……………….
পালাও পালাও
মাহবুব হাসান
…………………
ধেয়ে আসছে সুনামী এক জনসমুদ্রের
পালাও পালাও তুমি
ভূমি ছেড়ে পরভূমে,
নিখিলের ওপারে নয়, পার্শ্ববর্তী নিসর্গে,
তোমার আদিপুরুষের মনোভূমি, সেখানে সবুজ বৃক্ষ নেই,
তবু শ্বাস নিতে পারবে স্নেহমমতাহীন খরো দিগন্তে,
অবারিত ধুলিঝড়, অব্যাহত টিটকারির তীর
নগ্ন শ্লেষ
অশেষ কামনার বিষে জর্জরিত পরিবেশ ছেড়ে তোমাকে
পালাতে হবেই।
তুমি ঘোরতর ইরেনিজ নারী,
অবিশ্বাসীদের নিখিল-স্থপতি,
তুমি গণবিচ্ছিন্ন
কায়দা-কানুন আর রীতির বেড়া ভেঙে
ক্ষেতের ফসল তছনছ করে
মত্ত হস্তিনী তুমি ছিলে আমাদের,
জনসমুদ্রের বিপরীতে তুলেছো দেয়াল পুলিশের,
লেলিয়ে দিয়েছো সন্ত্রাস হেলমেটে পুরে ছাত্রলীগের শির,
দিয়েছো হুংকার অপত্য স্নেহের রঙে গড়ে তোলা পিতৃভূমি,
এই গাছপালা সবুজ ধানচারা, রাখালের বাঁশি,
দক্ষিণের দৈত্য-দানোর রাঙানো চিৎকার
ফুৎকারে উড়ে যায় সুনামির তোড়ে—
পালাও পালাও তুমি
ক্ষমতার মগডাল থেকে অকস্মাৎ হড়কে পড়তে পড়তে
তুমি দেখলে তোমার সাধের মানুষ
গিরগিটির মতো পাল্টে নেয় রূপ—
তুমি সুনামী দেখোনি কোনোদিন,
তার নিঃশব্দ গ্রহণ দেখলে নিজের ভুলে
ঢেউয়ের শিরে জ্বলজ্বলে মানুষের রণহুংকার
খালি হাতে বুলেটের সামনে দাঁড়ানো আবু সাঈদের সাহস,
দেখোনি মুগ্ধর পানির প্রপাত, কেন না
তুমি কালা ও অন্ধ টানেলের ভেতরে রচিত সিংহাসনে
পেখম মেলে বসে স্বপ্নডানা মেলে বলেছো —
আমিই তো করেছি এই সমৃদ্ধির আতরমাখা মিথ,
কেন আমাকেই চলে যেতে হবে! কেন এই অন্যায়?
টানেলে জ্বলে উঠেছে আলোর প্রপাত, নতুন পৃথিবী,
উত্তরআধুনিক সকাল।
পালাও পালাও
লুটের বাক্সগুলো ফেলে সবুজ পৃথিবীর ঘাসে!
সেখান জনসমুদ্র মহানাগের ফণা তুলে ফুঁসছে!
০৮/১৫/২৪
……………….
মুগ্ধ’র জন্য এলিজি
শাহীন রেজা
………………..
আমার সেজখালা মৃত্যুর আগে পাকা পেঁপে খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওই সময়ে লাকসামে কর্মরত খালুজান শত চেষ্টাতেও তা জোগাড় করতে পারেন নি আর এ সংবাদে মানসিকভাবে আহত আমার নানী আমৃত্যু পাকা পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত ছিলেন
‘মুগ্ধ’ আমার রক্তের কেউ নয় অথচ
ইউটিউবে দেখা ওর নিস্পাপ মুখ আমাকে সন্তানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল
টিয়ার শেল আর তীব্র ধোঁয়ার মধ্যে
চোখ মুছতে মুছতে ‘পানি লাগবে পানি লাগবে’ বলে ছুটতে থাকা ছেলেটি
প্রচন্ড বুলেটে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লে মনেহলো
‘মুগ্ধ’ নয় লুটিয়ে পড়ল আমার স্বদেশ; বাংলাদেশ–
প্যাকেট থেকে ছড়িয়ে পড়া পানির বোতলগুলো ভিজে উঠলে রক্তে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু নয় যেন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে গেল একঝাঁক তীব্র বুলেট
এরপর আমি আর ঘুমুতে পারি না
আমার রাত জুড়ে শুধু ক্ষোভ শুধু ঘৃণা
পানির গ্লাস হাতে নিলেই তাতে ভেসে ওঠে ‘মুগ্ধ ‘র মুখ; রক্তের তীব্র ধারা
আমার ‘মুগ্ধ’ এখন শহীদ ;
সালাম রফিক বরকতের পাশে ওর নাম
ওদের মিছিলে জ্বলজ্বল ফারহান, মাহমুদ, সাঈদ, রাসেল, হোসেন, ইয়ামিন, রুদ্র, তরুয়া, মোস্তফা, জাকির–
আমি কতো আর উচ্চারণ করবো
কতো নাম কতো নাম–
আমার নানী মৃত্যু পর্যন্ত বিরত ছিলেন পাকা পেঁপে খাওয়া থেকে–
আমিও কি দূরে থাকব পানি পান থেকে ;
আমৃত্যু, আর অন্ধকারে আঁকতে থাকব ঘাতকের নাম নিঃসীম ঘৃণায়।
৩০ জুলাই ২০২৪
…………………
রক্তের নকশিকাঁথা বাংলার মাটি
শান্তা মারিয়া
………………….
বাংলার শ্যামল ভূমি রক্তের নকশায় উজ্জ্বল।
আবু সাঈদ, আসিফ, ফারহান, নাইমা একগুচ্ছ নাম
বর্ণিল সুতায় গাঁথা থাক ইতিহাসের নকশিকাঁথায়।
বাংলার মাটি বারে বারে রক্তে ভিজে গেছে
প্রাকৃত জনের প্রাচীন ভুমিতে এসেছে ঘোর অমানিশা।
পুন্ড্র, বঙ্গ, সুহ্ম, রাঢ়, গৌড়, সমতট, হরিকেল, কামরুপ
আঘাতে আঘাতে ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে
মাৎস্যন্যায় শেষে জেগেছে আবার।
পুড়ে গেছে নালন্দার পুঁথি, বিহার, দেউল।
তরুণ স্নাতক রক্তক্লান্ত দেহে ঘুমিয়েছে বদ্বীপ ভূমিতে।
কোনো আগ্রাসী কৃপাণ জয়ী হয়নি মৃন্ময়ী জমিনে।
ইশা খাঁ, চাঁদ রায়, গাজী কালু চম্পাবতী,
বারো ভুঁইয়ার সাহসী হাতিয়ার
ঝলসে উঠেছে বাংলার রৌদ্র বরষায়।
ব্যারাকপুর থেকে আন্টাঘর ময়দান
সিপাহির চোখে জ্বলেছে আগুন
রক্ত মিশে গেছে বাংলার অহল্যা ভূমিতে।
তিতুমীর, সিধু, কানু, সাঁওতাল, কৈবর্ত, নীলচাষী
নুরুলদীন, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয়, বাদল,
সালাম, রফিক, বরকত, হামিদুর, জাহাঙ্গীর, রুহুল আমিন,
আসাদ, মতিউর, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরোত্তম, অগ্নিযোদ্ধা
এক হয়ে মিশে আছে প্রিয় পতাকায়।
সোনাভান, ইলামিত্র, মাতঙ্গিনী হাজরার দেশে
বীরকন্যা কোনোদিন রণক্ষেত্রে হয়নি বিবশ।
চারু মজুমদার, কানু স্যান্নাল, সিরাজ সিকদার
শুনিয়েছে সাম্যের ডাক, বিপ্লবের অমোঘ সংগীত।
বায়ন্ন, একাত্তর, নব্বই, রক্তাক্ত জুলাই
নকশীকাঁথায় একসূত্রে গাঁথা।
ফয়সাল, মুগ্ধ, রিফাত, তাহমিদ আরও শত নাম
বঙ্গজননীর শহীদ সন্তান
ফুল হয়ে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া পলাশের দেশে।
বাংলার মাটি অগ্নিগর্ভা
যুগে যগে জন্ম নেয় অয়োময় দীপ্ত যুযুধান।
স্বৈরশাসকের হৃদকম্প, দুঃশাসনের পরাজয় নিশ্চিত করে।
ছাত্র-জনতা বীরবেশে তোমাদের প্রণতি জানাই।
তোমরা অনিঃশেষ
মানচিত্র ধরে রাখা তোমরাই
মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলাদেশ ।
চমৎকার আয়োজন এই দ্রোহের বিজয়ের কবিতাগুলো। প্রতিটি কবিতাই বর্তমানবিপ্লবী সময়ের রক্তে রাঙানো সৃষ্টি। ধন্যবাদ সাজ্জাদ বিপ্লব।