তুষার শুভ্র বসাক
সংস্কৃতিতে কবি-কোবিদ বলে একটি শব্দ রয়েছে। এই শব্দটির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প-সংস্কৃতির যেকোনো অঙ্গনেই হোক– কেউ ভালো উৎকর্ষতা লাভ করলে তাকে কবি বলা হয়। তাইতো একটি সমৃদ্ধ নাটক দেখে বলা হয় কাব্যিক; কী কাব্যিক দৃশ্য, চিন্তা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ কিংবা সমরেশ বসু’র কোনো উপন্যাস পড়লেই মনে হয়– এগুলো একেকটি উৎকৃষ্ট মানের কবিতা। তাই ওই অর্থে কবি; এরপরও সবাই কবি নয়, কিন্তু আজকাল সবাই কবি হয়ে যাচ্ছে। যারা বুঝে তারা কবি পরিচয় দিতে একটু শ্লাঘা অনুভব করে। আসলে কবি একটা গর্বের সম্বোধন। আর এই সম্বোধন ড. মাসুদুল হক-এর ক্ষেত্রে যথার্থ প্রয়োগসিদ্ধ।
মাসুদুল হক ঢাকার জিন্দাবাহারে ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে ঢাকায় বেড়ে ওঠা হলেও বৈবাহিক বন্ধন, কর্মসূত্র এবং সাহিত্য প্রতিভার স্বকীয় স্বাক্ষরে– তিনি এখন দিনাজপুরের একজন কৃতি ব্যক্তিত্ব। স্ত্রী- সিরাজাম মনিরা এবং দুই সন্তান- হাসানুল হক সৌম্য ও মণীষা হক, তার সাহিত্যচর্চার পরম উদ্দীপক। তিনি তিন দশকের অধিক সময় ধরে বৃহত্তর দিনাজপুরের মাটি ও মানুষের জীবন-বৈচিত্র, লোক-সাহিত্য ও লোক-সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে হয়ে উঠেছেন দিনাজপুর তথা বাংলাদেশের গর্ব।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়– মাসুদুল হককে সবাই ‘কবি মাসুদ’ বলে ডাকতে শুরু করে। তার বন্ধু-বান্ধব এবং সমকালের যারা, তারা বিষয়টি জানে। মাসুদুল হকের জীবনে সাহিত্যচর্চার শুরু কবিতা দিয়েই। আশির দশক থেকেই তিনি কবিতা লিখছেন। মূলত কবি হলেও বর্তমানে একজন গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক, আলোচক এবং গবেষক হিসেবেও তার সমান পরিচিতি রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা–স্নাতকোত্তর (দর্শন) সম্পন্ন করার পর– মাসুদুল হক দিনাজপুরে ফিরে আসেন। এরপর কিছুদিন রংপুরের তামাকফিল্ডে থেকে তামাকচাষীদের জীবনযাপন নিয়ে ‘তামাকবাড়ী’ নামে একটি গল্প লেখেন। পরবর্তীতে ১০টি গল্পের সমন্বয়ে একই শিরোনামে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘টেনে যাচ্ছি কালের গুণ’ (১৯৮৭) শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে প্রিয় পাঠক সর্বপ্রথম মাসুদুল হকের সন্ধান পেলেও ‘তামাকবাড়ী’ গল্পগ্রন্থটি মাসুদুল হকের জীবনে এনে দিয়েছে ব্যাপক পরিচিতি।
২.
কবি মাসুদুল হক ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিন বছরের (১৯৯৭-১৯৯৯) জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃক বৃত্তি-গবেষক হিসেবে মনোনিত ও নির্বাচিত হোন। সেইবছর তিনজন বৃত্তি-গবেষক নির্বাচিত হয়। অপর দুজন হলেন– খালিদ হোসেন ও দিপু আশফাক। সেসময় বৃত্তি গবেষকের জন্য ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক, ঢাকা বিসহ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। মাসুদুল হকের পিএইচডির গবেষণার বিষয় ছিল– ‘বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব’। বাংলাদেশের কবিতার উপর বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা হলেও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে তিনি প্রথম কাজ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. হায়াৎ মামুদ-এর অধীনে তিনি এই গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেন। হায়াৎ মামুদ নিজেও একজন প্রসিদ্ধ গবেষক, ষাটের দশকের কবি ও গল্পকার। হায়াৎ মামুদ কর্তৃক ফেলো নির্বাচিত হওয়াটা সত্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার। অতীতে টোলের পণ্ডিতেরা স্নাপন হিসেবে শিক্ষার্থীদের যেভাবে গ্রহণ করতো, হায়াৎ মামুদের বাড়িটিও তেমনি একটি শিল্পচৈতন্যের জায়গা; সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন মাসুদুল হক। নন্দনতত্ত্বের জন্য কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা পড়ার প্রতি মনটা বেশী বিভর ছিল তার। সাধারণত পিএইচডি আড়াই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে করতে হয় কিন্তু নন্দনতত্ত্বের উপর পড়া, লেখা আর খানিকটা ফাঁকির অন্তর্জালে মাসুদুল হকের পিএইচডি করতে সময় লেগেছে প্রায় আট বছর (১৯৯৭-২০০৪)। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি থেকে তার এই অভিসন্দর্ভের একাংশ ‘বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের জীবনযাপনে লোকসংস্কৃতির যে প্রক্রিয়া রয়েছে, এগুলো বাঙালি সংস্কৃতির মূল আদি। এগুলোর অন্বেষণ হওয়া উচিৎ। আর তা অন্বেষণ করতে গিয়েই মাসুদুল হকের মাঝে গল্প ও কবিতা লেখার প্রবণতায় সৃষ্টি হয় নতুনত্ব। নিজের ভেতরে যে সৃষ্টিশীল তাড়না রয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্য– এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভূগোল পাঠ করতে থাকেন, মানুষের সাথে মিশতে থাকেন, অঞ্চল পরিভ্রমণ করতে থাকেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : দিনাজপুর’-এর প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, আদিবাসী বলতে যাদের জীবনযাপন আদি, যেমন: সাঁওতাল, ওরাঁও, কড়া, কাদর, মালি, মালপাহাড়ি-সহ বিভিন্ন জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, জীবনবোধ এমনকি মৌখিক সাহিত্যকে লিখিতরূপে উপস্থাপন করতে মাসুদুল হক যেনো দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’, ‘অরণ্যের অধিকার’ পড়ে মহাশ্বেতা দেবীকে আবার নতুন করে নিজের মাঝে আবিষ্কার করেন। মাসুদুল হক প্রথমে আদিবাসীদের নিয়ে গল্প লেখেন। ‘ঢুলকিপুরাণ’ (২০১০), ‘আবার কাৎলাহার’ (২০১১) শীর্ষক গল্পগ্রন্থে নারীর সংগ্রামের কথা আছে, বাহা, ফুলমনিকে নিয়ে বলা হয়েছে। পাটগ্রাম পাড় হলে যে ধুবরি, সেখানে কামতাপুরী সাহিত্য মুভমেন্ট চলছে; এটি বর্মন-কোঁচ সম্প্রদায়ের। আদিবাসীদের এরূপ জীবনবোধ আর নান্দনিক জায়গাগুলো নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন। এই বছর বইমেলায় তার ‘আদিবাসী কবিতাগুচ্ছ : উলগুলান ও অন্যান্য কবিতা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার ভাঁজপত্র উচ্ছ্বাস-এ প্রকাশিত তার একটি আদিবাসী কবিতা তুলে ধরা হলো:
মহাজন হে! তুই কহিলু:
এই চৌধার আমার
ফির কহিলু রাঙা চোউখে:
মোর জমিটুকু তুই লিবু
জমি যদি লেওয়া যায়
তো আকাশ কিনে লে
ওই যে পাহাড়, লাল মাটি
সমুদ্রটাও ছাড়বি কেনে?
মহাজন : মাসুদুল হক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য ইয়েটস-এর যথেষ্ট অবদান আছে। অর্থাৎ ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছে, মানে তখন সমকালীন সংযোগ ছিল। কিন্তু চল্লিশের দশকের পর- বাংলাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার বিপ্লবে সমকালীন অনুবাদ সাহিত্যের প্রচেষ্টায় খুব একটা তীব্র রূপ ছিল না। ঐ সময়টাতে সমকালীন সাহিত্য অনুবাদ না করে ক্লাসিক বা পুরনো সাহিত্যিকদের সাহিত্য অনুবাদ করা হয়েছে। মাসুদুল হক এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অনুবাদের ভিতর দিয়েই একটি ভাষা ও সংস্কৃতির যে বৈভব তা বিশ্বদরবারে পৌঁছে যায়। আর এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই কবি মাসুদুল হক বহির্বিশ্বের সমকালীন সাহিত্য এবং কবিদের কবিতা অনুবাদ করছেন, সমসাময়িকতাকে কাব্যিক করে তুলছেন। অপরদিকে, তার কবিতাও অন্য ভাষার কবিরা অনুবাদ করছেন। চীনের কবি সু-ঝু, হুয়াং হুইবো, লিয়াও ঝিলি; বেলজিয়ামের কবি অ্যাগ্রোন শেলে; ভুটানের কবি বাগাওয়াথ ভান্ডারী, যোগিতা পোখরেল, ফুরপা; লিথুনিয়ার কবি রাইসা মেলনিকোভা; নেপালের কবি কমল ধুনগানা; প্যালেস্টাইনের কবি মোহম্মদ হেলমি আল-রিশাহ; নাইজেরিয়ার কবি প্রিন্স স্টিভ ওয়েবোড; রাশিয়ার কবি তাতায়ানা তেরেভিনোভা, ভারতের আসামের কবি গায়ত্রী দেবী’র মতো সমকালীন কবিদের সাথে মাসুদুল হকের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের একটি সংযোগ তৈরী হয়েছে। মাসুদুল হকের অনুবাদে নেপালি কবি দিওয়াস ঘিমিরি-এর একটি কবিতা নিচে তুলে ধরা হলো:
পশ্চিম এবং পূর্ব থেকে
আগত দুই প্রেমিক
প্রেমের গান গাইতে গাইতে
আকাশ ও তারা দেখছেন
আকাশে একটাই চাঁদ
আর একজোড়াই প্রেমিক
একজন পূর্ব এবং অন্যজন পশ্চিম থেকে
প্রেমের গান গাইতে গাইতে
আকাশ ও তারা দেখছেন
সকালটা খুব সুন্দর ছিল
অনেক আশা নিয়ে
দিনটি ছিল আনন্দে ভরা
প্রচুর স্মৃতি নিয়ে
সন্ধ্যাও ছিল খুব চমৎকার
শক্তিতে পয়মন্ত ওরা
প্রেমের গান গাইতে গাইতে
আকাশ ও তারা দেখছেন
দুই প্রেমিক
পশ্চিম এবং পূর্ব থেকে
এক দেবতার কাছে প্রার্থনা করছে
পশ্চিম এবং পূর্ব থেকে
শুভরাত্রি কামনা করে
স্বপ্নে হারিয়ে যাচ্ছে
শুভ রাত্রি : রূপান্তর– মাসুদুল হক
৩.
বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য সব্যসাচী লেখকদের মধ্যে ড. মাসুদুল হক অন্যতম। তার কবিতা-যাপনের খন্ডচিত্র তুলে ধরার অভিপ্রায়ে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, পাঠক-মনে কিঞ্চিৎ ঠাঁই পাবে আমার বিশ্বাস।
ভাতঘুম থেকে উঠেই মনে হলো
আমি একটা
পুরোনো নারিকেল
জন্মের সম্ভাবনায় জল ও জন্মফল বুকে নিয়ে
ঝুলে আছি হাওয়ার সমুদ্রে
আমার চারপাশে কচি ডাবগুলো
লবণবুকে দুলতে দুলতে
চলে যাচ্ছে সুখী মানুষের বাড়ি!
নারিকেলজন্ম : লজ্জা ও বোতামের কবিতা
মাসুদুল হকের এই কবিতাটি একজন মানুষের জীবনের একটি নির্দিষ্ট অবস্থার প্রতিচ্ছবি; যা– এক ধরনের স্থবিরতা ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি প্রকাশ করছে। এটি একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টির কবিতা, যেখানে কবি নিজের জীবনকে একটি পুরোনো নারিকেলের সাথে তুলনা করেছেন। যৌবন পেরিয়ে গেলেও নারিকেলের ভিতরে থাকা জল ও তার বীজে (জন্মফল) এখনও জন্মের সম্ভাবনা রয়েছে, যা কবির জীবনের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কবি এই অপূর্ণতা নিয়েই জীবন-সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছেন। অপরদিকে, কচি ডাব (যুবা নারিকেল) যা লবণবুকে (তাজা পানির ইঙ্গিত) দুলতে দুলতে সুখী মানুষের বাড়ি যাচ্ছে; যা– তরুণ প্রজন্মের প্রতীক, যারা নতুন জীবনের সম্ভাবনায় ভরপুর এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্ছ্বসিত। মূলত কবিতাটি আধ্যাত্মিক এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশ্রণ, যা মানব জীবনের বিভিন্ন পর্যায় ও অবস্থাকে প্রকাশ করে।
মাসুদুল হক বরাবরই সমসাময়িকতাকে প্রাধান্য দেন। এটি তার একটি অনন্য গুণ। এই কারণে তার কবিতায় সমসাময়িক দৃশ্যপট প্রায় চোখে পড়ে। যা আগামীর জন্য ইতিহাস। একজন ইহুদি নারী ও একজন ফিলিস্তিন মেয়ের জীবনকে আবহ করে কীভাবে চালচিত্রকে কাব্যিক করে তুলতে হয় তা মাসুদুল হকের কবিতা পড়ে জানা যায়।
যখন প্রতিটি জিনিসের ছায়া জুতার ফিতার মতো
লাল বর্ণে অদৃশ্য
বাইপোলার চোখ
সিডার কাঠের গন্ধে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে
উলের রঙ্গিন স্কারলেট আগুনে
মনে হয় নিজেকে বদলে নেব
ফর্সা হবো ফর্সা!
তুমুল ফর্সা!
ইহুদি নারী : মাসুদুল হক
মাসুদুল হকের এই কবিতাটিতে অনুভূতি এবং প্রতীকী ভাষার মাধ্যমে আত্ম-পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে এক ধরনের বিশেষ মুহূর্ত বর্ণিত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি জিনিসের ছায়া রক্তিম বা লাল রঙে মিশে যায়। কবিতায় ‘বাইপোলার চোখ’ দিয়ে দ্বৈত মানসিকতা বা মানসিক অবস্থার পরিবর্তনশীলতা বোঝানো হয়েছে, যা বিভিন্ন অনুভূতির মধ্যে দোল খায়। সিডার কাঠের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে সেই মুহূর্তকে বোঝানো হয়েছে, যা– পরিবেশকে আরও গাঢ় ও রহস্যময় করে তোলে।
এরপরের স্তবকে– আগুনের ধর্ম ও তাপের মধ্য দিয়ে কবি যেনো নিজের বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক সত্তায় রূপান্তরিত হতে চায়। ফর্সা হবো ফর্সা! তুমুল ফর্সা! বলতে কবি বিশুদ্ধতা বা পবিত্রতা এবং উন্নতির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। এই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা শুধু বাহ্যিক নয়, আভ্যন্তরীণও। মূলত, কবিতাটি আত্মপরিবর্তন, পুনর্জন্ম ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের মাধ্যমে নতুন এক শুরু করার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে।
জীবনের জোয়াল এখনো আমার ঘাড়ে
বছরের পর বছর যুদ্ধ
পালিয়ে বেড়ানো
পরাজয়, গ্লানি
তাই বুঝি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ফর্সা মেয়ে…
ফিলিস্তিন মেয়ে : মাসুদুল হক
ফিলিস্তিন মেয়ে কবিতাটি একজন ব্যক্তির জীবনের সংগ্রাম এবং তাতে লড়াই করার যে অভিজ্ঞতা, তার চিত্র তুলে ধরে। কবিতার প্রথম লাইনেই কবি ‘জীবনের জোয়াল’ বলতে জীবনের দায়িত্ব এবং কঠোর পরিশ্রমের বোঝাকে ইঙ্গিত করেছেন। ফিলিস্তিন মেয়েটি যা দীর্ঘদিন ধরে বহন করছে। কবি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লাইনে বছরের পর বছর ধরে চলমান যুদ্ধের কথা বলেছেন। এখানে যুদ্ধ বলতে জীবনযুদ্ধ বা জীবনের বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলাকে বোঝানো হয়েছে। এখানে পালিয়ে বেড়ানো মানে সমস্যাগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করা বোঝানো হয়েছে। পরবর্তীতে পরাজয় এবং গ্লানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা জীবনের দুঃখ এবং ব্যর্থতার প্রতিফলন। সার্বিকভাবে, কবিতাটি একটি মানুষের জীবনের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ব্যর্থতা ও ত্যাগের বর্ণনা দেয়; যা শেষ পর্যন্ত ফর্সা অর্থে তার চরিত্রের দৃঢ়তা এবং বিশুদ্ধতাকে তুলে ধরে।
কী যেন নেই
বুঝতে পারছি!
কতো চাঁদ! এতো রোদ!
কামারশালায় নিভৃত ঘুম
গমগমে আগুন
পোড়া পিচ
কী যেন নেই
ঝুলে-পড়া জিভে কাঁপছে কুকুর
লু হাওয়া ভরা এই দুপুর
কী যেন নেই
বুঝতে পারছি
টিপ টিপ শব্দে মুখর
এই মন চাচ্ছে ভেজা কাপড়!
৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস : মাসুদুল হক
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি দিক হলো– বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অর্থাৎ তীব্র তাপদাহ ও অসহনীয় পরিবেশ। ‘৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস’ কবিতাটি প্রচণ্ড তাপ এবং অসহনীয় পরিবেশের সাথে মানুষের অভিজ্ঞতার চিত্র তুলে ধরে।
চাঁদ শীতলতার প্রতীক। প্রতিদিনই আকাশে চাঁদ ওঠে কিন্তু গ্রীষ্মের বাতাবরণে তার কোনো শীতলতা নেই। যেনো রোদে খুয়ে গেছে। কবিতাটিতে পোড়া পিচের রাস্তায় ঝুলে–পড়া জিভে কাঁপা কুকুর– তীব্র তাপদাহের উৎকৃষ্ট প্রতিচ্ছবি। কবিতাটির শুরু থেকেই কবি স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না– একটা কিছু কী নেই! কিন্তু শেষত ভেজা কাপড়ের কথা বললেন। অর্থাৎ তীব্র গরমে শরীর ও মন উভয়ে শীতলতার জন্য আকুল– এই অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে।
গার্হস্থ্য ঘরে ঢুকে থাকতে ভালো লাগে
প্রেসার কুকার ডাকছে
রোদ এসে পটলের বুকে বসে পড়ে
গার্হস্থ্য ঘরে গুপ্তকথার নীরবতা
বিছানার নিচে পড়ে থাকে
স্নানঘরে টিপটিপ বৃষ্টি
ঝোল-মসলার গন্ধে পোস্ত ঝিঙের
মিথস্ক্রিয়ায় মিথোজীবী দুপুর গড়ায়
সিমবায়োটিক : মাসুদুল হক
‘সিমবায়োটিক’ কবিতায় একটি ঘরোয়া পরিবেশের বর্ণনা আছে; যেখানে একটি শান্ত, অন্তর্মুখী জীবনধারার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কবিতার শুরুতেই কবি গার্হস্থ্যে থাকার আনন্দের কথা বলেছেন। যেখানে প্রেসার কুকারের শব্দ– ঘরোয়া জীবনের স্বাভাবিকতাকে নির্দেশ করে। আবার, গার্হস্থ্য ঘরে গুপ্তকথার নীরবতা এবং বিছানার নিচে পড়ে থাকা– ইঙ্গিত করে যে, ঘরটি কেবল বাইরের আড়ম্বরপূর্ণ জায়গা নয় বরং একটি ব্যক্তিগত এবং শান্ত স্থান, যেখানে অনেক ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং স্মৃতি লুকিয়ে থাকে। এই কবিতাটিতে স্নানঘরের টিপটিপ বৃষ্টি এবং ঝোল-মসলার গন্ধের মাধ্যমে ঘরের দৈনন্দিন কাজকর্মের সহজাত সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে। পোস্ত ঝিঙের মিথস্ক্রিয়ায় মিথোজীবী দুপুর গড়ানো বলতে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সৃষ্ট গভীর সংযোগ এবং সম্পর্ককে বোঝানো হয়েছে।
দুপুরে মাছের বাজার নিভে গেলে
পথ খুলে
নিভৃতে সন্ধ্যা এসে দাঁড়ায়
কামিনীর তলে
রান্নাঘর গল্প করে
গরম তেল টগবগিয়ে ওঠে
সমুদ্র ফেরত লাস্যময়ী ইলিশের গায়ে
জীবনের কোথাও লবণের গন্ধ নেই!
বিধবা : মাসুদুল হক
মাসুদুল হকের ‘বিধবা’ কবিতাটি মানবজীবনের একটি চিরায়ত অবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে যাপনের মাঝপথে সঙ্গহারা হলে জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে– তারই কথা বলা হয়েছে। কবিতাটিতে বাস্তবমুখী আরও একটি দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে। যেখানে বোঝা যায়, বৈধব্য নেমে এলে সাধ-আহ্লাদের মতো স্বাদ আর কোনো রান্নায় পাওয়া যায় না।
৪.
পাঠক মন বড়ই বিচিত্র। কার কাছে কোনটি ভালো লাগবে, কোনটি উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠবে তা বলা মুশকিল। এরপরেও মাসুদুল হকের সৃষ্ট কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্য থেকে আপাতদৃষ্টিতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা এখানে চয়ন করা হলো:
১
এক উন্মাদের তাড়া খাওয়া ব্যস্ত নগর চমক আলোয়
মৃত্যুপ্রিয় জলযন্ত্রণাভারে আর সুড়ঙ্গমন্থন প্রত্নক্রিয়ায়
চাঁদের নৈসর্গিক বাগানে বাষ্পচোখে উঠে দাঁড়ায়
আর আমি কুহকবিভ্রমে তার ইন্দ্রিয়-সারাৎসারে ছুটে বেড়াই।
২
আত্ম-শ্বাসে ফোলে বেলুন ধাঁধাশীল মেঘের প্রতিভায়
পারদবনে পিঞ্জরপ্লুত মহাশূন্যরেখা বিমূঢ়তা নিয়ে
স্মৃতির আমিষ-কোষে তোমাকে বিচূর্ণ করে বার বার
আর আমার সৌধের প্রতি শিরায় তোমার ছায়া নেচে বেড়ায়।
৩
হে ধ্বনিময় পালক তোমার অঙ্গ পুড়িয়ে তুমি ধ্বনি হও
অসার বক্ষ নিয়ে তোমার কণ্ঠে আমাকে জড়িয়ে রেখেছো
বহুকাল পর পূর্ণচ্ছেদ বন্দি আমি আজ তোমার কণ্ঠ নিয়ে
জলগর্ভ শরীরে আমার কামগন্ধহীন অগ্নিস্নান সম্পন্ন করি।
৪.
এত কান্না আমার দুচোখে অগ্নিগিরি উচ্ছিত আবেগে
চোখের তুলসী পাতায় ঝরে অবিরল মর্তের চিতাকাঠে
আর তুমি ছলনা করতে গিয়েও দু’হাতে তুলে নাও ধূপ-ধুনো
তোমার নির্জন স্নায়ুকোঠাতেও কোনো কান্না থাকে না।
৫
প্রতিটি কবিতার অক্ষরে অক্ষরে আমার স্মৃতির বমন
হাজার একটা শব্দ ডিঙিয়ে বোধের উজ্জীবন
প্রতিটি বাক্য জন্ম দেয় এক একটি শ্রেণী কক্ষের
শৈশবে যেভাবে পালিয়ে এসেছিলাম তার দরজা থেকে।
ধাঁধাশীল ছায়া : মাসুদুল হক
বিকালের ভেজারোদে ফেলে যাওয়া লুপ্তরহস্যে
ওরা দু’জন-যে যার সঙ্গী
কন্ঠমণি তুলে ধরে কাচুয়া বিড়ালের
বোবাকান্নায়-বাতাসে বৃত্তের শূন্যে
উড়ে বেড়ায়।
ওরা সার্কাসের মেয়ে
দুঃখরজনীর স্মৃতি ভুলে
বাসরজাগানি নৃত্যে-উড়ে বেড়ায় বিচিত্র মুদ্রায়।
অগণন মিথুনচিত্রের স্মৃতি ভুলে
ওরা দু’জন-যে যার সঙ্গী
ওরা মৃদঙ্গী বাতাসের ঢোলে
মেঘমন্দ্র রহস্য ছড়ায়।
ওরা সার্কাসের মেয়ে
আণবিক বিশ্বের বুকে
বাতাসে বৃত্তের শূন্যে-উড়ে উড়ে বেড়ায়।
সার্কাসের মেয়ে : সার্কাসের মেয়ে ও অন্যান্য কবিতা
কমলা রঙের টানা দড়িতে
বোধিদগ্ধ পাথর চোখের বিস্ফার নিয়ে
স্বেচ্ছাকৃতপ্রজার মতো তুমি হেঁটে বেড়াও…
তোমার অনায়াস ভ্রমণে
রহস্যের যত অবাক কাহিনীকুসুম
থরে বিথরে ফুটে ওঠে মুগ্ধ অশ্বকোবিদের চোখে।
নিয়মের আদিতে তোমার এই সার্কাস প্রদর্শন
মানবের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তার চাহনিকে
বেভুল রেখে চলে যায় আরো দূর জন্মে!
তবে আমার স্বস্তি এই
ছাগল ছিলে বলে মূর্ছিত সন্ন্যাসে
কমলা রঙের টানা দড়িতে তোমাকে রেখে
এসেছি দূরে।
সার্কাসের ছাগল : সার্কাসের মেয়ে ও অন্যান্য কবিতা
পরিবেশ বিষয়ক সেমিনার চলতে চলতে
আমি ঢুকে পড়ি জঙ্গলে
সবুজ পাতায় ঝুলে থাকা ফুল
তুলে আনতে গেলেই
লাল পাপড়ি ঢানা মেলে ত্রিমাত্রিক নীলে
একটা মথ আর ফুলের মধ্যে পার্থক্য জানা নেই
তবুও রোদ গলিয়ে ঝরা পাতার কণ্ঠ শুনি
অন্ধকারে ভেসে বেড়ানো মার্বেল কুড়াতে গেলেই
প্রাণিবিদ্যায় পড়া বাঘের ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়
অথচ জঙ্গল ঢুকে পড়েছে পাঠ্যপুস্তকে
পাতা উল্টালেই বোঝা যায় পশুপাখির চলাচল!
পরিবেশবিদ্যা : লজ্জা ও বোতামের কবিতা
মাসুদুল হকের অগ্রন্থিত দুটি উল্লেখযোগ্য কবিতা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
আমি অন্ধকারে আমার মুখ আঁকছি
দূরে কোথাও সূর্য ছড়িয়ে পড়ছে
জলের গভীর থেকে আলো উঠে আসে
আমার ছায়া বলে কিছু নেই;
কিন্তু শরীরের বিকল্প একটা মুখ খুঁজছি
সাত রঙ ধরে যে চোখ
চোখের গভীরে শব্দহীন রঙগুলো
পর্দা থেকে সরিয়ে দিলে
একটা ছায়াগ্রহ উঠে আসে
সূর্যের আগুনে আমি শরীর পুড়িয়ে
ছায়া নিয়ে উঠে দাঁড়াই
আলোতে ছায়া হারালেও আগুনে পোড়ে না কোনোদিন
অথচ অবিনাশী ছায়া
ভালোবাসার চোখ খুঁজে পায়নি আজও!
ছায়ামানুষ : মাসুদুল হক
চৈত্রের এক অমাবস্যায় আমি চিলেকোঠায়
হারিয়ে গিয়েছিলাম
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষ
আলোর মধ্যেই হারিয়ে গেছে
নিজের মধ্যে নিজে থেকেও হারিয়ে গেছে
অন্য মানুষদের কাছ থেকে;
পরিচিত ভূগোল, চেনাজানা ঘর থেকে
কিন্তু আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আমার কাছ থেকে
সেদিন সন্ধ্যায় ছিল না কোনো তারা
আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অন্ধকারে
হারিয়ে যাই; হারিয়ে ফেলি আমার ছায়া
হারিয়ে যায় আমার প্রতি অঙ্গ অন্ধকারে
সেই থেকে আমার অস্তিত্ব অন্ধকারে মজুদ হয়ে আছে
অন্ধকারের গভীর থেকে উঠে আসা আমি এক প্রাচীন খনিজ!
অন্ধকার মূলত খনিজের কারখানা!
জন্মউৎস ও অন্ধকার : মাসুদুল হক
কবি মাসুদুল হক সমকালীন চেতনায় যেমন বিভর থাকে, তেমনই চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কিংবা প্রত্যক্ষ কোনো বস্তু বা জ্ঞান– তার কবিতায় হয়ে ওঠে মূল উপজীব্য।
৫.
কবিরা সংসারে আছেন কিন্তু থেকেও নেই। যেনো রাজহংসের মতো; কাদায় আছে কিন্তু গা ঝারা দিয়ে শিল্পস্বরূপায় যেতে পারেন। মাসুদুল হক ঠিক তেমনি, সংসারে থেকেই সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর এঁকে নিরন্তর স্বকীয় দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, অনুবাদ সাহিত্য, গবেষণা, আলোচনা, সম্পাদনা– সর্বত্র রয়েছে তার সমান বিচরণ। তিনি চর্যাপদের প্রতিটি পদের গূঢ়ভাবকে ঘিরে কবিতা লিখেছেন, যা প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রম।
মাসুদুল হকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩৯টি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো: ‘টেনে যাচ্ছি কালের গুণ’ (১৯৮৭), ‘অলৌকিক স্পর্শ’ (১৯৯০), ‘ধাঁধাশীল ছায়া’ (২০০০), ধ্বনিময় পালক’ (২০০০),‘জন্মান্ধের স্বপ্ন’ (২০১০),‘ সার্কাসের মেয়ে ও অন্যান্য কবিতা’ (২০১২), ‘লজ্জা ও বোতামের কবিতা’ (২০২২), ‘আদিবাসী কবিতাগুচ্ছ : উলগুলান ও অন্যান্য কবিতা’ (২০২৪), ‘জল ও চিলমারীর কাব্য’ (২০২৪),’The Shadow of Elusion’ (২০০৫), ‘Blind Man’s Dream’ (২০১০)। বলাবাহুল্য, ‘লজ্জা ও বোতামের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটি শব্দরঙ হাউস প্রকাশনী থেকে কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।
মাসুদুল হকের গল্পগুলো অনবদ্য শব্দচয়নে– আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি ও যোগ্যতার স্বতন্ত্র বৈভবে পরিপূর্ণ। তার ‘তামাকবাড়ি’ (১৯৯৯), ‘ঢুলকিপুরাণ’ (২০১০), ‘আবার কাৎলাহার’ (২০১১), ‘নাবিকের জুতো’ (২০১৩) –এই ৪টি স্বতন্ত্র গল্পগ্রন্থ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘গল্পসমগ্র’ (২০২২)।
প্রবন্ধ-গবেষণায় মাসুদুল হক যেনো অনন্য। এই ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: ‘বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব’ (২০০৮), ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা’ (২০০৮), ‘দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি : ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার’ (২০০৮), ‘মুক্তিযুদ্ধ : দিনাজপুর’ (যৌথ, ২০০৮), ‘জীবনানন্দ দাশ ও অন্যান্য’ (২০১১), ‘রবীন্দ্রনাথ : ছেলেবেলা’ (২০১২), ‘বাংলা সাহিত্যে নারী’ (২০১৩), ‘বাংলা উপন্যাস অধ্যয়ন’ (২০১২), ‘ভিটগেনস্টাইন জ্যাঁ ককতো ও অন্যান্য’ (২০২১), ‘বাংলাদেশের কথাসাহিত্য : পাঠ ও অন্বেষণ’ (২০২৪), ‘নব্বই দশকের কবিতা : পাঠ ও মূল্যায়ন’ (২০২৪), ‘টি.এস এলিয়ট ও অন্যান্য’ (২০২৪), ‘ধনঞ্জয় রায় পাঠ ও মূল্যায়ন’ (যৌথ, ২০২৪)।
অনুবাদ-সম্পাদনা শাখায় ‘কবিতা সিরিজ’ (কবিতা সংকলন, ১৯৮৮), ‘এই সময় এই স্রোত’ (কবিতা সংকলন, ১৯৯১), চৌদল ঐকতান’ মূল: টি এস এলিয়ট (১৯৯৯), ‘ধূসর বুধবার’ মূল: টি এস এলিয়ট (১৯৯৯), ‘বালি ও ফেনা’ মূল: কাহলিল জিবরান (২০০৮), ‘হল্লা’ মূল: এ্যালেন গিন্সবার্গ (২০১৭), ‘তাইওয়ানের সমকালীন কবিতা’ (যৌথ, ২০২৪) মাসুদুল হকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক গ্রন্থ- ‘সেলিনা হোসেন’ (২০০০) এবং একমাত্র উপন্যাস ‘দিনমুলুক’ (২০১৫) মাসুদুল হকের সৃষ্টি-চেতনার অনন্য বহিঃপ্রকাশ।
মাসুদুল হক নব্বইয়ের দশকে লিটল ম্যাগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে (১৯৮৭-২০০০) ‘শ্রাবণের আড্ডা’ নামে একটি সমৃদ্ধ লিটল ম্যাগ সম্পাদনা করেছেন। ‘সেঁওতি’ নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রিকার সঙ্গেও জড়িত আছেন। কবিতা দিয়ে তো অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি দরকার– বস্তুগতভাবে সেটা আসে না, তাই তিনি শিক্ষকতার সাথে জড়িত। বর্তমানে তিনি বীরগঞ্জ সরকারি কলেজ-এর অধ্যক্ষ।
সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ– ‘স্মৃতি সংঘ ও সাহিত্য সংসদ’ ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম মাসুদুল হককে স্বর্ণপদক প্রদান করে। এরপর তিনি ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার’ (কথাসাহিত্য, ২০১১), ‘চিহ্ন পুরস্কার’ (কথাসাহিত্য, ২০১৩), ‘দিনাজপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি গুণিজন সম্মাননা’ (লোকসংস্কৃতি, ২০১৪), ‘অর্বাচীন-উপমা সাহিত্য সম্মাননা’ (অনুবাদ সাহিত্য, ২০২১), ‘কবি বাঙাল আবু সাঈদ স্মৃতি পরিষদ স্মারক পদক’ (২০২১), ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’ (অনুবাদ সাহিত্য, ২০২২) লাভ করেন। সম্প্রতি (জুন-২০২৪) ভাঁজপত্র উচ্ছ্বাস-এর যুগপূর্তি উপলক্ষ্যে উচ্ছ্বাস পরিবার ড. মাসুদুল হক ও সিরাজাম মনিরা– এই কবি-গুণী দম্পতিকে ‘উচ্ছ্বাস সম্মাননা’ প্রদানের অভিমত প্রকাশ করেছে। এছাড়াও প্রায় দেড়শত বছরের পুরনো ইংল্যান্ডের ‘The Poet’’ ম্যাগাজিন কর্তৃক ১৫ নভেম্বর ২০২০, তিনি ‘International Poet of the Week’ হিসেবে ঘোষিত হোন।
নামবাচকে মাসুদুল হক তো অনেকেই। কিন্তু কর্মদ্যুতিতে, বাংলা সাহিত্যের নন্দনতত্ত্বে– মাসুদুল হক একজনই। যার কবিতা– তার পরিচয়; সাহিত্যচর্চা– তার পরম আশ্রয়। আমি তাকে বলি ‘নন্দ্যকবি’। নিবেদিত কাব্য-ভাষায়:
শুভ্র-সৌরভ, প্রফুল্ল-চিত্তের সর্বজন জানে
রস-কস, সিঙ্গারা, বুলবুলি, আপাদমস্তকে–
তিন-দশকের কাব্য-বৃত্তে…
নন্দ্যকবি একজনই– কবিতার নন্দনতত্ত্বে।