আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রলয়ঙ্করী বন্যায় মানুষ ও প্রাণীকূলের অসহায়ত্ব এবং সম্পদ ও স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতিতে দু:খে জর্জরিত অবস্থার মধ্যে আরও যাতনা যুক্ত হয়েছে। সে যাতনার কারণ দেশ থেকে পলায়নে উদ্যত তিনজন ‘বাজে’ ও ‘ইতর’ ব্যক্তির আটক হওয়ার ঘটনা। এই ত্রয়ীর একজন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক অবসরপ্রাপ্ত ‘বাজে’ বিচারপতি, যিনি মনুষ্য পদবাচ্য কিনা তাতে আমার সংশয় আছে এবং অপর দুই জন এক টেলিভিশন চ্যানেলের সদ্য চাকুরিচ্যুত ‘ইতর’ সাংবাদিক। এই যুগল স্বামী-স্ত্রী– যারা ক্ষমতাধরদের প্রশ্ন করার নামে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের নিজেদের কথা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তুলে দিতেন। পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তাদের বিন্যস্ত বাক্যগুলো যে অতিরিক্ত তৈল-চর্চিত থাকতো, তা বলাই বাহুল্য। বিচারপতির নাম মোগল সম্রাটদের দীর্ঘ ‘আবুল হোসেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক’ (নামটি লিখতে ইংরেজি অক্ষর লাগে ৪১টি)। সাংবাদিক দম্পতির নাম শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপা।
তাদের আটক হওয়া আমার যাতনার কারণ নয়, আমার যাতনার কারণ হলো, তিন ব্যক্তিই দুটি মহান পেশা ‘আইন’ ও ‘সাংবাদিকতা’র প্রতি জনমানুষের সংশয়, অবিশ্বাস ও ঘৃণা সৃষ্টিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। পেশাকে তারা সমাজে বিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শামসুদ্দিন মানিক মাত্র গতকাল বিজিবি সদস্যদের হাতে ধরা পড়েছেন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করার চেষ্টাকালে। ঘটনাটি ঘটে সিলেটের কানাইঘাট উপজিলার ডনা সীমান্তে। ক’দিন আগে শাকিল-ফারজানা দম্পতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করার সময়। এ দম্পতিকে আদালতে হাজির করা হয়েছে হাতে হাতকড়া, মাথায় বুলেটপ্রুফ হেলমেট এবং বুকেপিঠে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। আদালত উভয়ের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
শামসুদ্দিন মানিকের প্রকাশ্য কথাবার্তা ছিল চরম শালীনতা বর্জিত, সারমেয়’র স্বভাবসুলভ ‘ঘেউ ঘেউ’ এর মতো, যেকোনো ভদ্রলোকের কাছে রুচিহীন ও অশ্রাব্য এবং ‘অপ্রাপ্তবয়স্কদের’ জন্য অশ্রবণযোগ্য। এহেন একজন বাজে ব্যক্তিকে যারা হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করার পেছনে ছিলেন, যারা নিয়োগ দিয়েছেন, যিনি তার শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন, তারা সবাই জাতির কাছে অপরাধী। তিনি অবসর গ্রহণের পর যারা তাকে টেলিভিশন টকশোতে আলোচক হিসেবে ডেকেছেন, সংবাদপত্রে কলাম লিখিয়েছেন, তারাও সমভাবে অপরাধী। তিনি নিজেকে যা দাবী করতেন, তাতে তাকে যারা ব্যবহার করতেন, তারা তাকে এমনভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন যেন তিনি মহাভারতের ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের অবতার। উচ্চ আদালতে বিচারকাজে তিনি যেসব অপকর্ম করেছেন, সেসব বিচারিক অপরাধের কারণে তার অবসর জীবনে তাকে ‘কাট টু সাইজ’ করার বদলে টেলিভিশন ও সংবাদপত্র ওয়ালারা এই অসৎ লোকটিকে মাথায় তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিকে বিভাজিত রাখার জন্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
শামসুদ্দিন মানিক, যিনি বিচারপতি হিসেবে অবসর নিলেও ‘মাই লর্ড’ না হোক, আমৃত্যু ‘মাননীয় বিচারপতি’ হিসেবে সম্বোধিত হওয়ার জন্য তর্কে লিপ্ত হতেন, তার এই গরিমার অবসান ঘটেছে তার নিজের সৃষ্ট জালে আটকা পড়ে। তার পছন্দের প্রধানমন্ত্রী ও তার পছন্দনীয় দল আওয়ামী লীগ সরকারের অপমানজনক পতন হলেও তার তো পলায়ন প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল না। তিনি তো ‘আমৃত্যু বিচারপতি।’ সত্য ও ন্যায়ের অবতার। তার হাতে তো ন্যায়বিচারের প্রাচীন গ্রিক দেবী থেমিসের তরবারি। তিনি নিজের সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার যে অহমিকা করতেন, সেই সত্যই তো তার শির উঁচু করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। সরকারের পরিবর্তনে তাকে পলায়ন করতে হবে কেন? শেখ হাসিনা পলায়ন করার পর তিনি ১৮ দিন পর্যন্ত আত্মগোপনে ছিলেন। এ সময়ে তিনি তার শশ্রƒু অযত্নে বৃদ্ধি পেতে দিয়েছিলেন। দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়েই তিনি গোল বাঁধান।
কদলিপত্রের শয্যায় শায়িত তার একটি ছবি, কেউ তার কলার খামচে ধরেছে, এমন একটি ছবি এবং বাদবাকি অধিকাংশ ছবিতে তাকে দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়। তার ভাগ্যে হাতকড়াও জোটেনি। গ্রামে চোরদের এভাবে দড়ি দিয়ে হাত বাঁধতে দেখেছি। সম্ভবত বিজিবির কাছে হাতকড়া থাকে না। তার পরিধেয় বস্ত্রের কাদামাটি মাখা অবস্থা এবং আতঙ্কিত মুখভাবে স্পষ্ট যে, ধরা পড়ার আগে তিনি ভালোরকম উত্তম মধ্যমের শিকার হয়েছেন। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন যে, আগের দিন দুই যুবক তাকে মারধোর করে তার ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। আহা! একজন আমৃত্যু বিচারপতির কি অপমান। কি পরিণতি! বাংলাদেশের সমগ্র বিচার ব্যবস্থার অপমান! সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে সীমান্ত প্রায় অতিক্রম করে ফেলেছিলেন। মরণকালেই (তার বয়স মোটামুটি ৭৫ বছর) যদি তিনি জীবন বাঁচাতে উৎকোচ প্রদানের পথ বেছে নিয়ে থাকেন, বিচারক থাকাকালে তিনি নিজে যে উৎকোচ গ্রহণ করেছেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
অপমানজনকভাবে একজন অহঙ্কারী বিচারপতির ধরা পড়াই তার বাকি জীবনের জন্য যথেষ্ট শাস্তি। বিচারে কি হবে না হবে তা বিবেচ্য নয়। আমার খুব ঘনিষ্ট ছিলেন মরহুম সচিব শহিদুল আলম। তিনি যুগ্ম সচিব থাকাকালে দুনীতি দমন ব্যুরোর পরিচালক (অপারেশন) ছিলেন। উঁচু পর্যায়ের কারও বিরুদ্ধে দুনীতির অভিযোগ তদন্তকালে তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতারের নির্দেশ দিতেন। তার কথা ছিল, ‘এসব লোক এত ক্ষমতাবান যে, তারা অর্থবলে আইনের ফাকফোকড়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করবেন। কিন্তু গ্রেফতার হয়ে এক রাত থানা হাজতে কাটালেও তা সারা জীবন তার কলঙ্ক টিকা হিসেবে থাকবে। শামসুদ্দিনের ক্ষেত্রেও তা যথার্থ। তাকে রিমান্ডে নিয়ে দু’এক দফা তপ্ত হংস ডিম্ব প্রবিষ্ট করালেই তার শিক্ষা হবে বলে মনে করি।
আমার প্রায় পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে হাল জমানার কিছু সাংবাদিকের অপসাংবাদিকতা আমাকে লজ্জিত করেছে। আমি কোনো এক খ্যাতিমান সাংবাদিকের কথা প্রনিধানযোগ্য কথাকে আমার মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। তার কথা সঠিকভাবে মনে না থাকলেও মোটামুটি এরকম: “সাংবাদিক তারাই, যারা রাজাকে রাজকার্য শেখায়, আর্কিমিডিসের বিজ্ঞানে ভুল নির্দেশ করে এবং নিউটনের গণিতে প্রমাদ খোঁজে।” কিন্তু ফারজানা রূপা ও শাকিল আহমদের মতো কিছু সাংবাদিকের ‘জি হুজুরী’ ও ‘তৈলমর্দন’ আমার প্রিয় পেশাকে কলঙ্কিত করেছে। মানুষের কাছে সাংবাদিকের যে সম্মান এবং সাংবাদিকতার যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তা ধ্বংস হয়েছে। তাদের অপসাংবাদিকতার পথ যাতে কেউ অনুসরণ না করে সেজন্য চাটুকারিতায় সেরা এই যুগলকে দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে নিয়ে তাদের দেহের জায়গামতো মুরগির ক্ষুদ্রাকৃতির ডিমের পরিবর্তে রাজহংসীর ডিম্ব ও লাল মরিচের গুড়া ইস্তেমাল করা যেতে পারে।
আমি বিস্মিত হয়েছি ডেইলি স্টারের সম্পাদক ভারত-প্রেমিক ছুপা রোস্তম মাহফুজ আনাম এরই মধ্যে তার নিজস্ব কলামে সাংবাদিক দম্পতির পক্ষে উকালতি করেছেন। ‘সিপিজে’ (কমিউনিটিজ টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস) এবং ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ তাদের আটক করার প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা এসব করতেই পারে। প্রতিবাদের নামে অপসাংবাদিকতা পথ খুলে দেওয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাদের উকালতি ও প্রতিবাদ গঠনমূলক হওয়া উচিত।