spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধমানসকুমার চিনি : বিবর্ণ পাণ্ডুলিপির কবি

লিখেছেন : তৈমুর খান

মানসকুমার চিনি : বিবর্ণ পাণ্ডুলিপির কবি

তৈমুর খান

চলে গেলেন মানসকুমার চিনি (১৯৬৫—২০২৪)। অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থের নাম আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
নোনাবালি (১৯৯০), স্রোতের ছায়া (১৯৯৩), নতজানু চিররাত্রি (১৯৯৪), জার্নাল (১৯৯৫), পাখিদের জন্য আয়না (১৯৯৬), ঘুম রোগের খাদ্যতালিকা (১৯৯৭), ঢেউ সমগ্র (২০০০), একক সংগীতসন্ধ্যায় (২০০৫), স্বপ্নের পুনর্বাসন (২০০৬), শারীরিক সংকীর্তন (২০০৭), শরণার্থী শিবিরে কীর্তুনীয়া (২০০৮), অক্ষরের জাদুবিদ্যা (২০০৯), পোড়া শরীরের মায়া (২০১০), ফকিরের দোতারা (২০১), পাণ্ডুলিপি রক্ত হয়ে আছে (২০১০), দেখে এলাম কারিগরের হাট (২০১৩), স্বপ্নলেখার কবিতা (২০১৩), রেলব্রিজে সন্ধ্যা (২০১৪), পথের পুরোনো ধুলো (২০১৪), সন্ন্যাসীর স্তব (২০১৪), হলুদ তুলোট পাতা (২০১৪), পটুয়াপাড়ার ঈশ্বর (২০১৫), পালকি চড়ে পরি (২০১৫), রেশমাকে লেখা কবিতা (২০১৫), রেশমা এবার পরচুলা খুলে রাখি (২০১৬), ছায়া বনে বনে (২০১৭), কী কথা তাহার সাথে (১৪২৪), অজ্ঞাতবাস কবিতাগুচ্ছ (২০১৭), ধ্বংসস্তূপের স্মৃতি (২০১৮), স্তব্ধ আলো, নিকটে এসো (২০১৮), স্বপ্নপূরাণ (২০১৯), আত্মরক্ষার অস্ত্র রেখেছি খামারে (২০১৯), পথের শেষে দেখি (২০১৯), বিষণ্ণ প্রেমিকার বেহালা (২০২০), ছায়াযুদ্ধ (২০২০), ছিন্ন পদাবলি (২০২২), আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন (২০২২) প্রভৃতি।
১৪০৫ বঙ্গাব্দে মানসকুমার চিনির সঙ্গে একবার তাঁর রেল কোয়ার্টারে যাবার সুযোগ হয়েছিল। প্রথম আলাপেই বুঝেছিলাম তিনি কতখানি কবিতা পাগল। আসলে কবিতাই তাঁর আশ্রয় ছিল। কবিতার কাছেই তিনি বিশ্রাম নিতেন। কবিতার কাছেই ভালবাসা চাইতেন। তাই প্রথম যৌবনের সমস্ত উদ্দামতা কবিতার কাছেই নিবেদন করেছিলেন। তাচ্ছিল্য করেছিলেন জীবনের যাবতীয় পার্থিব সুখ। যাকে তিনি রচনা করতে চেয়েছিলেন সে তো তাঁর ‘পাষাণ প্রতিমা’:
“গভীর রাতে নেমে আসে
আমার চিন্ময়ী—
আমি তার বন্দনা করি
চরণে মাথা রাখি
আর বলি—কেড়ে নাও
আমার জ্বালা যন্ত্রণা ও ভালবাসা।

চিন্ময়ী আমায় দেখে আর কাঁদে
চিন্ময়ের ঝরে পড়া জলে আমি
দেখি ক্ষমার নিঃশর্ত বাণী
দুই হাতের পাপ ঢেলেছি সাগরে
সমুদ্র মন্থনে উঠে আসে মাটি খড় তুষ
আমি গড়ি পাষাণ প্রতিমা।”
‘নোনাবালি’ কাব্যের এই উচ্চারণেই তাঁর কাব্য নির্মাণের মূল শর্তটি এখানেই খুঁজে পাই। কাব্য নির্মাণে যে সমুদ্র মন্থন তিনি করেছেন তা জীবনসমুদ্র। জীবনের নোনা জল ঘেঁটে যে স্বাদ তিনি পেয়েছেন তা তিক্ত বিষাদে ভরা। তাই মাটি খড় তুষ উঠে এসেছে আর মানবজন্মের পাপ তিনি সেই সমুদ্রেই বিসর্জন দিয়েছেন। এই চিন্ময়ী রূপের মধ্যেই আছে আটপৌরে তুচ্ছ ও ছেঁড়াখোঁড়া জীবনের অভিমান ও সংরাগ। তাঁর সমূহ সৃষ্টিতেই বিষাদ চালিত অভিমানের বার্তা এইভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। সুন্দরের কাছে গেলেও তা আর সুন্দর থাকেনি। চাঁদের কাছে গেলেও তা চূর্ণ আগুন হয়ে ঝরেছে। সুতরাং ‘বিবর্ণপাণ্ডুলিপি’-ই তার পরিণতি—
“কৃষ্ণচূড়ার তলায় গেলে প্রতিটি
অঙ্গে পাই বারুদের গন্ধ, কোন
নেশার তাড়নায় এখানে এসে
জ্বলছে আমার আমি?
আমি উদ্ধার করি বিবর্ণপাণ্ডুলিপি”
সমস্ত জীবন ধরে জ্বলতে জ্বলতেই তিনি যা রচনা করেছেন তা ছিন্ন-বিছিন্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ বিবর্ণপাণ্ডুলিপি হয়েই আত্মস্ফুরণের অভিমুখে উপস্থিত হয়েছে। কাব্যের গাম্ভীর্য নিয়ে, আলংকারিক কারুকার্যে জবরজং হয়ে তার ওজস্বিতা পূর্ণ করতে চায়নি। বরং সারল্য আর সংকেতবদ্ধ গুটি কয় শব্দ ও ভাঙা পংক্তির বিন্যাসে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে বিবর্তিত হয়েছে । তথাকথিত গৌরবময় প্রতিভার স্বাক্ষর নিয়ে তিনি নিজেকে উচ্চকিত আসনে বসাতেও চাননি। বরং মাটির কাছাকাছি, তাঁর রেল-জীবনের যান্ত্রিক কর্কশতায় ম্লান হয়ে আসা ধূসর পৃথিবীতে প্রবেশ করেছেন। নিজের ক্লান্ত জীর্ণ মুখ, নিজের ভাঙা সত্তার নীরব দীর্ঘশ্বাস দর্শন ও শ্রবণ করেছেন। তাই তাঁর কবিতার গায়ে তাঁর শরীরের গন্ধ, তাঁর দগ্ধচেতনার ঘ্রাণ, তাঁর শূন্য জীবনের বেদনার পরিধি পরিমাপযোগ্য হয়ে উঠেছে।
যে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তিনি জীবনকে গড়তে চেয়েছিলেন, সেই সম্পর্ক কখনো খুঁজে পাননি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রাষ্ট্রীয় আইন সবকিছুই অন্তঃসারশূন্য, মানবরসায়নের যোগ্য কোনো সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারেনি। কাছাকাছি এসেও সবাই যেন দূরের মানুষ। হাত ছুঁয়েও সবই যেন ছদ্ম-হাত। শেষ পর্যন্ত জীবন শূন্য, মিথ্যা ও ভ্রান্তির আড়ম্বরে পূর্ণ। ‘একক সংগীতসন্ধ্যায়’ কাব্যে তাই লিখেছেন:
“মন্ত্র ওড়ে, শব্দ স্রোতে ভাসে
কলম তুমি রক্ত চেনাও
অজ্ঞাত পরিচয়ে।

গড়িয়ে আসে কিছু কথা
ব্যথাগুলি ভাসিয়ে দিয়ে
অনন্ত আত্মায়।

কী দারুণ শোকে দু’কূল
ভেসে ওঠে, সম্পর্ক জুড়েই
এতদিন বসবাস ছিল।”
সম্পর্ক জুড়ে বসবাস থাকলেও, শাস্ত্রের মন্ত্র থাকলেও, আইনের বাঁধন থাকলেও কোনো কিছুই সদর্থক হয়ে ওঠে না। জীবন তার নিজস্ব নিয়মেই একাকী। তাই অনন্ত আত্মায় সে মিশে যেতে চায়। তখন চোখের পাতায় রোদ চলে গেলেও বিকেলের আলো গুঁড়ো হয়ে হৃদয়ের চারিপাশে পতিত হয়। তখনই কোনো বাউল এর জন্ম হতে পারে। নিসর্গ চেতনায় পাখিসত্তার মতো জীবনও তার বাসা খুঁজতে থাকে। ছোট ছোট মেঘের পাল তখন বুকে এসে জমা হয়। চাপা কান্না, স্বপ্নভাষা পেণ্ডুলাম হয়ে দুলতে থাকে। তখন প্রেমও আধ্যাত্মিকতায় তার উত্তরণ খুঁজে পায়। কবি লেখেন:
“তোমার ভেতর এই মৌন আয়োজন
ভেবেছি মনের এত কথা পাখিবন্দরে
ঝাঁক ঝাঁক জনশ্রুতি তেপান্তর পেরিয়ে
কার কপালে টিপ দিয়ে যায়।”
মনের কথা পাখিবন্দরে জমা হলেও ঝাঁক ঝাঁক জনশ্রুতি তেপান্তর পেরিয়ে পাড়ি জমিয়েছে। আসলে বিশ্বাস ও সংস্কার আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রকে কিংবদন্তির সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে। কবি সেখানেই তাঁর আয়োজন সম্পূর্ণ করতে চেয়েছেন।
দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ কবিকে যেমন স্মৃতিকাতর করেছে, তেমনি দুর্ভেদ্য একাকিত্বে সুউচ্চ প্রাচীর তুলে দিয়েছে। অতলান্ত শূন্যতার ভেতর নিজেকে নিক্ষেপ করেছেন। দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম এলোমেলো হয়ে গেছে। রক্তক্ষরণের তীব্র অবসেশনে ডুবে গেছেন। সে কথাই লিখেছেন ‘হলুদ তুলোট পাতা’ কাব্যে:
“বিয়ে হয়েছিল আমার
পুরোহিত এসেছিল ছাদনাতলায়
ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বলে

একদিন ঘর শূন্য করে
রাত আসে, দিন যায়
বারান্দায় শুয়ে থাকে বিড়াল

রান্নাঘর ফাঁকা কেন?
আনাজের ভেতর গলে গলে
রক্ত পড়ছে, জমাট রক্ত

সে চলে গেছে কুণ্ডলীর ভেতর”
আনাজের ভেতর রক্ত পড়া, জমাট রক্ত কবির মনন বিক্রিয়াকে তুলে ধরেছে। একদিকে কষ্ট ও শূন্যতার ক্ষত কতখানি নিরাময়হীন হয়ে উঠেছে তা এখানেই বোঝা যায়। জীবনের সংরাগ সূচনা ছিল, কিন্তু তা অপূর্ণতায় দিশেহারা পরিণতির শিকার হয়েছে। তখন শব্দের কাছেই আশ্রয় চেয়েছেন।চেতনাকে অনন্তের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ঘুমের ভিতর বিষ ঢেলে দিলে প্রেমিকাও নীল বর্ণ হয়ে গেছে। আর তখনই ব্রহ্মযোনির খোঁজ পেয়েছেন কবি—
“সুগন্ধ যোনির ভেতর ঠান্ডা বাতাস
রুমাল উড়ছে
ঘুম এসে যাবে

বাতাস ভেসে আসছে আকাশ থেকে
আকাশে রাত্রি ঠোঁট ছুঁয়ে
কে যেন রমণ করছে”
জীবন ও মৃত্যু এখানে একাকার। যে ঘুম আসবে তা নবজন্মের ঘুম। নবজীবনের উৎসের কাছে কবি পৌঁছে গেছেন। তাই সুগন্ধ যোনির ভেতর ঠান্ডা বাতাস উপলব্ধি করেছেন। আর এই বাতাসের ব্যাপ্তি আকাশময়, যেখানে আকাশও রাত্রির ঠোঁট ছুঁয়ে রমিত হচ্ছে। এই অনন্ত স্রোতের কাছেই কবির নিবেদন। তাই ‘পোড়া ছাই’ হয়েও শূন্যে সুখের নীরবতা এবং গ্রহ নক্ষত্রের রং মেখে দাঁড়িয়ে থাকা উপলব্ধি করেন। জীবনের আশ্চর্য উত্তরণে এভাবেই মুক্তির সোপান রচনা করেছেন। বিষণ্ণ সময়ের কলরব শুনতে শুনতেই আলো ও ছায়ারাশির ভেতর চৈতন্যের সাথে খেলা শুরু করেন। এক মগ্নতার গভীর সমুদ্রে কবি নিক্ষিপ্ত হন। সেখানে আবারও সেই মগ্ন ছবি অবচেতনের আলোকে জেগে ওঠে। ‘পথের পুরোনো ধুলো’ কাব্যে লেখেন:
“নিজের ছায়ার সাথে যে পাখি ওড়ে
গাছের ডালে দেখি
কোনো এক পাড়ায়
প্রেম হয়ে যায়
দু-একটি কদম গাছ
পরিদল এসেছে আজ
কত ময়ূর ছুটে আসে গাঢ় নীলখেতে।”

এই ছবি তখন বাস্তবতাকে অতিক্রম করে। মনন জগতের এক বিস্ময়কর চিত্রকল্পে আত্মমুক্তির পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে মানসকুমার চিনি চিরাচরিত ধারায় কবিতা লিখতে চাননি। অর্থ বা বিষয়ভিত্তিক ছন্দ ও ধ্বনিসাম্যের একমুখিনতাকেও তিনি উল্লঙ্ঘন করেছেন। তিনি জনপ্রিয় কবিতা লিখে জনপ্রিয় কবি হতে চাননি বলেই নিজের মতো পথে নিজেকে চালিত করেছেন। যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব যাপন তাঁর জীবনে ঘটেছে, কবিতাতেও এসেছে সেই দুর্মর বিচ্ছিন্নতা। জীবন ইতিহাস সময় তাঁর চেতনায় অবিমিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। নিরন্তর বিষাদের ভেতর নিজ স্বরূপকেই অন্বেষণ করেছেন। সেখানে—
“চোখের ভেতর ভাঙা দ্বীপ
আলো পড়ে নিভে যায়
নিজের ছায়ায়।”
সুতরাং নিজ স্বরূপও উন্মোচিত হয়নি। এক অসামঞ্জস্য অপূর্ণতার ঘোর, অর্ধ ও বিস্ময়কর চেতনা স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ