| মাহমুদ নোমান |
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই আন্দোলনে বিবেকবান মানুষেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল। এটি দেশের অধিকাংশ মানুষের; এই ব্যাপারটিকে উপলব্ধি করতে হবে। ছাত্ররা নেতৃত্বে ছিল বিধায় এটি ঘটতে, ঘটাতে সহজ হয়েছে। কেননা ছাত্রদের পক্ষে এই সমর্থন যোগাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। এক তরফা ছাত্রদের কৃতিত্ব দিলে ভুল হবে। কোনও বিবেকবান মানুষই কামনা করে না বৈষম্য। সেখানে একজন কবি লেখকের এক লাইনের কলম ধরাকে অস্বীকার, অবমূল্যায়ন করা চরম বোকামি। এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন নির্দিষ্ট কোনও পত্রিকা লাগাতার এমনকি বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক যখন অচল করে নরক বানিয়েছে সরকার তখন ‘বাংলা রিভিউ’ প্রবাসে এমনকি বাংলাদেশের বাইরে বাংলা ভাষাভাষী কবিদের জড়ো করেন অনলাইন সাহিত্য পত্রিকাটিতে, এই উদ্যোগের শুরুত্ব অপরিসীম। এখন হয়তো সুসময়ে দুর্যোগ বাহিত হওয়ার পরে সুবিধা নিতে অনেক পত্রিকা মায়া কান্না করে বিশেষ আয়োজন করবে; কিন্তু দুর্যোগের সময় ‘বাংলা রিভিউ’ কয়েকজন কবির কবিতা একত্রে একটা শিরোনামে কয়েকবার প্রকাশের পর ২১জুলাইয়ের পরে এই কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে দেন বৃহৎ পরিসরের দিকে। বিশেষত শাট ডাউনে আমার মতো অনেকে যখন স্বৈরাচারের অন্ধকার চাদরে মোড়ানো, চারপাশে কী হচ্ছে জানি না তখন ‘বাংলা রিভিউ’ এই আন্দোলনকে লেখালেখি দিয়ে বিশেষ গুরুত্বে প্রচারণায় প্রবাসী কবিদের গুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত করতে থাকেন। কবি বদরুজ্জামান আলমগীর, আহমদ সায়েম,সুমন শামসুদ্দিন, মনিজা রহমান ও ‘বাংলা রিভিউ’ এর সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লবের ১০টি কবিতার পরে বৈষম্য বিরোধী জনগণ, এমনকি বহির্বিশ্বের পাঠকের কাছে নিয়ে আসেন স্বনামধন্য ও প্রতিশ্রুতিশীল আরও কবিদের কবিতা; তন্মধ্যে বেশ পরিচিত আমাদের অগ্রজ কবিদের মধ্যে যাঁর কবিতা আমার বিশেষ পছন্দের তিনি তমিজউদদীন লোদী। আমার দুর্ভাগ্য এই আন্দোলন নিয়ে উনার তিনটি অনবদ্য কবিতা পড়তে হয়েছে বেশ পরে। কেননা আগেই বলেছি আমরা বাংলাদেশে অবস্থানরত মানুষ নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম। যেন আমরা এই যোগাযোগের পৃথিবীর কেউ না। এতো ভয় ঐ গদি হারানোর। কবি তমিজউদদীন লোদীর কবিতা তিনটি নিয়ে নতুন আয়োজন করে তেমন বলার কিছু নেই, কেননা তমিজ উদদীন লোদীর কবিতা মানে আলাদা কিছু, এছাড়া ভেতর থেকে ভালো লেগে গেলে এটিকে ব্যাখ্যা করে বলাটা দুরূহ; শুধু বলতে পারি এই আন্দোলনকে ঘিরে ‘বাংলা রিভিউ’ এর আয়োজনে প্রকাশিত কবিতা তিনটি অসাধারণ ছিলো–
মানুষ পাখি হয়ে গেলে তার জন্মভূমি থাকে, দেশ থাকে না
তার অতীত থাকে, বর্তমান থাকে না
প্রতিনিয়ত মানুষের মানবিক হবার দৃশ্য দেখে দেখে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে
ধর্মের ঊর্ধ্বে, জাতি ও বর্ণের ঊর্ধ্বে ওঠে সে কেবলি মানুষ হতে থাকে
কোথাও কোথাও মানবিক কিংবা মানুষ হবার কোনো সুযোগই থাকে না ।
– মানুষ পাখি হয়ে গেলে; তমিজ উদদীন লোদী)
নিঃসঙ্গ নৈরাশ্যবাদীর মধ্যে সত্যির এমন নিবিড় টান জাত কবিরাই দিতে পারেন। এছাড়া ‘বাংলা রিভিউ’এর এই আয়োজনে পড়তে থাকি পশ্চিমবঙ্গে স্বনামধন্য কবি গোলাম রসুলের কবিতা। মার্জিত ভাষায় কাব্যকলার সুষম বন্টন যেন এই কবির কবিতা; দৃশ্য থেকে দৃশ্যে ভাবনার এমন চমৎকার ঢেউ উঠে এই কবির কবিতায়– মর্মভেদী চিৎকারও বেশ গাম্ভীর্যে উপস্থাপিত; গোলাম রসুলের কবিতার ক্যানভাস অনেক বড়, আত্মস্থ করার অনেক হাওয়া বাহিত করে–
তুমি আমার খবর জানতে চেয়েছ
কিন্তু আমি এখনও মরেনি
আমি আমার কঙ্কালের হরিলুট অবধি বেঁচে আছি
পোকারা খেয়ে ফেললেও আমার সংবেদনশীলতা বেঁচে থাকবে বায়ুমণ্ডলে
সবুজ স্বপ্নের সারিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়াবে আমার আত্মা
তারপর আমি একটি আয়নাকে ব্যাখ্যা করবো
আমার ক্ষতস্থান হবে অলৌকিক
আর গৌরবান্বিত হবেএমন যেন অপার নিঃসঙ্গতায় ভেসে চলেছে এক পিয়ানো
– নিঃসঙ্গ বাঁক; গোলাম রসুল)
০২.
আমার কিছু চিন্তা চেতনা বেশ পোক্ত হয়েছে এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। এটি শেয়ার করার ইচ্ছে হচ্ছে — আমি ইদানীং কিছু হাঁস মুরগি পালন করছি কৃষি কাজের পাশাপাশি, বেশ শান্তি পাচ্ছি, এই শান্তি অনুভবের অনুধাবনের। আমি খালপাড়ে গেলে খালের জল,ঘাস, হাতে লাগানো কলাগাছ, মরিচ যা–এই হাতে লাগাই এমনকি হাঁস মুরগি সবকিছু কেমন আপন আপন লাগে। রাত নামলে এদের ছেড়ে এদেরকে ভাবি। এই এক শান্তির সাম্রাজ্য আমার। একটা কথা ভাবছি যে কেমনে শেখ হাসিনা ১৬বছরের এমন দম্ভ অহমিকা,গণভবনের পরিবেশ, আলো-বাতাস ফেলে কেমনতর পালিয়ে গেছে! এদিকে দেশকে এমন চুষে খাওয়া মানুষ শয়তানরূপী ব্যবসায়ী যিনি শেখ হাসিনার কানে কানে উপদেষ্টাগিরী করে লুটপাট করেছে এতো দাপুটে ঈমানদার দেখানো এতই শুভ্র সাদা ইসলামিক দাড়ি রাখা সালমান এফ রহমান সবকিছু ছেড়ে পালাতে গিয়ে দাড়ি সব চেঁছে ফেলে লুঙ্গি দৌড়! এটি চরম শিক্ষণীয় কিন্তু– অহংকার দাপট বেশিদিন টেকে না, তাই সময় থাকতে ভালোবাসার কাছেই থাকা ভালো,দিনশেষে কৃষিকাজ করে ঘরে ফিরে ডাল ভাত খাওয়া অনেক প্রশান্তির…
আমি মনে করি, এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে প্রাপ্ত সুবাতাস টিকিয়ে রাখা আরও বেশি কষ্টকর; স্বৈরাচার পতনের মধ্যে নিজেদের বিজয়ী মনোভাবের মধ্যে স্বৈরাচারী শয়তানি উদ্ভূত হতে পারে; নিজেদের মধ্য থেকে এটিকে হটানো বেশ সাধনার ব্যাপার বটে,নয়তো এই করুণ পরিণতির দিকেই নিয়ে যাবে স্বাভাবিক…
‘বাংলা রিভিউ’-এর এই বৈষম্য বিরোধী আয়োজনের সুবাদে কয়েকজনের নতুনরকমের কবিতা পড়া হয়েছে। কয়েকটি কবিতা উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হয়ে থাকবে। কিছু কবিতা সময়কে ধারণ করবে; এই আয়োজনে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ, ভারতের কবি মহসিন হাবিবের কবিতায় একটা প্রতিবাদের সততা পেয়েছি, বলনের আন্তরিকতায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ যেন–
আমার লাশের গায়ে জড়ানো
কাপড় যাতে লেগে আছে ছোপ ছোপ প্রতিবাদ
সেখান থেকে উড়ছে ঘৃণার বাষ্প
বিষোদগার করছে স্বপ্নময় পৃথিবীকে
নেই নেই কেউ নেই
শুষে নিতে সবুজ ছায়া দিয়ে
বুকের মধ্যে শুধুই হাহাকার
– ভাবনা; মহসিন হাবিব)
এছাড়া এই আয়োজনে প্রকাশিত সৈয়দ আহমদ শামীমের কয়েকটি লাইন লেখা থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভালোবাসায়, যখন কবি বলে —
ছাত্ররা যখন বিজয় মিছিল নিয়ে ফিরবে তখনই যেন তাঁর লাশটিকে বিজয়ী ঘোষণা করে দাফন করা হয়!
সৈয়দ আহমদ শামীম সহজ সরল বয়ানে ভাবিত কল্পজগতকে রিদ্মিক টিউনিং করতে পারেন; সহজে হৃদয়ে পশে প্রতিটি আবেদন। ‘বাংলা রিভিউ’ এর এই আয়োজনে তরুণের কেমন দাপুটে ভালোবাসায় জোরালো কন্ঠস্বর যেন আরিফ আজাদের কবিতা। তাঁর কবিতা যেন শহীদ মুগ্ধের ভেতরকার জিজ্ঞাসা ও আত্মত্যাগী তৃষ্ণার্তে বুকে জলযোগে সাহসী বার্তা–
একদিন লাশেরা চিৎকার করে উঠবে;
চিহ্নিত হবে খুনীদের চেহারা।
চিহ্নিত হবে তারা
যারা পাহারা দিয়েছিলো খুনীদের অস্ত্র।
কলমের কালিতে
দারুণ নির্লজ্জতায় যারা আদায় করেছে
সেই অস্ত্রের লাইসেন্স;
তাদেরকেও দাঁড় করানো হবে কাঠগড়ায়।
সুনিপুণ শিল্পীর মতো
খুন করে শাদা রুমালে যারা
মুছে ফেলেছিলো রক্তের দাগ;
লাশ সকল একদিন চিৎকার করে
বলে দেবে তাদের নামও।
যারা আজ—
খুনীদের হয়ে লেখে
গান গায়
অভিনয় করে
কথা বলে
সাবধান
সাবধান
সাবধান
লাশেরা ভুলে না কিছুই।
আরিফ আজাদের এই কবিতাটির কথা ধরেই বলি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছেন, জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তাঁরা নিশ্চয় ক্ষমা করবে না– যে অর্জিত বিজয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেটি যদি আবারও বৈষম্যেই কলুষিত হয়…
এর আগে ১—৪ পর্যন্ত পড়েছি।
৫ম পর্বও ভালো লেগেছে।
ঝরঝরে আলোচনা।
ধন্যবাদ কবি💚