। রমেশচন্দ্র নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য দ্বাদশ শতকের শেষে সংঘটিত তুর্কি আক্রমণকে দায়ী করেছেন।[5] ব্যসাম দাবি করেন, মুসলিম অভিযানের প্রথম তরঙ্গাভিঘাতেই নালন্দা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। [6]আম্বেদকরের মতে, বখতিয়ার নালন্দায় ধ্বংসলীলা চালায়। গণহত্যা এবং গ্রন্থ পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। ধ্বংসের ফলে প্রাচীন সভ্যতার তথ্য লাভ আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে উঠেছে।[7] রমিলা থাপার নালন্দায় গ্রন্থাগার ধ্বংসের জন্য তুর্কি আক্রমণকে দায়ী করেছেন।[8] ইরফান হাবিব লিখেন– “এই মহাবিদ্যালয় ১২০০ সালে মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নালন্দা আক্রমণ ও হত্যালীলা সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটা সামলে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত টিকেছিল।”[9]
সব দাবি এক রকম নয়। কেউ দৃঢ়তার সুরে তো কেউ সম্ভাবনা হিসেবে, কেউ অনুমান হিসেবে, তো কেউ মিথ হিসেবে দাবিটাকে উল্লেখ করেছেন ।
বাংলাপিডিয়া নালন্দা মহাবিহার প্রসঙ্গে জানাচ্ছে ‘বারো শতকের দিকে নালন্দা তার গুরুত্ব হারায়। তেরো শতকের প্রথম দিকে যখন ধর্মস্বামী নালন্দা পরিদর্শন করেন, ততদিনে এর অতীত গৌরব বিলুপ্ত এবং এর অনেকগুলো স্থাপনা তুর্কিদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে”। [10]
কিন্তু নালন্দার কোনো স্থাপনা কি আদৌ কি ক্ষতির কবলে পড়েছিলো তুর্কিদের হাতে? তুর্কি অভিযানের কোনো প্রমাণ কি আছে আদৌ? বাংলাপিডিয়ার নিবন্ধকার তা জানাচ্ছেন না। অসতর্ক অন্যদের মতো তিনি অবশ্য বলেননি , কথাটা তাবাকাত ই নাসিরিতে আছে!
Encyclopedia Britannica বলছে, Nalanda continued to flourish as a centre of learning under the Pala dznasty (8th-12th centuries), and it became a centre of religious sculpture in stone and bronze. Nalanda was probably sacked during Muslim raids in Bihar (c. 1200) and never recovered.
পাল রাজবংশের (৮ম-দ্বাদশ শতাব্দী) অধীনে নালন্দা শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে উন্নতি লাভ করে। এটি পাথর ও ব্রোঞ্জের ধর্মীয় ভাস্কর্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়।(আনুমানিক ১২০০ সালে) বিহারে মুসলিম অভিযানের সময় সম্ভবত নালন্দাকে ধ্বংস করা হয়, পরে আর একে উদ্ধার করা হয়নি।[11]
ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকা একটি বিদ্যাকেন্দ্র ধ্বংসের জন্য দায়ী করছে মুসলিম বিজয়ীদের, কিন্তু কোনো প্রমাণ পেশ করছে না, দায় চাপিয়ে বলছে probably (সম্ভবত), ব্যাপারটা প্রশ্নবোধক ।
মিডিয়া বা রাজনীতিতেও এই দাবি প্রবল সোচ্চারতায় বর্তমান। অতিসাম্প্রতিক নমুনাগুলোর দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে।
বিবিসি বাংলা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্জন্ম নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ২০১৪ এর ১ সেপ্টেম্বর। এই রিপোর্টের শিরোনাম ছিলো “ভারতের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দার পুনর্জন্ম।” প্রাচীন একটি শিক্ষাগারের পুনর্জন্ম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় রূপে, খুশিরই কথা। কিন্তু ছোট্ট এই রিপোর্টে ছিলো সমস্যাজনক এক মন্তব্য।
যেখানে সিদ্ধান্তের ভাষায় বলা হয় – “দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কী সেনাবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই নালন্দা ছিল এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বিখ্যাত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র।” । [12] এবিপি আনন্দের প্রতিবেদনের উপসংহার — ১২০০ শতাব্দীতে বখতিয়ার খিলজি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। নষ্ট করে দেয় এর সমস্ত প্রাচীন পুঁথি ও সম্পদ।[13]
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন হলো ২০২৪ এর জুলাইয়ে। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা জানালো “খরচ প্রায় ১৭০০ কোটি, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।” খুবই খুশির সংবাদ। সংবাদ বিবরণীতে পত্রিকাটি নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য হাজির করে। সেখানে তিনি বলেছেন, — ‘নালন্দা কোনও নাম নয়, এটা একটা পরিচয়। আগুন বইকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু জ্ঞান ধ্বংস করতে পারে না।’ [14]
খুবই সতর্ক বক্তব্য। যা দাবি করে এখানে আগুন দিয়ে বই পোড়ানো হয়েছিলো। কিন্তু কে পুড়িয়েছিলো?
[ চলবে….]