তৈমুর খান
২৬
নিষ্পাপ করুণ অসহায় মুখটি কবিতার শব্দে শব্দে ভেসে উঠছে
আমাকে সব থেকে বেশি ভাবিয়েছে এবং উদ্বিগ্ন করেছে সারা দেশ জুড়ে একের পর এক ধর্ষণ। কেন এত ধর্ষণ? শুধু কি নারী শরীর ভোগের কারণে? শুধু কি যৌনতার আকর্ষণ? শুধু কি অবদমিত ইচ্ছার প্রতিফলন? সঠিক কোনো কিছুকেই এর কারণ হিসেবে নির্ধারণ করতে পারিনি। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চরম রমরমা। এই রাজনীতিতে সমাজের উচ্চশ্রেণির সম্প্রদায়রা মানবিকতার কোনো মূল্য দিতে জানে না। তাই লাগাতার ভাবে সমাজের নিম্ন শ্রেণি তথা দলিত শ্রেণির এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের রমণীরা বেশি ধর্ষিতা হন। ২০২৩ সালে মণিপুরে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মহিলাদের নগ্ন করে উল্লাস করতে করতে রাস্তায় হাঁটানো হয়েছিল এবং শেষে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল এই ধর্ষণের ঘটনায়। আজ পর্যন্ত তার সঠিক বিচার হয়েছে বলে মনে হয়নি। নিজের পুরুষসত্তায় এবং পুরুষ-ইচ্ছায় ধর্ষণে সক্রিয় হবার অবস্থানটি কতটুকু সমর্থনযোগ্য তা উপলব্ধি করতে চেয়েছিলাম। একটি কবিতাতে তা লিখেছিলামও:
“মণিপুর ২০২৩
দৃশ্যটি বারবার দেখছিলাম,বারবার
আমিও পুরুষ নাকি?আমারও এমন ইচ্ছা হয়?
তাদের মতোই ইচ্ছাগুলি
জেগে উঠছিল নাকি এখনো জেগে ওঠে?
অনেক পশুর গান,যে গান কখনো শুনিনি
অনেক পশু, তবুও এমন পশু কখনো দেখিনি!
হাড় হিম হয়ে আসে,অশ্রুও আগুনের ফুলকির মতো
দুই হাত আজ শুধু তরবারি চায়,শুধু তরবারি
ধর্ষণের আর্তনাদে আকাশ ঢেকে যায়
স্বপ্নগুলি নারী শরীরের মতো
বাঁচার ইচ্ছাগুলি কুঞ্চিত স্থলিত যোনি
অপমানে রক্তাক্ত বেদনাবিধুর আয়ু
কোন্ লিপি লিখবে হৃদয় ভাঙার হাহাকার?
কোন্ ইতিহাস লিখবে পরিচয় নির্লজ্জ সভ্যতার?
কতদিন আর এই ধর্ষণ হুংকার?
কতদিন লিঙ্গোত্থিত রাষ্ট্রের এমন স্বৈরাচার?”
না, ধর্ষণের মতো বিকৃত রুচির পুরুষ-ইচ্ছা কখনো জেগে ওঠেনি। শুধু নিজেকে ধ্বংস করার মতোই এই কাজটি নয়, এর দ্বারা মানবসভ্যতাও ধ্বংস হতে পারে।যাদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, প্রশাসন আছে অর্থাৎ অর্থবল ও বাহুবল দুই-ই আছে—তারাই এই অসামাজিক নিষিদ্ধকর্মে দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে। যে রাজনৈতিক দল ভারতে ক্ষমতা দখল করে পক্ষপাত মূলক আইন ব্যবস্থাকে চালিত করছে মূলত ধর্ষণের কাজে তারাই এগিয়ে। কে করবে তাদের বিচার? যেখানে কোনো বিচারই নেই! সুতরাং এই সময়কালটি ধর্ষণ দেখে দেখে আমাদের পার করতে হচ্ছে। কবিতা যেন সময়েরই ডায়েরি। অন্যায়,ব্যভিচার শোষণ সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং মবলিঞ্চিং এর মতো ঘটনারই মুখোমুখি হতে হচ্ছে বারবার আমাদের। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জনগণও মাছির মতো। গুড়ের গন্ধ, না গু-এর গন্ধ তা তাদের বিচার করার ক্ষমতা নেই। যেকোনো গন্ধ পেলেই তারা ভন্-ভন্ শব্দে উড়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষের বিবেক থাকলেও তারা বিবেক বিক্রি করে দিচ্ছে। ভালো মানুষের সংখ্যা কম। তাই তারা আত্মগোপন করতে বাধ্য হচ্ছে। কে শুনবে কার কথা?
এসব ভাবতে ভাবতে মাথা ভারী হয়ে গেলে তখন সময় পেলে প্রকৃতির সন্নিধানে যাই। সভ্যতার ক্রন্দন বারবার কণ্ঠরোধ করে। তাই গাছগাছালি আকাশ ও মেঘের সীমানায় উড়ন্ত পাখির মতো মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলি। স্মরণে আসে আমার পূর্বজদের কথা। দুঃখের কথা। কত বিপন্ন দিন কাটানোর কথা। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে ‘তাহালা’ নামক একটি পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসতাম। একটি পাকুড় গাছের তলায়। সামনে ছিল গোরস্থান। মনে হতো মৃত মানুষদের জেগে ওঠার টের পাচ্ছি। দাদা-দাদি, ফুফু ও ফুফা, চাচা ও চাচি এবং গাঁয়ের আরও কত মানুষ সেখানে শুয়ে আছেন। নিজের মনে মনেই কথা চলত তাঁদের সাথে।
—তোমাদের দেখতে আসি রোজ। কত কষ্টে আছো তোমরা জানতে চাই।
—দুনিয়াতে আমরা সুখ পাইনি। এখানে তবু মনে হয় অনেক শান্তি। পৃথিবীর কোনো সম্পদ এখানে নেই। সম্পদই তো কষ্টের কারণ!
—আমারও কোনো সম্পদ নেই। তবু মানুষের কথা ভেবে কষ্ট পাই। চারিদিকে কত হাহাকার। মানুষ মারার কৌশল। রাজনৈতিক চক্রান্ত। জাত-ধর্ম নিয়ে হানাহানি।
—সবাই একদিন বিনাশ হবে। ক্ষমতা চিরদিন থাকবে না। মানুষের জীবনের আয়ু খুব সামান্য। ভয় পেয়ো না। স্রষ্টার প্রতি ভরসা রেখো।
—যেভাবে ব্যভিচার ঘটছে, ধর্ষণ ঘটছে, মৃত্যু ঘটছে—সেসব দেখে সহ্য করতে পারছি না। হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে কান্নায়। তবু চিৎকার করে কাঁদতে পারছি না। যুদ্ধের সৈনিকের মতো প্রতিবাদ জানাতে ইচ্ছে করছে। তবু প্রতিবাদ করতে পারছি না। কার কাছে বলব এসব?
—বলতে হবে না, তুমি তো লিখতে পারো, তোমার হাতে কলম রয়েছে। আমরা কেউ শিক্ষিত ছিলাম না। আমরা সবাই গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। দু’বেলা খাবার জোটাতে জোটাতেই আমাদের আয়ু ফুরিয়ে গেল। এখন এই বিশ্রামে রয়েছি। তুমিও একদিন আমাদের কাছে চলে আসবে।
—হ্যাঁ, আমি অবশ্যই আসব! যতদিন বেঁচে আছি, যতটা পারি লিখে যাব। এই লেখা কোথাও তেমন প্রকাশ হয় না। তবু কখনো কখনো তা কেউ প্রকাশ করেন। তাতেই আনন্দ। আমি তো তোমাদেরই প্রতিনিধি! একটা ছোট্ট গরিব গাঁয়ের সন্তান। অনেক লড়াই করে করে বড় হয়েছি। কত ঠাট্টা তামাশা ভ্রুকুটি সহ্য করে করে এগিয়ে এসেছি। জবাব দেবার কোনো কৌশল জানা ছিল না। তাই এই লেখা নিয়ে বসে ছিলাম।
—যাও তুমি ফিরে যাও ঘরে, মাগরিবের আজান ধ্বনিত হচ্ছে। সিজদা করো গিয়ে তোমার স্রষ্টার নিকটে। ইহকালে পরকালে সে-ই তোমাকে রক্ষা করবেন।
অবশেষে আমাকেও বাড়ি ফিরতে হয়। কিন্তু যে সংবাদে আমার ব্যথিত হৃদয় ভারাক্রান্ত তা নিরাময় কিছুতেই হয় না। তখন লিখতে হয়—
“কুমারী বিকেল
একটা কুমারী বিকেল সর্বনাশের দিকে চলে গেল
ওর রক্ত গড়িয়ে পড়ল মাটিতে
ওর বুকের পাপড়ি ঝরে পড়ল রোদ্দুরে
এত উদ্ধত লিঙ্গগর্জন কী করে সামাল দেবে?
রক্তচক্ষু মৃত্যুভয় আর বিকৃত পৌরুষাচার
ক্রমে ক্রমে থেঁতলে দিল জীবন
শিউলির শিহরন, কাশবনের হাওয়া
হারিয়ে গেল মোটরের টায়ারের নীচে
দুর্গন্ধ ধোঁয়ায় পোড়া রাত এল
কান্নাভেজা চাঁদ সারারাত ডেকে ডেকে
ফিরে গেল একা
অন্ধকারের কোনো আদিম গুহায়…”
রোমান্টিক হওয়ার অবকাশ কোথায়? ক্লান্ত বিষণ্ণ দিনযাপনের ছবি আর রক্তাক্ত মৃত্যুর আর্তনাদে সভ্যতা ভরে যাচ্ছে। কবিতাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে ফেললাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কবি মলয় রায়চৌধুরী কবিতাটি শেয়ার করলেন। আমাকে বাহবা দিলেন। উৎসাহিত বোধ করলাম। মলয় রায়চৌধুরী বরাবরই প্রতিবাদী কবি। আমার খুব পছন্দেরও কবি। তিনি একটি কবিতা লিখে তা আমাকে উৎসর্গও করলেন। কবিতাযাপনের সময়গুলিতে মলয় রায়চৌধুরীর গর্জন আমার কাছে এক ভিন্নমাত্রার ছিল। যে কথা আমরা বলতে পারতাম না, যে নতুন পথে আমরা চলতে পারতাম না, সেই পথ ও সেই কথা বলার মানুষ তিনি। তাঁর কবিতা যে ভালোলাগার বিষয় তা কিন্তু নয়। তাঁর সাহসী উচ্চারণ এবং নতুন পথের অন্বেষণ সর্বদা নিরীক্ষণ করার বিষয় ছিল আমাদের। একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, অনুবাদক, সাংবাদিক এবং হাংরিয়ালিজম্ ও পোস্ট মডার্নিজম্ এর রূপকার মলয় রায়চৌধুরীকে এক বহুমুখী উত্থান ও জীবনপর্যটক বলেই মনে হয়েছে আমার। পরিবর্তনশীল জগতের প্রবহমান অস্তিত্ব নিয়ে তিনি ঝংকৃত ও পরিব্যাপ্ত। শুধু কুশলী শিল্পী হিসেবে নয়, শিল্প ভাঙার শিল্পী হিসেবেও। তিনি কখনোই নিয়ন্ত্রিত ও সীমায়িত হতে চাননি। সামাজিক হয়েও সমাজমননের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন। শরীরবৃত্তীয় পর্যায়গুলি সক্ষমতার সঙ্গে লালন করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর লেখায় ফিরে আসে মগ্নচৈতন্যের অবধারিত ক্রিয়াকলাপ। প্রজ্ঞানাচারী বৈভাষিক মিথলজি ।
পরবর্তীকালে আরও এক কবিকে পেয়েছিলাম, তিনি গোলাম রসুল। একদিন হাওড়ায় ‘চাষির মাঠ’ এলাকায় তাঁর বাড়িতে যেতে পেরেছিলাম। অজস্র কুকুর-বেড়ালে ভর্তি বাড়িখানা মনে হচ্ছিল একটি চিড়িয়াখানা। বইয়ের আলমারির ভেতর বিড়ালের বাচ্চা এবং পোয়াতি বেড়ালও বিশ্রাম করছিল। কয়েকটি কুকুর আমার দিকে তেড়ে এসেছিল, নিমেষেই কবি তাদের শান্ত করতে পেরেছিলেন। একখানা তালাই পেতে দু’জনে পাঁউরুটির টোস্ট দিয়ে চা খেতে খেতে অনেক গল্প করেছিলাম। তারপর বিকেলে দু’জনে ভাত খেতে বসেও কুকুর-বেড়ালের সঙ্গেই কবিও খাচ্ছিলেন। প্রাণীদের সঙ্গে কবির অদ্ভুত সম্পর্ক। একটি পোয়াতি বেড়াল মারা গেছিল বলে কবি তার জন্যও খুব কেঁদেছিলেন। গোলাম রসুল মহাজাগতিক এক মহাবিস্ময়ের কবি। তিনি নিজেকে ভাবতেন এই মহাবিশ্বের নাগরিক। তাই মহাকাশ মহাপৃথিবী তাঁর খেলার স্থল। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র তাঁর খেলার বস্তু। আকাশ-পাতাল ভেদ করে ভিন্ন জগতে তাঁর চলাচল। মৃত মানুষের এবং মৃত মানুষের কবরগুলির সঙ্গেও তিনি কথা বলেন। সমুদ্র, মেঘ, বাতাস, আলো-অন্ধকার সবাই তার আজ্ঞাবহ। মহাব্যাপ্তির ভেতর আশ্চর্য অসম্ভব বলে তাঁর কাছে কিছু নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সবকিছু ঘটে চলে। আমরা যখন পৃথিবীর সুখ-দুঃখ, পাওয়া-না-পাওয়া, রাগ-অভিমানের আনন্দ-বেদনা উপভোগ করি—তখন তিনি এসবের ঊর্ধ্বে আবহমান মহাজীবনের অনুসারী হয়ে অবস্থান করেন। স্বেচ্ছাধীন স্বতঃস্ফূর্ততার মাধ্যমে অসীম,অনন্ত ও অচেনা এক জগতের সন্ধান করেন।এই জগৎকে পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না। অনুভূতির মাধ্যমেও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কল্পনাও সেখানে পৌঁছাতে ব্যর্থ। এই জগতের কথা বলতে গিয়েই প্রতীকবাদের প্রতি কবির ঝোঁক বেশি হয়। তাই তাঁর কাব্যদর্শন আমাদের কাছে একটি নতুন দিগন্ত হয়ে ওঠে। তাঁর দেওয়া সব বইগুলি পড়তে পড়তে আশ্চর্য হই। শূন্যের ভেতর বিস্ময়ের অট্টালিকা নির্মাণ কখনোই তাঁর শেষ হয় না। অনন্তচেতনায় মহাজীবনকে ধারণ করেই কবির যাত্রা অব্যাহত। আমার ‘বৃত্তের ভেতরে জল’ কাব্যগ্রন্থটি মূলত তাঁরই উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ১৭ জুলাই শিয়ালদহ কৃষ্ণপদ মেমোরিয়ালহলে তাঁরই হাত দিয়ে। গোলাম রসুলের কাছাকাছি গিয়ে দেখেছি মলয় রায়চৌধুরীর মতো তিনিও তথাকথিত যশখ্যাতির ঊর্ধ্বে থাকতে চান। তাই লেখালেখির জগতে কী পেলাম বা কী পেলাম না, কেউ লেখা ছাপল বা ছাপল না এসব কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। নিজের তাগিদেই লিখতেন। নিজের মতো করে লিখতেন।
আমার বিছানার দুই পাশে আজও ছড়িয়ে আছে বই, শুধু বই। গোলাম রসুলের কবিতা সমগ্র। মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা সমগ্র। চেতনে-অবচেতনে তাদের পাতা উল্টে যাচ্ছি। আকাশে ঘনকৃষ্ণ মেঘ। আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষিতা হয়ে বীভৎস মৃত্যুবরণ করেছেন ডাক্তার মৌমিতা দেবনাথ। তাঁর নিষ্পাপ করুণ অসহায় মুখটি কবিতার শব্দে শব্দে ভেসে উঠছে। এই সময় কি পাল্টাবে না?