| মাহমুদ নোমান |
এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থনের অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধকে যথেচ্ছা ব্যবহার করেছে স্বৈরাচার। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি এদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে শাসনে শোষণ উৎপীড়নে বৈষম্যে তৈরি দেয়াল বেশিদিন টিকবে না স্বাভাবিক; আমার পরিবারের কথা বলি আমার আব্বা আমার জন্মের এমনকি আব্বা বিয়ে করার আগ থেকে প্রবাসী ছিলেন। আমি ঘরের সেজো মানে তৃতীয় জন। আমার ছোটকাল থেকে দেখেছি আব্বা দুই বছর পরপর কয়েকমাসের ছুটিতে এসে চলে গিয়ে আবার ঐ দুই বছর পরে আসা-যাওয়া, আব্বার তেমন আদর যত্ন আমি পাইনি; আব্বা উনার পড়ন্ত বয়সে বিদেশ থেকে একেবারে চলে আসেন। দেশে আসার কিছুদিনের মধ্যে শয্যাশায়ী, তখন আব্বা খুব আস্তে এমনকি কথার মধ্যে একটা শব্দের সাথে আরেকটা শব্দ জড়ায়ে পড়তো। একদিন বললো – উনিও মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। আমার নানা সম্পর্কে প্রকাশ প্রয়াত কায়সার মিয়া ছিলেন কমান্ডার( কায়সার মিয়ার ছেলে সায়েম,যিনি ভূমিমন্ত্রী জাবেদের পিএস ছিলেন)…
এই কথা শুনে আমি কী সিদ্ধান্ত নিব বুঝতে পারিনি, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৫২ বছর পরে এসে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণে কী ঘাট ফরমায়েশি আমার সইবে না। আমার এক মামা মায়ের খালাতো ভাই জয়নাল উনিও একবার কী এক কথায় জানালো — তোর বাপও মুক্তিযোদ্ধা তো…
আব্বা সেইদিন আরও জানাল — উনাদের কমান্ডার প্রয়াত কায়সার মিয়ার সাথে দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২নম্বরের বাড়িতে গিয়েছিলেন…
একদিন আমার ছোটকালে আব্বা তখন কয়েক মাসের ছুটিতে বাড়িতে এলেন। একদিন বিজয় দিবসে নাকি কী একটা দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের লাইন ধরে কী কতগুলো উপহার কিংবা টাকা দিচ্ছে…
এই দৃশ্য দেখে আব্বার মুখে তিরস্কারের দৃষ্টি ভাব বোধ বুঝতে পেরেছি, কেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেননি এটার কয়েকটা কারণ বুঝেছি– আব্বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনও লেখপড়া করেননি হেতু সেটির মর্ম বুঝেননি,এখন বললে বলবো এটার কী কী সুবিধা নিজের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভোগ করতো, সেটি বুঝেননি…
আরেকটি কারণ উনি দেশ স্বাধীনের পরে বিদেশে বাহরাইন যাওয়া মানুষ, হাতে হঠাৎ অনেক টাকা, মুক্তিযোদ্ধাদের অল্প টাকার ভাতা নিতে নিজের মধ্যে হীনমন্যতা কাজ করেছিল…
এইসব কথা বলার কারণ হচ্ছে – আমার আব্বা মুক্তিযুদ্ধের বীর সেটি আমি জানি, এতেই অনেক খুশি আমি এবং আমার ছেলেকে জানিয়ে রেখেছি আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তবে কেন জানি আব্বা শেষ জীবনে নির্বাক,নিশ্চল থাকার মধ্যে আমার কষ্ট কিছুটা ছিল– আব্বার মুক্তিযোদ্ধার সনদ থাকলে লাশের খাটিয়ার উপরে বাংলাদেশের পতাকা থাকতো, সম্মান জানানো হতো রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়; অতোটুকু কষ্ট আমি লালন করি, কিন্তু খুব আনন্দ হয়, এক আনা সুবিধে নিইনি,আব্বা সারাজীবন প্রবাসে খেটে গেছেন, রেমিট্যান্স যোদ্ধা ছিলেন শেষজীবন পর্যন্ত এটুকু আরও গর্বের…
কিন্তু আওয়ামী সরকার এমনভাবে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ(আদতে রাজাকার ট্যাগ দেওয়ার ভয়) দিয়ে এতো সুবিধা নিয়েছে যে বেশ বিচ্ছিরি, লাখের উপরে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাদের জন্মও হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযোদ্ধা নয় তবুও ভূয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধার কোটা ব্যবহার করে অনেকে চাকরি নিয়েছে, এটি চরম অপরাধ, এটির জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ ডিবি পুলিশের হারুন! খবর বেরিয়েছে, ডিবি হারুন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কোটায় পাওয়া চাকরি অথচ উনার পিতা মুক্তিযোদ্ধা নন,এটি প্রমাণ হলে অন্তত এটির জন্যই আমি ডিবি হারুনের প্রকাশ্যে অতিসত্বর ফাঁসি দাবি করছি এবং যেসব ভূয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা উনারা বেঁচে থাকলে সর্বোচ্চ শাস্তি এবং সেসবে কোটায় প্রাপ্ত প্রতিটি চাকরি কেড়ে নেওয়া হোক; এজন্যই বুঝি হারুনকে নিয়ে কবি ফজলুল হক সৈকত লিখেছেন ‘বাংলা রিভিউ’ এর আয়োজনে,আদতে ভূয়া জনগোষ্ঠী সবসময় আতঙ্কে থাকে, তাই কয়েকজন সমন্বয়ককে সেদিন হেফাজত করার নামে মূলত টর্চার করেছিল —
ডিবি হারুন, তুমি কি ভয় পেয়েছো?
ওরা তো সংখ্যায় মাত্র ১২ জন
ইউনিভার্সিটির শিক্ষক।
তাঁদের সাথে কথা বলার সামান্য সময়ও হলো না, তোমার!
ছাত্রদের হাসপাতাল থেকে ‘হেফাজতে’ নিয়েছো বলে
শুনে, ওরা জানতে গিয়েছিল; পরিবার না-কি তোমরা
কে দিতে পারে আশ্রয় ও নিরাপত্তা!
– হারুন, তুমি কি হেরে গেলে?; ফজলুল হক সৈকত)
কবি ফজলুল হক সৈকতের উপরোক্ত কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে ২৯জুলাই ‘মৃত্যুর ঘ্রাণ ও অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে। সেখানে আরও লিখেছেন আমার পছন্দের কবি শাহীন রেজা ও আমিন আল আসাদ। কবি শাহীন রেজার কবিতা বিশ্লেষণের উর্ধ্বে, বিশ্লেষণ করার অপেক্ষা রাখে না। সহজাত শব্দ খেয়ালে যথাযথ উদ্দেশ্যে হানে শাহীন রেজার কবিতা। সহজ সরল বয়ানে কঠিন কথাকে এমনও সৌন্দর্যে সৃজিত করে আপনারই কথাসব মনে হবে–
বাতাস আজ ভারী হয়ে আছে
না সেখানে কাগজী লেবুর ঘ্রাণ নেই
নেই হৃদয় মাতাল করা কামিনী কিংবা বেলীর
চারদিকে শুধু বারুদ আর মৃত্যুর ছড়াছড়ি
একদিন একাত্তরে
তোমার দেহেও এমন ঘ্রাণ ছিল কি’না কিংবা বায়ান্ন’তে
আমার জানা’ই হয়নি
আজ লোবানে লোবানে ভারী ভোরের আজানে
শুধু মৃত্যুর ডাক শুনি
এমন মৃত্যু আমরা কি চেয়েছি কেউ
বন্দুকের নলের সামনে আমার স্বজন
তারপর তীব্র চিৎকার
ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তের ফোয়ারা
নাহ আমি আর সহ্য করতে পারি না
এই কি আমার দেশ
আমার প্রিয় জন্মভূমি
আমি ভাবতেই পারি না।
–যেখানে মৃত্যুর ঘ্রাণ; শাহীন রেজা)
এছাড়া এই শিরোনামে আমিন আল আসাদের কবিতাটি আন্দোলনরত যুব সমাজের সাহসকে আরও বেগবান করে এবং আবু সাঈদের জীবন দানকে মনে করিয়ে দেয়–
এই আমি দাঁড়ালাম বুকে গুলি করো
আমি জানি আলোকিত মৃত্যুই বড়ো
সত্যের মৃত্যু যে নেই ওরে ঠোলা!!
যত ছোড়ো বন্দুক কামানের গোলা
— মৃত্যুঞ্জয়; আমিন আল আসাদ)
স্বৈরাচারকে নিয়ে আমার অন্তর্দহন থেকে বুঝি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সাহিত্য জগতে অন্যতম ভূমিকা রাখা কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের ‘বাংলা রিভিউ’কে নিয়ে লেখালেখির সামান্য এই মেহনতি। পুরো জুলাইয়ে এমন জ্বালাময়ী সাহিত্য আয়োজনে ক্ষান্ত হননি মুহূর্তের জন্য। পুরো জুলাই মাসের শেষের দিকে এসে এই গতিবেগ আরও বাড়িয়েছেন। ৩১ জুলাইয়ের দিকে এসে পাই কবি পলিয়ার ওয়াহিদের সেই অনবদ্য কবিতাটি,যেটি সরাসরি স্বৈরাচারের দিকে আঙুল রেখে লিখিত হয়, সেটি অন্তর্দহনে পোড়া প্রতিটি যুব সমাজের কথাসবের প্রতিনিধিত্ব করে–
শিশুরা আপনাকে ভালোবাসে না
ছাত্ররা আপনাকে সম্মান করে না
শিক্ষার্থীরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে না
আপনি খুনি
আপনি হত্যাকারী
আপনি শহীদদের লাশের সঙ্গে বেইমানি করা মাদার ফাকার
আপনাকে আমরা চাই না
সত্যিই মানুষ আর আপনাকে চায় না।
আপনাকে চায় কুকুর বেড়াল
আপনাকে চায় গাধার দল
আপনাকে চায় ভেড়ার পাল
আপনাকে চায় চোর ডাকাত
আপনাকে চায় সুবিধাবাদী দালাল
মানুষ আর আপনাকে চায় না।
- মানুষের মূল্য; পলিয়ার ওয়াহিদ)
এছাড়া আগস্টের ২তারিখ এসে ‘বাংলা রিভিউ’ এই আয়োজনের ‘জুলাই ২০২৪ ও অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে কবি খসরু পারভেজ, সামুয়েল মল্লিক ও সেলিনা শেলীর কবিতা প্রকাশিত হয়। এই শিরোনামের কবিতাগুলি আমার অন্যরকম ভালো লেগেছে। শব্দের টিউনিং চমৎকার, কথা বলাতে পেরেছে ভেতরকার জিজ্ঞাসার সাথে; সাহিত্যমান বলে আলাদা না-করে বলবো আমার পছন্দসই ধাঁচের কবিতা,কেমন যেন মাধুর্য ছড়িয়ে বিপ্লবকে গহীনে আরও শাণিত করেছে —
এত ভারি বোঝা মাথায় নিয়ে যাওয়া যায় আর কতদূর?
যুদ্ধ থেমে গেছে তবু এখানে এখনো রক্তে ভেজা দ্রোহপুর।
আমাদের যেতে হবে ঘৃণার কাঁটা মাড়িয়ে কপোতাক্ষ পারে;
সূর্য ওঠার আগেই খুঁজে পেতে হবে তারে, ঘোর অন্ধকারে
দুচোখ শুধুই দূরবীণ, যা দেখে অন্যেরা দেখে না কিছুই
দেখে মরা নদী, বিষাক্ত দু’তীর, শুধু ভুল বীজে বোনা ভূঁই।
মাথায় তুলে দিলে এ কোন বোঝা নিতান্ত অসহ্য অপমান!
আবার দুহাতে তুলে নিতে হবে ফেলে রাখা সেই স্টেনগান?
উজ্জ্বল উদোম গায়ে বিস্তীর্ণ শীতের চাদর সরিয়ে দিয়ে-
আবার দাঁড়াতে হবে গেরিলার মতো বিক্ষত শরীর নিয়ে?
এমন তো কথা ছিল না, অথচ আবার কেন দাঁড়াতে হলো
মৃত্যুর দামামা হাতে প্রিয় দেশ, তোমারই মুখোমুখি বলো!
লজ্জা, ঘৃণা, লোভ, পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, হায়েনার পদধ্বনি শুনি;
দুরন্ত দুপুরে পথে পথে আজো তাই বুলেটের বীজ বুনি।
– জুলাই ২০২৪;খসরু পারভেজ)
কবি সামুয়েল মল্লিক আর সেলিনা শেলীর কবিতা মানে হৃদয় ফুঁড়ে যাবে টেরই পাবেন না–
প্রতিবাদের কথকমালা শূণ্যতায়
উপহারের শায়ক বেঁধে শুষ্ক দেহ
মানবপ্রেমে কৃষ্ণচাদর বদ্ধ দ্বার
হৃদয়মাঝে শিয়াল নাচে অবিরত
– স্বাধীনতা; সামুয়েল মল্লিক)
গ.
যখন তুমি পেতে দিয়েছিলে ওই বুক
বাড়ির কথা কী পড়েছিলো মনে তোমার!
দারিদ্র তোমাকে মেরেছিলো যে চাবুক
তা থেকে মুক্তির পথ কী ছিলো না আর!
– সাঈদের মৃত্যুর দিন লেখা কবিতা;সেলিনা শেলী)
কবি খসরু পারভেজ, সামুয়েল মল্লিক ও সেলিনা শেলীর কবিতা তিনটি এই আয়োজনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে, যেমন একটি আন্দোলনে সবার ডাক এক নয়; আমি আশা করি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ‘বাংলা রিভিউ’ এর এই আয়োজন মুদ্রিত সংখ্যা হলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অমূল্য স্বাক্ষর থেকে যাবে…