spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআরশি নিকেতন : ২৩

ধারাবাহিক আত্মজীবনী : তৈমুর খান

আরশি নিকেতন : ২৩

তৈমুর খান

২৩

সমাজের কাছে বারবার আমাকে প্রমাণ দিতে হয় আমি মানুষ

২০১২ সালের জুলাই মাসে আমি জঙ্গিপুর থেকে ট্রান্সফার নিয়ে বীরভূম বর্ডার সংলগ্ন বোখারা হাজি জুবেদ আলি বিদ্যাপীঠে চলে আসি। আগে জঙ্গিপুর বাসে চেপে যাওয়ার সময় খুব মনে হতো এই স্কুলটির কথা। এই স্কুলে যোগদান করে খুব কম সময়ের মধ্যেই আমি এলাকার মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করি। চায়ের দোকানদার, টোটো ও রিক্সাচালক, মিঠাইয়ের দোকানদার এবং এলাকার মানুষজন সকলেই আবদুর রাকিব স্যারের ছাত্র-ছাত্রী। সকলের সঙ্গেই কথা হয় স্যারের সম্পর্কে। তাঁর পড়ানোর ধরন, চালচলন, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে থাকি। শিক্ষক হিসেবে তিনি যত বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবেও ততোধিক বড়। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল সবারই তুঙ্গে। শ্রেণিকক্ষে ঢুকেই তিনি বুঝে নিতেন ছাত্র-ছাত্রীর কী প্রয়োজনীয়তা আছে। কেমন ভাবে কোন বিষয়ের উপস্থাপনা করতে হবে। কখনো লাঠি হাতে প্রহার করতেন না। ভালবেসে সস্নেহে কাছে ডাকতেন। অনেক দুষ্টু ছেলেও তাঁর ব্যবহারের গুণে পরিবর্তিত হয়ে যেত। তেমনি কবিগান, আলকাপ গান, পঞ্চরস বা সত্যপীরের গানের আসরে তিনি গিয়ে সর্বাগ্রে বসতেন। টেলার বা কমিকস দেখে অতি উচ্চস্বরে হেসে উঠতেন। বিদ্যালয়ের ভিতরের ক্লাসগুলিতে আমি যখন প্রবেশ করি, তখন মনে মনে ভাবি আবদুর রাকিব স্যারও এভাবেই প্রবেশ করতেন। তাঁর চোখ দিয়ে নিজেকে দেখি। যখন চেয়ারে গিয়ে বসি, তখন মনে হয় একটু আগেই রাকিব স্যার উঠে গেলেন। যখন ব্ল্যাকবোর্ড ইউজ করি, তখন মনে পড়ে যায় রাকিব স্যারও এই ব্ল্যাকবোর্ড ইউজ করতেন। বিদ্যালয়ের স্টাফরুম থেকে বাথরুম পর্যন্ত স্যারের স্মৃতি আমি বহন করে চলি। তাঁর বাড়িতে একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমি আজ কয়েকদিন থেকেই ভেবে দেখেছি আর নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছি: আমার লেখকসত্তা, না শিক্ষকসত্তা কোনটি বড়?
উত্তরও পেয়েছি নিজের কাছেই, অবশ্যই শিক্ষকসত্তা বড়। লেখালেখির কাজটি বাই প্রোডাক্ট। তাই আমি সর্বদা শিক্ষক সত্তাটিকেই মর্যাদা দিয়ে আসছি।”
শিক্ষক হিসেবে সমস্ত দায়িত্বই নিখুঁতভাবে পালন করেছেন। শনিবার বিদ্যালয় ছুটির পর ছুটে গিয়েছেন কাফেলা দপ্তরে। সোমবার সকাল সকাল এসে যোগ দিয়েছেন বিদ্যালয়ে। এতটুকু ওজর আপত্তি বা অলসতা করেননি। প্রাণ খুলে সকলের সঙ্গে কথা বলা এবং মেলামেশার বিষয়টি আজও আমার মধ্যে প্রভাব ফেলে চলেছে। প্রতিটি মুহূর্তেই তিনি মনের মাঝে জেগে উঠছেন। তাঁর শেখানো মূল্যবোধের পথ যে অনুকরণীয় আমিও তা বহু আগেই অনুধাবন করতে পেরেছি।
প্রথম জঙ্গিপুরের স্কুলটিতেও ছাত্র-ছাত্রীর অঢেল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছি। সহকর্মীদের আন্তরিকতা কখনোই ভোলার নয়। বিদ্যালয়ের নিচে একটি গুদাম ঘরে আমাদের চায়ের আড্ডা হতো। ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে চা খাওয়ার ইচ্ছে হলে সেখানে গিয়ে খেতে পারতাম। রাখা ছিল একটি বড় টিভিও। খেলা দেখা বা অন্যান্য সংবাদ মাঝে মাঝে পাওয়া যেত। বহু ছাত্র-ছাত্রীর পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমরা শিক্ষকরাও আমন্ত্রিত হতাম। সকলের সঙ্গেই ছিল একটি সুসম্পর্ক। কিন্তু আমার গ্রামের বাড়ি থেকে এই বিদ্যালয়টি আসতে অনেক সময় লেগে যেত। তাই কর্মস্থলটি সুখের হলেও পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে এই পরিবর্তিত বিদ্যালয়টিতেও সেই আন্তরিকতার অভাব হয়নি। ক্লাসরুমে প্রবেশ করলে অনেক সময়ই ছাত্রীরা তাদের ওড়না দিয়েই চেয়ারের ধুলো মুছে দিয়েছে। টিফিন বক্সে স্যারের জন্য আলাদা করে টিফিন এনেছে। কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদান করলে আমাদের আশীর্বাদও নিতে এসেছে। প্রথম প্রথম প্রধান শিক্ষককে গুরুগম্ভীর মনে হলেও পরবর্তীতে তিনি বন্ধুর মতোই আমাদের সঙ্গে মিশে গেছেন। সুখ-দুঃখে সুপরামর্শও দিয়েছেন। সুতরাং একদিকে রাকিব স্যারের স্মৃতি, অন্যদিকে তাঁর স্মৃতিচারণায় ভরপুর মানুষজনের আবেগ সর্বদা আমাকে আপ্লুত করেছে। খুব কাছের বন্ধু হিসেবে পেয়েছি বিদ্যালয়ের প্যারা-টিচারদেরও। চা খেতে খেতে বেলা গড়ে যায়। হঠাৎ আজিজুর মোবাইল বের করে বলে, “তৈমুরদা, পড়ুন আপনার নতুন একটি কবিতা।” কবিতা পড়া হলে তৎক্ষণাৎ সে ভিডিও করে দেয়। মুহাম্মদ মুসা সুখ-দুঃখে সঙ্গে সঙ্গে থাকে। স্কুল ছুটির পর ট্রেন আসতে দেরি হলে তার সঙ্গ পাই। দোতলার উপর থেকে আমার ব্যাগটি নামিয়ে এনে হাতে দেয়। “চলুন, আর এক কাপ চা খাই!” সাধারণ জীবন-যাপনের মধ্যেই তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন এক সততার দেখা পাই, যা আমাকেও ভালো লাগে।
আবদুর রাকিব স্যারের মতো আমিও যদি নিজেকে প্রশ্ন করি— কোন সত্তাটি আমার কাছে বড়—শিক্ষক সত্তা, না লেখকসত্তা?
আমিও ওই একই উত্তর দেবো,অর্থাৎ শিক্ষক সত্তাটিই বড়। শিক্ষকতার চাকরি না পেলে হয়তো বিয়েই হতো না। সংসারও হতো না। লেখকসত্তাও বেঁচে থাকত না মরে যেত সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বহুদিন বেকার জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। সেই সময় বহু লেখা লিখলেও মানুষের নজরে ততটা আসেনি। চাকরি পাওয়ার পর প্রথম পরিচয় শিক্ষক হিসেবেই সবাই চিনতে শুরু করেছে। লেখক পরিচয়টি গৌণ। সামাজিক মর্যাদাও লেখক পরিচয়ে একেবারেই নেই। স্বচক্ষেই দেখেছি ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক আফসার আমেদ মারা গেলে কলকাতার কোনো নামিদামি সাহিত্যিকই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে যাননি। না ফুলের তোড়া, না ফুলের মালা কিছুই ছিল না। দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমিতে কাটালেও সেখানেও তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়নি। সাহিত্যপ্রাণ নিরীহ হাসিখুশিতে ভরা মিশুকে মানুষটি একপ্রকার নিঃশব্দেই চলে যান। গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক মজুর হকার সাধারণ মানুষেরাই তাঁকে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করেন। সুতরাং সাহিত্যিক পরিচয়টি সমাজের কাছে তেমন মূল্যবান নয়, যতখানি শিক্ষক পরিচয়। আফসার আমেদকে গ্রামের লোকে ‘মাস্টার’ বলেই জানে, ‘কালো বোরখার বিবি ও কুসুমের গন্ধ এবং চল্লিশ জন লোক’-এর লেখক হিসেবে নয়। ভালো শিক্ষা দিতে পারলে, ছাত্র-ছাত্রীর কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠলে তবে একজন শিক্ষকের মূল্য থাকে। আমি যখন ক্লাসে শিক্ষাদান করি, তখন আমার মধ্যেও আমার শিক্ষক জেগে ওঠেন। কী করে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিষয় ব্যাখ্যা করতে হয় তা তিনি আগেই শিখিয়ে গেছেন। তেমনি আমার কাছেও ছাত্র-ছাত্রীরা শিখে নিচ্ছে। আমার মূল্যবোধ, আচরণ, কথা বলা এমনকি পোশাক-আশাকও তাদের কাছে অনুকরণীয়। সমাজের কাছে রোল মডেল একমাত্র শিক্ষকই হয়ে ওঠেন, সাহিত্যিক নন।
তবে বর্তমানে আদর্শ শিক্ষক সমাজও বিলুপ্তির পথে। মনুষ্যত্ববোধ, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নির্লোভ, উদারতা, যুক্তিনিষ্ঠতা তাদের মধ্যেও কম দেখা যায়। শিক্ষকরাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে তাদেরই ভাবনা ও কর্মের অনুসারী হন। ফলে তাদের মধ্যেও ধর্ম ও সম্প্রদায় বিদ্বেষীর জন্ম হয়। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেও হাতে বেঁধে রাখেন পাথর, অঙ্গুরীয়, মাদুলি ও তাগা। রাজনৈতিক দলের তথাকথিত স্লোগানও উচ্চারণ করেন। ফলে তাদের কাছে সমাজ কিছুই পায় না। বরং হিংস্র ও উগ্র একটি প্রজন্ম তৈরি হয়। এই সেদিন বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করল। শেখ হাসিনারও বিতাড়ন হলো। দেশ গঠনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আনা হলো বিখ্যাত ব্যক্তিদের। দেশকে যখন শান্ত করার প্রচেষ্টা চলছে, তখন গোটা ভারত জুড়ে প্রচার করছেন কিছু কবি-লেখক, শিক্ষক এবং একটি দলের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যে, “বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর চরম অত্যাচার চলছে। তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে, মেয়েদের বেজ্জত করা হচ্ছে, এবং জমি-জায়গা সব দখল করা হচ্ছে।”
তারা আরও প্রচার করছে, “ভারতের সংখ্যালঘুরা এখানে খুব আনন্দে আছে। তারা সংখ্যাগুরুদের থেকেও বেশি সুখ ভোগ করছে। তাদের সন্তান-সন্ততিতে দেশ ছাপিয়ে গেল। অঢেল সুখে আছে বলেই চারটে করে বিয়ে করছে আর অজস্র সন্তানের জন্ম দিচ্ছে।”
এই প্রচার উদ্দেশ্য প্রনোদিত হলেও সবাই বিশ্বাস করছে। আমি প্রতিবাদ করছি বলে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য কিছু লিখছি না বলে আমাকে গালিগালাজ করা হচ্ছে আমার ধর্ম ও জাত তুলে। কখনো বলা হচ্ছে পাকিস্তানি, তো কখনো বলা হচ্ছে জিহাদি। আমার মতোই হাজার হাজার শিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রী, চাকুরীজীবী এমনকি বিজ্ঞানীদেরও বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী, মৌলবাদী। সংখ্যা গুরুরা রামনবমীর মিছিলে অস্ত্র নিয়ে গেলেও তারা উদার, দেশপ্রেমী, মানবদরদি। হাতে তাগা ও বিচিত্র রকম মাদুলি কবেজ বেঁধে রাখলেও তারা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু সংখ্যালঘুরা নামাজ পড়লে, দাড়ি রাখলে, মাথায় টুপি পরলে, গোড়ালির ওপর থেকে কাপড় পরলে মৌলবাদী, পাকিস্তানের সমর্থক। সুতরাং পরিপূর্ণ সৎ শিক্ষক এবং সত্য শিক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষকের অভাব সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়। সমাজের একটা বিভেদপূর্ণ মানসিকতা বা অভ্যাস গড়ে উঠেছে, যাকে কোনো শিক্ষাই দূর করতে পারে না।
সারাদিন বিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের যে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করি তা মূলত মানবিক শিক্ষাই। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের শিক্ষায় পরিপূর্ণ সামাজিকতা এবং মানসিক বিকাশ সম্ভব নয়। তাই নিজের আচরণের মধ্যেই সহিষ্ণুতা, উদারতা, অকৃপণতাকে প্রশ্রয় দিতেই হয়। সাহিত্য নিজের ভাবনা ও উপলব্ধিকে প্রকাশ করার মাধ্যম। শিল্পসুষমায় ব্যক্তিচেতনাকে অনন্ত ও বৈশ্বিক চেতনায় রূপদান করাই এর কাজ। তাই শিক্ষকতার সঙ্গে সাহিত্যের একটি সামঞ্জস্য আছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। আর উভয়েই উভয়ের পরিপূরক। যে দৃষ্টিভঙ্গি আমি আমার শিক্ষকদের কাছে পেয়েছিলাম তা ছিল মানবিকবোধেরই চূড়ান্ত পরিচয়। সেই শিক্ষাকেই আমি ব্যক্তিজীবন তথা সাহিত্যজীবনের পাথেয় করে রাখি। কিন্তু সমাজ আমাকে ক্ষমা করে না। আমার নামের দোষ ধরে। আমার ধর্মের দোষ ধরে। আমার সম্প্রদায়ের দোষ ধরে। সমাজের কাছে বারবার আমাকে প্রমাণ দিতে হয়—আমি মানুষ। আমি হিংস্র নই। আমি বিদ্যাসাগর পড়াই, মধুসূদন পড়াই, আমি সৈয়দ মুজতবা আলী পড়াই। নজরুল রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ পড়াই।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on মা দিবসের কবিতা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি