১. বাংলা রিভিউ : জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?:
আমিনুল ইসলাম: জীবন হচ্ছে অন্য অনেক জীবনকে হত্যা করে নিজে বাঁচতে চাওয়া আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাওয়া। জীবনের খাদ্য হচ্ছে অন্যের জীবন—প্রাণী অথবা উদ্ভিদ। মানুষ পৃথিবীতে আসে বুক পকেটে নিয়ে মৃত্যু সার্টিফিকেট। সেখানে মৃত্যুর তারিখ, সময় ও স্থান লেখা থাকে । কিন্তু মানুষ তা পড়তে পাারে না। আর তার নিয়ন্ত্রণহীন পথচলার জন্য ফুয়েল স্বরূপ লাগে খাদ্য, পানি এবং আরও অনেক কিছু। পথ চলা তার মধ্যে একধরনের নেশা ও সম্মোহন সৃষ্টি করে । তার মধ্যে সৃষ্টি হয় নানাবিধ লোভ। সে চুরি করে, ডাকাতি করে, ঘুষ খায়, লুণ্ঠন চালায়, অপহরণ করে। সম্পদের পাহাড় রচনা করে এবং ক্ষমতার সিংহাসন বসায়। কিন্তু বাস্তবে এতকিছু তার লাগে না। মানবজীবনের এই ভুল যাপন নিয়ে আমি লিখেছি ‘‘ বোমাবাঁধা মানুষ’’ নামে একটি ছোটো আকৃতির প্রতীকী কবিতা। বোমা হচ্ছে মৃত্যুর প্রতীক। কোমরে আত্মনাশী বোমা বাঁধা অথচ মানুষ সেটা নিয়ে ছুটে চলে লোভের গন্তব্যমুখী আর যাত্রাপথে এটা ওটা কুড়িয়ে নিয়ে, চুরি করে, লুট করে ভরে তার কাঁধের বোঝা যা শেষ পর্যন্ত তার কানো কাজে লাগে না। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো প্রাণী জীবনকে এমন ভুলের চোখে দেখে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া ছিলো আমার লক্ষ্য। আমি প্রচলিত অর্থে ভালো ছাত্র ছিলাম। ছাত্রজীবনে স্কলারশীপ লাভ, বোর্ডে স্টান্ড করা– এসবই আমার দখলে ছিলো। আর ক্লাসে ফার্স্ট বয়। কিন্তু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি বলে বিজ্ঞান পড়িনি। সাহিত্যের শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য নিয়োগপত্রও লাভ করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়ি। আমার আর শিক্ষকতা করা হয়নি। তবে এখন সেটা নিয়ে কোনো আফসোস নেই। আমি দীর্ঘদিন ঘনঘন বদলিযোগ্য সরকারি চাকরি করার সুবাদে সরকারি অর্থে ও কাজে সারা বাংলাদেশ দেখেছি। বিদেশের অনেক দেশও দেখেছি। প্রায় সকল শ্রেণির এবং সকল স্তরের মানুষকে কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে আমার সরকারি চাকরি। আমার লেখালেখিতে পড়েছে তার গভীর ইতিবাচক প্রভাব। লেখক হিসেবে আমি মোটামুটি পরিচিত। আর জীবনে পূর্ণতা বলে কোনোকিছু নেই। ব্যর্থতা বলেও কোনোকিছু নেই। তারপরও কিছু কিছু কাজ করতে না পারার কষ্ট আছে মনের মধ্যে। উৎকৃষ্টমানের বেশ কিছু কাজ করতে চেয়েও করতে পারিনি। আমার সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা তো ছিলোই, তারচেয়ে বেশি ছিলো অনুকূল পরিবেশ ও সময়ের অনুপস্থিতি। কিন্তু সেসব নিয়ে আর ঘুম হারাম করি না। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি: “ জীবনের যত পূজা হলো না সারা, জানি হে জানি তাও হয়নি হারা ।’’ তো আমি আমার জীবনকে উপভোগ করি অন্য কারও সামান্যতম ক্ষতির কারণ না হওয়ার চেষ্টা ঠিক রেখে। জীবন ক্ষণস্থায়ী । জীবন নিয়ে গর্ব করা বোকামি। আর প্রতিটি কথিত সফল মানুষের সাফল্যের পেছনে থাকে সমাজের বহু মানুষের দৃশ্যমান বা অদৃশ্য সম্মিলিত অবদান; তার সাথে অবদান থাকে অন্যান্য প্রাণীর এবং প্রকৃতির। তার মানে কোনো সাফল্যই কোনো মানুষের একক সাফল্য নয়। তাহলে গর্ব করার কী আছে? হ্যাঁ, ভালো লাগার একটা ব্যাপার থাকতে পারে। থাকে। আমারও আছে। মানুষ কত কী চায়! আমিও চেয়েছি। সব চাওয়া পূরণ হওয়া অসম্ভব। সেটা আসলে একইসঙ্গে অপ্রয়োজনীয়ও। কত মানুষ মায়ের পেটেই মারা যায়! কত মানুষ শিশুকালে মারা যায়। কত মানুষ মাঝপথে মারা পড়ে। আমি ৬০ বছর পেরিয়ে এখনও বেঁচে আছি সবল অবস্থায় এবং অটুট সৃজনশীল ক্ষমতায়। কীসের অনুশোচনা! আমি কৃতজ্ঞ জীবনের প্রতি—জীবন দেনেওয়ালার প্রতি।
২. বাংলা রিভিউ: আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোনো অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পড়ে? তাড়িত করে?
আমিনুল ইসলাম: আমার শৈশব-বাল্যকাল-কৈশোর পুরোটাই বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এবং অনন্য। আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পদ্মা-মহানন্দা-পাগলা-পাঙ্গাশমারী নদীবিধৌত টিকলীচর নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করি সেই পাকিস্তান আমলের ষাটের দশকে। আমাদের ছিল একটি সাধারণ ও সচ্ছল কৃষি পরিবার। আমরা ধনী কৃষক পরিবার ছিলাম না। তবে আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ জমি ছিলো। নিজেদের হালের বলদ ছিলো। অনেক ছাগল ছিলো। আমি এসএসসি পাস করে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত সবধরনের কৃষিকাজ করেছি নিজহাতে। আমি ছাগল-গরু চরিয়েছি মাঠে। স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি। মারবেল খেলায় ওস্তাদ ছিলাম। শুধু জিততাম। খেলতাম পয়সাও। কাবাডি, ফুটবল, গাদ্দি( দাঁড়িয়াবাধা), বুড়ি, ভেল কুতকুত– ইত্যাদি সব খেলা খেলেছি। নদীতে সাঁতার কাটায় দক্ষ ও দুঃসাহসী ছিলাম। নৌকা ছিলো বর্ষাকালের সঙ্গী। তার সাথে কলার ভোঁড় বা ভেলা। রেডিওতে গান। আবদুল আলীম, নীনা হামিদ, ফেরদৌসী রহমান । পরে সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, রুনা লায়লা, খুরশিদ আলম, সৈয়দ আবদুল হাদী, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, মাহমুদুন নবী। কলের গান। মাইকে বিয়ের বাড়ির গান। স্থানীয় যাত্রাপালা। আলকাপ গান। কবিগান। ‘রূপবান’, ‘গুনাইবিবি’, ‘কাঞ্চনমালা’, লাইলী মজনু’ প্রভৃতি যাত্রাপালার গান শুনে দেওয়ানা রাত– দেওয়ানা দিন। রেডিওতে অনুরোধের আসর। কবে প্রচারিত হবে কবি জসীমউদদীনের “ মধুমালা’’ আর ‘‘বেদের মেয়ে’’ নাটক? একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। সীমান্ত এলাকায় বাড়ি। যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। থ্রি ব্যান্ড ইন্ডিয়ান রেডিও। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের গান। নাটক। চরমপত্র। আকাশবাণী কোলকাতা থেকে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের ভরাট কণ্ঠে সংবাদ পাঠ। স্বাধীনতার পর সীমান্ত খোলা। অবাধ যাতায়াত। বাংলাদেশ থেকে পাট, মাষকালাই, পিতল, তামা, কাঁসা ও ধাতব পদার্থের জিনিস ভারতে বাধাহীন ও বিবেচনাহীন পাচার । ভারত থেকে গরু আর বোম্বে প্রিন্টের শাড়ির অবাধ প্রবেশ। এলাকায় মারামারি। ডাকাতি। চর এলাকার গ্রাম্য কাজিয়া যাকে বলে লাঠিয়াল বাহিনীর মারামারি। এখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এটা ব্যাপক হারে ঘটে। সেই বয়সেই সংবেদনশীলতায় আক্রান্ত আমার হৃদয়-মন। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে মনের মাঝে ইঁচড়ে পাকা প্রেমের অনুভূতি। ক্লাসের কিশোরী বান্ধবীকে বুকের মাঝে পেতে চাই বেয়াড়া বাসনা। পাবো কই? ফলে একতরফা সঙ্গোপন বিরহযন্ত্রণা। আবদুল আলীম-ফেরদৌসী রহমান-নীনা হামিদের গানে চুর হয়ে থাকা একতরফা বিরহীমনের। “ শোনো গো রূপসী কন্যা গো কার লাগিয়া গাঁথো ফুলের মালা’’, ‘‘কি রূপ দেখিলাম রে সখি জলের ঘাটে গিয়া’’, ‘‘ আগে জানলে তোর রূপ সাগরে ডুব দিতাম না’’, ‘‘সোনার ময়না পাখি রে আমার সোনার ময়না পাখি’’, ‘‘সন্ধ্যার ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়া,– ভালো লাগে জীবনের এই গান গাওয়া”, ‘‘সোনা বন্ধুরে কোন দোষেতে যাইবা ছাড়িয়া’’, ‘‘ভাটি গাঙে ভাইটাল সুরে বাঁশি কে বাজাইয়া যাও রে বন্ধু একবার চাও ফিরে’’, “একটি মনের দাম দিতে গিয়ে জীবন চলার পথটি হারিয়ে কী আমি পেলাম’’ , ‘‘এই পৃথিবীর পান্থশালায় গাইতে গেলে গান’’, ‘‘অচিন গাঁয়ের অচিন বন্ধুরে—বন্ধু জানে না পিরিতি—তোর সনে মোর প্রেম করিয়া ঘটিলো দুর্গতি রে বন্ধু’’, ‘‘কে কান্দে রে নদীর কিনারায় আউলাচুল বাতাসে উড়ে ঘোমটা নাই মাথায়’’, ‘‘ শোনো তাজেল গো মন না জেনে প্রেমে মজো না’’, ‘‘ শীত গেল বসন্ত ঐ না এলো রে সামনে ফাল্গুন মান – বিরহিনীর মনের দুঃখ জ্বলে বারোমাস’’, ‘‘আমার বন্ধু বিনোদিয়া রে– প্রাণ বিনোদিয়া’’ এবং আরও কত গান! নবম-দশম শ্রেণিতে এক ফরসা রঙের সহপাঠিনীকে একতরফাভাবে ভালোবেসে ফেলে অংকের খাতা গদগদ রোমান্টিক কবিতা লিখে ভরে তোলা। নদীতে বিশেষত বর্ষাকালে মাছ ধরা। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া নদীপাড়ের ইঁদুরের গর্ত থেকে ডুব দিয়ে বাইলা মাছ ধরা। মাঠে পোশাড়ু (বনভোজন) খাওয়া। আরও কত স্মৃতি!
অব্যক্ত স্মৃতি অনেকগুলো আছে। বাল্যকালে গ্রামের একজনকে ভালোবাসতাম। খুব। তখন কিন্তু আমি হাফ প্যান্ট পরা বালক। প্রেমের বয়স নয়। ভালোবাসার। আমার বহু কবিতায় তার নাম এসেছে। কিছুদিন আগে তাকে নিয়ে একটা পুরো কবিতা লিখেছি—স্মৃতির সুবাস মিশিয়ে।
৩. বাংলা রিভিউ : সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?
আমিনুল ইসলাম: প্রায় সমরূপ প্রশ্নের উত্তর আমি আরও কয়েকবার অন্যত্র দিয়েছি। আমার রক্ত-মাংসে-স্বপ্নে-জাগরণে-আশায়-হতাশায় সাহিত্যের উপস্থিতি একেবারে ছোটোকাল থেকে। কবিতা, গান এবং নদী—এই তিনটি আমার ভালোবাসার স্থায়ী ক্ষেত্র। বাল্যকাল– আমাদের গ্রামে তখন পুঁথিপাঠের আসর বসতো অনেক বাড়ির বৈঠকে। আমার আব্বাও পুঁথি পাঠ করতেন। তিনি ছিলেন পারস্যের রুমি, সেখ সা’দী প্রমুখের রচনার ভক্ত এবং সহজবোধ্য বাংলা কবিতার নিবিড় পাঠক। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পাঠ্য ছিলো আরব্য-উপন্যাস। আমি তাঁর পাশে বসে শুনতাম সেসব । আর আপনা থেকেই মুখস্থ হয়ে যেতো সেসবের বহুকিছু। আব্বা ছিলেন লোক কবি। তিনি মুখেমুখে কবিতা ( ছড়া/কিশোর কবিতা) রচনা করতে পারতেন। তাঁর কাব্যপ্রেম ও কাব্যমেধা আমার রক্তে প্রবাহিত। আব্বার পরলোকগমনের কিছুদিন পর তাঁর ক্যব্যপ্রীতি, কাব্যচর্চা এবং আমার ওপর সেসবের প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে আমি লিখেছি দীর্ঘ আকৃতির কবিতা ‘‘বাবার খাটে শুয়ে’’। কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন একজন স্বনামধন্য বাচিকশিল্পী যা এখন ইউটিউবে সহজলভ্য। আর কমন সাবজেক্ট: প্রেম। হাইস্কুলে পড়ার সময় এক সহপাঠিনীর প্রেমে পড়ি একতরফা। সেটা ছিলো কঠোরভাবে গোপন। ভয়ে। তখন কবিতা লেখা শুরু করি। শহর থেকে অনেক দূরে চর এলাকা আমাদের। কবিতাগুলোর সবই ছিলো খাতায় আটকানো। রাজশাহী কলেজে ইন্টারমেডিয়েটে দুবছর লেখাপড়ায় নিশ্ছিদ্র মনোযোগী ছিলাম। বিশ্বববিদ্যালয় জীবনে আবারও প্রেমে পড়ি। আবারও কবিতা-গান লিখে ভরে তুলি ডায়রী। কিন্তু প্রকাশের জন্য কোথাও পাঠাতাম না । এমএ পাস করার আগেই বিসিএস দিয়ে চাকরির জন্য সিলেক্ট হই। চাকরিজীবনে আবার কবিতা লেখায় ফিরে আসি। অনেক বিলম্বে ২০০২ সালে আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘‘তন্ত্র থেকে দূরে” প্রকাশিত হয়। তারপর লিখে যাচ্ছি । এখন আমার গ্রন্থসংখ্যা ২৯।
৪. বাংলা রিভিউ : বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ– তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? আর কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
আমিনুল ইসলাম: ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ – ইনারা প্রত্যেকেই বিখ্যাত কবি। আমার বিবেচনায় এদের মধ্যে ফররুখ আহমদ এবং আল মাহমুদ সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। ফররুখ আহমদের ‘ লাশ’, ‘ডাহুক’ প্রভৃতি কবিতা অতুলনীয় সুন্দর ও সমৃদ্ধ। তেমনি অতুলনীয় তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝি’ । আহসান হাবীব আধুনিক মুসলমান কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তবে তাঁর কবিতা আমার খুব বেশি আকর্ষণ করে না । সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’ অতুলনীয় সুন্দর কবিতা। তিনি কবিতাবোদ্ধা ও শিল্পবোদ্ধা হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর সমতুল্য প্রায়। শামসুর রাহমান অনেক বড়ো কবি। তিনি খাঁটি বাংলাদেশের কবি। তাঁর কবিতায় মেধা ও অর্জিত জ্ঞানের সমৃদ্ধ সংশ্লেষ ঘটেছে। অবশ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তার অতিরিক্ত লোভ তাঁর পরের দিকের অনেক কবিতাকে বর্ণনাধর্মিতা ও তরলতায় দুর্বল করেছে। তিনি তাঁর প্রথম দিকের অবস্থানে অটল থাকলে তাঁর নগদ জনপ্রিয়তা হয়তো কম হতো কিন্তু আমরা তাঁর কাছ থেকে উন্নতমানের আরও অনেক সংখ্যক শিল্পসমৃদ্ধ আধুনিক কবিতা পেতে পারতাম। তাঁর সেই ক্ষমতা ছিলো। কিন্তু তাতে করে আমাদের লাভও হয়েছে। তিনি অন্যভাবে পুষিয়ে দিয়েছেন আমাদের। তিনি ইউরোপীয় ধারার আধুনিক কবিতা থেকে কিছুটা সরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ভাষাকে আধুনিক কবিতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘‘ স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন’’। তিনি লিখেছেন:
‘মনে পড়ে
শীতভোরে ফজরের নামাজের পরে
নানাভাই রেহেলে কোরান রেখে ঘন কুয়াশার
নেকাব সরানো
প্রথম আলোর মতো আয়াতের শুদ্ধ উচ্চারণে
দুলে দুলে কোঠাবাড়িটাকে
কেমন সঙ্গীতময় করে তুলতেন,
আমার রূপসী নানী হারিকেন নিভিয়ে যেতেন
রান্নাঘরে; টাটকা পিঠের ঘ্রাণে জিভে
ঝর্ণাধারা যেতো বয়ে আর মাতামহের পবিত্র
আয়াতের সুরে সুরে আমার চোখের পাতা জুড়ে
সাইবেরিয়ার সোনালী বাটান পাখি বসতো কোমল,
আজ আমি সেই সুর থেকে দূরে, বহুদূরে।’’
কাজী নজরুল ইসলামের পর শামসুর রাহমান বাংলা কবিতাকে প্রায় সকল শ্রেণির মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করেছেন সবচেয়ে বেশি। শুধু কবিতা লিখেই তিনি সবার কাছে হিরো এবং রাষ্ট্রীয় সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছিলেন। এটা একটা অতুলনীয় ব্যাপার। ফজল শাহাবুদ্দীন শক্তিমান কবি । কিন্তু তাঁর খুব বেশি সংখ্যক কবিতা আমার মনে ধরে না। শহীদ কাদরী শক্তিমান কবি। তবে আমার বিচারে তিনি শামসুর রাহমান-আল মাহমুদদের মাপের কবি নন। আবদুল মান্নান সৈয়দ নিরীক্ষাপ্রবণ কবি। তিনি অবশ্য কবিতায় পাঠকের হৃদয় জয় করতে পারেননি। কবি হিসেবে আল মাহমুদ অনন্য ও অতুলনীয়। তিনি একজন মৌলিক কবি। বাঙালি কবির কবিতায় ইউরোপের কবিদের প্রভাব ব্যাপক ও গভীর। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আধুনিক বাংলা কবিতায় আজও রাজত্বকারী জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ইউরোপের কবিতার অনুসরণ আর অনুকরণের ছাপ প্রচুর। ইউরোপের কাব্যপ্রকরণই শুধু নয়, সেখানকার কবিদের কবিতার অনুকরণও তাঁর কাব্যভাণ্ডারে অনেক। কিন্তু আল মাহমুদ কারও কাছ থেকে একলাইনও ধার নেননি। তাঁর কবিতায় সময়ের পরিবর্তনে নানরকমের বাঁকবদল ঘটেছে যার কারণে তিনি একইসঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছেন। কিন্তু কোনো পর্বেই তাঁর মৌলিকত্ব ক্ষুণ্ন হয়নি। আবহমান গ্রামবাংলার উপকরণ ব্যবহার করে নাগরিক রুচির উন্নতমানের আধুনিক কবিতা রচনার পথিকৃৎ তিনি এবং এই ধারার তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। কবিতার আসল সম্পদ তার প্রাণ। আল মাহমুদের কবিতায় প্রাণরস অনিঃশেষ । প্রাণরসের সঞ্চার ও উপভোগ্যতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর সমকক্ষ কোনো কবি আমার চোখে পড়ে না। নিজস্ব কিছু ভুল, ব্যাপক ঈর্ষা, দাঁতাল হিংসা, নোংরা অপপ্রচার, একচোখা অপবাদ, নেতিবাচক প্রচারণা, রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতা, পক্ষপাতদুষ্ট নেতিবাচক মূল্যায়ন আর ভয়ংকর উপেক্ষার জঞ্জালের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাঁর স্বর্ণসিংহাসন উজ্জ্বল ও অটল। জীবনানন্দ দাশের পর আল মাহমুদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি তাঁর সমসমায়িক ও উত্তর প্রজন্মের কবিদের ওপর।
বর্ণিত কবিদের কারও সাথেই আমার ব্যক্তিগত খাতির ছিলো না। ব্যক্তিগত চেনাশোনাও ছিলো না। যোগাযোগ ছিলো না। আমি ঘরকুনো প্রকৃতির লোক। রাজধানীতে বাস করেও তাঁদের কারও কাছে সেভাবে যাওয়া হয়নি। সেজন্য আমার কোনো আফসোস নেই। তাঁদের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কমবেশি জানি দূর থেকেই। কিন্তু সেসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি মূলত কবি-কথাসাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্ম নিয়েই সন্তোষ্ট থাকতে পছন্দ করি। আমি কবিদের ব্যক্তিগত জীবনের ঘরে-আঙিনায় জানালা বা দরোজার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে আগ্রহী নই।
৫. বাংলা রিভিউ : আপনি একাধারে একজন কবি-সম্পাদক-সাহিত্যবিশ্লেষক অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?
আমিনুল ইসলাম: আমি কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখি। সম্পাদনার কাজ করেছি তবে সেটা পেশাগত কাজের ভুবনে। অর্থাৎ সরকারি অফিসে। আমার বিচরণক্ষেত্র বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন যে– তিনি বাংলার মুখ দেখেছেন তাই পৃথিবীর রূপ দেখতে চান না আর। সেটা ছিলো কবির দেখা যা চমৎকার কাব্যিকতায় বর্ণিত হয়েছে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের Daffodils নামক কবিতায়: Ten thousands saw I at a glance. । আমি কিন্তু চর্মচক্ষুতেই সারা বাংলা দেখেছি। সেই সুযোগ করে দিয়েছে আমার বদলিপ্রধান চাকরি। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহর-বন্দর-গ্রামীণ জনপদ-সমুদ্র-পাহাড়-ঝরনা-হাওর-বনভূমি দেখেছি আমি নিবিড় নৈকট্যে থেকে । রাষ্ট্রপতি থেকে রিকশাওয়ালা, শিল্পপতি থেকে শিল্পমজুর, ভূমিহীন থেকে জোতদার , লোকশিল্পী-রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী-নজরুল সংগীত শিল্পী, সাংবাদিক-অধ্যাপক-সম্পাদক-কবি-কথাসাহিত্যিক, বাদী-আসামী-উকিল-পুলিশ এবং আরও অন্যান্য পেশার ও শ্রেণির মানুষকে নিকট থেকে দেখার বিরল সুযোগ হয়েছে আমার। কেবল দেখার নয়, তাদেরকে নিবিড়ভাবে অবলোকনেরও সুযোগ পেয়েছি। আবার পাঠক হিসেবে আমি সর্বভুক। দেশি-বিদেশি যে-বই যখন হাতে পেয়েছি কিংবা গ্রন্থাগারে দেখেছি, গভীর আগ্রহ ও নিবিড় অনুসন্ধিৎসার মন নিয়ে পড়েছি। আমি মানবিক বিভাগের ছাত্র কিন্তু অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি সকল ধরনের বই পড়ে এসেছি গভীর কৌতূহল নিয়ে । অন্তত পাঠক হিসেবে আমি বিশ্বচারী। ‘‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র”-—এটা আমার ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেও সত্য। আমার বাসাটি বরাবরই একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। বই কেনা আমার অন্যতম প্রিয় নেশা। আর এখন তো অনলাইনে সারা পৃথিবীর বই পড়া যায়। আমার আরেকটি অভ্যাস হচ্ছে গান শোনা। বাংলা গান তো আছেই, হিন্দি-উর্দু-আরবি-ইংলিশ সকল ধরনের গান শুনি আমি। একদিকে বাস্তব পৃথিবীকে ভ্রমণের মাধ্যমে চর্মচক্ষুতে দর্শন অন্যদিকে ব্যাপক পঠনপাঠন আমার জীবনাভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধতর হতে উপকরণ-উপাদান জুগিয়েছে। আমি জন্মসূত্রে বালাদেশের মানুষ কিন্তু মানসিকভাবে বিশ্বপর্যটক। এসবের ইতিবাচক ছাপ ও ছায়া পড়েছে আমার সৃষ্টিকর্মে। আমি উপভোগ করি আমার এই অবারিত ও এলোমেলো জীবন অভিজ্ঞান। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, তবে সীমান্তের কাঁটাতার আর দেওয়াল ভেঙে সারা দুনিয়াকে একটি রাষ্ট্র বানিয়ে দিতাম যেখানে প্রয়োজন হতো না পাসপোর্ট কিংবা ভিসার, অস্ত্রহাতে থাকতো না কোনো সীমান্তরক্ষী কিংবা কাঁটাতারের বেড়া। আমি কবিতা লিখি, ছড়া লিখি, প্রবন্ধ লিখি, সাহিত্য সমালোচনামূলক গদ্য লিখি , সংগীত নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছি। কোনো বৈষয়িক ভাবনা নয়, এসবই ভালো লাগা থেকে করি। আমি জীবনকে উপভোগ করি তার নানারূপে, আমি শিল্প-সাহিত্য-সংগীতকেও সেসবের নানা রূপে নানা রসে নানা গন্ধে উপভোগ করি সেই একই মন নিয়ে। আমি তো একজন সাধারণ মানুষ , একজন সাধারণ লেখক। কিন্তু আমি বৈরাগ্য চাই না, চরম ভোগবাদও আমার নয়। আমার হচ্ছে ভালোবাসামাখা উপভোগ। আমি একটি হলুদিয়া পাখি দেখে অপরিসীম আনন্দ পাই্, আমি একটি নদীর ঢেউ দেখে রোমাঞ্চিত হই, আমি একটি ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে অনির্বচনীয় আনন্দ পাই, একটি সীমাবদ্ধ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একচিলতে আকাশ দেখে মুক্ত আনন্দে উড়ে যায় আমার মন– বলাকার ডানায়। আমি চেনা বা অচেনা যেকোনো মানুষের সাফল্য বা সুখের কথা জেনে সুখ পাই। আমি কারও একটি কবিতার উত্তম পঙক্তি পাঠ করে অপরিমেয় আনন্দ পাই। আমার উপভোগের পথে বাধা হচ্ছে কিছু দুষ্ট ও ভ্রান্ত মানুষের অতিলোভজনিত যুদ্ধবাজিতা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে অশ্লীল কাড়াবাড়ি ও সাধারণ মানুষের সাথে পরিকল্পিত ধাপ্পাবাজি, ধর্মকে হাতে নিয়ে একশ্রেণির রাজনীতিকের সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর বিবেক বিসর্জনকারী অতি মুনাফাখোরদের সৃষ্ট শোষণ, বঞ্চনা, অনাহার ও দুর্ভিক্ষ।
৬. বাংলা রিভিউ : একজন লেখক একইসঙ্গে একজন ব্যক্তিমানুষ এবং সৃজনশীল মানুষ। একজন লেখকের এই দ্বিবিধ সত্তার সম্পর্কটা কতখানি দ্বন্দ্বমূলক অথবা সমন্বয়ধর্মী বলে আপনার অভিজ্ঞতা বলে?
আমিনুল ইসলাম: প্রশ্নটির জন্য ধন্যবাদ। এটা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার এবং লেখকভেদে অভিজ্ঞতাও ভিন্নধর্মী। আমি আমলাতন্ত্রে কাজ করেছি দীর্ঘ ৩৫ বছর। একইসঙ্গে লেখালেখি । আমার অভিজ্ঞতা অনেকটাই স্বতন্ত্র। একজন লেখকের ব্যক্তিসত্তা এবং লেখকসত্তার বিষয়ে মতপার্থক্য আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। টি এস এলিয়টের মতে একজন কবি নিজেকে এবং তার সময়কে অনুবাদ করেন নিজস্ব সৃষ্টির পাতায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘Tradition and Individual Talent’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘The great poet, in writing himself, writes his time.’
এলিয়টের কথার সূত্র ধরে বলা যায়, একজন কবির ব্যক্তিসত্তার এবং যাপিত সময়ের কাব্যিক রূপান্তর তার কবিতা। মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা বলে, ব্যক্তি হচ্ছেন ৫০% বংশগতির এবং ৫০% পরিবেশের দান। মেধা, কণ্ঠস্বর, গায়ের রঙ, উচ্চতা এসবই মূলত বংশগতির উত্তরাধিকার। এদের বিকাশ ও উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষা ও চর্চার ওপর যা পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। একজন কবি ব্যক্তি হিসেবে যে বোধ, মেধা, আদর্শ ও জীবনবোধকে ধারণ করেন, তার কবিতায় সেসবের ছাপ পড়ে। একইসময়ে জন্মগ্রহণ করে নজরুল এবং জীবনানন্দ ব্যক্তি হিসেবে ভিন্নতামুখী; কবি হিসেবেও তাদের ভাবনা ও প্রকাশভঙ্গি আলাদা। আবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্যক্তি হিসেবে এবং কবি হিসেবে এই দুজনেরই ফারাক বিস্তর। একজন আপোষকামী ব্যক্তির পক্ষে কিংবা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপনে আগ্রহী একজন ব্যক্তির পক্ষে ‘ বিদ্রোহী’ কবি হওয়া সম্ভব নয়। আবার জনগণের প্রতি , দেশের প্রতি প্রবলভাবে কমিটেড একজন ব্যক্তির পক্ষে প্রকরণসর্বস্ব আত্মমুখী কবি হওয়ার অবকাশ নেই। কাব্যক্ষমতাসম্পন্ন একজন অতিলোভী ব্যক্তির কবিসত্তায় চাটুকারিতা, দালালি , সুবিধাবাদ প্রভৃতি ঢুকে পড়ে এবং তা তার কবিসত্তাকে ও সৃষ্টিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে কারও প্রবল কবিসত্তা জন্মসূত্রে পাওয়া ব্যক্তিসত্তাকে প্রভাবিত করে। কবিসত্তার বিকাশের সাথে ব্যক্তির রুচি, কথা বলার ধরন, মেলামেশার ক্ষেত্র, বন্ধুনির্বাচন গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। সময় ও স্থান একটা বড় ফ্যাক্টর। কাজী নজরুল ইসলাম নানাবিধ কুসংস্কার ও বিভেদে আকীর্ণ পরাধীন বৃটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ না করে কোনো স্বাধীন দেশে জন্মালে তাঁকে প্রস্ফুটিত বিদ্রোহী কবিসত্তায় পৃথিবী পেতো বলে মনে হয় না।
আবার রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মতে কবিসত্তা হচ্ছে অন্য জিনিস। বাইরের আচরণ এমনকি কবির কবিতা-গান পড়ে বা শুনেও কবিকে চেনা যায় না। কারণ কবি সমাজের আর দশজনের আনন্দ-বেদনার মুখপাত্র। তার সৃষ্টির আরশিতে যে মানুষ উদ্ভাসিত হয়, সে-মানুষ কবি নিজে নন। নজরুল যখন আত্মজৈবনিক ঢঙে বলেন, ‘ তোমার হাসিতে যে বাঁশি বাজে সে তো তুমি নহ।’’, তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে—গানের বা কবিতার মানুষটি কবি নিজে নন। রবীন্দ্রনাথের মতেও কবিসত্তা ভেতরের জিনিস, গহিনের জিনিস; আর ব্যক্তিসত্তা হচ্ছে বাইরের জিনিস যাকে দেখা যায়, সহজেই চেনা যায়। ব্যক্তি হিসেবে একজন কবি আর দশজনের মতোই। তারও ক্ষুধা লাগে; পিপাসা লাগে; তারও যৌন কামনাবাসনা থাকে। তাকেও হাটবাজারে যেতে হয়। তাকে চাকরিবাকরি কিংবা ব্যবসা করতে হয়। এককথায় তারও সংসারধর্ম পালন করা লাগে। । কিন্তু সেসব তার কবিসত্তার আসল পরিচয়বাহী নয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিশ্র প্রকৃতির। “আমলা কবি” কথাটির খোঁচা আমাকেও শুনতে হয়েছে যদিও কিছুটা কম। এটাও সত্য যে, আমার অনেক লেখাই এসেছে আমলাতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে। আমলাতন্ত্র মানে নিয়মকানুন ও বিধিবিধানের বেড়া এবং অনেক ক্ষেত্রেই গতানুগতিক কাজের পুনরাবৃত্তি। এখানে সৃজনশীল উদ্যোগ অনুমোদিত নয়। ফলে কাজেকর্মে ও আচরণে একটা স্টীল ফ্রেম ওয়ার্ক দাঁড়িয়ে যায়। আমলাতন্ত্রের বেড়াঘেরা উঠোনে বসে থাকা মনে-মগজে ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম /মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল /মোরা বিধাতার মতো নির্ভয় /মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।’ কাজী নজরুল ইসলামের এই বাঁধনহারা অনুভব-ভাবনার আগমন সম্ভব নয়। আমি নিজে এটা অনুভব করেছি। এই আমি রচনা করেছি ‘বিধিবেষ্টিত উঠোন’ শিরোনামে একটি কবিতা। কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তি এমন:
“কাশের রোগীর মতো / বুকভরে অক্সিজেন টানা; / আকাশের অসীমতা /জানালার পর্দা সরিয়ে/ সালাম দিয়ে যায় দূরের…/ মোড়ানো আইসক্রিম হয়ে ঝুলে থাকে- / নিকট আকাশের মেঘ;/ আহা মেঘ! আহা বলাকা!’
আবার এটাও ঠিক যে, ব্যক্তিসত্তার চেয়ে কবিসত্তা অনেক বেশি আবৃত, অনেক বেশি করে চারপাশের ছায়া ও রোদের, সুর ও গন্ধের, তাল ও ছন্দের, কোলাহল ও নৈঃশব্দ্যের চাপে গড়ে ওঠা ও বিকশিত চিন্ময় অস্তিত্ব। সেটা তার অদৃশ্য সত্তা। এই সত্তা অনেকখানি শূন্যলোক বিহারী, এই সত্তা গহন গোপনচারী, এই সত্তা অনির্বচনীয় আনন্দলোকের যাত্রী। অন্যদিকে একজন কবি যখন ব্যক্তি তখন তার সংসার থাকতে পারে; সাংসারিক প্রয়োজন থাকতে পারে। ফলে লোভ লালসা ও অন্যবিধ সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ঘিরে রাখতে পারে তার যাপিত জীবনের দৃশ্যমান অস্তিত্বকে। নিন্দার ভয়, প্রশংসার লোভ, খ্যাতির মোহ, অস্বীকৃতির বেদনা তাকে বিড়ম্বিত করতে পারে, সোচ্চার অথবা নীরব-অভিমানী করে তুলতে পারে। এমনকি তিনি কোনো ফৌজদারী অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারেন, আদালত কর্তৃক বিচারশেষে দন্ডিত হতে পারেন। কিন্তু সেটা তার কবিসত্তার আসল রূপ নয়। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘মানুষ আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে,
ভূমিতে লুটায় প্রতি নিমেষের ভরে,
যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে,
কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে।’
বাংলাদেশে একজন লেখকের ব্যক্তিজীবন দেখেতার সৃষ্টিকর্মে মূল্যায়ন করার একটা নেতিবাচক সংস্কৃতি চালু রয়েছে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এমনটা নয়। সেসব সমাজে মূলত সৃষ্টিকর্মের ওপর জোর দেওয়া হয়।
৭.বাংলা রিভিউ : আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে?
আমিনুল ইসলাম: “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন্ খানে’’—রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ কবিতার ক্যানভাসে আঁকা এটাই জগৎ ও জীবনের বাস্তব ছবি। সময়, নদীস্রোত, জীবন, ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদি সবকিছুই চিরচলমান। বাংলা সাহিত্য তো চর্যাপদের যুগে থেমে নেই, চণ্ডীদাসের যুগে থেমে নেই, আলাওলের যুগেও থেমে নেই; থেমে থাকার কোনা কারণও নেই। বিদেশি সাহিত্য ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রভাব, শাসনব্যবস্থার ধরন, শাসকদের ধরন, ধর্মের প্রভাব, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, প্রযুক্তির প্রসার, ইন্টারনেট সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি কারণে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় রচিত সাহিত্যে বারবার পরিবর্তন এসেছে, সাহিত্যের বাঁকবদল ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাঙালি কবি একসময় বলতে পেরেছে, ‘‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” আরও পরে বাঙালি কবি মহাকাব্য রচনা করে বলেছে, “ কে-বা সে অধম রাম ? ’’ ‘‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?’’ আরও পরে বাঙালি কবি বলেছে, ‘‘ শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রীর’’, ‘‘ দুলোক ভূলোক গোলক ভেদিয়া / খোদার আসন আরশ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চিরবিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’’, ‘‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদচিহ্ন“!’’ ইত্যাদি। বাংলা কবিতা, কথাসাহিত্য, সংগীত ইত্যাদি বিশ্বমানের। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় তাঁকে পৃথিবীর মানুষ কমবেশি চেনে। এটা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য এককভাবে সবচেয়ে বড়ো লাভ। কিন্তু লালন-নজরুল-জীবনানন্দ–জসীমউদদীন-আল মাহমুদ-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-মানিক বন্দোপাধ্যায়- হুমায়ুন আহমেদ প্রমুখদের সেভাবে চেনে না । আধুনিক সাহিত্য মূলত ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত। তারা নানাবিধ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের প্রভু। তার মধ্যে আছে ভাষা সাম্রাজ্যবাদ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তারা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রাখতে চায় অস্বীকৃতি ও উপেক্ষার মাধ্যমে। সাহিত্য দাঁড়িয়ে থাকে একটি ভূগোলে— একটি সময়ের উঠোনে— দিগন্তে প্রসারিত করে তার পরিধি ডিঙানো বাহু। ইউরো-মার্কিন সাহিত্যের অনুকরণ হওয়া উচিৎ নয় আমাদের সাহিত্য, আমাদের নিজস্বতা থাকতেই হবে। আমাদের সাহিত্য মূল্যায়নের মাপকাঠি হবে কেন ইউরো-মার্কিন সাহিত্য? কিন্তু বহু যুগ ধরে সারা পৃথিবী ইউরো-মার্কিন জোট শাসন ও শোষণ করছে বিধায় একধরনের হীনন্মন্যতা আমাদের মনেও বাসা বেঁধে থাকছে। এডওয়ার্ড সাঈদ এসবের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত প্রাচ্যবাদ বা Orientalism নামক গ্রন্থে। আমাদের মনে ও মননশীলতায় একধরনের হীনন্মন্যতা ঢুকিয়ে দিয়েছে পশ্চিমারা। যে-আমরা ইলোরা-অজন্তা-কালিদাস–রুমি-হাফিজ-খৈয়াম-তানসেন-তাজমহল-গালিবের গৌরবময় উত্তরাধিকার বহন করি, সেই আমরা নিজেদের সবকিছুকে অনগ্রসর, অনাধুনিক, তুচ্ছ ও পরিত্যাজ্য জানতে শিখেছি। এই মগজ ধোলাই হচ্ছে পশ্চিমাবাদের প্রাচ্যবাদের মূল লক্ষ্য ও প্রধান সাফল্য। আমাদের সাহিত্য অত্যন্ত শক্তিশালী কিন্তু তাকে বিশ্বপর্যায়ে তার শ্রেষ্ঠত্বে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্য-মেকানিজম আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। না-পারার মূল কারণও আমাদের প্রাচ্যবাদে সংক্রমিত ও সম্মোহিত থাকা। ফলে আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলা যায় অমূল্যায়িতই রয়ে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ট্রান্স টমার কিংবা লুইস গ্ল্যুক এরা কেউই কাজী নজরুল ইসলাম—জীবনানন্দ দাশ—জসীমউদদীন—আল মাহমুদ-এর ধারেকাছে আসার মতো কবি নন, তুলনীয় তো নয়ই। কিন্তু তারাই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তারাই বিশ্বব্যাপী প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী ‘ কবিতার সমতুল্য কোনো সৃষ্টি অন্য ভাষায় নেই। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূল্যায়ন করবে কে? কে দেবে তার যথাযথ মূল্য ও মর্যাদা? জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ যদি পশ্চিমের সাহিত্যিক হতেন, তবে হয়তো এদের সবাই অথবা অনেকেই নোবেল পুরস্কার পেতেন।
৮. বাংলা রিভিউ : কবিতায় অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ পুরানো। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? আপনি কি কবিতায় যৌনতার ব্যবহার করে থাকেন?
আমিনুল ইসলাম: অশ্লীলতার ধারণাটি মানবসৃষ্ট। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণী বস্ত্র পরিধান করে না। গরু-ছাগল-কুকুর-বেড়াল-হাতি-ঘোড়া এসব তো মানুষের সঙ্গেই বসবাস করে। কিন্তু তাদের দিকে তাকিয়ে কেউ অশ্লীলতা দেখে না। কিন্তু মানুষ আরেক মানুষের দিকে তাকিয়ে অশ্লীলতা খুঁজে পায় বা পেতে চায়। এর সাথে মানুষের চারিত্রিক শৈথিল্যের সম্পর্ক আছে। ধর্ষণ ব্যাপারটি মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের মাঝে ঘটে না। তো যখন কাপড় আবিস্কৃত হয়নি, তখন মানবজাতি অশ্লীল ছিল? সাহিত্যে যৌনতার ব্যবহার করা হলে অশ্লীলতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। প্রাচীন যুগের আরবি কবি ইমরুল কায়েসের কবিতা সে হিসেবে অশ্লীলতায় ভরা। তিনি এক কবিতায় বলেছেন যার বাংলা অনেকটা এরকম ‘আমি প্রেমিকার ডালিম খাই আর অপরটি চোষে তার বাচ্চা।’ আমি ব্যক্তিগতভাবে কবিতায় নারীর যৌনাঙ্গের রগরগে বর্ণনা দিই না আমার কবিতায়। তবে যৌনতা তো আছেই আমার কবিতায়। আল মাহমুদের কথা ধার করে বলতে চাই যে আমি ওজু করে কবিতা লিখি না।
আসলে ভাষা শ্লীল নয়, অশ্লীলও নয়। এটা একটা প্রকাশ মাধ্যম। সাধারণত যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত করে অমন প্রশ্ন উঠেছে বহুবার– বহু আগে থেকেই। চর্যাপদের মধ্যেও যৌনাত্মক ভাষা আছে। লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার এবং বাংলা ভাষার কয়েকটি উপন্যাস নিয়ে অশ্লীতার অভিযোগ উঠেছিল। আল মাহমুদের বহু কবিতা আছে যেগুলো খুবই যৌনাত্মক। তাঁর সুবিখ্যাত ও বহুনন্দিত ‘সোনালি কাবিন’ কবিতা তো যৌনতার সুচারু শিল্প।
‘দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
অথবা
‘চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণ্যমান রক্তের ধাঁধায়।’
(সোনালি কাবিন/ আল মাহমুদ)
নির্মলেন্দু গুণের অনেক কবিতা আছে যা ভাবনায় ভীষণভাবে আদিরসাত্মক এবং সেসবের প্রকাশের ভাষা প্রচলিতভাবে অর্থে অশ্লীলতার কাছাকাছি। কিন্তু পাঠক গ্রহণ করেছে সেসব কবিতা। আমার নিজের কিছু কবিতা আছে যা খুবই যৌনাত্মক—ভাবনায় ও ভাষায়। একটি কবিতা আছে ‘ক্ষুধা’ যা পুরোপুরি যৌন-কামনাকেন্দ্রিক। সেটা একটা প্রতিষ্ঠিত ছোট কাগজে ছাপানো হয়েছিল। আমি কিছুদিন আগে আমার ফেসবুক টাইমলাইনেও কবিতাটি দিয়েছিলাম। পাঠক তো খুবই ইতিবাচকভাবে এবং ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছিল। উপরে দেওয়া উদাহরণগুলোর সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের এখনকার তরুণ কোনো কবি অমন যৌনাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন বলে তো চোখে পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি রহমান হেনরীর কবিতায় যৌনতার শিল্পসম্মত ব্যবহার চোখে পড়ে। তার ‘কামধেনু’ কবিতাটি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। কারও কারও চোখে এটা অশ্লীলও মনে হতে পারে। কবিতাটির শেষের অংশ এমন:
দুগ্ধপান করি বটে, অধিক আনন্দ হয় ডুবালে শরীর
দুগ্ধপসারিনী জানো? কামধেনু খোলে কেন উদার ওলান?
ফল তো খেতেই চাই, সৌন্দর্য-তৃষ্ণায় দুই চক্ষু হয় স্থির
পেয়ে গেছি অপুষ্পক সেই এক সুপ্রসিদ্ধ ফলের সন্ধান।
দুগ্ধরসিক জানে, শ্যামলা গাইয়ের দুধ মিঠা হয় অতি;
আমিও খাঁটিই পাই … শ্যামলা হে গোয়ালিনী, তুমি তো যুবতী!
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের কিছু কবি খুবই সাহসী যৌনাত্মক ভাষার ব্যবহারে । সেসবকে অশ্লীলও বলা যাবে যদি কেউ বলতে চান। একটা উদাহরণ দিই:
‘এখনও প্রেম জনপ্রিয়। এখনও টবে গোলাপফুল ফোটে…
তোমার কথা ভাবলে আজও পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ওঠে।’
(এখনও/ শ্রীজাত)
এমন সাহসী লেখা বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের তরুণ কবিরা লিখতে পারেন বলে তো চোখে পড়ে না। যৌনতা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয়, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। দুটি প্রাণীর শারীরিক মিলন প্রাণীকুলের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য। সেভাবেই প্রকৃতি তাদের মাঝে পারস্পারিক দুর্বার আকর্ষণ-শক্তি সৃষ্টি করে দিয়েছে। যৌনতা খুবই একটা স্বাভাবিক বিষয়। শক্তিমান কবি যৌনতাকে শ্রেষ্ঠতম শিল্প করে তোলেন; গড়পড়তা কবির হাতে তা রগরগে অশ্লীলতায় পর্যবসিত হয়।
৯.বাংলা রিভিউ : সাম্প্রতিক বাংলাদেশে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন? কেমন ছিলো?
আমিনুল ইসলাম: বাংলাদেশে এখন যুগপৎ নাড়া দেওয়ার মতো শক্তিমান ও মহান লেখক তৈরী হচ্ছে না । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘ আমি পৃথিবীর কবি যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি/ আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।’’ নজরুল বলেছিলেন, ‘‘এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের।’’ রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’’ বিদ্রোহী কবি ঘোষণা দিয়েছেন যে,– চিরউন্নত তাঁর শির এবং উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল না থামা এবং অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ বন্ধ না হওয়া অবধি তাঁর বিদ্রোহ চলবে এবং তিনি অত্যাচারী ভগবানের বুকেও পদচিহ্ন এঁকে দেবেন। এই মহৎ ভাবনার ও উচ্চ মানসিকতার কবি-সাহিত্যিক এখন আর দেখা যায় না। আবার একথাও সমানভাবে সত্য যে, সত্যিকারের মননশীল সাহিত্যের দুর্ভিক্ষের কারণে বিরাজমান ডামাডোলের মধ্যে অল্প যে দুএকজন উঁচুমানের ও মহান তাৎপর্যে সমৃদ্ধ সাহিত্য রচনা করছেন, তাদের সেই সৃষ্টিকর্ম যথাযথভাবে উপস্থাপিত ও মূল্যায়িত হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মুড়ি ও মিশ্রি একদরে নেয়া হচ্ছে। পর্বত ও ঢিবি সমান বলে রায় পাচ্ছে। এতে করে বৈশ্বিকমানের সাহিত্য রচনার উৎসাহে জল পড়ছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বামনতন্ত্র। শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ হয়ে নির্মলেন্দু গুণ–রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল বিবৃত বিশ্বমানসিকতার ধারাবাহিকতা ছিলো কমবেশি। তারপর থেকে আমাদের শিল্পসাহিত্য দখলে নিয়েছে একধরনের বামনতন্ত্র। বামনতন্ত্র আর যা-ই হোক কোনো বিশ্বমানের মহৎ শিল্পসাহিত্য উপহার দিতে পারে না। এই দুরাবস্থার জন্য আমি অন্যদের মতো শুধু রাষ্ট্রযন্ত্র বা রাজনীতিকদের আক্রমণাত্মক নিয়ন্ত্রণকে দোষ দিতে চাই না। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে মহৎ লেখক হওয়ার পথে লেখকরা নিজেরাই একটা মস্তবড়ো বাধা। আর বাংলাদেশ সামরিকভাবে দুর্বলতম একটি ক্ষুদ্রায়তনের রাষ্ট্র । এখানে মূলত অনার্যদের বসবাস, কথিত ‘‘অসুরদের” উৎসব। এই অনার্য জাতি-রাষ্ট্রকে ঘিরে আছে ভারতের মতো পারমাণবিক শক্তিধর একটি আর্য মহাশক্তি যারে মূলে আছে ব্রাহ্মণ্যবাদ।। বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির উঠোন তার নদী-বনভূমি-সমুদ্রের মতোই পরিবেষ্টিত এবং অদৃশ্যে নিয়ন্ত্রিত। এখানে কোনো কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা আল্লামা ইকবাল সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। একজন বাংলাদেশী লেখক হিসেবে এই বিষয়গুলো চেতনে-অচেতনে আমাকেও পীড়িত করে। এই বহুমাত্রিক বিড়ম্বিত বোধ, বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অদ্ভুত অভিজ্ঞান থেকে আমি লিখেছিলাম একটি কবিতা: ‘শৃঙ্খলিত কোকিলের গান’ শিরোনামে। কবিতাটির উপসংহারের কয়েকটি পঙক্তি এমন:
‘আমার প্রার্থনার ভাষা কুণ্ঠিত;
আমার আপত্তির ভাষা নিষিদ্ধ;
আমার স্বপ্নের ভাষা
ক্রীতদাসের চোখের মতো এলোমেলো;
আমি বনসাইয়ের মতো;
আমি তোতাপাখির মতো;
আমি পার্কের খালের মতো;
আমি ব্যাধের মেয়ের খাঁচায় সখের লাভবার্ড যে
হারিয়ে ফেলেছে তার সবুজ অরণ্য আর
অবারিত আকাশের মঞ্চ
বিজ্ঞাপিত খুদকুঁড়োর বিভ্রান্ত কোলাহলে।’
কিন্তু তারপরও পীড়িত মেধা ও হুমকিশাসিত কলম নিয়েও আমি অনেক প্রতিবাদের কবিতা, অন্যায়-অবিচার বিরোধী কবিতা লিখেছি। আমি প্রতীক, স্যাটায়ার, পরিহাস, বিদ্রুপ ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে সেধরনের কবিতা লিখেছি। আমি প্রধানত প্রেমের কবিতার কাঠামোর ভেতরে প্রতিবাদ ও আক্রমণের কথাগুলোকে গুঁজে দিই—উপমা, চিত্রকল্প-উৎপ্রেক্ষা-প্রতিতুলনা আকারে। এটা অনেকটাই নিরাপদ। আমি আমার চারপাশের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অতিক্রম করে কবিতা লেখার চেষ্টা করে এসেছি। এটা অনেকটা বিদ্রোহী কবির শিকল পরে শিকলকে বিকল করার ফরমুলার মতো।
১০. বাংলা রিভিউ : সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
আমিনুল ইসলাম: সৈয়দ শামসুল হকের কাছ থেকে ধার নিয়ে ধার করা উত্তর এভাবে দিতে পারি:
‘আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।’
কোনো লেখক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নয়। অতীতের লেখকদের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক থাকে। এর নাম পরম্পরা বা সিলসিলা। সুনির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, সাহিত্যে আমি আমার পিতার রক্তের আবেগ ও বাংলার প্রকৃতির সৃজন-উর্বর উত্তরাধিকার বহন করি যা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তেমন উদত্তরাধিকার বহন করি না যতখানি কবি কালীদাসের উত্তরাধিকার বহন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে উদার মানবিকতায়, সবুজ আবেগে, অবুঝ প্রেমে, অন্তরঙ্গ অভিমানে ও কাব্যিক প্রতিবাদে আমি কাজী নজরুল ইসলামকে ধারণ করি অনেকখানি কিন্তু নতুন ও নিজস্ব প্রকাশভঙ্গির কারণে সেটা মিলিয়ে দেখার সুযোগ নেই । আবার একইসঙ্গে পূর্বজ আরও অনেক সাহিত্যিকের সৃষ্টিকর্মের উত্তরাধিকার আমার কবিতা-প্রবন্ধ-ছড়া-সমালোচনা সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “লক্ষযুগের সঙ্গীতমাখা সুন্দর ধরাতল’’। সেই ধরাতলে কবি হিসেবে আমি কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নই। আমার পূর্বজনদের সঙ্গে আমার সৃজনশীল অস্তিত্বের পরম্পরা বা সিলসিলা আছে। সেটা যেমন বাংলাভাষী লেখকদের তেমনি পৃথিবীর অন্যভাষী অনেক লেখকেরও । কালিদাস, রুমি, খেয়াম, হাফিজ, চণ্ডীদাস, শেক্সপীয়ার, লালন শাহ, মীর্জা গালিব, মীর তকি মীর, ইকবাল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শার্ল বোদলেয়ার, মালার্মে, র্যাবোঁ, টিএস এলিয়ট, ফররুখ আহমদ, জসীমউদদীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, মজরুহ সুলতানপুরী, সাহির লুধিয়ানভী, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, আবিদ আজাদ—এবং এভাবে আরও কত কত জন! আমি কথাসাহিত্য রচনার চেষ্টা করিনি, প্রবন্ধ লিখেছি, সংগীত নিয়ে আধা-গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছি। শিশুদের জন্য ছড়া এবং কিশোরদের জন্য কিশোর কবিতা লিখেছি। কিন্তু আমার সৃজনশীল-মননশীল মন-মানস গঠনে ও বিকাশে কার্ল মার্কস, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া, দীনেশচন্দ্র সেন, সাদাত হোসেন মান্টো, কৃষাণ চন্দর, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়, যাযাবর, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, টমাস হার্ডি, ম্যাক্সিম গোর্কী, লিও টলস্টয়, এডওয়ার্ড সাঈদ, নোয়ম চমস্কি, মহাশ্বেতা দেবী, কাজী আনোয়ার হোসেন, গৌরকিশোর ঘোষ, ওরহান পামুক, হুমায়ূন আহমেদ, স্যার সৈয়দ আহমদ, বিনয় ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ আলী আহসান, অন্নদাশঙ্কর রায়, আহমদ ছফা, শিবনারায়ণ রায়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ইরফান হাবীব, রোমিলা থাপার, যতীন সরকার, হুমায়ুন আজাদ, আকবর আলি খান, ফরহাদ মজহার, সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমুখদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদানকে কীভাবে অস্বীকার করতে পারি? এবং নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে জয়া চ্যাটার্জী, অরুন্ধতী রায়, সলিমুল্লাহ খান, জাকির তালুকদার, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ লেখকগণের লেখা আমাকে পড়তেই হয়। তবে কবি হিসেবে আমার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছেন ওমর খৈয়াম, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ এবং আবুল হাসান। আর রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তো সংগীতে, জীবনদর্শনে, সামাজিক ভাবনায়, তর্কে, বিতর্কে কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে থাকেন আলো-হাওয়ার উপমায়– প্রায় প্রতিদিনই।
১১. বাংলা রিভিউ : আপনি নিজেকে কোন্ দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
আমিনুল ইসলাম: এটা একটা বিদঘুটে ব্যাপার যা আমাকে অশান্তি দিয়ে এসেছে বহুদিন। এখনও দিচ্ছে। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ কিংবা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ গত শতাব্দীর সত্তর দশকে রচিত দুটি বিখ্যাত কবিতা। অথচ তাঁরা দুজনই পঞ্চাশের দশক থেকে কবিতা লিখে এসেছেন। কেন যে ত্রিশের দশক কথাগুলো চালু করেছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডব! আমার একটা কবিতা আছে ‘কবিতা তো নেবে তাকে দশক নেবে না’ শিরোনামে। আমি ১৯৭৭-৭৮ সালে হাইস্কুল জীবনে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় প্রচুর কবিতা ও গান লিখেছিলাম। কিন্তু সব রয়ে গিয়েছিল খাতাবন্দি অথবা ডায়রীর পাতায় মোড়ানো। অবশেষে নব্বই দশকে আমি আবার কবিতা লেখা শুরু করি এবং পত্রপত্রিকায় ছাপানোর জন্য পাঠাতে থাকি। সেগুলো ছাপা হয়। তো আনুষ্ঠানিক আবির্ভাবের বিষয়টি বিবেচনা করলে আমাকে নব্বই দশকে রাখা যায়। আমার প্রথম দিকের ১০/১২ টি বইয়ের ফ্ল্যাপে দশক বিষয়ে কোনো তথ্য থাকতো না। আমিই দিতাম না। ফলে সংকলন বানানেওয়ালারা কেউ আমাকে আশির দশকে রেখেছেন কেউবা নব্বইয়ের দশকে। আবার কেউ বা বাদ দিয়েছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। অনেকের সংকলনের ভূগোলে আমি রয়ে গেছি জরিপের পরিভাষায় ‘ছুটদাগ’ হয়ে। লেখকদের দশকওয়ারী বিভাজন আমার কাছে অপছন্দের একটা ব্যাপার। কিন্তু দশক অন্তত এখন উপেক্ষিত না হওয়ার পজিশন দখল করে রেখেছে।
১২. বাংলা রিভিউ : আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
আমিনুল ইসলাম: আমি যেদিন জন্মগ্রহণ করেছি সেদিন থেকেই আমার কাল বা সমকাল শুরু হয়েছে। আমার বয়স এখন ৬০ বছর পার বছর হয়ে গেল। এই ৬০ বছর তো এক রকম নয়। পরিবর্তন সময়ের ধর্ম। তবে গত ১৫/২০ বছরকে যদি বিবেচনায় নিই, তবে বলতে হয়– এটা হচ্ছে প্রযুক্তির কাল। এটা হচ্ছে ইন্টারনেট ফেসবুকের জমানা। এ-যুগে মানুষে মানুষে নিবিড় সম্পর্ক হচ্ছে না। সবাই ইন্টারনেট-ফেসবুকে ব্যস্ত। আর সম্পর্কের মধ্যে break up হচ্ছে হাল আমলের সংস্কৃতির অঙ্গনে একটি বেশি চর্চিত নেতিবাচক বিষয়। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভোগবাদী । প্রেম নেই। ভালোবাসা নেই। হৃদয়-মন এসব এখন তামাদি হয়ে যাওয়া বিষয়। সবকিছু চটজলদি চাই, নগদানগদি চাই। আজ ভালোবাসি বললে আগামীকাল বিছানা ভাগাভাগি। পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংসপ্রায়। শিক্ষাঙ্গনে চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাস। শিক্ষকদের একটি অংশ নির্লজ্জতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মেতে উঠেছে ছাত্রীদের ধর্ষণ করতে। রাষ্ট্রীয় সেবদানকাজে আপোসহীন নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত আমলাতন্ত্রের Steel Frame অবস্থান ভেঙে পড়েছে। এখন রাজনীতি হচ্ছে রাতারাতি অঢেল সম্পদ অর্জনসহ সামাজিক অঙ্গনে জিরো থেকে হিরো হওয়ার প্লাটফর্ম। ধর্মীয় রাজনীতি মানুষকে পশুর মুত খাওয়াচ্ছে , চাঁদে দেখাচ্ছে ভণ্ডপীরের চলাচল। বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি ক্রুসেডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্বলের জন্য কোথাও কোনো আদালত নেই, রাষ্ট্রপতি ভবন নেই, জাতিসংঘ নেই। সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা—এই প্রবাদবাক্য এখন বাতিল ঘোষিত কাগজের নোট। এখন Ends justify the means. মানবিকতায় শিথিল এই সময়ের ইতিবাচক দিক প্রধানত একটাই: ঘরে বসে ‘‘আপনহাতের মুঠোয় পুরে” ‘বিশ্বজগৎ’ দেখা যাচ্ছে এবং আর ভালোমন্দ কোনোকিছুই বেশিদিন গোপন থাকছে না। অধিকন্তু হাওয়ার মতো নিত্যলভ্য ফেসবুকের যখন ইচ্ছা যেমন ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছা মানহীন ব্যবহার নতুন প্রজন্মের গ্রন্থবিুমখতা নিশ্চিত করে তাদের ফাঁপা মানুষে পর্যবসিত করছে। ফেসবুক ও অবাধ আকাশ মিডিয়া পরিচালিত আজকের এই সময়ে কোনো রুমি, শেক্সপীয়ার, লালন, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের জন্মলাভ ও বিকশিত হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
১৩. বাংলা রিভিউ : একজন লেখকের রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা কেমন হওয়া সমীচীন বলে আপনি মনে করেন? এটির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কেমন? বাংলাদেশে লেখকগণ কি রাজনীতিমুখী?
আমিনুল ইসলাম: বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন: ‘Hence it is evident that the state is a creation of nature, and that man is by nature a political animal. And he who by nature and not by mere accident is without a state, is either above humanity, or below it; he is the ‘Tribeless, lawless, heartless one,’ whom Homera denounces—the outcast who is a lover of war; he may be compared to a bird which flies alone.’ লেখকগণও সমাজের মানুষ। রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় রাজনীতি দ্বারা। রাষ্ট্র এবং রাজনীতি কোনোটারই প্রভাব বলয়ের বাইরে যাওয়ার পথ নেই অন্তত মানুষের জন্য। যুগে যুগে কবি-নাট্যকার-গীতিকার-ফিকশান রচয়িতাগণ জাতিকে পথ দেখাতে কলম ধরে এসেছেন। ফেরদৌসীর মহাকাব্য ‘শাহনামা’ পারস্যজাতিকে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনয়নে পথ ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলাম, পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমত, সুকান্ত ভট্টাচার্য, লোরকা, বেঞ্জামিন মলয়সি, মাহমুদ দারবিশ প্রমুখ কবি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছেন তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার কবিতার জন্য। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, সুবোধ সরকার , আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ কবিগণ নিবিড়ভাবে রাজনীতিসচেতন কবিতা লিখেছেন। শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘বুকতার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ ‘ আল মাহমুদের ‘আমিও রাস্তায়’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘জেলগেটে দেখা’, শঙ্খ ঘোষের ‘যমুনাবতী’, ‘ নৈশ সংলাপ ২০০৭’, নির্মেলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’, ‘স্বাধীনতা শব্দটি যেভাবে আমাদের হলো’, আবুল হাসানের ‘অসভ্য দর্শন’, রফিক আজাদের ‘ ভাত দে হারামজাদা’, রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’,‘মিছিল’, ‘অস্ত্র চাই’, সুবোধ সরকারের ‘ রাষ্ট্রনীতি’, ‘আমি ফিরোজা একটি ভারতীয় মেয়ে’, জয় গোস্বামীর ‘শাসকের প্রতি’ এবং এমন আরও অনেক কবিতা লেখা হয়েছে যেসবের মাঝে রাজনীতিসচেতনতা প্রবল।
লেখকদের রাজনীতি সচেতনতার দুটি দিক আছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কবিতার ভাষায় আবেগনিবিড় ও আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদাকিতা, শোষণ-নিপীড়ন প্রভৃতির বিরুদ্ধে রচিত কবিতা তেমনটি হয়ে থাকে। পরাধীন জাতির কবিরা সাধারণত এমন কবিতা লিখে থাকেন। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের কবির রাজনৈতিক সচেতনতা শিল্পিত ও অপ্রত্যক্ষ হওয়া সমীচীন। এমন অবস্থায় কোনো কবি বা কথাশিল্পীর লেখা দেশের শাসকের উলঙ্গ গুণগান অথবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সরাসরি পক্ষে রচিত হওয়া শোভনীয় নয়। তিনি রাজনৈতিক ইশতেহারধর্মী লেখা এড়িয়ে চলবেন, তেমনটাই শিল্পের দাবি, সৃজনশীল শোভনতার দাবি। একজন লেখকের আত্মমর্যাদা উঁচুমানের হওয়ার কথা। তার কাছ থেকে ক্রীতদাসসুলভ আচরণ কাম্য নয়। বাংলাদেশে অনেক লেখকই নগ্নভাবে রাজনীতির তাবেদারী করে থাকেন। এমনটা সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে ভারতের হিন্দি সিনেমার জগতেও। এতে করে লেখক-পরিচালক-শিল্পীদের প্রতি সমাজের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন লেখকদের ‘দালাল’ গালিটিও শুনতে হচ্ছে। আল মাহমুদ তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় এমন অবস্থার বিরুদ্ধে বলে গেছেন:
‘পূর্ব-পুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস ।
মুখ ঢাকে আলাওল– রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার ।
পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ ।
ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ?’
১৪. বাংলা রিভিউ : আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করা বিষয়ে।
আমিনুল ইসলাম: মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ইত্যাদি হচ্ছে কবিতার চিরকালের সমৃদ্ধ উপকরণ। পৃথিবীর বিখ্যাত মহাকাব্যগুলো তো সবই ধর্মীয় কাহিনি বা মিথের ওপর ভিত্তি করে রচিত। ধর্মগ্রন্থগুলোও কবিতার ভাষায় রচিত। আমার কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ এসবের অনেক ব্যবহার ঘটেছে তবে সেটা নতুন ব্যঞ্জনায়—নব নান্দনিকতায়। লালন শাহ, মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখ কবির কবিতায় ইসলাম ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও মিথ ব্যবহৃত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ধর্মীয় মিথের প্রয়োগ একটা কবিতাকে কত সমৃদ্ধ করতে পারে, কতটা গতি ও বৈচিত্র্য এনে দিতে পারে, তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ হচ্ছে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’। শামসুর রাহমান খুব চমৎকার আধুনিকতায় তাঁর কবিতায় ইসলামী মিথের ব্যবহার করেছেন। তাঁর ‘ একরাতে হযরত উসমান’ ইসলামী মিথ নির্ভর একটি উৎকৃষ্ট মানের কবিতা। আরেকটি উদাহরণ দিই। হরতালের জনশূন্য, শব্দশূন্য ঢাকা শহরের পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি উপমা হিসেবে ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর ধর্মসাধনার দুর্লভ সময়কে ব্যবহার করেছেন:
‘অন্ধ, ক্রদ্ধ, ক্ষিপ্র
থাবা থেকে গা বাঁচিয়ে বুকে
আয়াতের নক্ষত্র জ্বালিয়ে
পাথুরে কন্টকাবৃত পথ বেয়ে উর্ণাজাল-ছাওয়া
লুকানো গুহার দিকে যাত্রকালে
মোহাম্মদ যে স্তব্ধতা আস্তিনের ভাঁজে
একদা নিয়েছিলেন ভরে,
সে স্তব্ধতা বুঝি
নেমেছে এখানে।’
এখানে ‘আয়াতের নক্ষত্র জ্বালিয়ে’ চিত্রকল্পটি অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় এবং গভীরভাবে সদর্থক। সালমান রুশদীরা কোরানের আয়াতকে শয়তানের পঙক্তিমালা বলে আখ্যায়িত করে বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ তুলেছেন। কোরানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনকারী বহু মুসলমান লেখক এদেশেও আছেন। অথচ শামসুর রাহমান কোরানের আয়াতকে নক্ষত্রের সঙ্গে তুলিত করে তাকে মহিমান্বিত করেছেন। আবার ১৯৭১ সালে যখন চলছে মুক্তিযুদ্ধ, ইসলাম গেল গেল বলে এক ধরনের ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিক খুন, হত্যা, ধর্ষণ-লুন্ঠন-অগ্নিসংযোগে সহায়তা করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে, যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কবি সংস্কৃতিকর্মীর পক্ষে ইসলামে পক্ষে কথা বলাই কঠিন, তখন শামসুর রাহমান তাঁর অতুলনীয় জনপ্রিয় কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ এর একটি লাইন রচেছেন নিঃসংকোচে এভাবেই: ‘স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।’ আমি তো মনে করি এই একটি কাব্যিক পঙক্তির জন্য ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানের সারাজীবন শামসুর রাহমানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এবং প্রয়োজনও। আল মাহমুদের কবিতাতে একেবারে শুরু থেকেই ইসলামী মিথের সার্থক ব্যবহার ঘটেছে। তাঁর সুবিখ্যাত ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থের বাঁকবদলকারী কবিতা ‘‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা” শেষের অনুচ্ছেদ থেকে উদাহরণ দেওয়া যায়:
‘তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছটে বাগান।
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা-ই রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান….।’
মিথ ব্যবহারে আমারও কোনো শুচিবায়ুগ্রস্ততা নেই। কবিতার প্রয়োজনে আমি যেকোনো ভাষার যে কোনো ধর্মের যেকোনো ধরনের মিথ্য ব্যবহার করি। আর আমি তো বাঙালি মুসলমান , আমার কবিতায় ইসলাম ধর্মের অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমার একটি প্রেমের কবিতার নাম ‘ভালোবাসার সুপ্রীম কোর্টে দাঁড়িয়ে’, সেটা পুরোপুরি ইসলামী বা বাইবেলীয় মিথ কেন্দ্রিক। কুরআনে বর্ণিত আসহাবে কাহফ এর ঘটনা বা গল্পকে মিথ হিসেবে ব্যবহার করে আমি লিখেছি নিটোল প্রেমের কবিতা: “ভালোবাসা আসহাবে কাহফের কুকুর’’। আমার আরেকটি প্রেমের কবিতার দুটি লাইন হচ্ছে ‘‘ভালোবাসার সিরাতুল মোস্তাকিম ছেড়ে / কেন তুমি উকিলের আঘাটায় পথ খুঁজতে যাবে?”
এখানে একটা কথা বলে রাখি: আমি পরিকল্পনা করে কোনো মিথ ব্যবহার করিনি এবং করি না। কবিতার প্রয়োজনে যখন যে মিথকে সুপ্রযোজ্য মনে হয়েছে, তখন সেটাকে ব্যবহার করেছি। কোনো মিশন নিয়ে আমি ধর্মীয় মিথ ব্যবহার করি না । আরেকটি কথা বলা জরুরি। ইসলাম ধর্মীয় অনুষঙ্গ বা ইসলামী মিথ ব্যবহারের ঝুঁকিও আছে। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় নেতাগণকে নিয়ে ভয়। এই ভয় বিদ্রোহী কবির সময়েও ছিলো। কবিতার সত্য আর বাস্তবের সত্য এক জিনিস নয়। কবিতা চায় চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, কল্পচিত্র বা কল্পনা, তুলনা, প্রতিতুলনা ইত্যাদি। তাছাড়া প্রচলিত মিথ্যের বিপরীতমুখী ব্যঞ্জনার ব্যবহার কবিদের শক্তিমত্তার একটি দিক। আল মাহমুদের ‘ মিথ্যাবাদী রাখাল’ সেভাবেই একটি বিশ্বমানের কবিতা। আমার ‘‘ ভালোবাসার সুপ্রীম কোর্টে দাঁড়িয়ে” কবিতাটিও ইসলামী মিথের বিপরীত ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ ব্যবহার। কবিতাটি নিটোলভাবে নর-নারীর প্রেমের। কিন্তু এই কবিতাটি যখন আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম, অনেক প্রশংসার মাঝে বেশ কয়েকজন আমাকে ‘কাফের’’ ‘মুরতাদ’’, ‘‘কুরআন অবমাননাকারী” বলে আখ্যায়িত করে হুমকি দিয়েছিলেন। অথচ ‘‘রামছাগল’’, ‘‘রামবোকা’’, ‘‘হাঁদারাম’’ এসব বলা হয় কত বছর ধরে! কৃষ্ণকে নিয়েও কত ব্রিদুপ করা হয়। সেই বৃটিশ শাসন আমলে নজরুল বলেছিলেন, “ আমি বিদ্রোহী- ভৃগু ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন’’। তাতেই গোঁড়া মুসলমানরা তাঁকে শয়তানের অবতার বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তিনি যদি ভগবান শব্দটির বদলে আল্লাহ বা খোদা বা রব শব্দ ব্যবহার করতেন, তাহলে তাঁকে তখনই তলোয়ারে বা রামদার কোপে জীবন দিতে হতো। গভীর সাহিত্যবোধশূন্য একশ্রেণির মুসলমানের ধর্মীয় গোঁড়ামি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ইসলাম ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও মিথকে নতুন ব্যঞ্জনায় ব্যবহারের পথে মারাত্মক হুমকি।
১৫. বাংলা রিভিউ : আপনি বহুবছর সরকারি চাকরি করেছেন । পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করে এসেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি? সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে অনেকেই আমলাদের নেতিবাচক চোখে দেখে থাকেন। আপনার অভিজ্ঞতা কি?
আমিনুল ইসলাম: কোনো পেশার জন্য তো লেখালেখি নিষিদ্ধ নয়। তারপরও সেনাবাহিনীর লোকজন চাকরিরত অবস্থায় লেখক হন না বললেই চলে। পুলিশেও কবির সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয়। আমলাতন্ত্র আমার লেখালেখির ওপর দুধরনের প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত মাঠ প্রশাসনে ছিলাম প্রায় ষোল বছর। সেটা অনেক ব্যস্ততা এবং উৎকণ্ঠা বিজড়িত কাজ। লেখালেখির সময় পাওয়াই কঠিন ছিল। অধিকন্তু লেখালেখিকে বিশেষত কবিতালেখাকে সেখানে অনুরাগের চোখে দেখা হয় না । একবার অন্যায়ভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে সংশ্লিষ্ট একজন অতিরিক্ত সচিবের সাথে দেখা করি। তার হাতে আমার একটি কবিতার বই দিই। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তিনি আমাকে আরও আগে থেকেই কবি হিসেবে জানতেন। তিনি আমাকে কবিতা লেখা বাদ দিয়ে careerist হওয়ার পরামর্শ দেন। আমি তো অবাক! অন্যদিকে প্রশাসনে চাকরি করার সুবাদে আমি সরকারি কাজে এবং ঘনঘন বদলি হয়ে প্রায় সারা বাংলাদেশ দেখার সুযোগ পেয়েছি। সেইঅভিজ্ঞতা আমাকে “পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতা লেখার চিন্তা, প্রেরণা ও তথ্য দেয়। সরকারি কাজে আমি বিদেশে গেছি বেশ কয়েকবার। সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কবিতা লিখেছি যেগুলো পাঠক-সমালোচকগণ কর্তৃক গৃহীত ও প্রশংসিত হয়েছে। আমি আমলাতন্ত্রের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বহু প্রশাসনিক শব্দ, পরিভাষা ও ঘটনাকে কবিতায় ব্যবহার করেছি যা আগে কখনো কোনো কবি করেননি। যেমন ‘ আমার হাতে প্রাত্যহিকতার পৌনঃপুনিকতা আর তোমার আঁচলে ঈদ বোনাসের হাওয়া/ যতবার আসো আমার মাচানে উৎসব লাগে’ অথবা ‘ভালোবাসার সিরাতুল মুস্তাকিম ছেড়ে তুমি কেন উকিলে আঘাটায় পথ খুঁজতে যাবে?’ কিংবা ‘তুমি পদোন্নতি দিয়েছিলে অনুগত প্রেমিকের পদে’ অথবা ‘এভাবেই ষাট ছুঁই ছুঁই এবং উত্তেজক আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে / একান্ত অনুগত যৌবনের পিআরএল আরম্ভ;/ তো কী আর করা!/ ভায়াগ্রা দিয়ে তো ঠেকিয়ে রাখা যায় না বয়স।’ কিংবা ‘ ফ্যাক্সে হৃদয় ঢালতে গেলে ঘাঁটবে অপারেটর/ যদিও নাঙ্গা যুগের ঊরু মনটা কপটচারীর/ ডাকপিওনের বেতন জোটে আমার নিরুত্তর/ তোমার হাতে কলমটা কি ফিন্যান্স সেক্রেটারির?’
সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে আমলাদের দেখতে পারে না প্রায় কেউই, এটা সত্য। হাসান আজিুজুল হক তাঁর একলেখায় বলেছিলেন যে, আমলাতন্ত্র লেখালেখির জন্য অনুকূল পেশা নয়। হুমায়ুন আজাদ তো গালিগালাজ করেছেন নানাভাবে। অঅমি নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, নজরুল-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (বর্তমানে প্রয়াত) আমলাতন্ত্রকে খুবই নেতিবাচক চোখে দেখেন। আমলাদের স্ত্রীদের অত্যন্ত আপত্তিকর অর্থে ও নোংরাভাবে হেয় করে আবদুল গণি হাজারী লিখেছিলেন ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ নামক একটি কবিতা। কেবল এটাই নয়, আরও অনেক কবি ও কথাসাহিত্যিক আমলাতন্ত্রকে হেয় ও গালিগালাজ করে কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্থ ইত্যাদি লিখেছেন। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে, আমার উপস্থিতিতেই প্রতিদিনের পরিচিত লেখকরা বক্তৃতার মাঝে আমলা লেখকদের গালমন্দ করে বাহবা নেন। আমি বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে দেখেছি কী ভয়ংকর বিদ্বেষ পোষণ করতেন প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। এই বিদ্বেষ ও বিরোধিতা কতখানি যৌক্তিক বা অযৌক্তিক সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হচ্ছে এমন বিরূপ পরিবেশে সাহিত্যচর্চা করা খুবই কঠিন ব্যাপার। আমলা কবিরা কয়জনই বা কামাল চৌধুরীদের সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন? তবে আমি কতিপয় লেখেক এবং দুএকজন সাহিত্য সম্পাদকের বৈরিতার মুখে অধিকাংশ লেখক-অধ্যাপক-গবেষক-আলোচক-সাহিত্য সম্পাদকের কাছ থেকে সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছি। আমার কবিতা নিয়ে প্রচুর লিখেছেন তারার এবং সাহিত্য সম্পাদকগণ অকাতরে ও উদারভাবে ছেপে এসেছেন সেসব আলোচনামূলক গদ্য-প্রবন্ধ-নিবন্ধ-রিভিউ এবং আমার নিজের লেখা ।
১৬. বাংলা রিভিউ : একটা নির্দিষ্ট কালখণ্ডে রচিত কবিতার কি কোনো নির্দিষ্ট ধরনের ভাষা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম: কবিতা একটি জীবন্ত ব্যঞ্জনার সৃষ্টি। শব্দে শব্দে রচিত বটে কিন্তু কবিতার মূল বিষয়টি হচ্ছে প্রাণ। প্রাণবন্ত কোনোকিছু ছাঁচে ঢালা হয় না। ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’—এটি কেবল একটি প্রতিতুলনাজাত অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রকল্পই নয়, এই বাক্যে কবিতার স্বাধীন ও জীবন্ত সত্তার প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। কবিতা মানুষ লেখে। মানুষে মানুষে মিল যেমন থাকে, একই সঙ্গে থাকে কিছু পার্থক্য। কবিতার ওপর কবির ব্যক্তত্বের ছাপ ও প্রভাব পড়ে যায় চেতনে কিংবা অবচেতনে। ফলে একই কালখণ্ডে রচিত সব কবিতার ভাষা একই রকম হয় না। বলা হয়, কবিতার ইতিহাস হচ্ছে টেকনিকের ইতিহাস। টেকনিক মানেই কাব্যভাষা। অর্থাৎ কবিতার ভাষা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু তারপরও এই মতবাদ বীজগণিতের ফুর্মলার মতো অপরিবর্তনীয় সত্য নয়। কবিতার টেকনিক কেবল কালের ব্যাপার নয়; আরও কিছু জড়িত আছে এর সাথে। কালে কালে কবিতার ভাষায় পরিবর্তন এসেছে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল যে-ভাষায় প্রেমের কবিতা লিখেছেন, জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ সে-ভাষায় লেখেননি। আবার শামসুর রাহমান যে-ভাষায় প্রেমের কবিতা লিখেছেন, আল মাহমুদ তেমন ভাষায় লেখেননি। আবার রবীন্দ্রনাথের মোলায়েম ভদ্র ভাষায় অথবা জীবনানন্দ দাশের ‘নির্জন স্বাক্ষর’ এর অসহায়ত্বের ভাষায় অথবা এখনকার উত্তরাধুনিক কবিদের ‘রক্তহীন ভাষায়’ একটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা সম্ভব নয়। একই দশকের কবি হওয়া সত্ত্বেও আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার ভাষাই কোনো মিল নেই। রহমান হেনরী, টোকন ঠাকুর, বীরেন মুখার্জী, ওবায়েদ আকাশ, আমিনুল ইসলাম—সবাই নব্বই দশকের কবি; কারও ভাষারা সঙ্গে কারও ভাষার মিল নেই। আবার এদের কাউকে খারিজ করার জো নেই। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আর জীবনানন্দ দাশ একই দশকের কবি—একই আধুনিকতার অনুসারী কবি—একথা শতভাগ সত্য কিন্তু তাদের দুজনের কবিতা পড়ে এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব। তার মানে ব্যক্তিকবি, কাল , বিষয় প্রভৃতি ভেদে কবিতার ভাষায় তারতম্য হয়। বিজ্ঞানের যুগ পেরিয়ে এখন টেকনোলজির যুগ। বিশ্বায়নের বাহক মিডিয়া এখন প্রচুর টেকনোলজিকাল শব্দ আমদানি করেছে এবং করে চলেছে যেসবের স্থানীয় প্রতিশব্দ নেই। কবিতায় সেগুলো ঢুকে যাচ্ছে সরল অপরিহার্যতায়। ‘শরতের আকাশ হয়ে বসে থাকি/ আমাকে ছুঁয়ে চলে যায় / মিলনের রিংটোন বিচ্ছেদের এসএমএস;’ কিংবা ‘ ফ্যাক্সে হৃদয় ঢালতে গেলে ঘাঁটবে অপারেটর’ অথবা ‘ আজ এই বিউটিপার্লার রাতে / কেন রচে রাখো অন্ধকার!/ উতল ভেতর থেকে/ কেন আর আসে নাকো/ ডিজিটাল উৎসবের গান?’ অথবা ‘ তোকে ছুঁবো সহযোগী কম্পিউটারের কী বোর্ডের সামনে;’– এমন কাব্যভাষা তো ৩০ বছর আগেও ছিল না। তো কবিতার জন্য কোনো ধরাবাঁধা ভাষার প্রেসক্রিপশন দেওয়ার অবকাশ নেই, প্রয়োজনও নেই। কোনো বিশেষ ভাষারীতির অনুগত অনুসরণ কাউকে কবি বানায় না; শক্তিমান কবি মেধাগত সহজতায় নিজস্ব কাব্যভাষা গড়ে তোলেন। কাল-দশক নির্ভর ভাষার প্রেসক্রিপশন শুধু ঝাঁকবদ্ধ গড়পড়তা কবিদের জন্য প্রযোজ্য।
১৭. বাংলা রিভিউ : আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
আমিনুল ইসলাম: আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা এই দুটি প্রপঞ্চ সংজ্ঞার চাপে এখন শ্বাসরুদ্ধপ্রায়। আধুনিক শব্দটির চেয়ে সুন্দর কোনো বিশেষণ হতে পারে না। সাধারণত কালসীমায় ফেলে এদের বিবেচনা ও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সেটা নিখুঁত নয়। আর এসব তো পশ্চিমরা ব্যবহার করে আসছে আমাদের ছোটো করতে। পশ্চিমাদের সেই কৌশলের নাম প্রাচ্যবাদ। তাদের কাছে প্রাচ্য সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুই অনাধুনিক বা সেকেলে। সেটাও আমাদের মানতে হবে? মধ্যযুগে সৃষ্ট তাজমহল তো স্থাপত্যশিল্প হিসেবে চির-আধুনিক সর্ব-আধুনিক। গালিব কি চিরআধুনিক নন? ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ অথবা রুমির মসনবী মধ্যযুগে লেখা অথচ আজও আধুনিকতার একচ্ছত্র মালিকানার দাবিদার ইউরো-মার্কিন বিশ্বে সেসব সমানভাবে জনপ্রিয়। আসলে যা আলোকিত প্রাণের আনন্দের উৎস এবং মানবসমাজ কর্তৃক সাদরে গ্রহণযোগ্য তা-ই আধুনিক। প্রতিটি সময়ের অগ্রসর মানুষ সেই সময়ের আধুনিক মানুষ এবং তাদের সৃষ্টিকর্ম আধুনিক সৃষ্টিকর্ম। উত্তরাধুনিকতাও ইউরো-মার্কিন ভূগোলে উদ্ভূত ও প্রচারিত প্রপঞ্চ। শেকড়ে ফিরে যাওয়ার বা শেকড় সংশ্লিষ্টতার একটা ব্যাপার আছে উত্তরাধুনিকতায় বলে অনেকে বলেছেন। কিন্তু আধুনিক শিল্পসাহিত্য কি পুরোপুরি শেকড়বিচ্যুত ছিলো কোনোদিন? মনে হয় তা নয়। আগেই বলেছি যে, আধুনিক-আধুনিকতা ইত্যকার ধারণাগুলা ইউরোপের । তাদের যখন আধুনিক সাহিত্যের জয়জয়কার, তখন বাংলা সাহিত্যে রোমিান্টিকতার ভরা মৌসুম। অর্থাৎ আমরা পিছিয়ে শুরু করেছিলাম। উত্তরাধুনিকতার ব্যাপারটাও তাই। বাংলাদেশে উত্তরাধুনিকতা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় এমনকি পশ্চিমবঙ্গেরও বেশ পরে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের কবিরা উত্তরাধুনিকতার পথ ধরে “ শেকড়ে’’ ফিরে যাওয়ার কোলাহল তুলেছিল। তারা ‘‘অনার্য দিন” ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের নবীন মুসলমান কবিরা বাপ-মার দেওয়া নাম আড়ালে রেখে অনার্য বাংলা নাম ধারণ করেছিল । সেটার শুরুর অবশ্য ‘সোনালি কাবিন’ এর আল মাহমুদের হাতে। তিনি লিখেছিলেন:
‘বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে
লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন ?
শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেবো আদ্যক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।
বাঙালী কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।’
উল্লেখ্য, অনার্য সাহিত্য তো আর্যসাহিত্য বা ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতির বিপরীত। আমাদের ‘‘নও অনার্যরা” সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয়েছে, সবকিছু একটা জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবিরা এখন দিশেহারা এবং তারা উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল যা-কিছুই করছে, এলোমেলোভাবেই করছে।
১৮. বাংলা রিভিউ : আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোনো প্রভাব কি আছে?
আমিনুল ইসলাম : দেশি- বা বিদেশি কোনো পার্টিকুলার লেখকের প্রভাব দূষণীয় মাত্রায় আমার লেখায় পড়েনি বলে আমার ধারণা। এটা হচ্ছে কবিতার শৈলী বা প্রকরণের বিবেচনায়। কিন্তু কবিতাভাবনা বা বিষয়ের কথা বলতে গেলে পূর্ববর্তী দেশি-বিদেশি কবিদের কাছে ঋণ স্বীকার করতেই হবে। কারণ বিষয় বা ভাবনা তো আনকোরা নতুন হয় না বললেই চলে। একটা বিষয় খোলসা করে বলা দরকার যে,– ওমর খৈয়াম, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, আবুল হাসান এই চারজনের কবিতা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। গালিব এবং বোদলেয়ারও খুব প্রিয় আমার। আর রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তো বহুমাত্রিক সৃষ্টিসম্ভারের মালিক। তাঁরা নানা কারণেই উপস্থিত থাকেন আমার মনে ও মননে। এদের সবার কাছে কোনো না কোনো ভাবে ঋণী আমি। আমি কোনো না কোনো কবিতায় অথবা কোনো পঙক্তিতে তাদের কারো কোনো কবিতার অথবা পঙক্তির ছাপ লাগতেই পারে। তবেআমি কাউকে অনুসরণ করি না, অনুকরণ তো নয়ই। আমি নিজে যা শুধু তা-ই হতে চেষ্টা করছি।
১৯. বাংলা রিভিউ : বাংলা একাডেমি নবীন লেখক প্রকল্প পুনরায় চালু করেছে। এটা লেখক তৈরিতে কতখানি সহায়তা করবেন বলে আপনি মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম: আমিও সেটা দেখেছি ফেসবুকের পাতায়। আগেও একবার নেয়া হয়েছিল এমন প্রকল্প। সেখানে আসলে কী পড়ানো হয়, কী শেখানো হয়, আমি জানি না। কারও সাথে আলাপও হয়নি এটা নিয়ে। তবে বিষয়টা ভাবলেই আমার মনে পড়ে হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর একটি বিখ্যাত উক্তি। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ভালো অভিনেতা হওয়ার জন্য কীধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেছিলেন: “Acting school helps to know What is Acting. but there’s no School or University to make you Mr. Shah Rukh Khan” প্লেব্যাক মিউজিকে ঝড় তোলা কিশোরকুমার কোনো ওস্তাদের কাছে গান শিখেছিলেন বলে প্রমাণ নেই । দিলীপকুমার সিনেমাজগতে অভিনয় সম্রাট হিসেবে খ্যাত এবং Method Acting এর প্রবর্তক। অথচ তিনি সিনেমায় অভিনয় করার আগে কোনো আর্ট স্কুলে পড়াশোনা করেননি। আমাদের লালনশাহ অথবা আরজ আলী মাতব্বর শতভাগ স্বশিক্ষিত ছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কোনো পূর্বনজির ছিল না। কিন্তু একজন নজরুল সেটি লিখেছিলেন। আল মাহমুদের মতো এমন উৎকৃষ্টমানের কবিতা কয়জন কবি লিখতে পেরেছেন পৃথিবীতে? তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, কোথাও কবিতার ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। কবিতার নিয়মকানুন জেনে যদি কবি হওয়া যেতো তাহলে তো সাহিত্যের অধ্যাপকগণ সকলেইএক একজন শেক্সপীয়ার, রুমি, হাফিজ, এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা জীবনানন্দ দাশ হয়ে যেতেন। মূলকথা হচ্ছে জন্মগত প্রতিভা। কণ্ঠে বিধাতা প্রদত্তসুর নিয়ে না জন্মালে ওস্তাদের কাছে বছরে পর বছর শিখেও কেউ মেহেদী হাসান-মহম্মদ রফি-লতামঙ্গেশকর-হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা রুনা লায়লা হতে পারবে না। লিও টলস্টয়, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বা হুমায়ূন আহমদ জন্মগত প্রতিভার বিকশিত রূপ মাত্র। তারপরও বাংলা একাডেমির নবীন লেখক প্রকল্পকে আমি স্বাগত জানাই। আর কিছু না হোক সাহিত্য সম্পর্কে ওখানে পরিস্কার জ্ঞান লাভ করা যাবে এবং জ্ঞানার্জন বা বইপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। এই সর্বমুখী দুর্নীতি ও নষ্টামির সময়ে সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
২০. বাংলা রিভিউ : এ যাবৎ সর্বমোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম: ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলা নাগাদ আমার প্রকাশিত গ্রন্থ ২৯টি। তার মধ্যে ছড়ার বই ৩টি, প্রবন্ধের বই ১টি, সংগীত বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থ ১টি এবং বাকিগুলো কবিতার বই। আমি মূলত ও প্রধানত কবি। কবিতাগ্রন্থগুলোর প্রতি আমার ভালোবাসা সর্বাধিক। আমাকে অনেকগুলো সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য। তবে নজরুল সংগীতের কাব্যমূল্য নিয়ে রচিত এবং বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আমার প্রায় পাঁচশত পৃষ্ঠার ‘‘ নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব’’ গবেষণাগ্রন্থটির জন্য আমি আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘‘গ্রেস কটেজ নজরুল সম্মান ২০২৩’’ লাভ করেছি। বাংলা একাডেমি দুই বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ বের করেছে। সংগীতের কাব্যমূল্য নিয়ে এমন বড়ো আকারের গবেষণাগ্রন্থ ইতোপূর্বে রচিত বা প্রকাশিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এভাবে বিবেচনা করলে ‘‘নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব” বইটির একটা আলাদা ও বিশেষ গুরুত্ব আছে বলে ধরা যায়।
২১. বাংলা রিভিউ : সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
আমিনুল ইসলাম: চলমান ২০২৪ সালে আমার ২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। দুটোই কবিতার বই: (১) ‘মতিহারী ভালোবাসা’ এবং (২) ‘পরদেশী মেঘ’। আমার কোনো দুটি কবিতার বইয়ের কবিতা হুবহু একই রকমের নয়। কবিতা রচনায় আমি বৈচিত্র্য পিয়াসী। তবে আমার কাব্যভাবনার নিউক্লিয়াস হচ্ছে প্রেম। আমি প্রেমের ভেতর দিয়ে জীবন ও জগৎকে দেখি। কিন্তু সেই প্রেম গতানুগতিক রোমান্টিকতার অনুসারী নয়। আমি প্রেমের মোড়কে জীবন ও মহাবিশ্বকে ধারণ করার চেষ্টা করি। এই দুটি কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুলোতেও আমার সেই কাব্যপ্রবণতার ছাপ আছে। বইদুটি নিয়ে এখনও কেউ রিভিউ লিখেননি। হয়তো লিখবেন । হয়তো-বা লিখবেন না।
২২. বাংলা রিভিউ : কোথায় আছেন? কি করছেন ? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
আমিনুল ইসলাম: আনুষ্ঠানিক ছাত্রজীবন শেষ হতে না হতেই বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯৮৮ সালের শুরুতে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলাম আমি। সেই চাকরি করেছি প্রায় ৩৫ বছর। প্রচলিত অর্থে বলতে গেলে এখন আমার পূর্ণ অবসর জীবন । আমার আব্বা বেলায়েত আলী মণ্ডল এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন ২০১২ সালে এবং আম্মা সাজেনুর নেসা বিদায় নিয়েছেন ২০১৬ সালে। এখন আমি এতিম মানুষ। আবার আমি একইসঙ্গে গোছানো একটা সংসার জীবনের অধিকারী। আমার জীবনসঙ্গী রোকশানা পারভীন লীনা অর্থনীতিতে এমএ কিন্তু চাকরি করেননি। আমার বড়ো সন্তান ডালিয়া নওশিন লুবনা বিসিএস পরীক্ষায় সফল হয়ে পিতার পেশায় অর্থাৎ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেছে। সে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল ডিগ্রি প্রাপ্ত। কনিষ্ঠ সন্তান রাগিব ইশরাক সজন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল ডিগ্রি প্রাপ্ত। সে ১ বছর একটা বেসরকারি চাকরি করে ছেড়ে দিয়েছে। অন্য চাকরির জন্য এখন তার প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে । আমার সংসারজীবন সুখে ও শান্তিতে উপচে পড়া না হলেও সচ্ছল। সেই হিসাবে আমি ভাগ্যবান। আর এমন সাজানো গোছানো শান্তিতে সচ্ছল সংসারটি প্রায় একক হাতে গড়ে তুলেছেন এবং গড়ে তোলার পর তা আগলে রেখেছেন আমার জীবনসঙ্গী রোকশানা পারভীন লীনা । তাঁর এই একতরফা গঠনমূলক ভূমিকার বদৌলতে আমি ‘‘পরিকল্পনাহীন দিন ও পরিকল্পনাহীন রাত” এর পুঁজি নিয়েও একটি ‘‘ সুখের সংসার” এর শেয়ার হোল্ডার। Fortune favours fools? একসময় কতকিছুর ঠোঁটে চুমু দিয়েছি! এখন চা-সিগারেট কোনোটাই খাই না। আর মদ খাওয়ার মতো বিলাসিতা আমার কোনোদিনও ছিলো না। তবে বই পড়া, গান শোনা এবং লেখালেখি—এই তিনটি কাজ থেকে কোনো অবসর নেই আমার। গান না শুনলে আমার একদিনও চলে না। এই তিনটি কাজ নিয়ে জাগরণের সবখানি ব্যস্ততা আমার। এভাবেই আমি সুখী। বাকি জীবনের কাছে একমাত্র চাওয়া: আমৃত্যু শারীরিক-মানসিক সুস্থতার ধারাবাহিকতা।
২৩. বাংলা রিভিউ : আপনি কখনো কি কোনো পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
আমিনুল ইসলাম: আমি পেশাগত কিছু সরকারি প্রকাশনা সম্পাদনা করেছি। সেগুলোর দুয়েকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার বাইরে আমি কোনো পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করিনি। তবে বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আড়ালে ও অলিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। কিন্তু সেগুলোর নাম বলে সম্পাদকদের কষ্ট দিতে চাই না।
২৪. বাংলা রিভিউ : লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
আমিনুল ইসলাম: এই প্রশ্নটির উত্তর লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকগণ ভালো দিতে পারবেন। লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা, পরিধি, সীমা কোনোটাই আয়ত্ব করতে পারিনি আমি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, নতুনত্বের অগ্রদূত, সমমনাদের সম্মিলিত সাহিত্য প্রয়াস—এসব কথা শুনে এসেছি। তবে বাস্তবতার সাথে সেসবের মিল পাইনি খুব একটা। আর বাংলাদেশে তো কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিনের আয়তন মহাভারতের চেয়েও বড়ো। কোনো কোনো লিটল ম্যাগাাজিন সম্পাদক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে/ অদৃশ্য অবদানে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান। বাংলাভাষার জীবিত বড়ো ও সুপ্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে দহরম মহরম করতে ওস্তাদ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের অনেকেই। এদের কাজে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বালাই নেই। তবে ইতিবাচক দিকটা হচ্ছে এই যে,– এসকল লিটল ম্যাগাজিন প্রচুর সংখ্যক লেখকের লেখা প্রকাশের সুযোগ করে এসেছে যার গুরুত্ব কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
২৫. বাংলা রিভিউ : অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
আমিনুল ইসলাম: বিজ্ঞানের যুগকে পিছে ফেলে দিয়ে এখন চলছে প্রযুক্তির যুগের অগ্রনায়কত্ব। এখনকার জীবন প্রযুক্তি পরিচালিত , প্রযুক্তি শাসিত। জীবনের ছোটোখাটো খুঁটিনাটি বিষয়গুলো থেকে সাম্প্রতিকতম মারণাস্ত্র সবকিছুই এখন প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ইন্টানেট তো পরিবর্তনের মহাপ্লাবন এনেছে। এনালগ দিনরাতকে পিছে ফেলে রাজত্ব করছে ডিজিটাল সময়। এখন প্রেমও ডিজিটাল। বই, নথি, সিনেমা, নাটক, সংবাদ–ইত্যাদি সবকিছুই মানুষ পড়ছে ও দেখছে ইন্টারনেটের সহায়তায়। সাহিত্যও কমবেশি তাই। ইন্টারনেট লেখকদের ঘরে বসে রাতারাতি পৃথিবীর সকল দেশের লেখক ও পাঠকদের সঙ্গে সংযুক্ত ও সংশ্লিষ্ট হওয়ার অব্যর্থ সুযোগ করে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিনের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সাহিত্য বিশ্বমানের । কিন্তু বিশ্বে তার সেই পরিচিতি নেই। কারণ বৈশ্বিক মিডিয়ায় তার প্রচার নেই। জীবনানন্দ দাশ- জসীমউদদীন–আল মাহমুদের কবিপরিচিতি বিশ্বব্যাপী হওয়া সমীচীন ছিল কিন্তু হয়নি। অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন বিশেষত অনুবাদ-সাহিত্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করণে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও এখন অনলাইন ম্যাগাজিন-ওয়েবজিনকে ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।
২৬. বাংলা রিভিউ : আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
আমিনুল ইসলাম: আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে তা বলা মুস্কিল। ইন্টারনেটের কারণে সাহিত্যক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ছাপ ও চাপ বেশি করে পড়বে তা বলাই যায়। আবার কোনো কোনো দেশে সাহিত্যিকগণ রাজনীতি বা রাষ্ট্রক্ষমতা দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন , এমনটাও দেখা যাচ্ছ। ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশেই এটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। একধরনের কূপমণ্ডূকতা , ক্ষমতাসীন শক্তির লেজুড়বৃত্তি, ধর্মীয় অন্ধত্ব ও রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার কাছে আত্মসমর্পণ ইত্যাদি লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিক কালে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যের মতো বিশ্বমাপের সাহিত্য পাওয়া যাচ্ছে না এসব দেশে। তবে আমার মনে হয়, এসব ক্রান্তিকালীয় পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠে সাহিত্যিকগণ বিশ্বশান্তি ও বৈশ্বিক মনের পক্ষে কাতারবদ্ধ হবেন । পৃথিবী পাবে আন্তর্জাতিকতার ঘ্রাণে সচ্ছল ও সমৃদ্ধ বিশ্বমানের মহৎ সাহিত্য, বিশ্বমানবের মহৎ সাহিত্য । অবশ্য তখন সাহিত্যরুচি আরো পাল্টাতে পারে এবং সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে সাহিত্যের স্বরূপেও পরিবর্তন আসতে পারে।
২৭. বাংলা রিভিউ : কেমন পৃথিবী দেখতে চান?
আমিনুল ইসলাম: আমি কবি; প্রকরণ বা কাব্যশৈলীতে নয়, কিন্তু মনেপ্রাণে লালন-রবীন্দ্র-নজরুলের অনুসারী। তাঁরা ছিলেন অন্যায় যুদ্ধবিরোধী এবং সকল প্রকার হানাহানির বিপক্ষে। অর্থাৎ শান্তির পক্ষে। আমার স্বপ্নের পৃথিবীকে নিয়ে আমি আটদশ বছর আগে একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটির নাম ‘‘অবুঝ স্বপ্নের সমীকরণ’’। কবিতাটিই তুলে দিচ্ছি এখানে:
স্বপ্ন দেখি—ছুরিগুলো স্যালুট করছে গোরুগুলোর পায়ে
আর গোরুমশায়েরা ডান পা উঁচিয়ে গ্রহণ করছে সালাম;
স্বপ্ন দেখি—নেকড়েরা রাখি বাঁধছে হরিণের গলায় আর
হরিণ-নেকড়ের নাচের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে বাঘ;
স্বপ্ন দেখি—সামরিক কারখানাগুলো উৎপাদন করছে
গোলাপগন্ধী পারফিউম আর কামানগুলো লিখছে কবিতা;
স্বপ্ন দেখি—পেন্টাগনে পড়ানো হচ্ছে প্রেমের বর্ণমালা
আর সৈন্যরা পরে আছে বেহুলা-লখিন্দর ইউনিফরম।
স্বপ্ন দেখি–বাংলাদেশের রাজনীতিকরা একতাবদ্ধ হয়েছেন
জাতীয় স্বার্থের এজেন্ডায় আর নদীগুলো ফিরে পাচ্ছে জল।
স্বপ্ন দেখি—-দ্বিধার শহর থেকে ফিরে আসছো তুমি আর
তোমার জন্য কফির মগ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি দুয়ারে।
——-০০০——-
গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
আগস্ট ২১, ২০২৪