spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার 'বাংলা রিভিউ' : পর্ব--৭

ধারাবাহিক আলোচনা : মাহমুদ নোমান

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার ‘বাংলা রিভিউ’ : পর্ব–৭


| মাহমুদ নোমান |

ঘৃণাতেও এক ধরনের টান থাকে,যে-কোন কিছু কিংবা যে কাউকে ঘৃণা করবেন,সেজন্য আপনার মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ অথবা উগ্রতার শ্বাস-প্রশ্বাস থাকে অন্তত সে ঘৃণার জন্য উনাকে ভাবতে হয়; আর আমি করি কী ঘৃণার কথা ভাবনাও আসে না। আমি এড়িয়েও যাই না,যাঁকে কিংবা যে মতে আমার মন টানে না সেটা আমার আশপাশে থাকলেও ভাবি না আছে,এতে নিজের কাজ করতে পারি,সাধনার হেরফের হয় না। পারলে ঘৃণিত ব্যক্তিকে ভালোবাসবো,এই তো…

কথাগুলো বলছি এই কারণে আমার আশপাশে এমনকি চেনাজানা সুসম্পর্কের অনেকের এতো উগ্রতা, সেটি ধর্মের, কিন্তু উগ্রতা হলো অধর্ম; একটু খেয়াল করলে দেখবেন যাঁরা হিন্দু ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা, তাঁর মধ্যে ইসলাম নিয়ে উগ্রতা; এমনি যাঁর ইসলামের মানুষের প্রতি ঘৃণা, তাঁর মধ্যে হিন্দু নিয়ে উগ্রতা; আমি মনে করি যাঁর নিজ ধর্মের প্রতি একান্ত ভক্তি সে অন্যের ধর্মের মানুষকে নিয়ে ঘৃণা করার ভাবনাতেও থাকে না। বাংলাদেশে নিজেকে অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি মনে করা ব্যক্তিকে দেখি ইসলামকে নিয়ে কটাক্ষ করতে, এরা খুব বাজে লোক। আপনার ভালো লাগে না আবার যেটা ভালো লাগে সেটা চাপিয়ে দেওয়া কিংবা দিতে চাওয়াটা চরম মূর্খতা, এটা নিজ নিজ ধর্মের ইজ্জত বিনষ্ট করা; ইসলাম মানে তো শান্তি, তাহলে উগ্রতা কোত্থেকে আসে এতো! উগ্রতা থাকলে তাহলে আপনি ইসলামে নেই, আপনার মনে শান্তি নেই, যেই মনে শান্তি নেই, সেখানে আল্লাহও থাকে না…
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অর্জিত স্বৈরাচার পতনে ধর্মীয় উগ্রতা চোখে পড়ার মতো। আপনি নেতা হতে চাইলে সবাইকে এক দেশের লোক মনে করতে হবে। যে দোষী তাকে জনসমক্ষে এনে দেখাতে হবে এই এই অপরাধ, প্রচলিত আইনে বিচার হবে,সহিংসতা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়; আমি বিশ্বাস করি আমার মতো কেউ কোনোদিন জীবনে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে বলে যাবে– শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০কোটি ডলার চুরি করেছে,তাঁদের ছায়াকেও যেন সমর্থন না-দেয়, সেটিকে প্রমাণ করে যদি জনসমক্ষে উত্থাপন করা যায় যথার্থ। উগ্রতার জয় ক্ষণিকের আর ভালোবাসার জয় চিরদিনের… আমি মনে করি এখন যোগাযোগ ও প্রচার ব্যবস্থা অনেক উন্নত, মুহূর্তেই প্রচার করা যায়। কিন্তু তলে তলে তাঁরা খেয়েছে আপনারাও তাদের ঘেউ ঘেউ করে খেয়ে যাবেন সেটি কাম্য নয়…
কথা ছিল বৈষম্য বিরোধী, কথা ছিল স্বাধীনতার এতোদিন পরেও দেশে শ্রেণী বিভাজন লোপ, নিশ্চয় স্বৈরাচার পতনে আপনারা নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ বলে নতুন শ্রেণীকরণে কোটার সুবিধায় চলবেন,তাহলে বারবার মুক্তিযুদ্ধ হতেই থাকবে…
উপরোক্ত কথাসব বলার কারণ অবশ্যই আছে কেননা বুদ্ধিবয়স থেকে আমি শুধু কবি হতে চেয়েছি। মানুষের মঙ্গলের জন্য নয় শুধু ভালোবাসার বিরোধী এসব কিছু দেখলে ভেতর থেকে তাগাদা পাই যেন; একজন কবি একটা দলের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে,কিন্তু দালাল নয় আর বন্ধু হলেই যে শুধু প্রশংসা করতে হবে এমন নয়,ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া বন্ধুগুলো উৎকৃষ্ট। ভুল ধরিয়ে দিলে আপনি ক্ষেপে গেলেই স্বৈরাচারী। কবিতা লিখি বলেই তো এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে কবিদের ভূমিকায় নিয়ে লিখতে তাগাদা পেয়েছি…
স্বৈরাচারী সরকারের সবচেয়ে দৃষ্টিকটু বিচ্ছিরি ব্যাপার ছিল শুধু নিজের গদি ঠিক রাখতে ভারত যা বলে এমনকি পোদ ধুয়ে দিয়েছে, বর্ডারে দেশের মানুষ মরুক,দেশের সম্পদ লুট হোক গিয়ে আর একটা কথা অপরাধ না-করলে এতো ভয় কেন, মানুষ এতো ক্ষিপ্ত কেন এবং শেষমেষ পলায়ন…! বন্ধু রাষ্ট্র হলে তো চাপে রাখবে না কোনও স্বার্থে, চুষে খাবে না বরঞ্চ বন্ধুরাষ্ট্রকে আগলে রাখবে, অধিকার আদায়ে সুবিচার করবে এটাই তো বন্ধুত্ব; এক্ষেত্রে কবি আবু জাফর সিকদার ‘বাংলা’ রিভিউ’ এর আয়োজনে ১০টি কবিতার মধ্যে ‘শিকার ও শিকারী’ কবিতাটি এসব কর্মকাণ্ডের যথার্থ উপমায় সরল বয়ানে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি একেবারে খাপেখাপে মেলানো কথাগুলো বলেছেন চমৎকার অন্তমিলে শব্দিত সৌন্দর্যে–

দাদার খেলা খেলছে দাদা দিদির খেলা দিদি
নদীর জলে হাসবে স্বদেশ নয় তো সহায় বিধি।
আশায় আশায় বুক বেঁধেছি পাবো জলের হিস্যা
শেষ হয় না দাদা দিদির বারো মাসি কিচ্ছা!
ধানাই-পানাই করছে সদা মধু কেবল ঠোঁটে
পড়শি মরে মরুক তবে জল দিবে না মোটে!
চারিদিকে ঘেরাটোপে কাঁটা তারের বেড়া
মন্দ কপাল, আমরা সবাই বেল তলার সেই ন্যাড়া।

জ্যৈষ্ঠ মাসে আম দিলাম বর্ষা মাসে ইলিশ
রসিক বন্ধু কালা সোনা অন্তরে ক্যান বিষ?
বারো মাসের তেরো ছুতোয় দিলাম কতো ছাড়ও
আমার বেলায় উল্টো কষে প্যাঁচটা ঠিক-ই মারো।
প্রতিরোধে জ্বলবে আগুন জাগবে যবে বোধে
দিনে দিনে বাড়ছে দেনা দিতে হবে শোধে।
– শিকার ও শিকারি; আবু জাফর সিকদার)

‘বাংলা রিভিউ’ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যে ভূমিকা রেখেছে এককথায় অতুলনীয়। সাহিত্য মানেও সম্পাদক কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের কথা মনে রাখার মতো। ৩১জুলাই প্রকাশিত হওয়া আবু জাফর সিকদারের ১০টি কবিতায় শব্দের সচেতনতা আর সজাগ বোধ খেয়ালের মধ্যে স্পন্দন বিবেকবান মানুষকে স্পর্শ করবেই…
এছাড়া ২৯জুলাই কবি তাজ ইসলামের ‘বাংলা বসন্ত’ দীর্ঘ কবিতাটি তেজোদ্দীপ্ত উচ্চারণে স্বতঃস্ফূর্ত ইতিহাস-চেতনা বোধের কৌমার্যে প্রকাশিত; স্বাধীনতা নামে আমরা আদতে ফাঁপর বাজিতে পড়ে গেছি। সিস্টেমের মধ্যে শোষণ বঞ্চনায় নিপীড়িত হওয়াকে আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে তাজ ইসলামের ‘বাংলা বসন্ত’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতাটি লিখেছেন আন্তরিক বলনে; কবিতাটি আবৃত্তিযোগ্য নিঃসন্দেহে, সময়ের দাবি রাখে–

জেনে রেখ রাক্ষসপুরীর রাণী
এই আগুনে তোমার শাড়ি ও সিংহাসন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, আজ অথবা আগামীকাল।

যারা মাতৃভূমির পবিত্রতা রক্ষার শপথ নিয়ে এসেছে।
আশা করি তারা ফিরবে নিশ্চিত করে
তোমার লজ্জাজনক পরাজয়।

শহীদের রক্তের কসম
শহীদের সাথীরা রক্তের সাথে বেইমানী করে না।
আর খুনীর সাথে করে না তারা কখনও আপোষ।
বাংলা বসন্ত তুলেছে দেহে দেহে রক্তের জোয়ার
বুলেট বোমা পায়ে দলে
তারা খুলবেই খুলবে আলোর দুয়ার।
— বাংলা বসন্ত; তাজ ইসলাম)

৩০জুলাই প্রকাশিত আবদুল হাই শিকদারের একগুচ্ছ কবিতায় শাণিত বোধ বিশ্বাস আর উনার শব্দের সাথে শব্দের মজবুত বাঁধনে বৈষম্য বিরোধী ডাক আর আন্দোলনে নিহত আহত নির্যাতিত প্রাণের জয়গান উচ্চকিত করেছেন; ‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতাটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি এই ‘বাংলা রিভিউ’ এর আয়োজনে–

আমরা মানুষ আমরা এসেছি অনাদি অতীত উদয়ের পথ ধরে
আমরা এসেছি হাজার হাজার বছরের ধূলি পায়ে
আমরা এসেছি নিযুত কালের পুঞ্জিত ব্যথা হয়ে
আমরা এসেছি মেসোপটেমিয়া গিলগামেশের মতো
আমরা মানুষ আমরা এসেছি দাস বিপ্লব করে
–আমরা মানুষ আমরা এসেছি; আবদুল হাই শিকদার)

‘বাংলা রিভিউ’ এর আয়োজনে কবি ফরিদ ভূঁইয়ার তিনটি কবিতা প্রকাশিত হয় ১আগস্টে। ফরিদ ভূঁইয়ার কবিতার মধ্যে মর্মস্পর্শী চালচিত্র নির্মোহ দৃষ্টিতে ভেতরে নিয়ে দেখাতে পারে ক্ষত, শব্দের আকুলতা উদযাপন চমৎকার —

বিংশ শতাব্দীর পরিক্রমা–
ভাষার বায়ান্ন
উর্দি ছেঁড়ার ঊনসত্তর
স্বাধীনতা সংগ্রামের একাত্তর
তারপর, আবারও উর্দি ছেঁড়ার নব্বই…

প্রতিবারে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন বাজির বীরের লড়াই–
আবু সাঈদের বুক সে বিশ্বাসে নতুন শোভায়;
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেখেছ সবাই
পর পর গুলিবিদ্ধ, তবু সে সটান–সাহসে সুঠাম বাংলাদেশ !
– তুমি ও বাংলাদেশ; ফরিদ ভূইয়া)

ফরিদ ভূঁইয়ার কথায় বলতে পারি বাংলাদেশ সুঠাম দেহের,সটান দাঁড়িয়ে যাবে বৈষম্য দূর করতে…

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
আমিনুল ইসলাম on কবিতাগুচ্ছ
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ