আবু তাহের সরফরাজ
বাংলা কবিতার কালস্রোতে নব্বইয়ের দশক প্রায়ই ঘুরেফিরে আলোচিত হয়। যারা আলোচনা করেন তাদের বেশিরভাগেরই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের মতলব থাকে। কোনটা যে সঠিক মূল্যায়ন আর কোনটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেই খতিয়ান পাঠক হিসেবে খুব বেশি মেধা না-থাকলে কারো ধরতে পারার কথা নয়। যান্ত্রিক বাস্তবতা আসলে এমনই। কেবল শিল্প-সংস্কৃতি নয়, যান্ত্রিক এই বাস্তবতায় সকল ক্ষেত্রেই ক্ষমতার আধিপত্য। সেই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচেবর্তে থাকার অভিপ্রায়ে সকলেই ফাঁক-ফোকর খুঁজছে। ক্ষমতাবান কারো স্তুতি বর্ণনার এতটুকু সুযোগ পেলে প্রত্যেকেই নিজেকে ধন্য মনে করছে। নব্বইয়ের দশকে একঝাঁক তরুণ লিখতে শুরু করেন কবিতা। তিরিশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে আজকে সেইসব কবিদের দিকে তাকালে দেখতে পাই, কেউ কেউ রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের কবিতা যেনতেন হলেও স্তুতিকারদের প্রচারণায় তারাই ওই সময়ের প্রধান কবি হিসেবে পাঠক-মহলে স্বীকৃত। আবার এমন কবিও রয়েছেন যারা ক্ষমতার ধারে-কাছে না-থেকেও পাঠকনন্দিত হয়ে উঠেছেন। এসব কবির কবিতাই প্রকৃত শিল্প-বিচারে কবিতা। এদেরই একজন মজনু শাহ। তিনি দীর্ঘদিন ইতালিতে বসবাস করছেন। সেখানে একটি পলিমার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার কেজি কার্বন গ্রাফাইট প্রসেস করেন। কাজ শেষে কারখানা থেকে যখন বের হন তখন মাঝে মাঝে গায়ের ব্যথার কারণে ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। এতকিছুর পরও দেশের মাটি, মানুষ ও বাংলা ভাষা তার অন্তকরণে প্রশান্তির প্রলেপ জোগায়। আর তাই তো এখনো কবিতার বীজ তিনি অঙ্কুরিত করে চলেছেন। ২০২৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় তার কবিতার বই ‘ধীরে রজনী, ধীরে’। মেলাইতে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বিষয়টি ভাবার মতো। আমাদের দেশে কবিতার পাঠক খুবই কম। যারাও বা কবিতা পড়েন তারা গণমাধ্যম দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু মজনুর কবিতার পাঠক কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে নিজের শিল্পরুচির ওপর আস্থাবান। তবে এখানে বলে রাখা দরকার, ওই বইটি বইমেলায় যারা কিনেছেন তারা সকলেই যে আস্থাবান পাঠক তাও কিন্তু নয়। এদের ভেতর শতকরা অন্তত বিশজন ‘সবাই কিনছে দেখে আমিও কিনলুম’ গোছের। এ ধরনের হুজুগে পাঠক থাকবেই। তবে আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে, কী আছে মজনুর কবিতায় যার জন্য তার পাঠককে বিশেষভাবে নজর দিয়ে দেখতে হয়? মজনুর কবিতা কিন্তু পাঠকঘনিষ্ট নয়। শব্দের বিন্যাসও বেশ জটিল ও ঘোরানো। পড়তে গেলে শব্দগুলো চিবোতে হয়, নয়তো অনুভূতির অদৃশ্য হাত দিয়ে শব্দগুলো ধরে এনে নেড়েচেড়ে দেখতে হয়। এরপরও তার কবিতা বহুল পঠিত। পাঠকঘনিষ্ট না হয়েও মজনুর কবিতার জনপ্রিয়তার কারণ, শিল্পের অদৃশ্য একটি জগৎকে মজনু নির্মাণ করেন। এই জগৎ যাপিতজীবনের প্যারালাল। মজনু নির্মিত এই প্যারালাল জগতে পর্যটন করতে করতে পাঠক নিজের বাস্তবজীবনের দিকে তাকান। দূরের একটি জগৎ থেকে পাঠক দেখতে পান, কী ক্লিশে একটি জীবন তিনি কাটিয়ে দিচ্ছেন!
বলতে কি, যাপিতজীবনে কেউ সুখি নয়। সুকুমার রায়ের গল্পের সেই ‘সুখি মানুষের জামা’ হাজার তালাশ করেও আমরা বের করতে পারব না। কেননা, জগতে সুখি কোনো মানুষই নেই। প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে কিছু না কিছু জটিলতা। জীবন যেন একটা চক্র। সেই চক্রেই মানুষ ঘুরছে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। আর এই চক্র গড়ে উঠেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ফলে, সিস্টেমের এই বাণিজ্যিক দুনিয়ায় দিন দিন মানুষ হয়ে পড়ছে কোণঠাসা। পশুবৃত্তীয় যা যা, মানুষ সেসবের সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়ে চলেছে যাপিতজীবনে। যা যা মানবিক, যেসব বৈশিষ্ট্য মানুষকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে, তা মানুষের যাপিতজীবনে দেখতে পাওয়া যায় না। এর মানে, মানুষ মানুষ নয়, পশু। সমাজের বৃহত্তর এই প্রভাব এসে পড়ছে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিজীবনের ওপর। ব্যক্তি হয়ে পড়ছে চিন্তাশূন্য। সবসময়ে তার ভেতর ভয় কাজ করছে, কখন না-জানি সিস্টেমের বাইরে চলে যাই! জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা বুঝে গিয়ে যারা আরসব মানুষের চিন্তার বাইরে গিয়ে চিন্তার জগৎ তৈরি করে নেন, তাদেরকে সাধারণ মানুষ খুব একটা ভালো চোখে দ্যাখে না।
আসলে যে জীবন মানুষ যাপন করে, তা সে যাপন করতে চায় না। সে চায় তার আকাঙ্ক্ষার জগতের জীবনকে যাপন করতে। এই দ্বন্দ্বে পড়েই মেসমার মানুষ, সংসার ও হৃদয়ঘটিত জীবন। বলা চলে, মানুষ আজ ক্লান্ত আর বিষণ্ণ। মানুষ আজ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ একা। এই যদি হয় মানুষের যাত্রাপথ, তাহলে মানুষ বেঁচে থাকে কেন? যাপিতজীবনে মানুষ আসলে বেঁচে থাকে না। মানুষ বেঁচে থাকে তার আকাঙ্ক্ষার জগতে। এই আকাঙ্ক্ষার জগৎ মানুষের সৌন্দর্যবোধ দিয়ে তৈরি। সুন্দরের প্রতি তৃষ্ণা আছে বলেই মানুষ শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। নানাজন নানাভাবে এ তৃষ্ণা মেটায়। কেউ প্রেমিকার ঠোঁটে থরোথরো গোলাপের পাপড়ি দ্যাখে। কেউ কবিতা লেখে। কেউ তা পড়ে। কেউ ছবি আঁকে। এর সবই শিল্প। কুৎসিত জীবনকে সুন্দর করে রাঙিয়ে তোলার চমৎকার এক মাধ্যম শিল্পকর্ম। সেই আদিম সময় থেকে মানুষ এভাবেই কুৎসিত জীবনকে শৈল্পিক জীবনে উত্তরণ ঘটানোর কৌশল শিখে এসেছে। যে যত নিখুঁত ও সুন্দর উপায়ে এই কৌশল আয়ত্ব করেছে, সে তত মহৎ শিল্পী।
কবি হিসেবে মজনু শাহ কতটা মহৎ সেই বিবেচনা আমার কাজ নয়। তবে তার কবিতা যে যাপিতজীবনকে ছাপিয়ে শিল্পের সৌন্দর্যে ঘেরা আরেক জগতে পাঠককে পরিভ্রমণ করায়, সে বিষয়টি আমাকে স্বীকার করতেই হবে। একটা সময়ে মজনুর সাথে বেশ মাখামাখি ছিল আমার। নিপাট সাধাসিধা মানুষ। কথা বলেন নিচু স্বরে। কবিতার প্রতি প্রগাঢ় প্রেম। আজিজ মার্কেকেট যখন দ্যাখা হতো কবিতা বিষয়ক নানা বই থেকে চুম্বকীয় অংশ আমাকে নিজের খরচে ফটোকপি করে দিতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হতো কবিতা নিয়ে। কবিতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার চাতুরি তার ভেতর আমি কখনোই দেখিনি। ইতালি চলে যাবার পর তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে ফেসবুকে প্রায়ই আমাদের কথা হয়। কখনো কখনো তিনি আমার মুঠোফোনে কল দিয়ে কথা বলেন। ভালো লাগে তখন। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। বঙ্গের কবিসমাজ বেশিরভাগ বাটপার। ফলে, কারো সাথেই আমার যোগাযোগ নেই। যে দু’চারজনের সাথে এখনো কথা হয় মজনু শাহ তাদের একজন।
মজনু শাহ’র প্রথম বই ‘আনকা মেঘের জীবনী’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। এই বইয়ের কবিতাগুলো সিরিজধর্মী। বিশটি ছোট-ছোট কবিতার সমষ্টি। এই বইয়ের উপক্রমণিকায় তিনি লিখেছেন, ‘দৈবাৎ এসে পড়েছি শব্দের রাস্তায়।’ কেন তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন তার একটি ইঙ্গিত আমরা বাক্যটিতে পাচ্ছি। কবিতা এক ধরনের ঘোর। পরিকল্পনা করে, গুছিয়ে-গাছিয়ে কবিতার ঘোর নিজের ভেতর তৈরি করা যায় না। কবিতার ঘোর ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ধার ধারে না। কবিতা হয়ে ওঠার বিষয়। সকল শিল্পকর্মই আসলে তাই। তবে আরসব শিল্প থেকে কবিতা যেন বেশি ঐন্দ্রজালিক। যেখানে কবি নিমিত্ত মাত্র। তো, হঠাৎ করেই কবিতার ঘোরে আক্রান্ত হয়ে মজনু একটা জীবন সেই ঘোরের আনন্দেই কাটিয়ে দিলেন। এই ঘোর যাপিত জীবনের বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে আরেক কোনো জীবন ও জগতের স্বপ্নাচ্ছনতা। মজনুর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য বিমূর্ততা। তবে সেই বিমূর্ততার ভেতরও তিনি একটা বাস্তবতাকে মূর্ত করে তোলেন, যা যাপিত বাস্তবতার সমান্তরাল। ‘আনকা মেঘের জীবনী’ থেকে ‘ধীরে রজনী, ধীরে’ বই পর্যন্ত মজনুর যে কবিতা-যাত্রা সেই যাত্রায় বিমূর্ত বাস্তবতাই তার কবিতাকে নব্বইয়ের দশকের আরসব কবিদের কবিতা থেকে আলাদা শিল্প-সুষমায় বিশিষ্ট করে তুলেছে।
২০০৫ সালে দ্বিতীয় বই ‘লীলাচূর্ণ’ প্রকাশিত হবার পরপরই কবিতা-বোদ্ধাদের দৃষ্টি মজনু শাহ’র দিকে নিবদ্ধ হতে শুরু করে। লীলাচূর্ণের কবিতাগুলো সনেট। বাংলাদেশের কবিতায় সনেট চর্চা যখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, ঠিক সেই সময়েই মজনুর লীলাচূর্ণের সনেটগুলো পাঠককে চমকিত করে। সনেটগুলোর আলাদা-আলাদা কোনো শিরোনাম নেই। সনেটগুলো সংখ্যাভিত্তিক সাজানো। মোট ৫৬টি সনেট নিয়ে মলাটবন্দি ‘লীলাচূর্ণ’। বইয়ের দ্বিতীয় সনেটটি পড়া যাক:
বিজেত্রীর ঘরে আমি যাইনি সেদিন, লোকে তবু
আমাকেই বেরুতে দেখেছে। অথচ সেই সন্ধ্যায়,
গোলাপ ও আফিমের কোনো তৃতীয়-উদয়-পথে
হেঁটে গেছি এক স্বপ্নরিক্ত নটরাজনের মতো।
সেই হাড়-কঙ্কনের পথে, প্রভু, ভেবেছি বিস্ময়ে:
রঘু ডাকাতের মতো হয়ে যাই কেন যে আমরা
ওষ্ঠ চুম্বনের লগ্নে! মাটিতে অর্ধেক ডুবে থাকা
রথের চাকার গোয়ার্তুমি কীভাবে শরীরে জাগে!
নায়িকা-চূর্ণের রাতে, মৃত বেলফুলের ভেতর
তার গাঢ় কেশগন্ধ আমি পাই। বিজেত্রী বলেছে:
কাছে না এসেও এইভাবে নিকটে থাকার পথ
উন্মুক্ত রয়েছে, এইভাবে বাক-বিভূতির দেশে
যখন তখন যেতে পারে কেউ, সকল সম্পর্ক
হয় খরতর নদী— সময়ের সুতো কেটে চলে…
নারী-পুরুষের প্রেমজ সম্পর্কের এক রকমের রূপরেখা সনেটটিতে আমরা দেখতে পাই। তবে সেই রূপরেখা চিনে নিতে মাথাটাকে একটু ঝাঁকি দিয়ে নিতে হবে। মাথা খোলতাই না হলে পাঠক বুঝতেই পারবেন না, বিজেত্রীর ঘরে না গিয়েও মজনু আসলে বিজেত্রীর ঘরেই গিয়েছিলেন। এই যে ধোঁয়াশা, এর ভেতর দিয়ে যাপিত বাস্তবতার সমান্তরাল আরেক বাস্তবতায় মজনু পাঠকে খানিক সময় ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন। এই পর্যটনে বিমূর্ততা, আশ্চর্য সম্মোহনে স্পষ্ট হতে গিয়েও অস্পষ্টতা পাঠকের মগজে ঘোরের সৃষ্টি করে। এই খেলা মজনুর প্রতিটি কবিতাকেই আমাদের চোখে পড়ে। তার কবিতার ভেতর লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত রকমের কুহক। আর কবিতার বাইরে থাকে নানা রকম ঐন্দ্রজালিক শব্দ। এসব শব্দ বাংলা ভাষারই। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, শব্দগুলো দূরতম কোনো গ্রহ থেকে ভেসে এসেছে। ফলে, মজনু শাহ’র কবিতার পাঠক হতে গেলে মেধাকে খরচ করতে হয়। পড়লাম আর বুঝে ফেললাম, এ ধরনের কবিতা মজনু শাহ’র নয়। বিষয়টি তিনি স্বীকারও করেন। তিনি মনে করেন, কবিতা কেবলমাত্র কবির কাজ নয়। পাঠকের মেধা-বিনিয়োগ ছাড়া কবিতা সম্পূর্ণ হয় না। এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি, পশ্চিমি বিমূর্ত চিত্রকলা ও অ্যাবসার্ড নাটক। বিমূর্ত চিত্রকলা সরাসরি দর্শককে কোনো ম্যাসেজ দেয় না। দর্শকের শিল্পবোধ অনুযায়ী বিমূর্ত চিত্রকলা মূল ক্যানভাস থেকে দর্শকের মনের ক্যানভাসে পুনঃনির্মিত হয়।
এ বিষয়ে মজনু শাহ’র বক্তব্য হচ্ছে, “কবিতার কাজ এমন নয় যে, তা বাজিমাত করতে এসেছে। তার একটা অন্তশ্চারী যাতায়াত আছে। তা কোথাও নীরব তীক্ষ্ণ সংবেদি কোনো প্রান্তবাসী মনের সমর্থন খুঁজে ফিরছে মাত্র। আর এজন্য তার মধ্যে দিশেহারা হওয়ার কোনো ব্যগ্রতা নাই। অ্যাপেলেসের আঁকা মাদি ঘোড়ার ছবি দেখে বাস্তব জগতের একটা ঘোড়া সঙ্গমোদ্যত হয়েছিল, রসানুসন্ধানির তরফে কবিতা কখনো কখনো সেইরূপ যুক্তিহীন আকর্ষণীয় পথ পরিক্রমা করতে চায়। ডিভাইন কম্যান্ডস থেকে উৎসারিত হয় কবিতার পঙক্তিমালা, এইরূপ তত্ত্বে আমার সায় নাই তত। কেননা, কবিতার তথাকথিত অ্যাঞ্জেলিয়মে আমি আস্থা রাখি না। পরিবর্তে লৌকিক এক স্বরপ্রবাহকে আমি কবিতা ভাবি। ওই একই কারণে শব্দপুঞ্জ নয়, ঈগলের ক্রুদ্ধ চোখ, তারা আছে ডানা হয়ে। শিকারের নিষ্ঠুরতা নিশ্চয়ই জগতে আছে। আমি তবু প্রথম পক্ষপাত রাখি তার ধীর উড়ে চলায় তার রাজসিক একাকিত্বের অদ্ভুত লীলাই আমার অভিপ্রায়।”
২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় মজনু শাহ’র তৃতীয় বই ‘মধু ও মশলার বনে’। দীর্ঘ একটি কবিতা নিয়েই এই বই। মজনুর বড় ভাই আলী জন্মের সাতদিন পরই মারা যায়। তার কবরটা কোথায়, সেটাও আজ বিস্মৃত। আলীকে নিয়ে স্মৃতিকাতর মজনু এই দীর্ঘ কবিতাটি লিখেছেন। কবিতাটি সূচনা হয়েছে এভাবে:
অনেক দূরের কেউ হয়ে গেছে যেন সে যে আজ,
তবু আলী আলী বলে বহুবার
ডাকলাম তাকে।
অনেক দিনের পুরনো ট্র্যাঙ্ক খুলে জামা-কাপড় বের করলে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ এসে ঝাপটা মারে নাকে। সেই ঘ্রাণে কত কত যে স্মৃতি জড়িয়ে থাকে! পুরনো দিনের কত যে কথা মনের ভেতর বুদবুদ তোলে। আর নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে ওঠে। ‘মধু ও মশলার বনে’ ঠিক সেই রকম একটা স্মৃতির ট্র্যাঙ্ক। কবিতাটি পড়লে পাঠকের মনে হবে, আলী যেন তারই মৃত ভাই। যে অনেককাল আগে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে দূর নক্ষত্রের দেশে হারিয়ে গেছে।
২০১১ সালে প্রকাশিত হয় মজনুর চতুর্থ বই ‘জেব্রামাস্টার’। এই বইয়ের কবিতাগুলো টানাগদ্যে লেখা। কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে পাঠক বারবার চমকিত হবেন মজনুর নীরিক্ষাধর্মী শিল্পকৌশল লক্ষ্য করে। কবিতায় নীরিক্ষার কাজটি যেনতেন কর্ম নয়। অনেক কবিই কবিতায় নীরিক্ষা করতে গিয়ে কবিতাকে ল্যাজে-গোবরে করে ফেলেছেন। সে রকম উদাহরণ নব্বইয়ের দশকের অনেক কবির কবিতায় আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু মজনু কী যেন এক জাদুর কৌশলে নীরিক্ষার বুননে কবিতাগুলোতে শিল্প-সুষমাকে ঈর্ষণীয় ব্যঞ্জনা এনে দিয়েছেন। কবিতাগুলো টানা গদ্যের হলে কী হবে, পড়তে গিয়ে ভেতর শব্দের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অন্তর্লীন ছন্দ ও গীতলতা টের পাওয়া যায়।
২০১৪ সালে মজনুর পঞ্চম বই ‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না’ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের কবিতাগুলো নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনধর্মী প্রশ্নোত্তর ফর্মে সাজানো। কবিতাগুলোর আঙ্গিক জালালউদ্দিন রুমির ‘মসনবি’ থেকে গ্রহণ করা। এ বিষয়ে মজনু শাহ লিখেছেন, “সে একটা সময় আমি পার করছিলাম, বছর দুয়েক আগে, এখন ভাবি, ঐ সময় পড়ছিলাম ঘুরেফিরে জালালউদ্দিন রুমির বইপত্র, কেবলই রুমি। তাঁর মসনবি। ফিহি মা ফিহি। এইসব। কেমন একটা আশ্রয়ের মতো হয়ে গিয়েছিল তাঁর লেখা। পরিত্রাণও। রুমি নিজে এক জায়গায় বলছেন দেখতে পাচ্ছি, তিনি কবিতা লিখতে চাইতেন না, এগুলোকে ফালতু জিনিস আখ্যা দিতেন। বস্তুত, কেন একজন লিখবেন, তা আবার হয়ে উঠবে কবিতা, বা না-কবিতা, এ আসলে রহস্যই একরকম। এসব ভাবনার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কেমন করে যেন সংলাপধর্মী দুটো প্যারা লিখি প্রথম। তারপর ভাবি যে, শেষ হলো। কিন্তু লেখাটা দ্রুতই ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকে। মাস দুয়েক এমন চলেছিল। লিখতে লিখতে এর ফর্মটা স্পষ্ট হচ্ছিল। রুমিতে খুঁজছিলাম মূলত ফর্ম। যা বলতে চাইছি, বলতে বলতে, লুকিয়ে পড়তে চাইছি কথার মধ্যেই হয়তো, এরকম লেখার জন্য একটা নতুন ফর্মেও দরকার হয়ে পড়েছিল। সংলাপ, বা বলা যাক একে সলিলকি, যা আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যে অবিরাম বহমান, নিজের সঙ্গে নিজের, তারই একটা রূপ এই বইটা। যেখানে প্রশ্ন আর উত্তর— দুই-ই অনিশ্চয়তার পথ ধরে চলেছে।”
‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না’ থেকে কয়েক পঙক্তি পাঠ করা যাক:
১. কে তুমি?
আমাকে বলছ? আমি?
ওহ, তবে শোনো, আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া।
২. মৃত্যু আসবে এপিফ্যানি লেখার রাতে।
৩. স্থলপদ্ম, ভিতরে আসব?
৪. রাস্তাটিই বিষণ্ণ, আমি নই।
৫. একটি স্ফুলিঙ্গে কেঁদে ওঠে আল্লাহ্র ব্যাখ্যা।
৬. ঘাসফুল কোনও এক নক্ষত্রকে সারাক্ষণ প্রশ্ন পাঠায়।
২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় মজনু শাহ’র ষষ্ঠ বই ‘আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া’। তিন ফর্মার এই বইয়ের কবিতাগুলো ছোট ছোট বাক্যে লেখা। মোট কবিতার সংখ্যা ২৬২। এসব কবিতার বিষয়ে মজনু লিখেছেন, “এ বইয়ের কবিতাগুলো তাৎক্ষণিক বা সামান্যকে খুঁজে ফেরার কাজে নিয়োজিত। জগতে তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ, স্খলিত যা কিছু— সেসবের দিকে হিতৈষী কৌতূহল নিয়ে যদি তাকাই— একেকটি মুহূর্ত যেন সেখানে ভাবনাবীজ, প্যারাডক্স হয়ে উঠতে সক্ষম।”
২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘বাল্মীকির কুটির’। বাল্মীকির কুটির শিরোনামে মোট ৫৭টি কবিতা রয়েছে বইতে। উপক্রমণিকা কবিতার কয়েকটি পঙক্তি পড়া যাক:
আকাঙ্ক্ষার ফাঁদে পড়ে, তুমিও কি হারাওনি লক্ষ লক্ষ স্পার্ম!
দেখো, এরা কিংবদন্তির কথা কিছু বলছে না, তবু
সূর্যাস্তের দিকে যাবার পথে তুমি বীণা হয়ে ওঠো, এখানে
ক্রৌ মিথুন, পাতার কুটির, এক বাল্মীকি ঘুমায় চিরকাল।
মজনু শাহ’র প্রথম বই ‘আনকা মেঘের জীবনী’ থেকে আপাতত শেষ প্রকাশিত বই ‘ধীরে রজনী, ধীরে’র কবিতাগুলো ধারাবাহিকভাবে পাঠ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি বইতেই তিনি আঙ্গিক পরিবর্তন করেছেন। কখনো অক্ষরবৃত্তের কঠোর অনুশাসন মেনে নিয়েছেন, কখনো সনেটের আঙ্গিক, কখনো টানা গদ্যে দীর্ঘকবিতা, আবার কখনও স্বল্পপরিসরের কবিতা লিখেছেন। কেবল নব্বইয়ের দশকেই নয়, বাংলা কবিতায় ষাট, সত্তুর কিংবা আশির দশকেও একজন কবি মজনু শাহ’র মতো আর কোনো কবি কবিতাকে নানা ফর্মে নীরিক্ষার বৈচিত্র্যের ভেতর দিয়ে এগিযে নেননি। মজনু শাহ’র কবিতা আসলে প্রজ্ঞাবান পাঠকের কবিতা। যাপিত জীবনের বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যে পাঠক শিল্পবোধে আচ্ছন্ন হতে চান, মজনু শাহ’র কবিতা তার জন্য।
এই আলোচনায় কবি মজনু শাহকে ভালোভাবেই চেনা যায়।
সুন্দর একটি আলোচনা।