তাজ ইসলাম
স্বৈরাচারের পতন হলে,কোন খুনির পরাজয় হলে,ফ্যাসিস্ট উৎখাত হলে কিছু ঘটনা ঘটে। তার একটা চরিত্র হল তার বাসস্থান, অফিস,কর্মস্থল বিজয়ীরা দখল করে। এতে উপস্থিত থাকে লক্ষ কোটি জনতা। এদের বুকের মধ্যে প্রথম থাকে বিজয়ের উল্লাস।তারপর ঘটে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সরল বয়ানের নীতিগত নম্রতা তখন গরহাজির থাকাই স্বাভাবিক। তাদের কেউ তখন উল্লাস প্রকাশে পতিতের বেডরুমের খাটে,সোফায় উঠে নাচে,কেউ ভিক্টরি চিহ্ন দেখায়।কেউ চেয়ার ছেড়ে টেবিলে পা মুড়িয়ে বসে সিগারেট খায়।বুঝায় দেখ তোর দাম্ভিকতা আজ কোথায়? কেউ তার ছবি ফ্লোরে আছড়ে মারে। কেউ তার খাবারের প্লেটে জিদ করে মুতে দেয়।
তারা পতিত শাসকের প্রাসাদে প্রবেশ করে। দরজা ভাঙে,জানালা ভাঙে।
কোটি জনতার মাঝে কিছু স্বার্থান্বেষী লোকও থাকে। সুযোগ বুঝে তারা
আসবাবপত্র, সোনাদানা নিয়ে, আসে। কেউ কেউ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে হাতের কাছে যা পায় নিয়ে আসে।
নিয়মিত বাহিনী কোন শত্রু ক্যাম্প জয় করলে তারা শত্রুর রেখে যাওয়া অস্ত্র ও সম্পদ নিজেদের দখলে নেয় না? হয়তো তারা একটা শৃঙ্খলার মধ্যেই তা হস্তগত করে। এটা এজন্য যে যে কোন বাহিনী একটি নিয়মের মাঝে থাকে। তাই তাদের কার্যাবলী নিয়মতান্ত্রিক থাকে। গণঅভ্যূত্থানে এ নিয়ম কাটে না। জনস্রোত পতিত শাসকের প্রাসাদে ঢোকার পর অনিয়মতান্ত্রিক কিছু ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে গেল ৫ তারিখে গণভবন দখল ও শেখ হাসিনার পলায়ন মূলত গণ অভ্যূত্থানের ফসল। সারা ঢাকা জনস্রোতে টইটম্বুর। কোটি জনতার ঢল ছিল সেদিন। হাসিনা সরকারের প্রতি মানুষের কতটা ক্ষোভ ছিল তা সেদিনের জনস্রোত না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। কার্ফিউ উপেক্ষা করে কোটি মানুষের মিছিল ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। মানুষ গণভবনে প্রবেশ করে হাতের কাছে যে যা পেয়েছে নিয়েছে। একটা মুরগি,একটা হাঁস,কাঁথা,বালিশ,হাঁড়ি পাতিল নিয়ে রাস্তায় এসেছে।চেয়ার,বিছানার চাদর,ফ্রিজ,টিভি,ফ্রিজ থেকে খাসির আস্ত রান,মাছের কাটা মাথা সব নিয়েছে। পুকুরে,লেকে নেমে সাঁতার,তাজা মাছ ধরা,শাড়ি,চূড়ি সবই নিয়েছে জনতা। চায়ের কাপ, পিরিচ,কেউ কেউ স্টিলের তালা বাসন,চামচ নিয়ে বাজাতে বাজাতে স্বৈরাচার পতনের স্লোগান দিয়েছে। ভদ্রতার সংজ্ঞায় এটাকে ‘ঠিক না ‘বলাই ঠিক। কিন্ত গণ অভ্যূত্থানের বিচারে এটাই বাস্তবতা। এটাই সফল অভ্যূত্থানের চরিত্র।পরিত্যক্ত ব্রা লাঠিতে উঁচিয়ে উল্লাস করাকে লুট বলা যায় না।অভদ্রতাও বলা যায় না তখনের পরিবেশে। বিগত পনের বছরের জমানো ক্রোধ উপশমিত হয়েছে গণভবনের জিনিসপত্র হাতে নিয়ে। এ ক্রোধ নিবারণ করেছে কেউ এসব নিয়ে,কেউ দেখে। তারা শাড়ি,চূড়ি ব্রা,মুরগি লুটতে যায়নি। গিয়েছে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করতে। তার আগেই সে পালিয়ে গেছে।
স্বৈরাচারের ব্যবহার্য সামগ্রী এই ভবন থেকে বের করে অভিশাপ মুক্ত করেছে এই ভবনটিকে। আর স্বৈরাচার মুক্ত করে দেশকেও করেছে পবিত্র। শান্ত পরিবেশে কারও বাসায় এরকমটা করলে সরল শব্দে তা লুটপাট বলা হত । অভ্যূত্থান পরবর্তী যা ঘটেছে তা অভ্যূত্থানেরই অংশ। পৃথিবীর সব সফল অভ্যূত্থান ঘটলে এর ব্যতিক্রম পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
ফিরতি মিছিলে এক কিশোরী তার হাতে থাকা মাটির একটা পেয়ালা দেখাচ্ছে তার সতীর্থকে।
বলছে আমি আমার পাওনা নিয়ে আসছি। বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে রাখব। অন্যজন বলছে এটাতো অভিশপ্ত। সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব ‘ এটাতে মুতমু’।ঘৃণাটা বুঝলেন?
ফিরতি মিছিল থেকে ফোন দিয়েছে একজন।মোবাইলে বলতে ছিল গণভবন দখল করেছি।আমি আমার টাকা উসুল করেছি। ভিডিও কলে দেখাচ্ছে একটা চায়ের কাপ।আর বলছে এটা রাখব আমার পরের প্রজন্মের জন্য স্মৃতি হিসেবে।চায়ের কাপকে আপনি লুট বললে বলতেও পারেন। আমি লুটপাট মনে করি না। আমি মনে করি এটি এই অভ্যূত্থানের অনেকগুলো চরিত্রের একটি।
আপনার চিন্তাকে অন্য দিকেও মোড় দেওয়াতে পারেন। তখন মনে হবে উইনার টেকস ইট অল! ক্রিকেটে জয়ের পর যেন স্ট্যাম্প খুলে হাতে নিয়ে আসছে তারা। জনতা গণভবন জয় করে নিয়ে আসছে গণভবনের মুরগি,পাঙ্গাস,খাসির রান,প্লেট ইত্যাদি। এটাই বিজয়ের উল্লাস।
৩ আগস্ট শনিবার ছিল বিক্ষোভ কর্মসূচী। বিকেলে শহীদ মিনারে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ ও সমাবেশ। পরদিন ৪ আগস্ট ছিল অসহযোগ আন্দোলন । আমরা বিক্ষুব্ধ লেখক সমাজের ব্যানারে উপস্থিত হলাম প্রেসক্লাবে ।কবিতা পাঠ ও বক্তব্য দিয়ে মিছিলসহ যাত্রা করলাম শহীদ মিনারে। কবিতা পাঠ চলাকালেই ক্ষণে ক্ষণে আসতে ছিল মিছিল।মিছিল যাচ্ছে শহীদ মিনারের দিকে। আমাদের বামপাশে অন্য একটি সভা । আমাদের যাত্রাও শহীদ মিনারমুখী। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত রাজপথ। পথচারীদের দু হাত তুলে সমর্থন মিছিলের উৎফুল্লতা বেড়ে যায়।রিক্সা চালকের স্লোগানে শক্তি পায় মিছিলকারীরা। আগের দিন ছাত্ররা মার খেয়ে আজ সতর্ক।সবার হাতে হাতে লাঠি। অবাক হয়েছি নরম দেহের কিশোরী মেয়েদের দেখে। তাদের হাতেও লাঠি। কেউ কেউ রুটি বেলার বেলুন নিয়ে আসছে।মেয়েদের স্লোগানেও আগুন। নারী পুরুষ,ছেলে মেয়ে একাকার। কণ্ঠে তাদের ব্যাঘ্র গর্জন।
৩ আগস্টে শহীদ মিনারে জমায়েত হল লক্ষাধিক জনতা।
এই জনতা দেখে নিশ্চিত হলাম এবার সরকারের পতন অনিবার্য।
এ পতন থামানোর সাধ্য নাই কারো। হয়ত সময় লাগবে। কিন্ত পতন হবেই। পতন হবেই তবে এ পতন যে ৫ তারিখেই হবে এটা ছিল অকল্পনীয়।
মিছিল থেকে বের হলাম সম্ভবত ৬ টায়। বাসায় আসতে আসতে রাত ৮ টা বেজে গেল। পরদিন রবিবার অসহযোগ আন্দোলন।
বিকালে আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভাষণে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন অলি-গলি, পাড়া মহল্লায় হাজির থাকতে। মুহূর্তেই রাজধানী ও রাজনীতিতে বেড়ে গেল আতঙ্ক। এই কয়দিন এক কথায় সমগ্র দেশ থেকে বলতে গেলে আওয়ামীলীগ বিতাড়িত। দেশের থেকেও কোন আওয়ামীলীগ নেই। দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে,রাজপথে কোথাও আওয়ামীলীগের উপস্থিতি নেই। আন্দোলনকারীদের দখলে রাজপথ। স্কুল,কলেজ,ভার্সিটির ছাত্রদের মিছিলে যোগ দিয়েছে জাতী,ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। এত দিন আওয়ামীলীগকে সাপোর্ট দেওয়া দলীয় কর্মীবাহিনীর পাশে যে পুলিশ বাহিনী ছিল কার্যত তারাও মনোবল হারা। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে আশংকা হল তারা রাস্তায় নেমে আসবে আবার । নেমে আসলে সংঘাত অনিবার্য। এমনিতেই এই আন্দোলনকে ঘিরে ব্যপক প্রাণহানি ঘটেছে। শহীদ মিনারে লক্ষ জনতা ঘরে ফেরার আগেই দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি এই আহবান জানিয়েছেন। গণজমায়েত দেখে রাজনীতি সচেতন মহলের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে সরকার আর পতন ঠেকাতে পারবে না। এই রাত তাই আওয়ামীলীগের মরণ কামড়ের রাত। পুরো জাতী উদ্বিগ্ন। তার মাঝে দ্বিতীয়বারের মতো ইন্টারনেট বন্ধ। তাৎক্ষণিক কোন খবর পাবার মাধ্যমও বন্ধ। রেডিও আর টিভি চ্যানেল যে কয়টা চালু আছে তার সবই বিটিভি। বিভিন্নজনকে ফোন দিলে তাদের মাঝেও সরকারের মরণ কামড়ের আতঙ্কই প্রকাশ পায়। সঠিক তথ্য জানার প্রায় সব মাধ্যম অবরুদ্ধ। রাতে ম্যাসাকারের সম্ভাবনাও বিরাজ করে সচেতন মহলে। ভিপিএনেও ফেসবুকে প্রবেশ করা যায়নি। বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।ধারণা করলাম আজ রাতে যে করেই হোক আওয়ামীলীগ রাজপথ দখলে নিবে। রাতের রাজপথ আওয়ামীলীগের হলে পরদিন রবিবার ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলন থমকে যাবে। ধারণা করলাম আজরাত ঢাকা যার আগামীকাল বা পরবর্তী আন্দোলনের ফলাফলের ইতিবাচকতা তার। কাল কি হয়! খবর জানাটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া ফের বন্ধ।ইন্টারনেট বন্ধ।দেশ জুডে কার্ফিউ। অস্থির সময়। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মোবাইল হাতে নিলাম।সময় দেখি রাত ৩টা। ফেসবুক চালু করলাম।প্রবেশ করতে পারলাম। চোখ ছানাবড়া।ঢাকা ছাত্রলীগ আওয়ামীলীগের দখলে।এমন পোস্টের ছড়াছড়ি।ক্রমশঃ স্ক্রল করতে করতে বুজলাম গুজব। তবে লীগের লোকেরা রাতের প্রথম ভাগে ঢাকার কিছু অংশে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সেসব এলাকায় বাড়ি বাড়ি গেটে লাঠির আঘাত করে বাড়ির লোকজনকে হুমকি ধামকি দিয়ে নগরবাসীকে তটস্থ করে তোলে।
পরদিন যথারীতি অসহযোগ কর্মসূচী পালিত হয়। সারাদেশে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিক। লং মার্চ টু ঢাকা ছিল ৬ তারিখ। পরিস্থিতি বিবেচনা করে একদিন এগিয়ে নিয়ে আসে। এবং সর্বশেষ ঘোষণা হিসেবে একটি ঘোষণা দেয়। সরকারও সর্বাত্মক কার্ফিউ জারি করে।
শুরুর দিকে কোটা আন্দোলন আমাকে আকৃষ্ট করেনি। অন্য আর দশটা আন্দোলনের মতো বিষয়টি জানতাম। বিগত বছরগুলোতে বহু ব্যর্থ আন্দোলন দেখেছি। সফল হয়েও শূন্য ফলাফল নিয়ে ফিরে যাওয়া আন্দোলনও দেখেছি। দেখতে দেখতে মন মগজ ভোঁতা হয়ে গেছে। কত তারিখ তা মনে নাই। সে রাতে কী হয়েছিল তাও বলতে পারব না। তবে সকালে মোবাইলে চোখ রেখে দেখি বিভিন্নজনের প্রতিবাদী পোস্ট। সবার আক্ষেপ ভার্সিটির ছেলেরা স্লোগান তুলেছে ‘ তুমি কে? আমি কে? রাজাকার,রাজাকার! রাজাকার শব্দটি,রাজাকার পরিচয়টি এদেশে নেতিবাচক অর্থ বহন করে। ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা এমন স্লোগান দিল কেন? ইতোমধ্যে অনেকে ছেলেমেয়েদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। ভিডিওতে গেলাম। দেখলাম যারা ছাত্রদের দোষী বানাচ্ছে তাদের কাজ উদ্দেশ্য প্রনোদিত। বিষয়টি আমার কাছে মন্দ মনে হল। যারা কবিতা লেখে,যারা শিল্প চর্চা করে তারাই ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে।স্লোগানটি ছিল
তুমি কে,আমি কে?
রাজাকার,রাজাকার।
কে বলেছে? কে বলেছে?
স্বৈরাচার,স্বৈরাচার।
তুমি কে? আমি কে? রাজাকার,রাজাকার এটি প্রশ্নবোধক স্লোগান,স্বীকারোক্তিমূলক স্লোগান না। এবং প্রথম পঙক্তিটির ব্যাখ্যা দ্বিতীয় পঙক্তি । এই কথা সাধারণ মানুষও বোঝার কথা। একজন কবিতো আরও বেশি বোঝার কথা।
সত্য ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই এর সাথে জড়িয়ে গেছি। অর্থাৎ তুমি,আমি রাজাকার, তা কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার। এই সহজ বিষয়টিকে জটিল করেছে একদল লেখক। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুইটা পক্ষ হল। এক পক্ষ পুরো স্লোগানটা বলে তার ব্যাখ্যার পক্ষে। আরেকপক্ষ স্লোগানের খণ্ডিত অংশের ব্যাখ্যায় হাবুডুবু খাচ্ছেন। তারা আন্দোলনটিকে জামায়াত শিবিরের দিকে ঠেলে দিতে প্রয়াসী। মূলত আন্দোলনটি ছাত্রদের। তারা মন্ত্রী, এম পি, প্রধানমন্ত্রীর কানকে ভারী করে তোলেছেন।তাদের বুঝাতে চেষ্টা করছেন এটি ছাত্রদের আন্দোলন না।জামাত শিবির বা বিএনপির আন্দোলন। সরকার হার্ডলাইনে চলে গেল। ১৪ জুলাই থেকে ১৬ জুলাইর মধ্যে আন্দেলন তুঙ্গে উঠল। সরকার ঘেঁষা কবি সাহিত্যিকদের একগুয়েমি মন্তব্যে ফেসবুকে মতামত দেওয়াই যায় না। মিথ্যা বা ভুল ব্যাখ্যাও মানতে পারিনি। হ্যাঁ শব্দ চয়নে একটু অসর্তকতা ছিল।এটা এমন হলে তাদের বিরুদ্ধে অপব্যাখ্যার সুযোগ থাকত না।এটি হতে পারতো’ তোমাকে আমাকে
রাজাকার রাজাকার
কে বলেছে? কে বলেছে?
স্বৈরাচার,স্বৈরাচার। মঙ্গলবার গুলি করে হত্যা করা হয় বেরোবির ছাত্র আবু সাঈদকে।
এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। সাধারণ মানুষ হিসাবে কিছুতেই মিলাতে পারিনি। একদম অকারণে গুলি।
তখনও ইন্টারনেট আছে। সেদিন ছিল ছাত্রদের বাংলা ব্লক। জরুরি কাজে বাড়ি গিয়েছিলাম। পরিবহন ব্যাবস্থা ছিল স্থবির। তবু গেলাম।আবু সাঈদ হত্যার ভিডিওটা দেখলাম। মর্মাহত হলাম।আমি মূলত একটি অপব্যাখ্যার জবাব দিতে গিয়ে এই আন্দোলনে প্রথমে জড়াই। মিথ্যা সহ্য হয়নি। ১৬ জুলাইর দিনগুলোর পরে সরকারের হত্যা মিশন দেখে আর কোন সুস্থ্য মানুষ চুপ থাকতে পারেনি। ১৬ তারিখের রাত থেকে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। জনসাধারণের কপালে জুটল সোশ্যাল জেল। ওয়াই ফাই,মোবাইল ডাটা সব বন্ধ। কোন খোঁজ খবর নাই। আঠার বিশ তারিখে ওয়াইফাই চালু করলে ভিপিএনে টুকটাক অনলাইনে যেতে পারি। এর আগে টিভির সেন্সর করা সংবাদে তুষ্ট থাকতে হয়। বিশ তারিখেই আবার ওয়াইফাই বন্ধ। সোশ্যাল মিডিয়া তখনও বন্ধ। দশ কি এগার দিন পর্যন্ত মোবাইল ডাটা,সোশ্যাল মিডিয়া,ওয়াইফাই অকেজো। আমি সম্ভবত ২৩/২৪ তারিখ থেকে টুকটাক ভিপিএনে ফেসবুকে ঢুকি।
শনিবার মানে ৩ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে অফিসিয়ালি লাশ আর রক্তের স্রোতে তলিয়ে গেল। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ দিয়ে শুরু। ৩ তারিখে এসে আতঙ্কের নগরী হয়ে গেল। মিছিল মানেই খুন,রক্ত,লাশ। বাংলাদেশ যেন আরেক ফিলিস্তিন। বাংলাদেশের পুলিশ মানেই যেন ইসরায়েলী পুলিশের বাংলা সংস্করণ।
আন্দোলনকারীদের দমন করতে আগস্টের ২/৩ তারিখে রাষ্ট্র তার সব বাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে দিল। ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে দেশে কার্ফিউ। আগস্টের ২/৩ তারিখে আন্দোলনকারীদের লাশের পরিমান বিবেকবান মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আর কোন সরকারের আমলে এতো বেশি লাশ ও রক্ত ঝরেনি। হেলিকপ্টারে গুলি করা হয়। ঢাকা যেন যুদ্ধরত কোন শহর,শত্রু বাহিনী আক্রমণ করছে, বিল্ডিংয়ে বাসার ভিতর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শিশু,নারী,বৃদ্ধ। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ মাথায় নিয়েই আন্দোলন চলতে থাকে।
ঘরে বসে থাকায় নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ১৬ জুলাই থেকে ১ আগস্ট,তারপর ২ আগস্ট শুক্রবার একদিনে কুড়ি, পঁচিশজন গুলিবিদ্ধ ছাত্রের মৃত্যুতে অস্থিরতা কাজ করে।
রবিবার ছিল ছাত্রদের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। বাংলা ব্লক,শাটডাউন,কমপ্লিট শাটডাউন এদেশের আন্দোলনে শব্দগত অভিনবত্ব আনে ছাত্ররা । মানুষ চমকিত হয়। সর্বাত্মক অসহযোগের দিন শতাধিক মানুষ খুন করে হাসিনা সরকার।
৩ তারিখে ছিল সারাদেশে বিক্ষোভ। ঢাকায় বিক্ষোভের পর শহীদ মিনারে সমাবেশ।
দুই তারিখ শুক্রবারে বিক্ষুব্ধ কবি লেখকদের জমায়েত ছিল বাংলামোটর ও ধানমন্ডি আবাহনি মাঠের পাশে। যেতে পারিনি। একজন লেখক হিসেবে অপরাধবোধ কাজ করে। ঐদিন রাতেই কবি জাকির আবু জাফর ফোন করেন। শনিবারে বিকাল ৩ টায় প্রেসক্লাবে বিক্ষুব্ধ কবি লেখক সমাজ উপস্থিত হবেন। দ্রুতই কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করলাম। যেতে একটু দেরী হয়ে যায়। গিয়ে দেখি শতাধিক লেখক উপস্থিত। ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কবি ফরহাদ মজহার,আবদুল হাই শিকদার,জাহাঙ্গীর ফিরোজ,
জাকির আবু জাফর,মাহবুব মুকুল,
আবৃত্তি শিল্পী নাসিম আহমেদ,আফসার নিজাম, রহমান মাজিদ,তাসনিম মাহমুদ, সীমান্ত আকরাম, রবিউল মাশরাফী, নুরুজ্জামান ফিরোজ প্রমুখ। কবিতা, বক্তব্য চলাকালীন ই মিছিল আসতে থাকে দু দিক থেকে। দ্রুতই কার্যক্রম শেষ করে আমরাও মিছিল নিয়ে রওয়ানা দিই শহীদ মিনারের দিকে। প্রেসক্লাব ছাড়তেই আমরা জনস্রোতে মিশে যাই। ডানপাশে সামান্য রাস্তা ছাড় দেওয়া বিপরীত দিক থেকে আসা লোকদের জন্য। তারাও মিছিলে একাত্মতা ঘোষণা করে। সবচেয়ে প্রেরণাদায়ক রিকসাচালকদের স্লোগান।আমাদের মিছিলের কাছাকাছি আসতেই প্রতিজন রিকসাচালক ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই সর্বশক্তিতে হাত ছুঁড়ে মারে আকাশে। ফরহাদ মজহারের প্রাণশক্তিতে অবাক হই। বৃদ্ধ মানুষ! হাজার হাজার মানুষের ভীড় ঠেলে যাচ্ছেন সামনের দিকে । শহীদ মিনার চত্তরে মিছিলকারীরা যার যার গ্রুপ নিয়ে বৃত্তাকারে বসেছে। ফরহাদ মজহার একেক বৃত্তে প্রবেশ করে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তোলে ধরছেন। মুহূর্তে স্লোগান গগনবিদারী হয়ে যাচ্ছে। শহীদ মিনারের বেদীতে গিয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। কারো কোন ক্লান্তি নাই। আগের দিন ছাত্ররা মার খেয়ে এদিন মনে হল প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।মেয়েরাও আজ হাতে কিছু নিয়ে এসেছে। আকাশে কাক দেখেই স্লোগান ” কাউয়া,কাউয়া”।
ড্রোনের আগমনে হেই বলে চিৎকার। মিছিলে কোন মেয়ে হাঁটতে দেখলে সসম্মানে রাস্তা করে দিচ্ছে ছেলেরা। ছেলেমেয়েদের ভাব দেখে মনে হল এদিন আওয়ামীলীগ সামনে এলে মনের জ্বাল মিটাত পিটিয়ে।
রাত থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখছি লং মার্চে যাব। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে ফজরের নামাজ পড়েই গোসল করে তৈরী হয়ে গেলাম। দুইটায় গণভবন ঘেরাও।ভাবলাম সকাল বারটায় রওয়ানা দেব।আবার ভাবতে ভাবতে সীদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ফেললাম। যাব না।আবার পরিবর্তন, যাব। যাব, যাব না করতে করতে বেলা দশটা বেজে গেছে। নাস্তা করিনি। একটা চা আর একটা বনরুটি খেয়ে কয়েকজনকে ফোন দিলাম। তারা যাবে।তড়িৎ সীদ্ধান্ত নিলাম আমাকে যেতে হবেই। দ্রুত অযু করে তওবা করে নিলাম। মৃত্যু কবুল করে বের হয়ে গেলাম। হয়ত স্বৈরাচারের গুলিতে আজই আমার শেষ দিন। দেশের এই ক্রান্তিকালে যাওয়াটা অপরিহার্য মনে হল। সারাদেশে কার্ফিউ।প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকেরা না আসতে পারলে জনস্রোত কম হবে। আমার তাই যেতে হবে।অন্তত একজন লোকতো বাড়লো।আর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যদি আসতে পারে তাহলে আমি যাব না কেন? যেতে হবেই। মৃত্যুতো ঘরে বসে থাকলেও হতে পারে। দেশের জন্য না হয় মরলামই। এসব ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলাম ওয়াসপুর।আমার জন্য ঢাকায় প্রবেশ মুখ এটি। কয়েক মিনিট পরেই বসিলা ব্রিজ।ব্রিজে ট্রাকভর্তি বালু দিয়ে চলাচল আটকে দিয়েছে পুলিশ। গাবতলি ব্রিজেও একই অবস্থা। ওয়াসপুরে গলির আগেই জটলা, সামনে তাকিয়ে দেখি পুলিশ র্যাবের টহল। মুহুর্মুহু ফাঁকাগুলির আওয়াজ।সাউন্ড গ্রেনেড। নাক-মুখ জ্বালা শুরু হয়েছে টিয়ার শেলের ধোঁয়ায়। ঢাকায় ঢুকার কোন সুযোগ নেই। পিছু হটে চলে এলাম শ্যামলাশি গুদারাঘাট।ওখান থেকে নৌকায় গেলাম নদীর ওপারে ৪০ ফিট।এই পথে আমি এবারই প্রথম।শুরু হল বৃষ্টি। রিকসায় মেইনরোডে গেলাম।শ খানেক পুলিশ।কাউকে যেতে দিচ্ছে না।কেউ যাচ্ছেও না।দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনের সাথে কথা বলে গেলাম অন্য গলিতে।চাঁদ উদ্যান সে গলির নাম। ওখান থেকে গেলাম কৃষি মার্কেট মোহাম্মদপুর। কৃষি মার্কেট থেকে আসাদ গেট। আসাদ গেটে আরও কড়াকড়ি। তবে একা হেঁটে যাওয়া যায়। ডান বাম না তাকিয়ে ব্যারিক্যাট পার হয়ে আবারও রিকসা নিলাম। গন্তব্য প্রেসক্লাব। ওখানে আমাদের লোকজন জড়ো হয়েছে।সোবহান বাগ, বত্রিশ হয়ে রিক্সা সাইন্সল্যাবের ব্যারিকেটে দাঁড়াল। কনস্টেবল কোথায় যাই জিঙ্গেস করলে পিজির কথা বললাম। কারণ? কোমড়ে ব্যাথা।হেঁটে যাবার আদেশ দিল।কিন্ত বাঁধা দিল অফিসার।যত বড় অফিসার মনে হল তত বড় হারামজাদা।রিকসা চালককে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে রিকসা ঘুরাতে বলল। অগত্যা রিক্সা ওয়ালাকে পূর্ণ ভাড়া দিয়ে নেমে গেলাম। সারা রাস্তায় প্রশাসনের লোক ছাড়া অন্য কাউকে দেখিনি। আর্মি, পুলিশের কড়াকড়ি আর শূন্য শহর দেখে মনে হল রাজধানী সরকারের নিয়ন্ত্রণে। স্লোগানের আওয়াজ শোনে সামনে তাকিয়ে দেখি আইডিয়াল কলেজের সামনে ছাত্ররা স্লোগান দিচ্ছে। বেলা তখন বারটা বেজে গেছে। হতাশার মাঝে আশার আলো উঁকি দিল। এতো কড়াকড়ির মাঝে যখন ছাত্ররা একত্রিত হতে পারছে তখন যথাসময়ে তারা হাজির হবেই।
আমি অন্য একটা রিকসা নিয়ে সেন্ট্রাল রোড হয়ে গেলাম হাতিরপুল হয়ে পিজির গলিতে। রাস্তার মাথায় আর্মি ব্যারিকেটকে আরও শক্ত করেছে নিজেদের গাড়ি খাড়া করে। গেলাম অন্য গলিতে। সবখানেই স্বৈরাচারের সজাগ পাহারা। ফোন করলাম কবি আফসার নিজাম আর তাসনিম মাহমুদকে। আমার কথা ছিল আমি তাদের সাথে একত্রিত হব।
ওখানে আগে থেকেই তারা আছে। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ফোনে কথা বলেছিলাম তাদের সাথে। জেনে নিয়েছিলাম রাস্তায় লোক বের হতে দেয় কিনা! নিজামের ইস্পাত- দৃঢ় কথা যেভাবেই হোক যাবেই। কথা বলেছিলাম কবি রহমান মাজিদের সাথে। তিনিও যাবেন।মাজিদ যাবে শেওড়াপাড়া থেকে। আমি যখন পিজির কাছে মাজিদ তখন মিরপুর দশ নাম্বার গোল চত্তর। তার সাথে কবি হাসনাইন ইকবাল ও অন্যরা। দশ নাম্বারে লোকজন জড়ো হচ্ছে। । বেলা একটা বেজে গেছে। আর্মির গাড়ি তখন দোকান বন্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছে। একা অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকাবোধ বেড়ে গেল। মাজিদকে ফোন দিলাম। তখনও দশ নাম্বারেই। পেটে ক্ষুধা চু চু করছে। সেই সকালে একটা বনরুটি খেয়ে বেরিয়েছি। এবার একটা বিস্কুট আর চা খেলাম।পান মুখে দিয়ে রাস্তায় হাঁটছি।আর প্রেসক্লাব ও দশ নাম্বারে যোগাযোগ রাখছি। মিছিলে যদি যোগ দিতে না পারি বা লং মার্চ ও গণভবন ঘেরাও যদি বানচাল হয় তাহলে বিকালে ফিরতি পথে আক্রান্ত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা থাকছেই। ফিরে যাব ভেবে রিকসা খুঁজছি। রহমান মাজিদ আবার ফোন দিলেন। এক্ষনই দশ নাম্বার চলে যাবার কথা বললেন। তিনি খুব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন ‘আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পদত্যাগ করবে হাসিনা,আপনি যাইয়েন না, আগারগাঁও চলে আসেন।আমি আবার রিক্সা নিলাম।আসাদগেট এসে দেখি ব্যারিকেট আরও মজবুত করছে মিলিটারি। কাটাতারের বেড়া মাথার উপর চলে গেছে। সৈনিকেরা তখনও স্বৈরাচারকে রক্ষার বাঁধ মজবুত করে যাচ্ছে। আমার তখন প্রচন্ড চাপ প্রসাবের। অবস্থা বেগতিক।সময়ও কম। একটা দেওয়ালের আড়াল পেয়ে রাস্তার পাশেই বাধ্য হয়ে কাজ সারলাম। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সময় দেড়টা। মাজিদ ফোন দিচ্ছে,দুইটায় মিছিল দশ নাম্বার ছাড়বে। আমাকে আগারগাঁও পৌছতে হবে। রিক্সা নিলাম।বুড়ো চালক। মন্তর গতিতে চলছে।মনে হল ভুল করলাম।মোটরচালিত রিক্সা নেওয়া দরকার ছিল। শিশুমেলায় পৌছে দ্রুত ওভারব্রিজ পাড় হলাম। অভারব্রিজে সারিবদ্ধ আর্মি। ওপারে গিয়ে রিক্সা নিলাম।
তরুণ রিকসাচালক বলল, মামা মাগি নাকি ক্ষমতা ছাইড়া দিছে?’ আমি বললাম ‘ হু দুইটায় সেনাপ্রধান জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবে।’ আমাকে রেডিওর খবর ধরতে বলায় আমি ইয়ারফোন নাই বললাম। চালক তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে আমার হাতে দিল। ঘোষক ভাষণের ঘোষণা দিল।কিন্ত দুইটায় শুরু হল গান। চালক তখন রেডিও,টিভিগুলোর গুষ্টি উদ্ধার করল। আমি আস্বস্ত করলাম, হয়ত প্রসেস চলছে। মিছিল আগারগাঁও চলে আসছে। শিশুমেলা থেকে যে গলি গেছে তার পূর্ব মাথায় মিছিল।আমি মাঝখানে। এই রাস্তার মাথায় তখনও আর্মিদের ব্যারিকেট। গণভবনমুখী রাস্তাও ঘেরা। মুহুর্মুহু স্লোগানে চারপাশ কাঁপছে। আর্মিদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম।
আগে থেকেই আরও গোটা পঞ্চাশ লোক জড়ো।সেনারা তখন নমনীয়,কিন্ত আমাদের ছাড়ছে না। একজন জোয়ান হাসি হাসি মুখে বলল ‘ আপনারা হয় মিছিলে যান,না হয় সরেন।’ ‘আমরা মিছিলে যাব’ বললে বাঁশি ফুঁ দিয়ে সরে যেতেই বললেন। দু হাত সরে গিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎ বোকার মতো স্লোগান তুলতেই মিলিটারি আমার দিকে তেড়ে আসল।অপেক্ষমানরা বকাঝকা করতে লাগল। আমি মাথা নিচু করে পিছে সরে গেলাম। স্লোগানের পরিনতির কথা ভাবলে এখন গা শিউরে ওঠে। মিলিটারি আমাকে লাঠিপেটা করতে পারত,বুটে পিশতে পারত,গুলিও করতে পারত। কোনকিছু না ভেবেই সেসময় স্লোগান ছেড়ে ছিলাম।এখন মনে করি এটি চরম বোকামি ছিল। কিন্ত এমন বোকামিটিই করে ফেলেছিলাম।রহমান মাজিদ ফোনে খবর নিলেন। আমি বলে দিলাম মিছিলের পাশেই ব্যারিকেটে আছি। আমরা আবার ব্যারিকেটের সামনে এলাম।একজন, দু জন যাচ্ছে।চার পাঁচজন যাচ্ছে।এক সময় সবাই যেতে চাইলে তারা ব্যারিকেটই তোলে নেয়। পিছন থেকে পূর্ব পাশ ঘেঁষে আর্মির গাড়ি ফিরে যাচ্ছে। মিছিলে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য কেউ কেউ আশঙ্কা করে বিজয় স্বরণীতে দু পাশ থেকে আক্রমণ করে কিনা! সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করা যায় না তাদের মতে। অন্যরা এই আশঙ্কা নাকচ করে দেয়। কত মানুষ খুন করবে তারা? লক্ষ লক্ষ জনতা নেমে গেছে রাজপথে।রহমান মাজিদ পোস্ট দেয় ” পঞ্চাশ লাখ লোক নিয়ে আমরা আসছি গণভবনে ” পঞ্চাশ লাখ না হলেও লক্ষ লক্ষ লোক যে তাতে সন্দেহ নাই। চলন্ত মিছিলেই মাঝে মাঝে মোবাইলে অনলাইনে যাই।ততক্ষণে মন্ত্রী পলক বাঁধা অকার্যকর হয়ে গেছে। আগারগাঁও পেরুতেই তখন দুইটার পর সম্ভবত আড়াইটার সময় দুটো হেলিকপ্টার আকাশে উড়াল দেয়। সঙ্গে সঙ্গে
” পালাইছেরে পালাইছে,শেখের বেটি পালাইছে সহ নানারকম স্লোগান। সেনা- জনতা করমর্দন, কোলাকুলি শুরু হয়ে গেছে। সৈনিকদের কেউ কেউ স্লোগানে শরিক হচ্ছে।ভি চিহ্ন দেখাচ্ছে। মাইকে বারবার নির্দেশনা হচ্ছে কিছু সময়ের মাঝেই সেনা প্রধান জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। সংসদ ভবন আর গনভবনের রাস্তায় জনতা ঢোকে গেছে।
কিছু লোক প্রবেশ করতেই মিছিল শাহবাগের দিকে রওয়ানা হল। মিছিল যাচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবকেরা পানি ও শুকনো খাবার দিচ্ছে।
পানির খুব পিপাসা ছিল,এক বোতল পানি নিলাম। আমরা যাচ্ছি সামনে। রাস্তার পাশের বাড়ির নারী পুরুষ গেট খুলে বাইরে চলে আসছে। কিশোর,কিশোরী,তরুণ,নারী,পুরুষ হাতে হাতে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়েরা,মেয়েরা মিছিলকারীদের পানি দিতে পেরে যেন আনন্দিত।
মনে হচ্ছিল আন্দোলনের মুখোমুখি এখন কেবল দুটো পক্ষ।একপক্ষে আওয়ামীলীগ অপরপক্ষে সমগ্র বাংলাদেশ। গোটা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের বিপক্ষে।
আফসার নিজাম ও তাসনিমরা শাহবাগে। গণভবন ঘেরাওয়ের খবর শাহবাগে পৌছে দিলাম।মনে হয় আমার মতো অনেকেই নিজ নিজ সার্কেলে পৌছে দিয়েছে খবর। আমার মোবাইলে ব্যালেন্স শেষ।ছোট ভাইকে বললাম কিছু মিনিট পাঠাতে। আবেগে কথা বলতে পারছি না। বাকরূদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।
আমাদের মিছিল ফার্মগেট যেতেই শাহবাগ থেকে মিছিল চলে আসল। মিছিল ঘুরে গেল ফের গণভবনের দিকে। আমরা গণভবনে ঢুকলাম।ক্লান্ত হয়ে গেছি।
ক্লান্ত হয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকপাড়ে বসে গেছি। পথে এক বোতল পানি নিয়ে ছিলাম।একটু মুখে নিলাম। জনতা গণভবন,সংসদ ভবনে ঢুকে গেছে। আমি বসে আছি।
।রহমান মাজিদকে ফোন দিলাম। পরিচিত কারও সাথেই দেখ হয়নি। একা বসে আছি। একটি ছেলে এনার্জি বিস্কুট খাচ্ছে।আমি এক পিস বিস্কুট চাইলাম।তিনি পুরো প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।আমি এক পিসই নিলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি অন্য একজন আমার পানির বোতল নিয়ে গেছে। আমিও অন্যজনের কাছ থেকে পানি চেয়ে নিলাম। আরেকজন এসে আমার দিকে দুই রুটির একটি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলে আমি ইতস্তবোধ করছি। আঙ্কেল নেন বলে ছেলেটি আমার হাতে দিয়ে চলে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখি লোকেদের হাতে নানারকম জিনিস। বড় মাছ,মুরগি,হাঁস,খাসির রান,চেয়ার,টেবিল,শাড়ি কত কী? বিষয়টি প্রথম আমার মাথায় আসেনি যে এগুলো গণভবনের।
একটু পরেই বুঝতে পারি এসব গণভবনের জিনিসপত্র। রহমান মাজিদ আসলেন। আমরা একসাথে বসলাম। মাজিদ বলল ‘ চলেন আমরা ভেতরে যাব ‘ আমি বাঁধা দিলাম। না আমরা ভেতরে যাব না।কৌতুহল বশত কোন একটা জিনিসে হাত দিব আর অমনি মনে করেন পড়ে গেলাম টিভি ক্যামেরার সামনে।রেকর্ড হবে আমরা এসব এনেছি। তা করা যাবে না।মাজিদ আমার কথায় সায় দেয়।আমরা আর ভেতরে ঢুকিনি।
আর্মি,সাজোয়া যান,জনতা একাকার। মিলিটারি সদস্যদের হ্যান্ডস্যাক করতে করতে মনে হয় বিরক্তি এসে গেছে অনেকের। আমরা তখন জনতার ভিড়ে রিকসায়।মাজিদ মিছিলে রিকসা নিয়েই এসেছিল। কামানের কাছে গিয়ে মাজিদ ছবি তুলতে চাইলে একজন সৈনিক সামনে যেতে অনুরোধ করল। আমি আর ছবি তোলার আগ্রহ দেখালাম না। শুরুতে আমরা কজন ভাঙচুরে বাঁধা দিয়েছিলাম। পরে আর দিইনি।ভেবে দেখলাম দিয়ে কাজ হবে না। কোটি জনতা। কে কার কথা মানে। লোকেরা যে যা পেয়েছে হাতে নিয়েছে। সংসদের ছাদে উঠে গেছে,লেকে নেমে গেছে,গণভবনে ঢোকে গেছে। বাউন্ডারি ওয়ালে লোক। ভিতরে লোক,রাস্তায় লোক।সিকিউরিটি অফিসারদের গ্রেফতারের মতো ধরে এনেছে। ড্রেস ছেঁড়া,ইউনিফর্মের চিহ্ন হিসেবে আছে প্যান্ট। তাদের কপালে কী হয়েছে আমরা জানি না। হয়তো ছেড়ে দিয়েছে। একজন ছিন্নবস্ত্রের অফিসারকে সেইফ করলেন আর্মিরা।গাড়িতে বসায়া রাখলেন।
পশ্চিম দিকে আস্তে ধীরে আসতে লাগলাম। মেইনরোডে উঠলাম।সামনে পড়ল এনটিভির গাড়ি। জনতা উত্তেজিত।হাতে পায়ে ধরে গাড়িটির ভাঙচুর ঠেকাতে চেষ্টা করলাম। শ্যামলি পর্যন্ত ঠেকানো গেলেও শ্যামলির কাছাকাছি এসে আর ঠেকানো গেল না। দুজন লোক এসে ধরাম করে সামনে পিছে দুই বাড়িতেই গ্লাস ভেঙে খানখান।
শ্যামলি উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে এসে দেখি বাতাসে কাগজপত্র উড়ছে। তাকিয়ে দেখি একদল লোক ভিতর থেকে সবকিছু রাস্তায় ফেলছে। আর রাস্তার জনতা পুলিশের জিনিসগুলো বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে।গলি দিয়ে এনটিভির ভাঙা গাড়িটি ভোঁ টান দিয়ে আহত পথিকের মতো পালিয়ে জান বাঁচালো। পুলিশের অফিসে মনে হয় কিছুই অবশিষ্ট নাই। একটি চ্যানেল ভিডিও করছে।মাজিদ বলল ‘ এই যে দেখেন,সে কিন্ত বিষয়টি রেকর্ড করে ফেলছে। আমি রিকসা থেকে নেমে গেলাম।মাজিদ চলে গেল।
শ্যামলিতে নেমে রিক্সা না পেয়ে হেঁটে যাচ্ছি। মানুষের ক্ষোভের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সরকারী অফিস, আওয়ামী নেতাকর্মীদের অফিস ও বাসভবন। বাড়ির গেটে লোকেরা আক্রমণ প্রতিহতের প্রস্ততি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথাবার্তায় মনে হচ্ছে এখানকার আওয়ামীলীগেরা এখনও হাল ছাড়েনি। বেলা তখন ৫টা বা ৫.৩০ টা বাজে। কিছু দূর এগুলেই গুলির আওয়াজ পেলাম। সামনে আর গেলাম না। পিছনে হাঁটব এমন সময় ট্যা ট্যা ট্যা গুলি। দৌড় লাগালাম। আবার মেইন রোড বরাবর।এবার রিক্সা নিলাম। এবারও গুলি। জানতে পারলাম আদাবর থানার পুলিশ গুলি করছে। লীগের কিছু পোলাপানও আছে। এসব জানা বাসার গেটে জটলা পাকানো লোকদের মুখ থেকে। বসিলা বেড়িবাঁধের চার রাস্তার মোড়ে চলে এলাম। রাস্তার দু পাশে সর্বস্তরের জনতার ভীড়। বাসাবাড়ির সকলেই যেন নেমে আসছে রাস্তায়। মায়ের কোলে শিশু,বাবার কাঁধে শিশু।আইল্যান্ডে মানুষ, ফুটপাতে মানুষ। তারা দেখছে বিজয়ী মানুষের ঢল। দেখছে বিপ্লবী জয় নিয়ে ফেরা মানুষের চেহারা।মোবাইলে ধারণ করছে ভিডিও ও ছবি। চলে এলাম বসিলা ব্রীজে। এই ব্রীজেই সকালবেলা ছিল বালুর বাঁধ। বালু ছিল স্বৈরাচারের পক্ষ হতে গণমানুষের চলাচলে বাঁধা। বিকাল হতে হতেই পদাঘাতে উড়ে গেল বালুর বাঁধ। সকালে যে পথ,যে নগর আমার জন্য ছিল অবরুদ্ধ। আমার দেশের পুলিশ আমার কাছে ছিল যেন দখলদার ইসরাইল। সকালে ছিল এ নগরে অবরুদ্ধ বাতাস।বিকেলে মুক্ত হাওয়া টানতে টানতে আমি ফিরছি মনের আনন্দে, ফিরছি জয়ের তৃপ্তি নিয়ে। কুক্ষিগত স্বাধীনতা মুক্ত এখন। আহ আমার দেশ! আমি তোমায় ভালোবাসি।
কেউ কেউ বলে এটিকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলা যাবে না। অবশ্যই বলা যাবে।কেন বলা যাবে তা বলব আরেক দিন। ৫ আগস্টের পর থেকেই একদল লোক হা হুতাশে লিপ্ত।তারা কারা। তারা ঐসব লোক,যারা পনর বছরের সমস্ত অত্যাচার,নির্যাতনের নীরব সমর্থক। পনর বছরের জুলুম নিয়ে তাদের কথা নেই।তারা কথা বলা শুরু করছে সপ্তাহ বয়সী সরকারের। তারা আওয়ামীলীগ হয়ে কথা বলার সাহস রাখে না।তারা আওয়ামীলীগের কথাই বলে নিজেদের গায়ে বর্ণিল পদবি সাঁটিয়ে।তারা কবি,সাহিত্যিক,সাংবাদিক,লেখক ইত্যাদি পরিচয়ে। এরা আগে কথা বলেনি। তখন তারা ছিল সরকারের পক্ষের লোক। এই যে বিপক্ষের লোকেরাও এই আড়াই দিনেই দেদার মন্তব্য করতে পারছে এটাই স্বাধীনতার প্রাথমিক সুফল। কথা বলাটা বন্ধ ছিল।পরিস্থিতি শ্বাসরুদ্ধকর ছিল,পরিস্থিতি অবরুদ্ধ ছিল। এখন পটাপট কথা বলছে।এই স্বাধীনতাটাই বা কম কিসে। এই অর্জনে কত লাশ পড়েছে,কতজন আহত হয়েছে! শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে তারা। জয়ী হয়েছে বিপ্লব। জয়ের পরও পতিত ও তার দোসররা থেমে নেই।বিপ্লবীরা তাই পাহারা দিচ্ছে বিজয়। বিপ্লব ধরে রাখতে হবে। যদি ৫ তারিখে পতন না হত! তাহলে হয়তো আমি,আমার মতো অজস্র মানুষ হারিয়ে যেতাম চিরতরে। জয়ী হয়ে বেঁচে গেছে মানুষ।বেঁচে গেছে বাংলাদেশ।ইনকিলাব জিন্দাবাদ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।