জিভ কাটো প্রজ্ঞায়
বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর
ইস্টার দীপে আয়নাবাজি
হুলিও করতাসার
তুমি ইস্টার দীপের পশ্চিম মাথায় একটি আয়না বসাও– দেখবে সবকিছু পিছনের দিকে যাচ্ছে; আবার আয়না দীপের পুবদিকে বসাও- দেখবে সবকিছু সামনের দিকে ধাবমান। আবার সবকিছু সরেজমিন তত্ত্বতালাশ করে আয়নাটি বসালে কোনকিছু আগপিছ না হয়ে ঠিকঠিক কাজ করবে। কিন্তু আয়নায় পাকাপাকিভাবে স্থির ও অনড় কোন অবস্থান বিন্দু নেই– প্রত্যেকের জন্য দর্পণের আয়নাবাজি আলাদা আর প্রাতিস্বিক; সবারই স্বভাবে যেমন চির আছে- যে যেমন টোটকা নিয়ে ঘোরে, আয়না সেমত প্রতিসরণ দেখায়। এই যেমন, গুগেনহেইম ফাউন্ডেশনের নৃবিজ্ঞানী সলোমন লেমস দাড়ি কামানোর জন্য আয়নার সামনে দাঁড়ায়– আয়নার ভিতরে সলোমন নিজের মৃতদেহ দেখতে পায়- সেসময় আয়নাটি বসানো ছিল দীপের পুবদিকে। একই সময়ে সলোমন খেয়ালই করেনি- সে বিম্বিত হয় দীপের পশ্চিম মাথায় রাখা ছোট আরশির ভিতর- আয়নাটি তার নজরে আসেনি, ওখানে সে একটি বাচ্চা ছেলে হাফপ্যান্ট পরে তিড়িংতিড়িং স্কুলে যাচ্ছে, কী গোসলখানায় সম্পূর্ণ ন্যাংটা, ওর মা-বাবা তার উদাম শরীরে সাবান ডলে স্নান করাচ্ছে; ওখান থেকে সলোমন তাইরে নাইরে ট্রেঙ্ক ল্যাঙ্কুয়েনে তার খালার বাথান বাড়ির দিকে ছুটে যায়।
Julio Cortazar : The behavior of mirrors on Easter Island.
প্রতিবিন্যাস
রাসেল এডসন
আয়নার অপরদিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীমুখী একটি দুনিয়া আছে- যেখানে বিকারগ্রস্ত লোকটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক; নিরেট হাড়গুলো এই ব্রহ্মাণ্ড ছেড়ে আদিতম দিনের আনকোরা কাদামাটি ক্ষণের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
এমনই উলটা ধারার দেশ– ওখানে সূর্য ওঠে সন্ধ্যায়।
একদিনের বয়স কমে আরো তরুণ হয়ে ওঠার কারণে প্রেমাষ্পদ মানব-মানবী কান্নায় ভেঙে পড়ে, কেননা অচিরেই ঘনিয়ে আসা শৈশব তাদের যুগল আনন্দ কেড়ে নেবে।
এমত জগতে আছে এমনই বিষাদের ঘনঘটা- যা তাদের আনন্দ।
English version : Antimatter.
ফুঁপিয়ে কাঁদা গাছ
গুন্টার কিউনার্ট
ছোট শহর কিয়েলস-এর খানিকটা বাইরে নিরিবিলি একটি গাছ- আহামরি কিছু নয়, একেবারে সাধারণ, সে রাশভারি কিছু নয়, তল্লাটে তার যে বিরাট নামডাক তেমনও নয়, দুনিয়ার এক কোণায় মৃদু এক গাছ।
পাতা ঝরার মরশুমে বড়জোর আপনি শুনবেন- ঝরে পড়া সবুজ পত্রালির ভিতর কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদে, মর্মছেঁড়া এই কান্নার ধ্বনি মনে হবে শিশুর কাঁচা কন্ঠের বিলাপ, পাতাদের মহল্লায় হাওয়ার বিলি কাটায় তারা এমন বুক চিরে মর্মর তোলে। কিয়েলসের লোকেরা বলে- এই কান্নার খুব নিজস্ব অন্তর্গত একটা ব্যাপার আছে- সবাই এই রোদন শুনতে পায় না।
একবার হলো কী- এক জার্মান বিজ্ঞানী একটি টেপরেকর্ডার বগলদাবা করে ওই গাছের নিচে ওঁৎ পেতে থাকে। তার কাছ থেকে সাকল্য ফলাফল আসে এরকম- দু’টি জে পাখির কিচিরমিচির আর ওক গাছের স্বনন ছাড়া বাকি যা চাউর করা হচ্ছে এগুলো গালগল্প- তার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
Gunter Kunert : The Polish Tree.
প্রিয় প্রাণী
বের্টোল্ট ব্রেশট
কে সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হলো- জীবজন্তুর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় প্রাণী কোনটি, তিনি বললেন- হাতি। তার কারণ বললেন, বুদ্ধি আর শক্তিমত্তার এমন যৌগ অন্য আর কোন জীবে নেই। শিকারীর চোখে ধূলা উড়িয়ে ফাঁদে ধরা পড়া থেকে বেঁচে আসা, বা অন্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে খাবার নিজের পাতে তুলে আনার চাতুর্যের কথা এখানে বলা হচ্ছে না, বরং আমি বলছি লাগসই বুদ্ধির কথা যা দরকারের সময় ঠিকঠিক কাজটি গুছিয়ে আনে।
অতিকায় হস্তী যেদিক দিয়ে যায় সেখানেই একটা হালট তৈরি হয়। হাতি ভীষণ লক্ষ্মী, আর আমুদে। সে হয় উঁচুমানের বন্ধু, একইভাবে সমানতালে শত্রু। সে দশাসই কিন্তু ক্ষিপ্র, আজদাহা পেটে চালান করে ক্ষুদ্রকায় বাদাম, বা যবের দানা। এর কান ভীষণ সম্পাদনাপ্রবণ– যা সে শুনতে চায়, তা-ই শোনে, বাকিটা কানের বাইরে থেকে যায়।
হাতি দীর্ঘ জীবন পায়। সে অতিশয় বন্ধুবৎসল- খালি যে গজসম্প্রদায়ের সঙ্গেই তার মনের মিল হয়, তা কিন্তু নয়; যারা তাকে পছন্দ করে তাদের সঙ্গে, যারা খোঁচায়, ধুরধুর করে– তাদের সঙ্গেও যোগাড়যন্ত্র করে চলতে পারে।
একটা দৃষ্টান্তমূলক গুণ আছে তার- যার ফলে সবখানেই হাতি সম্মান পায়। ওর চামড়া এতোটাই পুরু যে ধারালো চাকুর মুখও ভোঁতা হয়ে অকেজো ঝুলে থাকে। হাতির মন খুব নরম– কো কারণে সে মুষড়ে পড়লেও এর ভার সে নিজের মধ্যেই রাখে; আবার কারণবিশেষে প্রচণ্ড ক্ষোভও ধরে রাখতে জানে। হাতি প্রাণ উড়িয়ে নেচে ওঠে, সে গভীর জঙ্গলের আচ্ছাদনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। ছোট ছোট বাচ্চারা হাতির জন্য পাগল, অন্য অনেক প্রাণী হাতি দেখে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।
দেখতে ধূসর, কিন্তু বিশাল বপু জন্তু বিধায় কেউ তাকে দেখে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে না, একদম সোজা– বিশাল এক হস্তী একেবারে সামনে। সে খাবার মাংসের যোগানদার নয়– তবে কাজ করে চৌকস ; এক নিমেষে এন্তার পানি সাবাড় করে ফেলে, আর হাসিখুশি উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
একটি ক্ষেত্রে তার অবদান অগ্রগণ্য– কারুশিল্পের উৎকর্ষে হাতি তার অমূল্য দাঁত– আইভরি উপহার দেয়।
Bertolt Brecht : Mr. K’s Favorite Animal.
জননী প্রতীতি
মিগুয়েল সেরানো
সূচনাকালে জননী মহাত্মন আরশিতে নিজের রূপ দর্শন করেন। তৎপরে তিনি দ্বিতীয় আর তৃতীয় দর্পণে দৃকপাত করেন। আয়নায় রূপ দেখতে দেখতে মহামাতা মানবীরূপ প্রাপ্ত হন।
আদি মাতার নয়নজোড় গহন গভীরতায় মহীয়ান ছিল, কিন্তু অবশিষ্ট মাতৃকূলের চোখ নীল– আকাশের নীলাভায় রঞ্জিত।
সুপ্রাচীন এমবার নগরে কালি মন্দিরের পাশে লাল জোব্বায় আবৃত একজন পুরোহিত, তার পদযুগল বলির রক্তধারায় স্নাত– আমাকে ঘোরার্থ ব্যাখ্যা করে বোঝান। এভাবেই আমি অবগত হই– আমরা একজনমাত্র মায়ের অধীন নই, একাধিক জননী যথা আছে।
জীবন আমাকে এমন একটি আজ্ঞায় বাঁধে, আমার মনে হয়– আমি একটি সুগভীর খাদে পতিত। আমার অন্তঃপুরে আদি অকৃত্রিম মায়ের বাঞ্ছা করে যাচ্ছিলাম। শেষপর্যন্ত আমি অন্দরমহলের কপাট খুলবো- তার দেখা পাবো। মা হয়তো অন্যকারো রূপে লীন একাকার।
সম্ভবত তিনি শেবার রাণী হয়ে আছেন, কিংবা স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট। আমার প্রথম জননী যে-রূপই ধারনা করুন– তিনি আমার আত্মার রূপে চিত্রিত। যখন কেউ একটি শবাধার উন্মোচিত করে- সে ওটা ভেঙে ফেলে- তথাপি তা থেকে চন্দন কাঠের সুবাস ছড়ায়।
Miguel Serrano : The great mother.