তৈমুর খান
২০
ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিতে লাগল কোনো কোনো গোপন চোখ
———————————————————-
ইংরেজি ২০০০ সালে এতই বন্যা হয়েছিল যে বেশ কিছুকাল উত্তর-পূর্ব ভারতে ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ যেমন কষ্টে দিন যাপন করছিল, তেমনি চারিদিকে মৃত্যুর পচা দুর্গন্ধে পরিবেশও দূষিত হয়ে উঠছিল। সাদীনপুর রেলওয়ে স্টেশনে ব্রহ্মাণী নদীর ব্যারেজ বসে গেছিল। আর ওই ব্যারেজের উপর দাঁড়িয়ে ছিল তিস্তা-তোর্স্তা ট্রেন। ট্রেনের ভিতরেও থৈ থৈ করছিল পানি। পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল ট্রেনটিকে। আমরা সাদীনপুর পর্যন্ত গিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম জলের তোড়ে ভেসে আসা অনেক ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ এবং গোরু-ছাগলের মৃতদেহ। সে একটা দিন গিয়েছে বটে। তবু বৃষ্টি থামেনি। অনেক ক্ষতি করে দিয়ে গেছে।
পিএইচডির থিসিসের কাজ সম্পন্ন হলেও জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বলে তা দিতে যেতেও পারিনি। তাহলে ২০০০ সালেই পিএইচডি কমপ্লিট হয়ে যেত। ২০০১ সালে জমা দিতে গেলে আবার আমাকে ১০০০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। এবং ইউনিভার্সিটির উচ্চতর কর্তৃপক্ষের অনুমতি আদায় করতে হয়। বহু ঘোরাঘুরি করে অধ্যাপিকা ললিতা সান্যালের সহায়তায় সেই কাজটি করতে পারি। ফলে ২০০১ সালেই তা জমা দিয়ে আমি সার্টিফিকেট পাই। স্কুল মাস্টারির চাকরিতে পিএইচডির জন্য আলাদা ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যেত। কিন্তু সেই সময় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন বহরমপুরের এডিআই হয়েছিলেন সেকেন্দার আলি। তিনিই তা জানিয়েছিলেন। সুতরাং পিএইচডি কোনো কাজেই লাগে না। তবে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা আবার পুনরায় চালু হয়। ডিআই অফিসে দরখাস্ত করলে তখন আমি সহজেই অনুমোদন পাই। সেই দিনই পিএইচডি করার উপকারিতা বুঝতে পারি। সেইদিনই মনে পড়ে যায় ললিতা সান্যালের কথাও।
চাকরিতে যোগদানের আগেই রামপুরহাটের টুয়েলভ ক্লাসের অনন্যা দত্ত নামে একটি মেয়েকে আমি টিউশনি পড়াতে যেতাম। তখনই ‘কাঞ্চিদেশ’ পত্রিকা শ্যামচাঁদ বাগদির সহযোগী হয়ে সম্পাদনা করতাম। সেইখানেই আমার আড্ডা ছিল। অনন্যা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। বাংলা বিষয়টাও তার কাছে খুব আগ্রহের একটি বিষয়। তাই সিলেবাসের বাইরেও সে অনেক কিছু জানতে চাইত। তাদেরই পাড়ার একটি মেয়ে কবিতা লিখে তাকে পড়তে দিলে সেগুলো সে আমার কাছেই নিয়ে আসত। আর সেই কবিতা পড়ে আমিও অবাক হয়েছিলাম। মেয়েটি নাকি বিএসসি পাশ করেই বাড়ি থেকে বেরোয় না, অথচ কবিতা লেখে। সেই কবিতা পড়ে ওকে একটা চিঠিও লিখেছিলাম। পরে তার কিছু কবিতা ‘কাঞ্চিদেশে’ও প্রকাশিত হয়। চাকরি পাওয়ার পর-পরই ওকে একদিন ডেকে বলেছিলাম, “চলো ঘর বাঁধি! অনেক বেলা গড়িয়ে গেল। জীবনের মধু ফুরিয়ে যাচ্ছে।”
সে কাচুমাচু করেছিল। হাসিতেই জবাব দিয়েছিল, কথা বলতে পারেনি। আমি রামপুরহাট ছেড়ে চাকরিস্থলে চলে গেলে এবং হঠাৎ ছাত্রী অনন্যা দত্তর মৃত্যু হলে তার সঙ্গে সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে আর কবিতা লিখেছিল কিনা জানা হয়নি। তবে আমার বিয়ের খোঁজ রেখেছিল শ্যামচাঁদের কাছে। আমি যে বিয়ে করে নিয়েছি এই সংবাদ জানার পর তার ভারি আফসোসও হয়েছিল।
কবিতা যে কবিকে কাছে টানে আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই খুব পরিচিত নয় মেয়েটি তবুও তার প্রতি দুর্বলতা ছিল শুধু কবিতার টানেই। কিন্তু জীবন দ্রুত এগিয়ে চলেছিল, পিছন ফিরে তাকানোর ফুরসত ছিল না। স্বপ্ন দেখার মতো সময়ও ছিল না। প্রতিদিন স্কুল-অফিসে কেউ না কেউ বিয়ের ঘটক এসে বসে থাকত। এদিকে ভাড়ার ঘরের দরজায়ও সাগরদিঘি থেকে একজন ঘটক এসে আমার অপেক্ষা করত। যে জীবনের কানাকড়িও মূল্য ছিল না, সেই জীবন এত মূল্যবান কী করে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর সবাই জানে। আমার মূল্য নয়, শুধু চাকরির মূল্য। মানুষ স্বার্থান্ধ। স্বার্থ টুকুই আগে দেখে। একদিন মুর্শিদাবাদের এক নামকরা এমএলএ তার দামি গাড়ি নিয়ে এসে উপস্থিত হলো স্কুলে। ওই একটাই আর্জি—বিয়ে করতে হবে। সেদিন আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম। সে অনেক কান্না।
সারাদিন পর ভাড়ার ঘরে ফিরে এসেও এতটুকু শান্তি ছিল না। বিয়ের ঘটক অহেতুক কথাবার্তা বলে আমাকে অপমান করত। একদিন সে বলে বসল, “এতদিন থেকে যাওয়া-আসা করছি, তাতে আমার বহু টাকা খরচ হয়েছে। সেসব টাকা আমাকে দিতে হবে!”
“আমি কি তোমাকে আসতে বলেছিলাম? বলেছিলাম নাকি আমার জন্য বউ খুঁজে আনো?”
“কেউ তা বলে নাকি? আইবুড়ো কেউ থাকলে আমরা আগেই বুঝে নিই।”
“আমি এক পয়সাও তোমাকে দেবো না। যা পারো করোগা!”
তখন সে হম্বিতম্বি করে বেরিয়ে গেছিল। বাড়ির ল্যান্ডফোনে ফোন করে আমার মাকে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করেছিল। সেই অপমান সহ্য করাও খুব কঠিন হয়েছিল আমার পক্ষে।
ভাড়াবাড়ির মেয়েটিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত আমার ভুল ছিল। যে মেয়ে নিজের শরীর প্রদর্শন করতে পারে, অচেনা পুরুষ হলেও তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে, সে মেয়ে যে স্বৈরিণীও হতে পারে তারপরেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার ভাড়া নেওয়ার এক বছর মধ্যেই আরও কয়েকটি কলেজ ছাত্র অন্যান্য রুমগুলোতে ভাড়াটিয়া হিসেবে এলে মেয়েটির সেই আচরণ আরও বিভ্রান্তিকর ও রহস্যময় হয়ে ওঠে। সাজসজ্জা করে, কখনো অর্ধনগ্নতা প্রদর্শন করে সেসব ভাড়াটিয়ার সঙ্গেও তার ফষ্টিনষ্টি চলতে থাকে। তার বহুগামিতা রূপ স্পষ্ট হয়ে যায় আমার কাছেও। একদিন তার মা আমার রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করে।
—ব্যাটা, বিহা-শাদি করবা না?
—কেন চাচি! এ কথা জানতে চাইছেন কেন?
—একলা একলা থাকো, রান্না করি খাও, আর কত দিন কষ্ট করবা!
—বিয়ে তো চাচি করব, কিন্তু রান্না করার জন্য করব না। মনের মতো মেয়ে হলেই করব।
—তোমার চাচা কহাইছিল, বিহা করলে আমাদের জানাইও।
—তা জানাব।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য ভিন্ন কিছু কথা বলার জন্য তখন ভাবছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ে গেল চাচির বাম হাতের কনুইয়ের দিকে। দেখলাম কনুইয়ের ছাল-বাকলা উঠে রক্ত জমে আছে। সেদিকেই ইঙ্গিত করে বললাম:
—হাতে কী হয়েছে চাচি?
—আর কহাইও না, তোমার চাচার সঙ্গে রাতে খেলতি গিয়ে দিয়ালে ঘষা লেগি এরকম ছাল উঠি গেছে!
চাচির কথা শুনে আমার মুখ রাঙা হয়ে উঠল। এ খেলা যে কোন খেলা তা আর বুঝতে বাকি রইল না। পঞ্চাশ অতিক্রম করেও যৌন সংরাগের এমন উচ্ছল তীব্রতা খুব কম মহিলার চোখে-মুখেই ফুটে উঠতে দেখি। এ মহিলা নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম। কোনো কথা বলতে যেমন তার মুখে আটকায় না, তেমনি লজ্জা-শরমেরও ধার ধারে না। তার পেটের সন্তান-সন্ততিও যে বেলেল্লাপনা আচরণ পাবে না একথা বলতে পারি না। তাই বহু ভাড়াটিয়ার ঘরেই তার মেয়েদের কণ্ঠস্বর অনেক রাত অবধি বেজে উঠত । হি-হি হা-হা উচ্চ হাস্য ধ্বনির কী কারণ থাকতে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হতো না।
২০০৫ সালের ১২ই এপ্রিল নলহাটি থানার উত্তরের বসন্ত গ্রামে হঠাৎ করেই আমি বিয়ে করে ফেললাম। চারিদিকের সাঁড়াশি চাপ থেকে বাঁচতে বিয়ে করা ছাড়া আমার আর কোনো গতি ছিল না। চাকরি পেয়ে লোকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে মেয়ে নির্বাচন করে, কিন্তু আমি সে পথে যেতে পারলাম না। বন্ধুবর ইসলাম শেখ জানাল, “একটা এম এ পাস মেয়ে আছে। নিম্নবিত্ত চাষি পরিবারের। এমন কোনো গৌরব ও আভিজাত্য নেই। অতি সাধারণ একটা পরিবারের মেয়ে।”
আমি ইসলামকে বলেছিলাম, “তুমি মেয়েকে নিয়ে তোমার বাড়িতে আসতে বল। যত দ্রুত হয়, একেবারে বিয়ে করে আমি কর্মস্থলে যাব।”
পরের দিনই ইসলাম তাদের বসন্ত গ্রাম থেকে আসতে বলেছিল তার নিজের বাড়ি আয়াস গ্রামে। মাটির একটি কোঠাপাড়া বাড়িতে বিকেলবেলা দেখেছিলাম মেয়েটিকে। সাদামাটা চেহারার হলেও আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল যা শরৎ কালের সকালের মতো শান্ত স্নিগ্ধ, নম্র ও সহিষ্ণু। সুতরাং আর দ্বিতীয়বার দেখার প্রয়োজন হয়নি। বাড়ির অন্য কারোরই অমত ছিল না।
বিবাহ পরবর্তী জীবনে সেই ভাড়ার ঘরে আর থাকা যায়নি। ক্রুদ্ধ ফণিনীর মতো ফুঁসে উঠে চাচি বলেছিল, “এমন মাইয়া বিহা করে জীবনে সুখ পাইবা না। না আছে শরীল, না জানে কাজ; কী দেইখা করলা আমরা বুঝতাছি না। এই মাইয়া ছাড়ি দাও, ভালো মাইয়া দিবো!”
কয়েক দিন থাকার পরেই বুঝতে পারলাম ওদের আচরণ মোটেও ভালো নয়। একে একে সব জিনিসও ঘর থেকে চুরি হতে লাগল। বন্ধ হতে লাগল ইলেকট্রিক আলো। ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিতে লাগল কোনো কোনো গোপন চোখ। কখন কী অঘটন ঘটবে তা কে জানে। সেই সংশয় পীড়িত সংকট মুহূর্তে রঘুনাথগঞ্জে একমাত্র পরিচিত আব্দুল্লাহ মোল্লাকে সব কথা বললাম।আব্দুল্লাহ মোল্লা দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। ‘সাহিত্য চেতনা’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। ‘রংধনু’তে লেখার সময় বহু বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কও করেছি। তিনি তৎক্ষণাৎ বাজারপাড়ায় এক হাজি সাহেবের বাড়ি ঠিক করে আমাদের গৃহ পরিবর্তন করতে সাহায্য করলেন। আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।