spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যমতিউর রহমান মল্লিক : সৌন্দর্যবাদী আধ্যাত্মিক সাধক কবি

লিখেছেন : আল মাহমুদ

মতিউর রহমান মল্লিক : সৌন্দর্যবাদী আধ্যাত্মিক সাধক কবি [ জন্ম : ১ মার্চ ১৯৫০–মৃত্যু : ১২ আগস্ট ২০১০]

আল মহমুদ
……

ভালোবাসার ছবির মতো তোমার ছবি
ইচ্ছে জাগে দেয়ালজুড়ে সাজিয়ে রাখি
ছবির ছায়া মায়ার টানে ছড়ায় আলো
তোমার কথা ভাবলে ভাবি– আগুন জ্বালো!

যাক পুড়ে যাক ছায়ার খেলা মায়ার টানে
কোনদিকে যে পথ আছে তা পথিক জানে?
পথের শেষে যেতেই হবে পথ বিপথে
পৌঁছতে হবে দিগন্তের ওই সন্নিধানে।।

‘মল্লিকের জন্য’ শিরোনামের এ কবিতাটি প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত আমার এ যাবৎ সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার রক্তে তোমার গন্ধে’ স্থান পেয়েছে। কবিতাটি যখন লিখেছিলাম মল্লিক তখন আমাদের মাঝে ছিল, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়েছিল– আর আজ আমাদের মাঝে নেই এক বছর হয়ে গেল। হায়রে কবি মতিউর রহমান মল্লিক। একটি নাম। একটি জীবন্ত ইতিহাস। একটি স্বতন্ত্র দুনিয়া। অন্য এক পৃথিবী। মল্লিক তুমি এভাবে যেতে পারলে? আল্লাহ গাফুরুর রাহিম তোমাকে জান্নাতবাসী করুন।

কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। পরিচয়ের পর থেকেই তার স্বভাবসুলভ নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে আমার ভীষণ আপন হয়ে যায়। মল্লিকের হাজারো পরিচয়ের মধ্যে সংগঠক পরিচয়টি বারবার তার চরিত্রের মধ্যে ধরা দিত। আমাকে ভালোবাসতে গিয়ে আমার এই অনুজ কবি আমার জন্য কী না করেছে? মল্লিকের কাছে আমার ঋণের আসলে কোনো শেষ নেই। শুধু আমি নই, মল্লিকের কাছে ঋণী বাংলাদেশের এ রকম লক্ষ কোটি মানুষ, কেন– এমন কী করে গেছে মল্লিক? তার সাথে যারা মিশেছে, তাকে জানে তাদের নতুন করে বলার কিছু নেই। নানা বিবেচনার পর মল্লিকের সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে স্থির হয়, যা সারা জীবন অটুট ছিল। মল্লিকের মৃত্যুটা আমাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে।

ব্যক্তি হিসেবে কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন এক হীরকখণ্ড। হীরকখণ্ডের মতোই তিনি দ্যুতি ছড়িয়ে গেছেন সর্বত্রই। গোটা বাংলাদেশ এমনকি বহির্বিশ্বে ঘুরে ঘুরে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির বীজ রোপণ করেছেন। অনেক গুণে গুণান্বিত মল্লিক পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনায় দিনযাপনে ছিলেন সদা তৎপর, তার কর্মযজ্ঞের লক্ষ্যবস্তু ছিল ঐশী জীবনাদর্শের রূপায়ণ। কি কবিতায়, কি গানে এমনকি তার জীবনযাপনে আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার এক অপরূপ শিল্পিত বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। তার কবিতার ভাব-ভাষা-ছন্দ আধুনিক মনীষার পরিচয় বহন করে। ধর্ম ও নীতিনৈতিকতা সম্পর্কিত ভাববস্তুকে তিনি বাংলার প্রকৃতির সাথে দ্রবীভূত করে প্রকাশ করেছেন। মল্লিকের অন্যান্য বিষয়ের মতো কবিতা ও গানও আমাকে অভিভূত করত। রেডিও টিভিতে ওর গান বাজলে আমি মনোযোগসহকারে শ্রবণ করতাম। মল্লিক বেঁচে না থাকলেও তার সৃষ্টিসম্ভার এবং গড়ে যাওয়া অসংখ্য সাহিত্য-সংস্কৃতি সঙ্গীতমনস্ক মানুষ অবশিষ্ট রয়েছে। একটা কথা আমি অনেকের মুখেই শুনেছি। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতা ও গানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং জাগরণের কবি ফররুখ আহমদের ধারায় যার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিনিই হচ্ছেন কবি, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক, গবেষক, সংগঠক, সম্পাদক এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী মতিউর রহমান মল্লিক। হয়তো মল্লিকের মতো প্রতিভাবান মানুষ সময়ে একটাই জন্মে, অনেক নয়। এ কথা স্বীকার করতে আমার কি দ্বিধা থাকা উচিত, যে আশির দশকের এই উজ্জ্বল কবি বাংলা কাব্যে নতুন এক বাঁক নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। মল্লিকের কবিতা এক কথায় ছিল স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মল্লিক যে তার বিশ্বাসের কাছে সমর্পিত, তা তার কাব্য ভাষাতেও উচ্চকিত এবং বহমান। বিষয়বিন্যাস ও শব্দ ব্যবহারের চলমান টেকনিক সময়কে সম্পর্শ করলেও বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণের ঐকান্তিকতা মল্লিককে ভিন্ন উপত্যকায় হাজির করেছে। ভাষার সারল্য, বিষয়ের গভীরতা আর শব্দ বুননের আধুনিক কৌশল তার কবিতাকে ঐশ্বর্যের চৌকাঠ অবধি পৌঁছে দিয়েছে ইতোমধ্যে। মল্লিক যেন কাব্যবৃত্তের এক মুখর পাখি। মল্লিকের কবিতা চরম আধুনিক হওয়ার পরও ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং শেকড়ের দিকে ধাবিত। মল্লিক আধুনিক অথচ জটিল ও যান্ত্রিক নয়। প্রকৃতি ও প্রবহমানতায় তার চেতনা প্রতিনিয়ত শব্দ করে ওঠে। বিশ্বাসকে তিনি শুধু বিষয়বস্তুই করেননি বরং যেন বিশ্বাসই তার অবলম্বন। উত্তর আধুনিক স্লোগানের ঘোরবিরোধী তিনি। অথচ শেকড়ের দিকে তার যাত্রা এবং বারবারই তিনি উৎসে, মূলে আলো ফেলেছেন। সঙ্গীত মল্লিকের আনন্দ, সুর তার কণ্ঠস্বর, সরল ও স্বাভাবিক বাণী অথচ খোলাখুলি নয় গভীর। তাকে উন্মোচিত করতে হয় কেননা অনেক ভেতরে গিয়ে তিনি যা উন্মোচন করেন তা সোনালি সম্ভার। একজন স্বপ্নচারী কবির সামাজিক সঙ্কট ও চাহিদার সুগভীর উপলব্ধি কতটা হৃদয়পূর্ণ মল্লিকের কবিতা পড়লে তার প্রমাণ মেলে। আমার এই বয়সে এর চেয়ে বেশি কবিতার তাৎপর্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে মল্লিকের সাথে আমার হৃদ্যতার স্মৃতি কম নয়, দেশে-বিদেশে আমরা একসাথে বহুবার ঘুরেছি।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র সাহিত্য পরিসরে যে ক’জন অন্তরালোপরায়ণ কবি আছেন তাদের মধ্যে আসলে মতিউর রহমান মল্লিকের কবিতা আমাকে স্পর্শ করে বেশি। কোলাহলবিমুখ এসব কবির কাব্য প্রতিভাই আমাদের সাহিত্যের প্রাণশক্তি। আমাদের কাব্যাঙ্গনে আস্থা ও বিশ্বাসের একটি স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণে তাদের অবদান অবশ্যই গ্রাহ্য করা উচিত। আর মল্লিকের সাফল্যই হলো আস্থাপূর্ণ সাহিত্যের বিজয়। মল্লিক তার অসাধারণ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু আমার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা এবং প্রেমমূলক আচরণ আমাকে বশীভূত করেছে বরাবরই। যেকোনো বিষয়ে ধর্মের দীপ্তিতে তিনি এমনভাবে আলোকপাত করেন যে, আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, হা করে গিলতাম। মল্লিক মেধা, মনন এবং কর্মমতায় দলীয় গণ্ডি অতিক্রম করে জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন অবদান রাখতে পেরেছিলেন। মল্লিককে মনে মনে আমি পীর বলে জ্ঞান করতাম। আমি একথা বলি না যে, মতিউর রহমান মল্লিকের মতো লোকদের কোনো মূল্যায়ন হলো না; বরং সব সময় ভাবি, মূল্যায়ন করতে যে দাঁড়িপাল্লা লাগে সেটা টান কিংবা উঁচু করে ধরার মতো বান্দা কোথায় পাওয়া যাবে? জ্ঞান হলো আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের বিষয়। মল্লিকের চেহারা ছিল নিস্পৃহ, অহঙ্কারহীন ও বিনয়ীর প্রতিকৃতি। পৃথিবীতে জ্ঞানীরা কখন কী বেশ ধারণ করে বাঁচেন, তা আমার মতো সামান্য কবি বলতে পারবে না। মল্লিক ছিল সত্যিকারের জ্ঞানের বটবৃক্ষ, যা তার জীবদ্দশায় অনেকেই বুঝতে পারেনি।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ফাউন্ডেশনের মল্লিক উৎসবে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে কথা বলতে হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ জ্ঞানী-গুণী অনেক পণ্ডিত ছিলেন, মরহুম মল্লিকের জ্ঞান এবং গুণের কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে। এ-ও বলেছে মল্লিক ছিল এক উঁচু মাপের দার্শনিক। তরুণ এক কবি আহমদ বাসির যে মল্লিককে নিয়ে গবেষণা করে সে তো বলেই ফেলল, কেউ কেউ মল্লিককে এ সময়ের লালন বলে আখ্যায়িত করে। তবে মল্লিকের মধ্যে কোনো সংশয়বাদিতা ছিল না। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ বিশ্বাসী মানুষ। অনুষ্ঠানে আরেক কবি আবদুল হাই শিকদারের একটি কথা মনে পড়ে, তিনি বলেছেন, কবি মতিউর রহমান মল্লিকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধ, নজরুলের চেতনা, ইকবাল ও ফররুখের আদর্শ ও জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতির এক অনুপম নির্যাস বিদ্যমান ছিল। মল্লিককে নিয়ে অনুষ্ঠানাদি এবং লেখালেখি কিছুটা হচ্ছে– তবে আমি মনে করি তা ব্যাপকহারে হওয়া দরকার। এই তো আমার হাতে এখন খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত সাহিত্য ত্রৈমাসিক “প্রেক্ষণে”র কবি মতিউর রহমান মল্লিক সংখ্যা। এটি হাতে নিয়ে আমি যতটা না মুগ্ধ তার চেয়ে বেশি অভিভূত। মল্লিককে নিয়ে ৪০০ পৃষ্ঠার একটি সঙ্কলন, যাতে তাকে নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের অনেক গুণী কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং মল্লিক শুভাকাঙ্খিরা। এটা একটা ব্যাপার। খন্দকার মোমেন সাহেব দেখা যাচ্ছে প্রতিভাবান মল্লিককে নিয়ে একাই দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে চাই এরকম অনেক কাজ হওয়া উচিত মল্লিককে নিয়ে। মোট কথা মল্লিকের চর্চা করা উচিত।

মল্লিক ছিলেন ক্ষণজন্মা এক দেশপ্রেমিক আধ্যাত্মিক দরবেশ। একটি জীবন সে তার আদর্শ, দেশ মা মাটি এবং মানুষের জন্য উৎসর্গ করে গেছে কিন্তু তার বিনিময় আশা করেনি।

মহান আল্লাহ পাক যার সহায় তার আর মানুষের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। মল্লিক আমাদের জন্য একটি আদর্শ, একটি অনুপ্রেরণা, একটি বাতিঘর। মল্লিককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আদর্শবান সৎ মানুষদের মহত্ত্ব এবং অস্তিত্বের স্বার্থে। মল্লিক কি আল্লামা ইকবালের সেকেন্ড এডিশন নয়? না মল্লিক শুধু মল্লিকই। এমন একজন প্রতিভাবান পুরুষের পক্ষে আমাদের দেশ-কাল, সময় এবং ইতিহাস কী দাঁড়াবে না!
..

২০১১

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ