| মাহমুদ নোমান |
কবি সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা ‘বাংলা রিভিউ’ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় জনসাধারণের মধ্যে পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দ্দশা, ক্ষোভ,ঘৃণা, হাহাকার,ক্রোধ, দাবি এক শর্তেই ধাবিত করে। সেই শর্তটি ছিল বাঙালির কাছ থেকে বাঙালির মুক্তি। কেমন করুণ আর্তিতে ‘বাংলা রিভিউ’ সদাই জাগ্রত জনতার সংগ্রামের উজ্জীবিত শক্তি হয়ে উঠে। প্রতিদিনই একেকটা শিরোনামে কয়েকজন কবির কবিতা আপলোড করতে থাকে। ‘বাংলা রিভিউ’ এর কার্যক্রমে আমার মনে এলো ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুচ্ছের কথা। ঐ সংকলনে ১১টি কবিতার কবিরা হলেন—শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক এবং হাসান হাফিজুর রহমান। আপনারা হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন সেসব কবি আর এখনকার ‘বাংলা রিভিউ’তে প্রকাশিত কবিতা এক নয়। হুম, এক নয়,তবে আরেক তো…সম্মিলিত শব্দস্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন মুক্তির অক্ষরে ‘বাংলা রিভিউ… ভাষা আন্দোলন হয়েছিল পাকিস্তান সরকার আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার সেই পৈশাচিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আর এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনও তো আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নয় একেবারে জব্দ করে রাখার জন্যই!
অনেকে এটিকে মুক্তিযুদ্ধ বলছেন, মহান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা,ভাস্কর্য এমনকি বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ভাঙচুর অসম্মান করে আরেক মুক্তিযুদ্ধ বলছেন সেটি কিন্তু কাম্য নয়। কেননা আপনি সম্মান না করলে আপনি সম্মান পাবেন না,এখানে নিশ্চয় উগ্রবাদী মানুষের বাড়াবাড়ি হয়েছে। আমি মনে করি আমার কাছে কোনও ভাস্কর্যের কাপড়চোপড় আছে কীনা সেই ভাবনাও আমার ভক্তিকে টলাতে পারে না, আমি অস্থির নই আর অস্থিরতা উগ্রতার মধ্যে শান্তি থাকে না,পরমতসহিষ্ণুতা থাকে না,এক কথায় বিপথগামী। আমাদের বাংলাদেশ বহু বর্ণের বহু ধর্মের বহু মতের… থাকুক না যে যার মতো… আমার পরিবার কী আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীতে কেউ লেখালেখিতে ছিল না,কবি বললে টিটকারি দেয়,সেটাতে নিশ্চয় ব্যথিত হই অথচ কখনও কাউকে বলিনি আমার মতো লেখালেখি করতে হবে; ইদানীং যাঁরা সবসময় নীতির কথা বলে তাঁদেরকে ভীষণ সন্দেহ হয়, মানসিক রোগী মনে হয়, আদর্শ লালন করার, কাউকে চাপ দিয়ে আপনার আদর্শে আদর্শিক করা সেটিও স্বৈরাচার…
অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের পরে ড. মুহাম্মদ ইউনুস রংপুরে গিয়ে শহীদ আবু সাঈদের কবর জেয়ারতে যান। সেখানে আবু সাঈদের স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের কথা এলে আবু সাঈদের মা-বাবা এটিকে লিখিত আকারে না-করার অনুরোধ করেন। এটি ধর্মের ব্যাখ্যায় বললেও আমার সেই ঐতিহাসিক ঘটনা মাথায় আসে– ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পরে ২২শে ফেব্রুয়ারি শফিউরের হত্যাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শফিউরের পিতা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন; পাকিস্তানবাহিনী সেটি ধ্বংস করে দেয়। এই মর্মপীড়ায় কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেন ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ নামক কবিতা–
‘ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক/একটি মিনার গড়েছি আমরা/চারকোটি পরিবার।’
শহীদ আবু সাঈদও হয়ে গেলেন আপামর বাঙালির আবেগের নাম, স্বৈরাচারী বন্দুকের সামনে দুই বাহু দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে,কেমন যেন আকাশে উড়তে চাওয়া; নিশ্চিত মৃত্যু জেনে মৃত্যুকে আলিঙ্গনে নিশ্চয়ই নিজের কথা ভাবেননি, আমার আপনার সর্বোপরি দেশের কথাই ভেবেছিল। মূলত আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর আর এভাবে বুক পেতে মৃত্যুকে পরোয়া না- করে স্বৈরাচারের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেই পুরো দেশ কেঁপে ওঠে। আন্দোলন চূড়ান্তে রূপ নেয়। আবু সাঈদকে নিয়ে মুহূর্তে অনেক কবি কবিতা লিখেন,তবে কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতাটি বুঝি যথাযথ উপলব্ধি গাম্ভীর্যে ধরা দিয়েছে, ‘বাংলা রিভিউ’-এর ২০জুলাই প্রকাশিত ‘শহীদ আবু সাঈদ ও অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে–
জল্লাদ পুলিশ তখনও বোঝেনি
ক্রমাগত গুলি ছুঁড়ছে সে বাংলাদেশের বুক লক্ষ্য করে,
রংপুরের মাটিতে, কংক্রিটের ফুটপাতে
ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লো নতুন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ,
আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ আবু সাঈদ।
– শহীদ আবু সাঈদ; কাজী জহিরুল ইসলাম)
গণমানুষের কবি কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় যে আত্মিক টান, সেটি নিপীড়িত মানুষের জয়গান উচ্চকিত করতে সদা জাগরূক; ইতোমধ্যে দেখেছি কবির যে সত্য উঁচিয়ে ধরার আকুতি ও লক্ষ্য উপলক্ষ পেলেই বারুদের মতো মিথ্যা ও অসুন্দরকে বিনাশ করতে উদ্যত; ‘বাংলা রিভিউ’এর ২০জুলাই প্রকাশিত ‘শহীদ আবু সাঈদ ও অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে একমাত্র ভারতীয় কবি তৈমুর খানের কবিতা ছাপা হয়। এই শিরোনামে শুধু নয় পুরো আন্দোলন চলাকালীন ভারতীয় কোনও কবির এই আন্দোলন-ফ্যাসাদ নিয়ে একমাত্র তৈমুর খান-ই কবিতা লিখেন। তবে আড়াল প্রিয় এই কবির কবিতায় কিছুটা দুলিয়ে দিয়ে সরাসরি উত্তর না দিয়ে কবি-ই আড়াল হয়ে গেছেন সেটির কিছু নমুনা পেশ করছি নিম্নে —
আমরা বিশ্বাস পুষে রাখি
বিশ্বাস এসে আলো জ্বালে
আলোকিত ঘরে
আমাদের শিশুরা চাঁদ দ্যাখে।
চাঁদ কি টিপ দিয়ে যায়
তাদের কপালে?
– বিশ্বাস; তৈমুর খান)
খ.
তিনি চলে যাচ্ছেন শুকনো ফুলের মতো হালকা
তিনি চলে যাচ্ছেন বালিকার ঘুমের মতো সুন্দর
তিনি চলে যাচ্ছেন এক টাকার কয়েনের মতো
আমরা তার আকাশযানের নিকটে গিয়ে
আজ আর কেউ চেঁচামেচি করতে পারছি না!
–খবর; তৈমুর খান)
‘শহীদ আবু সাঈদ ও অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে শেষ কবিতাটি কবি শিমুল আজাদের, তিনি আন্দোলনের মাঝ সাগরে ইঙ্গিত করে, যেন তরী বাইতে বলেছেন আরও জোরালো প্রচেষ্টায়–
ইতিমধ্যে আমরা চলে এসেছি বেশ কিছু পথ
এ পথে অন্ধকার ভেঙে রোজ সূর্য উঠবে
বিশ্বসংসার তার নিজস্ব রূপ ছড়িয়ে
আরো ক্লান্ত আর বিপর্যস্ত হবে দিনকে দিন।
কিন্তু অন্যায়কারী তার ভুল কোনদিন বুঝতে চাইবেনা!
– সংগ্রাম দীর্ঘজীবি হোক; শিমুল আজাদ)