আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
বিশ্ব ইতিহাস সাক্ষী, একনায়ক ও স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণবিপ্লবের আগে ও বিপ্লবের সফলতায় পরে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ অনিবার্য। আগে ধ্বংস করে একনায়ক, পরে বিপ্লবীরা। অনেক ক্ষেত্রে বিপ্লবের করুণ শিকার হয় স্বয়ং স্বৈরাচারী — লিবিয়ার গাদ্দাফিকে কীভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলো! ইরাকের সাদ্দামকে কীভাবে গর্ত থেকে টেনে বের করে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। আল্লাহর ইচ্ছায়, শেখ হাসিনা যথাসময়ে পলায়নে সফল হয়েছিলেন। বাংলাদেশে এই মহান বিপ্লবের পর হত্যাকাণ্ড হয়নি। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞও হয়নি। পুলিশ স্বৈরাচারীর লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করায় তাদেরকে একটু মূল্য দিতে হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্রই তা ঘটে। বিপ্লবীরা বয়সে তরুণ হলেও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে।
বিপ্লবীদের ক্ষোভের এবং গত ১৫ বছরের দু:শাসনে নিস্পেষিত, সর্বসান্ত, কোনঠাসা হয়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাঝে ঘৃণার যে বিষবাস্প জমেছিল, তা তারা ঝেড়েছে একটি প্রতীকের ওপর। সেই প্রতীক শেখ মুজিবের কংক্রীট ও ধাতব মূর্তি। প্রত্যক্ষ জালেম যেহেতু পলাতক, ধরাছোঁয়ার বাইরে — তারা তাদের সম্মিলিত ক্রোধ, আক্রোশ ও পুঞ্জীভূত ঘৃণার জান্তব প্রকাশ ঘটিয়েছে শেখ সাহেবের মূর্তির ওপর। তারা তার মূর্তির ওপর মূত্র ত্যাগ, জুতার মালা পরানো, ঢিল-জুতা নিক্ষেপ, ভাংচুর ও ধ্বংস করেছে।
কোনো কীর্তিমানকে মানুষের হৃদয়ে স্থাপন না দেশের কোনায় কোনায় তার মূর্তি স্থাপন করলে এহেন পরিণতি ঘটেই। শেখ মুজিবের মূর্তিকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে তা শোভনীয় ছিল না। কিন্তু কার সাধ্য ছিল ঠেকানোর? কিন্তু তার মূর্তি এবং আরো কিছু মূর্তি ভাঙার কারণে অনেক স্বল্পদর্শী, দিনকানা, দলকানা বা দলদাস বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী “হায় হায়“ করে উঠেছেন। তারা “দেশে ইসলামী শাসন, জঙ্গি উত্থান, তালিবান এসে গেল” ইত্যাদি বলে কান্নাকাটি শুরু করেছেন। শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙার সাথে জড়িত মানুষের ঘৃণা, বঞ্চনা, স্বাধীনভাবে কথা বলতে না পারা, বিচার না পাওয়াসহ সকল অনাচার। বাংলাদেশে কস্মিনকালেও ইসলামী শাসন আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। যারা বিশ্বাস করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তারা সে চেষ্টা তো করতেই পারে। যে দেশে নতুন সরকার এসেই পুরোনো সরকারের সব স্মৃতি মুছে ফেলে, সেখানে এত বড় একটি বিপ্লবের পর যা যা ঘটা সম্ভব ছিল তা যে হয়নি, সেজন্য আলহামদুলিল্লাহ। সপরিবারে পিতা-মাতাকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে স্বাধীন দেশের অন্যতম স্থপতি হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত পিতাকে অপমানের পথে ঠেলে দেয়ার জন্য দেশজুড়ে পিতার মূর্তি স্থাপন করা শেখ হাসিনার উচিত হয়নি।
যারা মূর্তি ভাঙার সাথে “বিপ্লব” না দেখে ”ইসলাম” দেখেন, তাদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী সময়ে বলশেভিক বিপ্লবের পুরোধা লেনিন ও একনায়ক স্টালিনের মূর্তি উৎপাটন, ভাঙা ও অপমানের দৃশ্যগুলো অবলোকন করতে অনুরোধ করবো। সোভিয়েত ইউনিয়নে লেলিনের কমবেশি ১৪ হাজার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরোধীরা অধিকাংশ মূর্তি ভেঙে অপসারন করেছে। কোনো কোনো স্থানে স্মারক হিসেবে রাখা হয়েছে। ওখানে তো মুসলমানরা মূর্তি ভাঙ্গেনি বা অপমান করেনি। যার অথবা যাদের যেখানে যেভাবে অপমানিত হওয়াই অদৃষ্ট, তা খণ্ডন করা কারও সাধ্যের মধ্যে থাকে না। কোনো ধর্মের বা ধর্মানুসারীদের কি করার থাকতে পারে?
বিশ্বের দেশে দেশে লেনিনের বহু মূর্তি ছিল। সেগুলোর বেশির ভাগ এখন ধ্বংস হয়েছে। একটি মতবাদের প্রবক্তার যদি এই হাল হয়, যার মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বের বহু দেশে, তার মূর্তি বা ভাস্কর্যের পরিণতি থেকেই বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনেক কিছু শিখতে পারেন, যদি তারা শিখতে চান। আর যদি না শেখেন, তাহলে কি হতে পারে, আমরা তো তা প্রত্যক্ষ করছি। জার্মান শহরগুলোতে হিটলারের মূর্তি ভাঙা হয়েছে ঘৃণায়. স্পেনে ফ্রাংকোর মূর্তি, রোমানিয়ায় চসেস্কুর, চীনে মাও জে দং এর মূর্তিও অধিকাংশ জায়গা থেকে উৎপাটন করা হয়েছে। বহু মুসলিম দেশ — ইরান, ইরাক, লিবিয়া, মিশর, তুরস্কেও একই ঘটনা ঘটেছে।
আহা! আমিও মাও জে দং এর অনেক লাল বই পড়েছি। অনেক সময় তার ছবিযুক্ত প্লাস্টিকের স্টিকারও বুকে ধারণ করেছি। কিন্তু চোখের সামনেই কি হয়ে গেল! মাও এর কত বাণী ‘অমর’ বিবেচনায় মুখস্ত করেছিলাম। তরুণদের উদ্দেশ্যে দেওয়া মাও এর একটি বাণী এখনও মনে আছে: “পৃথিবীটা তোমাদের এবং আমাদের। অবশেষে তোমাদেরই। তোমরা সকাল বেলার আটটা-ন’টার সূর্যের মতো। তোমাদের ওপর ভরসা করি।” কিন্তু কোথায় ভেসে গেল তার বাণী, লাল বই, স্টিকার!
ভবিষ্যতে সকল যুগের বিপ্লবে এ ধরনের ঘটনারই পূনরাবৃত্তি ঘটবে। বাংলাদেশে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগতের লোকজন যেকোনো কিছুতে কেন ইসলাম ভীতিতে ভোগেন, এর বিশ্লেষণ হওয়া আবশ্যক। তারা হুজুরদের “ইসলামের জিগির তোলা’র অভিযোগ করেন, কিন্তু হুজুররা নন, বাস্তবে তারাই “ইসলামে জিগির” বেশি তোলেন।
আমি কোনো মূর্তিপূজারী নই। ভালো মুসলমানও নই। কিন্তু মূর্তি হোক, ভাস্কর্য হোক, তা দর্শন উপভোগ করি। আমি শৈশব থেকে স্কুলে স্বরস্বতী পূজা উপভোগ করেছি। শরৎকালে বন্ধুদের সাথে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের ছোট্ট শহরের প্রতিটি দুর্গা মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন, প্রসাদ গ্রহণ, আরতি উপভোগ করেছি এবং দশমীর আড়াই আনি বাড়ির পুকুরে বিসর্জন দেখে বাড়ি ফিরেছি। কলেজ জীবন পর্যন্ত এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কোনো জাদুঘরে গেলে আমার প্রিয় সেকশন হলো ভাস্কর্য। গ্রিক ভাস্কর্যে প্রতিটি ভাঁজ ও ভঙ্গিমাসহ নারীর নিখূঁত অপূর্ব নগ্ন দেহ দেখে আমি লজ্জা বোধ করি না। আমি বলি “সুবহানআল্লাহ!” আত্মাহীন ও স্পন্দনশূন্য অপরূপ ভাস্কর্য আমাকে নারীদেহের সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত করেছে।
শৈশব থেকে নামাজ-রোজায় কিছু মতি ছিল বলে আমার প্রতিমা দর্শন এবং হিন্দু বন্ধু ও মহল্লার হিন্দু মাসি-পিসীদের বাড়িতে আহার্য গ্রহণে আমার নামাজি আব্বা আম্মার আপত্তি না থাকলেও অনেক মুসলিম ভাইবন্ধু ও মুরুব্বিরা বিস্মিত হতো এবং “পূজায় না গেলে হয় না,” টাইপের ইঙ্গিতও দিত। আমি সাধারণত কারও ওয়াজ নসিহতে কান দেই না। অতএব তাদের ইশারা-ইঙ্গিতে আমার ওপর কোনো আছর হয়নি।
কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছিলাম ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আমার এলাকার জামায়াত-শিবির নেতাদের দল বেঁধে দুর্গা পূজা মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনের জজবা দেখে। ব্যাপারটি পুরোপুরিই রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির প্রয়াস, — যাহোক উদ্যোগটি শুভ ছিল। ক্ষমতার অংশীদারিত্ব তাদের মাঝে অন্তত একটি ইতিবাচক বোধের জন্ম দিয়েছে। আমি পরিচিত দু’চারজনকে খোঁটা দিতেও ছাড়ি না। তাদের বলি, “আমি শৈশবে যা বুঝেছি, তা বুঝতে অথবা আপনাদের ওপর আল্লাহর আদেশ আসতে বছর পঞ্চাশেক লাগল।”
একেবারে ব্যতিক্রম ছাড়া আওয়ামী লীগ ১৯৪৭ সালের পর থেকে হিন্দুদের তাদের কেবল ভোট ব্যাংক নয়, সম্পত্তি বলেই বিবেচনা করে এসেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর তা আরও বেড়েছে। আমার ধারণা, শুধু ধারণা বললে ভুল হবে, নানা ঘটনা থেকে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে, হিন্দুরা যে আওয়ামী লীগের ওপর বহুলাংশে ভর করে, তার কারণ হচ্ছে, তারা জানে যে, তারা যদি আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে অন্য কোনো বড় দলকে ভোট দেয়, তাহলে সেই দল তাদেরকে আওয়ামী লীগের রোষ থেকে রক্ষা করতে পারবে না। অতএব, তাদের “শ্যাম রাখি না কূল রাখি’র ব্যাপার নয়, জানমাল বাঁচানোর ব্যাপার।
এবারের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী লীগের গনেশ উল্টে গেছে। আধুনিক বিশ্বের সর্বাধিক পরাক্রমশালী ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী, দারিদ্র কাটিয়ে উঠার পথে পা পা করে এগুনো বাংলাদেশের অধীশ্বর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের জান বাঁচানোর জন্য কারও অপেক্ষা না করে, এমনকি তার দলের কোনো একজন নীতি নির্ধারককেও না জানিয়ে সটকে পড়েছেন। তার দলীয় নেতাকর্মী এবং তার আস্কারায় পরিণত হওয়া লুটেরা বরকন্দজরা পড়েছে বিপদে। একটি গোলমেলে পরিস্থিতি পাকানোর জন্য তারা ঢাকা শহরের এবং বাইরের দু’একটি স্থানে মন্দির ভেঙেছে, হিন্দুদের দোকান-বাড়ি লুট করেছে। কিন্তু খুব সুবিধা করতে পারেনি, কারণ তারা নিজেরাই দৌড়ের ওপর ছিল।
হিন্দুদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে আলেম ওলামা ও মাদ্রাসার ছাত্ররা। জামায়াত নেতাকর্মীরা পর্যন্ত মন্দিরে মন্দিরে যাচ্ছেন, পূজারিদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। সত্যিই এ এক অভূতপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব এবং অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা। তবে এমন অবস্থা কি কখনও আওয়ামী লীগের উপস্থিতিতে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল? অসম্ভব, প্রশ্নই উঠে না। তারা প্রয়োজনে হুজুরদের পিটিয়ে, পণ্ডপে ভাংচুর করে, বোমা ফাটিয়ে দোষ দিত ইসলামী জঙ্গি, জামায়াত-শিবির করেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবসময় বজায় থাকুক।