১/ জীবন কী? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা হয়েছেন– এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?
উত্তর :: এ প্রশ্নের জবাব গভীর দার্শনিক প্রতীতির অপেক্ষা করে। সেদিকে আপাতত যাচ্ছি না। কারণ, দর্শন-ভূয়োদর্শন-নীতিকথা, ধর্মগ্রন্থ, লোকায়ত ভাবনামণ্ডলে এই জীবনকে যেভাবে, যে-আলোকে দেখা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে সভ্যতার প্রদোষকাল থেকে, তা এড়িয়ে নতুন কোনো জীবনদর্শন হাজির করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না, একই বিষয়ে গভীরতর উপলব্ধি ছাড়া। যদি তা করতে যাওয়াও হয় পুনরুক্তি দোষ ঘটার আশংকা থেকে যায়।
অন্যদিকে কবি তাত্ত্বিক নন। অধীতবিদ্যা ও জ্ঞানের একাডেমিক ব্যাখ্যাকার বা ভাষ্যকারও নন। জীবন সম্পর্কে ধর্মীয় ও অন্যান্য জ্ঞানতাত্ত্বিক গহন জিজ্ঞাসার অরণ্যে আর তার ব্যাখ্যা-বাখানে সন্তুষ্ট মানবমণ্ডলীর স্বাভাবিক জীবনযাপনের ভেতরে আপন অনুভাবনার টানাপোড়েনে নিরন্তর পরিয়ায়ী এক সত্তার নাম কবি।
সকল প্রশ্ন ও জবাব যেখানে অবসিত হয়েছে বলে মনে করা হয় সেখানেই কবি জাগেন মানবকল্যাণের ব্রতে– হয়তো তা নতুন, হয়তো তা পুরোনোকে নতুন
রঙে রাঙিয়ে। কবি তা করেন শব্দের সীবনে, কবিতার নভোযানে ভেসে-ভেসে। বড় কবির উন্নত প্রাতিস্বিক চেতনা ও অনুসন্ধান সেখানে নতুন অপরূপ
ব্যাখ্যা-বয়ানও হাজির করতেও পারে। সে এক অভিনব অনুরণন। তিনি তা করেন তার মাতৃজবানে, তার যাপনের উসিলায়। সে হলো এক সম্মোহক
উদ্ভাসন। সুতরাং জীবন হলো মানুষের মন ও মনীষার উত্তাপ থেকে উৎসারিত কিছু নমনীয় ও অনমনীয় প্রশ্নমালার বিভিন্ন উত্তর, যার কোনো সমাপ্তিবিন্দু নেই।
ছোটোবেলা থেকে কবিতারচনার সূত্রে যুবাবয়স থেকে বিভিন্ন স্বীকৃত পেশার মাধ্যমে জীবিকা আহরণের চেষ্টা করেছি চট্টগ্রাম শহরের বৃত্তেই।
সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত আছি দুই দশক ধরে। কবি হবো বলেই তো সেই কবে থেকে এই জীবনকে নিংড়ে চলেছি।
না, কোনো আক্ষেপ নেই। ‘আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা’– মনে হয় এই জায়গাতেই এসে দাঁড়িয়েছি এখন।
২/ আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোনো অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পড়ে, তাড়িত করে?
উত্তর :: আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রাম শহরেই। স্বাধীনতাপূর্ব কালের এক মধ্যবিত্ত সরকারি চাকুরে পিতার আমি সপ্তম সন্তান। বাড়ির সামনের
অবারিত মাঠে ডাংগুলি, কানামাছি, ফুটবল খেলে, মাঠের লাগোয়া পুকুরে মাছ ধরে, সাঁতার কেটে আর মায়ের কড়া শাসনে সবকিছুতে রয়ে-সয়ে, দুষ্টুমিভরা, ডানপিটে সেই এক কৈশোর ও প্রাকযৌবনের জীবন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালে আমার দুই অগ্রজের সেখানে সংস্রবের কারণে আমাদের বাড়ি পাকিস্তানি নৌসেনাদের দ্বারা নভেম্বর মাসের শেষদিকে আক্রান্ত হয়। আমার বয়স তখন ১০, যেহেতু ১৯৬১ সালে আমার জন্ম। জান বাঁচাতে ঘরের সবাই পেছনের ঝোপঝাড় ও পুকুর পেরিয়ে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হলেও আমি বেশি দূর যেতে না-পেরে বাড়ির পেছনের পুকুর ধারের একচিলতে ঝোপের ভেতরে আশ্রয় নিই। বৈদ্যুতিক বাতি ছিল না। ওরা অপারেশনের আগে তা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। তবে রাতটি ছিল ভরাপূর্ণিমার। ওই ঝোপে বসে চারপাশে প্রচণ্ড গুলি, গ্রেনেড চার্জ ও নানা ধরনের বিস্ফোরণের শব্দে ঝোপের ভেতরে আল্লাহর নাম জপতে-জপতে জড়সড় হয়ে কাঁপছিলাম জীবন সংশয়ের পূর্ণ আশংকা নিয়ে। কারণ, আমার
মাথার ওপর দিয়ে গুলির অজস্র লাল-লালখণ্ড এসে পড়ছিল সামনেই, পুকুরের জলে। কী আশ্চর্য! বিভিন্ন দিক থেকে ওড়ে আসা গুলির অংশগুলো ঝুপ-ঝুপ
শব্দে আমার চারপাশে পতিত হতে থাকলেও আমার গায়ে একটিও লাগেনি! অথচ ওই গুলির একটিও যদি আমর মাথার ওপর পড়তো– তার ষোলোআনা
আশংকাও ছিল– তাহলে নির্ঘাৎ আমার মৃত্যু হতো সেদিন, সেই ঝোপের ভেতরেই। কেউ জানতো না। এই দুঃস্মৃতি মাঝেমাঝে খুব তাড়িত করে। সেই থেকে
মনে হয় একটা মরণোত্তর জীবনই যাপন করছি এখন।
৩/ সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে, কোথায়?
উত্তর :: এ প্রশ্নের খুব গোছালো জবাব হয়তো এখন আমার কাছেও তেমন নেই। ছোটোবেলা থেকেই এক-আধটু ছড়া-গল্প লিখতাম নিজের মতো করে।
১৯৭৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবার পর নিজেকে প্রকাশ করার দুর্নিবার ইচ্ছেয় বের করি দেয়ালপত্রিকা ‘আলোকসম্পাত’। আশপাশের ছড়া-কবিতা-গল্পলিখিয়ে বন্ধুদের নিয়ে দুবছর এটি অব্যাহত গতিতে চলে আমাদের বাড়ির দেউড়িঘরের বেড়ায় টাঙিয়ে। মাঝে-মাঝে সাহিত্যসভা করতাম
ওখানেই, আসরটির নাম দিয়েছিলাম ‘সাহিত্যিকা’। পরে মুদ্রিত আকারে ওই দেয়ালিকাটির বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। নানা কারণে দেয়ালিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে বের করলাম ‘রেনেসাঁস’। এবার শুধু নিজের কবিতা ছাপানোর উদ্দেশ্যেই ওটার প্রকাশ। এটি ১৯৮২ সালের কথা। ৪ সংখ্যা পর্যন্ত বেরিয়েছিল। ১৯৮৩ সালে প্রকাশ করি চটিকাব্য ‘সুন্দরের দুর্গ’। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
কয়েকজন ছাত্রের উদ্যোগে বেরোলো আমার রচিত একক প্রেমের কবিতার ভাঁজপত্র ‘বিধ্বস্ত ক্যাম্পাস’। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়ে কয়েকজন ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে প্রকাশ করি ‘ফুলবাড়িয়ার নিহত পলাশগুলো’ নামে একক প্রতিবাদী কবিতাপুস্তিকা। ১৯৮৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বায়ান্নের ভাষা শহীদদের ওপর নিজস্ব ভাবকল্পনার সংমিশ্রণে রচনা ও প্রকাশ করি ‘শোণিত প্রপাত’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা। ১৯৮৬ সালে আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে বের করি ‘বৃষ্টি’ নামক ছোটোকাগজ।
একটিই সংখ্যা বেরিয়েছিল ওটার। ১৯৮৮ সালে ‘চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড়’ নামের কৃশকায় কাব্যটি প্রকাশের পেছনে ছিল তাও আমার কয়েকজন বন্ধুর অবদান।
ওই ছোট্ট বইটিতে সেই সময়ের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের দ্রোহচেতনার সপক্ষে কয়েকটি কবিতা ছিল– এ অভিযোগ তুলে বইটি পার্বত্য অঞ্চলে নিষিদ্ধ
ঘোষণা করেছিল সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এ হলো শুরু থেকে আমার সাহিত্যচর্চার মোটামুটি একটা কালপঞ্জি। এ তৎপরতার সকলই ঘটছে চট্টগ্রাম শহরে।
৪/ বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান,
আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ– তাঁদের সাহিত্যকর্মকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন। আর কার-
কার সঙ্গে আপনার সখ্য বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল? তাঁদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাঁদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর :: যে কজন কবির নাম বললেন তাঁরা বাংলাদেশের সাহিত্যে অনিবার্য নাম– কবিতায়– মননশীলতায়। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ-এর সঙ্গে
কাকতালীয়ভাবে (মানে আমি যেচে কারু সঙ্গে পরিচয়ে কুণ্ঠিত স্বভাবের মানুষ) আমার সাক্ষাৎ ঘটে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। দুর্ভাগ্যবশত উল্লিখিত কবিদের আর কারু সঙ্গে তাঁদের কিছু সাহিত্যপাঠ ব্যতীত আমার চাক্ষুস দেখা বা পরিচয় ছিল না। রাহমান ও মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার দুই মহা স্তম্ভ। দুজনের কাব্যধরনের নিজস্বতাখচিত শনাক্তরেখাসহ এ পর্যবেক্ষণ সর্বসম্মত। ফররুখ আহমদ এ দুই কবির পূর্বসূরি। তাঁর কবিতার দার্ঢ়্য বন্ধন ও অপূর্ব অনুরণন
ছোটোবেলা থেকেই আমাকে টানতো। তাঁর ‘পাঞ্জেরী’, ‘সাতসাগরের মাঝি’, ‘ডাহুক’, ‘লাশ’ প্রভৃকি কবিতা বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ। আবুল হোসেন চল্লিশের দশকে কলকাতায় বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রকৃত আধুনিক-মনস্কতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সৈয়দ আলী আহসান তাঁর অসামান্য
পাণ্ডিত্য ও মনীষা নিয়ে বাংলা কবিতা ও গদ্যে যে বলিষ্ঠ স্বাক্ষর রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়। তাঁর ‘আমার পূর্ববাংলা’ কবিতাগুচ্ছ ৬০-৭০ দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের অন্যতম স্মারক। ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী পঞ্চাশের উল্লেখযোগ কবি। অন্যদিকে পরবর্তী দশকের আবদুল মান্নান সৈয়দ কবিতার সুবেদী ও মনস্বী বিশ্লেষক। তাঁর ‘শুদ্ধতম কবি’, ‘দশদিগন্তের দ্রষ্টা’, ‘করতলে মহাদেশ’, ‘নজরুল ইসলাম কেন বড় কবি’ প্রভৃতি ব্যক্তিগতভাবে আমার ভেতরে কবি ও কবিতাভুবনের অনেক দরোজা-জানালা উন্মুক্ত করতে সহায়তা করেছে। একই সঙ্গে মান্নান সৈয়দ ষাটের অন্যতম প্রধান কবি।
৫/ আপনি একাধারে একজন কবি ও সাহিত্যবিশ্লেষক– অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল, বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কীভাবে দেখেন? কীভাবে উপভোগ করেন?
উত্তর :: ধন্যবাদ। এ অধমের পরিচয় নির্ণয়ে যে-বিশেষণগুলো প্রয়োগ করা হলো তা মনে আনন্দসঞ্চারী হলেও আমি তার যোগ্য নই।
কারণ, নিজের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে আমি সচেতন। বলতে পারি, সাহিত্যের বড় ভুবনে আমি এক প্রমুগ্ধ পর্যটকমাত্র। কবিতায়, বিশেষ করে বিগত
বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতার নিবিড় পাঠের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র স্বর উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি– অনেক বিশিষ্ট
কাব্যসমালোচক তার কিছু প্রশংসাও করেছেন– তা সত্ত্বেও আমি কবিতার ভুবনে নিজেকে পরিতৃপ্ত মুসাফির মনে করতে অনীহ। কবিতাকুহকের এক অশেষ পথের শেষটার সন্ধানে আমি আজও অক্লান্ত পথচারী। বলা যায়, আমার অনুভূত কবিতাকলার বিন্দু-বিন্দু আলোকণাগুলো একত্র করে এক উজালা
ভুবন সৃষ্টিতেই ধ্যানমগ্ন ও কর্মচঞ্চল থাকতে চাই।
৬/ আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে– আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে?
উত্তর :: চর্যাপদ বাংলা কবিতা ও ধ্রুপদি গানের বনেদি পশ্চাৎভূমি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এর ভাষা অনেকটাই আঞ্চলিক বা গোত্রীয় ভাষার গন্ধবাহী।
প্রতাপী ও সংহারী স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুর শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে সিদ্ধাচার্যগণ যে-ভাষাবর্ম ধারণ করেছিলেন তা পরবর্তীকালে যথার্থ সমাজচিত্রসহ তাঁদের
বঞ্চিত ও নিপীড়িত আত্মার বার্তা আমাদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁরা পর্বত ও পর্বতের গুহায় বসবাসে বাধ্য হলেও প্রতিবাদের জোরালো প্রকাশ অব্যক্ত রাখেননি। সেই ধারা বেয়ে আমাদের সাহিত্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা ও কর্তৃত্বের ভুজঙ্গ ফণাকে প্রতিহত করার অহং ধরে আছে সগৌরবে। সিদ্ধাচার্যদের দেখানো ওই পথ ধরে আমাদের কাব্য, কথাসাহিত্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, গ্রাফিতি ও রাজপথের বাচিক স্পন্দন
সকল কালের সকল দুঃশাসনকে রুখে দেবার শক্তি ও সম্ভাবনাকে পেয়েছে উত্তরাধিকাররূপে।
৭/ সাম্প্রতিক বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন্ কোন্ চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে মনে হয়? কীভাবে এগুলো মোকাবিলা করেন?
উত্তর :: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ বটে। সত্যি করে বলতে গেলে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের
আলাদা করে কোনো স্পষ্ট অবয়ব খুঁজে বের করা ভারি দুষ্কর– হাতেগোনা কয়েকজন বাদে। এটি এখানে প্রায়শ একটি পীড়াদায়ক বিষয় যে, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এখানে যতটা না সাহিত্য-শিল্পের গহন মঞ্জিলে ভ্রমণশীল অর্থাৎ নতুন-নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা বা সৃজনশীল সূত্র বা পাঠকের পক্ষে প্রলুব্ধকর অনুভূতির উপস্থাপক, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন তারা দুঃশীল, ক্ষমতাবান রাজনীতিকের স্তাবকরূপে। ঠিক গলায় চেইন বাঁধা প্রশিক্ষিত অ্যালসেশিয়ানের মতো। ইতিবাচক রাজনৈতিক সচেতনতার বোধ অবশ্যই শিল্পসাহিত্যের সাধকদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার উপস্থিতি কাম্য, কিন্তু তার নামে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অপকর্মটাও যদি তারা সর্বত্র প্রদর্শনে মরিয়া হয়ে ওঠেন, তাহলে রসিকমহলের হাস্য সম্বরণ অসাধ্য হয়ে ওঠে বইকি। বাংলাদেশের এই অসুস্থ বা বিকারগ্রস্ত বাস্তবতা প্রতিনিয়ত আমাকে বিরক্ত ও বিব্রত করে। সাহিত্যের নামে এই উপরচালাকি আমাদের সৃজনশীলতাকে তলানিতে ঠেকিয়েছে ইতোমধ্যে। আগেও বলেছি, এ নিন্দিত ধারার বিপরীতে কিছু অতীব নমস্য ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব অবশ্যই রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা ওই নৈরাজ্যের তোড়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত নির্বাসিত, নেপথ্যচারী জীবন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন বা হচ্ছেন। এই নষ্ট সময় ও ভ্রষ্ট তথাকথিতদের নাগপাশ থেকে জাতীয় সাহিত্যকে মুক্ত করার জন্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও কূলছাপানো নয়া জোয়ারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বস্তুত, উল্লিখিত বিষয়গুলোই সাম্প্রতিক বাংলাদেশে অনাবিল শিল্পসাহিত্যচর্চার প্রধান চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা। এই বৈরী ও প্রতিকূল প্রতিবেশ মোকাবিলার জন্যে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত সৃজনশীলতার চর্চা ও তাকে উর্ধ্বে তুলে ধরাই বড় দায় বলে বিবেচনা করি।
৮/ আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিল? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিল?
উত্তর :: ‘জোছনা কেমন ফুটেছে’– আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম থেকে এটি প্রকাশিত হয়। এই কাব্য প্রকাশের পর ঢাকার
তখনকার ‘বাংলার বাণী’, ‘দৈনিক দেশ’, ‘গণকণ্ঠ’, সিকদার আমিনুল হক সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিপ্লব’সহ বেশ কয়েকটি কাগজে অম্লমধুর সমালোচনা
মুদ্রিত হয়। নির্মলেন্দু গুণ-এর তত্ত্বাবধানে দৈনিক বাংলার বাণীর সাহিত্যপাতায় সমালোচকের নামবিহীন আলোচনায় পৃষ্ঠাব্যাপী এ কাব্যের বিস্তর
গীবৎ করা হয়। পরে সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে জানতে পারি যে, এটি নির্মলেন্দু গুণ-এর নিজের লেখা সমালোচনা। নিজের নাম তো
নয়ই, কোনো ছদ্মনামই লেখাটাতে না-থাকায় তখনকার তরুণমহলে এ কুৎসামূলক বাক্যব্যয়ের বিরুদ্ধে বিরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। হেলাল হাফিজ-এর তত্ত্বাবধানে দৈনিক দেশ-এর সাহিত্যপাতায় মাশুক চৌধুরীর আলোচনায় দৈনিক বাংলার বিপরীত অর্থাৎ প্রশংসাসূচক বাক্য ব্যবহার করা হয়।
সাপ্তাহিক বিপ্লব ও গণকণ্ঠে এ কাব্যের কবিকে সাহিত্য অঙ্গনে স্বাগত জানানো হয়। এসব তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতার পাশে আমার সতীর্থ কাব্যসহচরদের
প্রেরণা ও উৎসাহ আমাকে নতুন উদ্যমে কবিতাচর্চায় সম্পৃক্ত রাখে, আজ এ কথা স্বীকার করতেই হয়।
৯/ সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
উত্তর :: বাংলা ও পাশাপাশি ভিনদেশি সাহিত্যের যৎসামান্য পঠনপাঠন ও সেসবের অনুধাবনার মাধ্যমে আমার ভেতরে একটি নিজস্ব সৃজন ও মননশীলতার
ভুবন তৈরি হয়েছে মনে করি। সেখানে অসাধারণ, প্রাতঃস্মরণীয় পূর্বজদের প্রভাব ও প্রতীতি যেমন রয়েছে, তেমনি নিজস্ব দেশকাল চেতনা ও মানুষের
হিতাকাঙ্ক্ষাও যুক্ত রয়েছে একই সমতালে। এই মিথোস্ক্রিয়ায় যে শৃঙ্খলা ও আবেগ, দায় ও স্ফূর্তি, সৌন্দর্যবোধ ও বাস্তবতার অভিঘাত আমি প্রত্যহ
অনুভব করি নিজের ভেতরে, এক কথায় তা কোনো লুটেরা অভিজাত শ্রেণির পৃথুল প্রত্যাশাকে পরিতৃপ্ত ও প্রলম্বিত করে না। বরং বাংলাদেশের ধর্মবর্ণগোত্রভাষা নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের অতিসাধারণ জীবনের রূপকার হবার সাধনাই সেখানে প্রধান অভিমুখ। মহান তলস্তয়, ফিওদর দস্তেয়ভস্কি, ইব্রাহিম ফ্রানৎজ ফানন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাকসিম গোর্কি, মহাশ্বেতা দেবী, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যাক লন্ডন, গারথিয়া লোরকা, রুবেনদারিও, মিগুয়েল হারনানদেজ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এডওয়ার্ড সাইদ, রণজিৎ গুহসহ আরও অনেকেই– এই তো আমার সাহিত্যের উত্তরাধিকার!
১০/ এ যাবৎ সর্বমোট আপনার কটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন্-কোন্ কাজকে বা বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
উত্তর :: আমার এ পর্যন্ত প্রকাশিদ বইগুলো হলো : জোছনা কেমন ফুটেছে ১৯৮২, চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড় ১৯৮৮, লোহিত ম্যান্ডোলিন ১৯৯১, বাংলাদেশের
উপজাতি ও আদিবাসী : অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত (সম্পাদিত) ১৯৯৩, স্বপ্নখণ্ডের রোকেয়া বেগম রুকু ১৯৯৫, আদিবাসী কাব্য ১৯৯৭, আমাদের কবিতা ও আদিবাসী প্রসঙ্গ ২০০১, টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড ২০০২, জুমপাহাড়ের ওম ২০০২, আদিবাসী প্রবন্ধ ২০০৪, নির্বাচিত আদিবাসী গদ্য ২০০৫, হাফিজ রশিদ খানের ৭ সাক্ষাৎকার ২০০৬, এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না ২০০৬, অরণ্যের সুবাসিত ফুল ২০০৯, আদিবাসী জীবন আদিবাসী সংস্কৃতি ২০০৯, আদিবাসী কবিতাসংগ্রহ ২০১০, পড়শিওয়ালা জাগো ২০১৩, রোদের পোস্টার ২০১৪, লর্ড ক্লাইভের পথিকেরা ২০১৫, কবিতার কারাবাস কবিতার মুক্তি ২০১৬, উজানি ছড়া লামনি ধার (আদিবাসী বিষয়ক মুক্তগদ্য) ২০১৬, প্রত্নজীবনের রত্ন ২০১৭, ডিঙা ভাসে দক্ষিণ সমুদ্রে, অলস করতালি ও অন্যান্য প্রবন্ধ ২০১৯, শ্রেষ্ঠকবিতা ২০১৯, রাতে আমার পেখম মেলে ২০২০, আদিবাসী সাহিত্যের দিগবলয় ২০২১, নির্বাচিত কবিতা : আদিবাসীপর্ব ২০২২, লালঝুঁটি সেই রাতা ২০২৩, চার গ্রহের বাসিন্দা (করোনাকালের গদ্য) ২০২৩, না দেখিলে পরান পোড়ে ২০২৩, মোহের তিমিরে ২০২৪, আদিবাসিতার ঝরনাতলায় ২০২৪।
একার্থে গদ্যপদ্য মিলিয়ে ওপরের ৩৩টি গ্রন্থের সবকটিই আমার কাছে উল্লেখযোগ্য। পরের বিবেচনায় তারা কানা ছেলে হলেও হতে পারে, কিন্তু
জন্মদাতার চোখে তারা কি পদ্মলোচন নয়! তারপরও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যতার নিরিখে যদি বলতে হয়– ‘লোহিত ম্যান্ডোলিন’, ‘স্বপ্নখণ্ডের রোকেয়া বেগম রুকু’, ‘আদিবাসী কাব্য’, ‘রোদের পোস্টার’, ‘লর্ড ক্লাইভের পথিকেরা’, ‘রাতে আমার পেখম মেলে’, ‘নির্বাচিত কবিতা : আদিবাসীপর্ব’, ‘না দেখিলে পরান পোড়ে’, ‘মোহের তিমিরে’ আর গদ্যের বিচারে ‘কবিতার কারাবাস কবিতার মুক্তি’, ‘আদিবাসী সাহিত্যের দিগবলয়’, ‘আদিবাসিতার ঝরনাতলায়’–
এগুলো।
১১/ সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
উত্তর :: কাব্যগ্রন্থ ‘মোহের তিমিরে’ ও ‘আদিবাসিতার ঝরনাতলায়’ গদ্যগ্রন্থটি ২০২৪-এর বইমেলায় প্রকাশিত আমার সর্বসাম্প্রতিক গ্রন্থ। ‘মোহের তিমিরে’
বাংলাদেশের গত দেড়-দুই দশকের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার চালচিত্র রূপায়িত হয়েছে প্রতীকী বিন্যাসে। ‘মোহ’ হলো মানুষের ভেতরে বসবাসরত দুষ্ট ষড়রিপুর (কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য) একটি। ওই সময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহল ও তার অনিবার্য প্রভাবে সমাজের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে অপরিমেয় ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি লাভের মোহ ভয়াবহ মহামারিরূপে আবির্ভূত হয়। এই ‘মোহ’ মানে গভীর অন্ধকার বা ‘তিমির’। যা দুর্নীতি-দুঃশাসন, দমন-পীড়ন, বাক ও ভোটাধিকারহরণসহ নানাবিধ নৈরাজ্যকে ধারণ করতে চায়। আর ‘আদিবাসিতার ঝরনাতলায়’ হলো বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজে চর্চিত শিল্পসাহিত্য, শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দেয়া এবং সেই সমাজের নানাস্তরে কর্মরত জ্ঞানী ও সুবেদী নরনারীর প্রোফাইল। বাংলাদেশের বৃহত্তর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশে আলাপ-আলোচনার পরিধির মধ্যে যে বিষয়গুলো থাকে না বললেই হয়। অথচ ওই অঞ্চলের নানা ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জনসাধারণও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১২/ আপনি নিজেকে কোন্ দশকের কবি-লেখক বলেন, কেন?
উত্তর :: আমার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পুরোটাই দেখছি আশি’র দশকজুড়ে। প্রথম কাব্যের প্রকাশ ১৯৮২ সালে। সুতরাং কালচক্রের বিচারে কাব্যচর্চা, সাহিত্য সংশ্লিষ্ট ভাবনা ও তৎপরতা– এসব মিলিয়ে আমি তো আশি’র দশকেরই জাতক।
১৩/ আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
উত্তর :: আমার সমকাল মানে যখন জগত ও জীবন বিষয়ে কিছু জানতে-বুঝতে শুরু করেছি অর্থাৎ বিগত শতকের আশি’র দশক থেকে এই পর্যন্ত (২০২৪) সময়টাকে চিহ্নিত করতে চাই। আর ওই কালপ্রবাহটি আমার জীবনে সমন্বয়, দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্ন হবারই কাল। এ যেমন আপন ব্যক্তিস্বভাবের দোষে কিছু ঘটেছে, তেমনি বন্ধুবান্ধব, স্বজন-পরিজনের স্বার্থপর ও অবিদ্যাসুলভ চাণক্য আচরণের কারণেও ঘটেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষ, গোষ্ঠীবিশেষ এবং রাষ্ট্রেব্যবস্থার অসম বিকাশের এবড়োখেবড়ো পথে আমার সমকাল বিদীর্ণ। সেই কৈশোর থেকে একটি অস্থির স্বদেশে আমার বেড়ে ওঠা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, মুজিবহত্যা, জিয়ার সমর শাসন ও তাঁর হত্যাকাণ্ড, এরশাদের স্বৈরশাসন ও তাঁর বিদায়, ৯০-এর গণআন্দোলন, নির্বাচিত সরকার ও তার
ব্যর্থতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, তার সংবিধানভুক্তি এবং আওয়ামী শাসনকালে ওই সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নমূলক শাসন, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে তাঁর দেশত্যাগ। এসবের বাঁকে-বাঁকে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার খুনে রাঙা পথ, গণহত্যা, অবদমন, ধর্ষণ ও শিশুহত্যা, সামাজিক বিপর্যয়, অসন্তোষ, জনসাধারণের আহাজারিভরা জীবন-জীবিকার নিত্য অনিশ্চয়তা– এই-ই তো আমার সমকাল! সুকান্তের ভাষায় : ‘এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম/ অবাক পৃথিবী সেলাম, তোমাকে সেলাম।’
১৪/ আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম, ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামি বিষয়, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করার বিষয়ে।
উত্তর :: আমি আমার কবিতায় গ্রিক-হিন্দু-রোমান মিথ ব্যবহার করেছি বক্তব্যকে সূচালো ও সুস্পষ্ট করার তাগিদে, তাও প্রয়োজনের অনুরোধে। একই সঙ্গে
কবিতায় মিথ ব্যবহারের পশ্চাতে প্রচলিত ঝোঁক বা প্রবণতাও কিছুটা কাজ করেছে, বলা যায়। যৌবনকালে নবীন কবি হিশেবে তিরিশের দশকের বাংলা কবিতা ও ইউরোপীয় কবিতা আর শামসুর রাহমান-এর কবিতাপাঠের দুর্মর ছায়া এসে পড়েছিল আমার কবিতায়। সেই সূত্রে কবিতায় মিথের ব্যবহার একধরনের ঐতিহ্য ও পণ্ডিতন্মন্য মনের বহিঃপ্রকাশ বলেও ধরে নিয়েছিলাম, কারণ তখন কবিতায় মিথ-টিথের ব্যবহার না-থাকলে কবিরূপে কারু সংস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের অদেখা বাধা ছিল। তাই নিজেকেও তাতে যুক্ত করে একপ্রকার প্রশংসা ও বাহবাও কুড়িয়েছি। কিন্তু দিন যত গেল আমার চেতনা ও উপলব্ধিতে কবিতায় মিথের প্রয়োগ অপরিহার্য বিষয় বলে আর মনে হচ্ছে না। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাব্যিকতার চেয়ে পাণ্ডিত্য প্রদর্শনই বড় হয়ে দেখা দেয়। উত্তম কবিতা তো তেমন করে পাণ্ডিত্যের বিষয় নয়। পঠনপাঠনের অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়তার কথা মেনেই বলা যায়, প্রকৃত কবিতাকে মিথ-এর দুয়ারে কাঙাল বেশে ভিক্ষাপ্রার্থী না-হলেও চলে। যেমন আল মাহমুদ-এর কবিতা। তাঁর কবিতায় সর্বজনবিদিত ক্লাসিক্যাল মিথ-এর চেয়ে লোকপুরাণ ও ইতিহাস চেতনা এমন সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত গরিমায় অভিষিক্ত হয়েছে যে, একটা বিমল কাব্যিক আবহের সংক্রামে পাঠকের চিত্ত আর্দ্র হয়ে ওঠে। এই কবিত্বই সর্বলোক ও সর্বকালের জন্যে আরাধ্য। আর ধর্মীয় অনুষঙ্গও কবিতায় অবলীলায় জায়গা নিতে পারে। যেমন, ফররুখ আহমদ-এর কবিতা। তিনিও জানতেন, ইসলাম ধর্মে সেই অর্থে মিথ-এর স্বীকৃতি নেই। তাই মিথ-বহির্ভূত ধর্মীয় অনুষঙ্গের ব্যবহারে তাঁর কবিতা গ্রহণযোগ্যতার ছাড়পত্র পেয়েছে। মিথ ব্যক্তিকে বহুমাত্রিক মৌলিক বৈশিষ্ট্যের ধারক-বাহকরূপে উপস্থাপনের অবারিত সুযোগ করে দেয়। কোনো ঘটে যাওয়া বাস্তব বিষয়কেও পরবর্তীকালে নানা বিভাসে বিভিন্ন অভিরুচির পক্ষে ব্যঞ্জিত-রঞ্জিত করারও অবকাশ দেয়। ইসলামের মৌল প্রত্যয়ে ব্যক্তি ও ঘটনাকে সে রকমের বিস্তার বা রূপদানের অনুমোদন খুব একটা নেই। যদি মিথীয় দৃষ্টিকোণে ইসলামের মহান নায়ক ও ঘটনাগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে রূপায়িত করা হয় তাতে চরিত্র ও ঘটনাবলিতে বহুমাত্রিকতা যুক্ত হয়ে বিভ্রান্তি উদয়ের আশংকা থাকে। তবে মুসলমানি ধারার একেবারে সাধারণ জীবনের গার্হস্থ্য আবেগ-অনুভূতি, ইতিকথা, কিংবদন্তি, উত্তরাধিকার ও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ অবশ্যই কবিতা বা আখ্যানের আধার হতে পারে। যেমন, জসীম উদ্দীন-এর কবিতায় বাঙালি মুসলমান কৃষক সমাজের দৈনন্দিন জীবনের কথকতা
চিত্রিত হয়েছে দরদি ভাষায়। আপাতত এ ধারায় আমার একটি সাম্প্রতিক কবিতা প্রসঙ্গটিকে খোলসা করার জন্যে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
‘আল্লার বিশিষ্ট ইমারত তুমি অঙ্গসৌষ্ঠবের ধনে/ মজবুত হাতে তোমাকে আমার ঘরে ধরে রাখি বিনম্র বচনে/ নাক ফুলিয়ে করো না নিন্দা/
আমার দৈন্যের আর কমখরচের স্বভাবের/ তুমি যথেষ্ট পড়েছ ঐশী বিশ্ববিদ্যালয়ে/ নিজের নয়ন খুইয়ে পরের চোখে আমাকে দেখো না/ উচ্চাভিলাষের গিলটি করা গৌরবে ভেসেছ বহুদিন/ এই দরিদ্রকে তবুও অনেক বাসিয়াছ ভালো, সেও বুঝি আমি/ আমার এই যে ঘামঝরা থালাভরা শাদা ভাত/ পুদিনার ঘ্রাণ আর কাঁচামরিচের ঝাঁজে/ শুঁটকির ভর্তায় মজেছ সোনার মেয়ে গো/ আরও আনবো কলাপাতায় ঢাকা দূরের গাঁ থেকে/ গোয়ালার কালো গাভির অজল দুগ্ধ/ নির্ভেজাল থকথকে ঘিয়ের বয়াম/ শাদা ভাতের গরম ভাপে খাবে তুমি সেহরিতে/ একটু সবুর করো, প্রিয় মানবী আমার, শুভদিন আসবেই …
(‘প্রিয় মানবী’, মোহের তিমিরে)।
১৫/ আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর :: এ দুটি বিষয়ই ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ড থেকে উদ্ভূত এবং বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে পরে গৃহীত হয়েছে। ১৯৭৪-পূর্ব ঔপনিবেশিক ভারতের কলকাতাকেন্দ্রিক
বাংলা কবিতায় তিরিশের দশকের কবিরা ওই ‘আধুনিক’ কনসেপ্টের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন অনেকটাই অনুকরণ-অনুসরণের সুবাদে। পঞ্চপাণ্ডবের কবিতার শরীরে এই অনুকৃতির অসংখ্য নমুনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আপাতত ডাব্লিউ বি ইয়েটস ও জীবনানন্দ দাশ এবং টি এস এলিয়ট ও জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা
পাশাপাশি পাঠ করা যাক :
He Reproves the Curlew
O curlew, cry no more in the air,
Or only to the water in the West;
Because your crying brings to my mind
Passion-dimmed eyes and long heavy hair
That was shaken out over my breast;
There is enough evil in the crying of the wind.
(The Reproves the Curlew).
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আন? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে। (‘হায় চিল’, বনলতা সেন)।
টি এস এলিয়ট-এও জীবনানন্দের অলস, মন্থর পরিভ্রমণ লক্ষণীয়– এলিয়ট বলছেন :
In that open field
If you do not come too close, if you do not come to close
On a summer midnight, you can hear the music
Of the weak pipe and the little drum
And see them dancing around bonfire
The association of man and woman
…………………
Round and round the fire
Leaping through the flames, or joined in circles,
Rustically solemn or in rustic laughter
Lifting heavy feet in clumsy shoes,
Earth feet, loam feet, lifted in country mirth
Mirth of those long since under earth
Nourishing the corn.
(East Coker 1 : Four Quatrets).
জীবনানন্দের উচ্চারণ :
মাঝে মাঝে প্রান্তরের জ্যোৎস্নায় তারা সব জড়ো হয়ে যেত–
কোথাও সুন্দর প্রেতসত্য আছে জেনে তবু পৃথিবীর মাটির কাঁকালে
কেমন নিবিড়ভাবে বিচলিত হয়ে ওঠে, আহা।
সেখানে স্থবির যুবা কোনো-এক তন্বী তরুণীর
নিজের জিনিস হতে স্বীকার পেয়েছে ভাঙ্গা চাঁদে
অর্ধ সত্যে অর্ধ নৃত্যে আধেক মৃত্যুর অন্ধকারে :
অনেক তরুণী যুবা– যৌবরাজ্য যাহাদের শেষ
হয়ে গেছে– তারাও সেখানে অগণন
চৈত্রের কিরণে কিম্বা হেমন্তের আরো
অনবলুণ্ঠিত ফিকে মৃগতৃষ্ণিকার
মতন জ্যোৎস্নায় এসে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে প্রান্তরের পথে
চাঁদকে নিখিল ক’রে দিয়ে তবু পরিমেয় কলঙ্কে নিবিড়
করে দিতে চেয়েছিল,– মনে মনে– মুখে নয়– দেহে
নয়; বাংলার মানসসাধনশীত শরীরের চেয়ে আরো বেশি
জয়ী হয়ে শুক্লরাতে গ্রামীণ উৎসব … (‘ইতিহাসযান’, বেলা অবেলা কালবেলা)।
আর উত্তর আধুনিকতাও পশ্চিমের পোস্ট মডার্নিজম-এর বঙ্গীকরণ। নব্বই দশক থেকে কলকাতাবাহিত হয়ে বাংলাদেশে এটির চর্চা হতে দেখা যাচ্ছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তর আধুনিকতাচর্চাকারীরা তা স্বীকার করেন না। পশ্চিমবঙ্গের তাত্ত্বিকেরা বলেন যে, ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জ্ঞানকাণ্ড বেদান্তদর্শনের ‘উত্তর মীমাংসা’ ও অন্যান্য উৎস থেকে এ তত্ত্বের মৌল উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। সেই ‘উত্তর’-এর নানা বয়ানের আলোকে বাংলাদেশেও কিছু কবি ও কবিতাপ্রেমী উত্তর আধুনিকতার চর্চা করছেন। তবে আমার বিবেচনা বা পক্ষপাত উত্তর উপনিবেশিকতা বা পোস্টকলোনিয়ালিজম-এর দিকে। ইব্রাহিম
ফ্রানৎজ ফানো’র ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’, ‘রেচেড অব দি আর্থ’ এবং এডওয়ার্ড সাইদ-এর ‘অরিয়েন্টালিজম’ নামের বিশ্বনন্দিত অভিসন্দর্ভ থেকে আসা এই অনুশীলন বাংলাদেশের মতো দীর্ঘকালব্যাপী উপনিবেশকবলিত থাকা দেশখণ্ডের উপনিবেশমুক্তির পরবর্তী আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্বিন্যাসে এই দৃষ্টিভঙ্গি অধিকতর কার্যকর ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। ঔপনিবেশিককালের একরৈখিক শাসন-শোষণমূলক আইনকানুন ও বিদেশি মন-মেজাজের স্বদেশি বানানোর শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও সংশোধন কিংবা নব্যধারায় উল্লিখিত বিষয়গুলোর ভূমিজ বাস্তবতার মাটিতে আনয়নে আমাদের বিদ্বৎ ও রাজনীতিবিদদের মনোযোগ দেয়া দরকার বলে মনে করি।
১৬/ আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিকদের কারো কোনো প্রভাব আছে কী?
উত্তর :: কাব্যর্চচার ঝোঁক তো ছোটোবেলা থেকেই ছিল। সমতালে ছিল বিভিন্ন গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন পাঠের আগ্রহও। পাশাপাশি জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষের
কথাবার্তা, চালচলন মনোযোগ দিয়ে শোনা-বোঝার অভ্যাসও। এভাবে ভালো লেগেছে বা মনে আঁচড় কেটেছে যে বই– সে কবিতা কি উপন্যাস, দর্শন,
ধর্ম বা লোকসাহিত্য– যাই হোক না কেন– সেসবের কিছু-কিছু নির্যাস যে মনের কোণে অগোচরে জমা হয়নি, তা কি বলা যায়? এসবের মিশ্রণে আর নিজের
অকিঞ্চিৎকর ‘কল্পনাপ্রতিভা’ বা মেটে কল্পনাশক্তির সম্মিলনেই তো এই ব্যক্তি আমির গড়ন। সুতরাং কোনো না কোনোভাবে দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিক ও জ্ঞানী-মনস্বীদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটাকে অস্বীকার করা যায় না।
১৭/ কোথায় আছেন? কী করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
উত্তর :: চট্টগ্রাম নগরের এক উপকণ্ঠে আমার জন্ম। এখানেই বেড়ে ওঠা। বদলপ্রবণ চাকরি বা রুজি-রোজগারের প্রয়োজনে নিত্য লড়াই-সংগ্রাম, প্রধানত সাংবাদিকতার পেশায় যুক্ত। আমার সহধর্মিণী স্কুল শিক্ষক আর দুই কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া।
১৮/ আপনি কখনো কোনো পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
উত্তর :: লেখালেখির শুরুতে এলোমেলো ভাবনার ভেতরে কিছু মৌসুমি কবিতার কাগজ বা পত্রিকা প্রকাশ করেছি। সেগুলোতে ঠিক লিটল ম্যাগাজিনের
বৈশিষ্ট্য ছিল না। তবে ১৯৯০ সাল থেকে আমার সম্পাদিত ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’ ও ১৯৯৩ সাল থেকে ‘পুষ্পকরথ’ প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের কমিটমেন্ট ও
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার স্পৃহা নিয়ে প্রকাশিত হয়। প্রথমটি পার্বত্য বান্দরবান জেলায় এক মিশনারি স্কুলে শিক্ষকতাকালে ওখানকার কিছু বন্ধুবান্ধবকে
সঙ্গে নিয়ে বহু ঝড়-ঝাপ্টা, প্রশাসনের রক্তচক্ষুর আস্ফালন– এমনকি যাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদতার কথা বিবেচনায় রেখে ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’ প্রকাশনার পরিকল্পনা করেছিলাম এবং অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম সেই আদিবাসীদের একাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও অনিয়মিতভাবে এটির ১৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০১৮ সাল পর্যন্ত। ২০০৩ সালে কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র এটিকে সে বছর বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন হিশেবে সম্মানিত করে। আর ‘পুষ্পকরথ’-এরও ৯টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তি উজিয়ে। ২০২২ সালে এটির সর্বশেষ সংখাটি করি বৃহত্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও লোকায়ত আধ্যাত্মিক ঘরানার গীতিকবি সৈয়দ মহিউদ্দিকে নিয়ে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে এটি দেশের অন্যতম সেরা লিটলম্যাগরূপে সম্মাননা অর্জন করে।
এছাড়া ১৯৯৩ সালে আমার সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী : অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়।
এটি প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতটি মোটামুটি এ রকম– নব্বই দশকের শুরুতে দেশে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন। এর ঠিক অব্যবহিত আগের
আশি’র দশকটি ছিল অবরুদ্ধতা, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতাহীনতার ভেতর এক সার্বিক নৈরাজ্য ও নির্যাতনের সামরিক শাসনকাল।
বাংলাদেশের সর্বস্তরের সমতলি মানুষের ওই নিরাশাকবলিত দিনকালের সমান্তরালে এদেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত
আদিবাসী জাতিগুলোও ওই অনাচার-দুরাচারের নির্মম শিকারে পরিণত হয়। একদিকে এই উভয় পরিপ্রেক্ষিত সামনে, অন্যদিকে জাতিসংঘ ১৯৯৩
সালকে আদিবাসীবর্ষ হিশেবে ঘোষণা দিলে এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতও যুক্ত হয়। এছাড়া আমার কাব্যচর্চার অন্তর্নিহিত প্রেরণার মূলে আছে সৌন্দর্যসৃষ্টির পাশাপাশি আর্থসামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত, দলিত ও অধিকারহারা মানুষ ও জনপদের প্রতি মমতা ও পক্ষপাতিত্ব। ঠিক এ রকম একটি সময়প্রবাহের অভিঘাতে আমার মনে হলো, একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নময়তায় বহুদিন ধরে অবহেলিত পার্বত্য আদিবাসীদের সমাজবাস্তবতা, তাদের পরম্পরাগত জীবনধারা, তাদের মনোজাগতিক আশা-ভরসা, হতাশা-দুরাশার ওপর একটি প্রতিনিধিস্থানীয় প্রকাশনা দেশের সুশীল সমাজের সামনে তুলে ধরা দরকার। পার্বত্য বান্দরবান জেলায় আমার শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা পেশার সূত্রে পরিচয় ঘটেছিল আদিবাসী সমাজের কয়েকজন শিক্ষিত-সচেতন যুবকের সঙ্গে। আমার ভাবনার বিষয়টি তাদের পছন্দ হলে গ্রন্থনাম ঠিক হলো ‘বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী : অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত’। গ্রন্থটি পাঁচটিটি পর্বে বিন্যস্ত ছিল– ‘আদিউৎসের সন্ধানে’, ‘সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ’,
‘ভূরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত’, ‘সম্ভাব্য সমাধান ও অন্যান্য’, ‘সাক্ষাৎকার’। ‘ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত’ আর ‘সম্ভাব্য সমাধান ও অন্যান্য’ অংশে মুদ্রিত প্রবন্ধগুলো সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছিল একবারেই নতুন অথচ সময়োপযোগী ভাবনাবিস্তারী।
বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের বহুল আলোচিত ভুমিসমস্যা, অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উদ্বাস্তু সংকট, বসতিস্থাপনকারী তথা সেটেলার প্রভৃতি জাজ্বল্যমান
ইস্যুর ওপর মুক্ত ও বিস্তারিত আলোচনাগুলো দেশের বিদ্বৎসমাজে বেশ আলোচনা-সমালোচনা ও আলোড়নের জন্ম দেয়।
১৯/ লিটল ম্যাগাজিন-এর সংজ্ঞা কী? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
উত্তর :: লিটল ম্যাগাজিন আমার কাছে অপ্রথাগত অথচ বলিষ্ঠ নতুন চিন্তাপ্রকাশের প্লাটফর্ম। নবীন কবি ও চিন্তকদের আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রকাশের হাতিয়ারও বটে। সাহিত্যক্ষেত্রে ‘প্রতিষ্ঠান’ নামক আত্মতৃপ্তির ঘেরাটোপে জড়িয়ে পড়া অগ্রজ-অগ্রবর্তীরা যখন তারুণ্যের আবির্ভাব ও তাদের নতুন সৃজনীশক্তির সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে, নতুন চিন্তা ও নবীন শিল্পপ্রবাহকে স্বাগত জানানোর সুস্থতা বা স্বাভাবিকতা যখন তারা হারিয়ে ফেলে, আর নিজেদেরকেই শুধু শিল্পসাহিত্যের অবিসংবাদিত ‘পুরোহিত’ ভাবতে থাকে, তখন লিটল ম্যাগাজিনের তীব্র হাতুড়ি নতুন জীবন ও নতুন সাহিত্যসৃষ্টির ঢ়্যাঁড়া পেটাতে থাকে। লিটল ম্যাগাজিন তো শুধু কিছু কবিতা গল্প প্রবন্ধ আলোচনা মুদ্রণের জায়গা নয়। এ তো একই সঙ্গে দিকবদলের, মনবদলের, সময় বদলেরও ঝকঝকে আয়না। নিষ্ঠ পঠনপাঠন আর সে-পাঠ থেকে ওঠে আসা সুবেদী আড্ডা, আলোচনা-সমালোচনায় মগ্ন ও সজাগ থাকার জায়গা। লিটল ম্যাগাজিন যদি সত্যিকারের সৃজনশীলসত্তাকে চিনতে ও লালনে ব্যর্থ হয় এবং কেবলি এদল-ওদলের তকমা লাগিয়ে চলতে চায়, তবে সেই আন্দোলনের স্মরণযোগ্য কোনো অবদান থাকে বলে বিশ্বাস করি না। তাই লিটলম্যাগকর্মীদের লক্ষ হবে, ক্রিয়েটিভ রাইটিংসের প্রকৃত জাতক-জাতিকাদের পাঠকের সামনে নিয়ে আসা। তাদের চিন্তাভাবনা, রচনাকর্মকে উদ্ভাসিত করে তোলা। এক্ষেত্রে গোষ্ঠীপ্রীতি, দলপ্রীতি, ব্যক্তিপ্রীতির বলয় ভেঙে ফেলতে হবে। সাহিত্যশিল্পের প্রকৃত স্রষ্টাদের সৃষ্টিকর্মের নতুন-নতুন আলোকায়নে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারে লিটলম্যাগই। এখানেই নতুনসাহিত্য আন্দোলনের যোদ্ধারা নিজেদের পরিসর খুঁজে পেতে পারে। রুদ্ধ মন ও অবগুণ্ঠিত চৈতন্যের মুক্তি একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনেই সম্ভব।
২০/ অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিনচর্চাকে আপনি কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন?
উত্তর :: এটি নতুন প্রযুক্তিবাহী খুবই ফলপ্রসূ একটি প্রকাশ মাধ্যম। আমরা ছাপাখানার আধো অন্ধকারে দিনরাত প্রুফ কেটে-কেটে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে, পৈতৃক অর্থ ও শরীর ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম, সন্দেহ নেই, এই অনলাইন বা ওয়েব ম্যাগাজিনচর্চা তার থেকে অনেক সহজ ও অগ্রগামী। এটি তড়িৎ গতিতে বিপুল পাঠকের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে। এই প্রকাশ মাধ্যমটি নতুন ও বৈপ্লবিক সাহিত্যচিন্তা লালন ও প্রকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
২১/ ‘বাংলারিভিউ’ পড়েন? কেমন লাগে বা কেমন দেখতে চান– আগামীতে?
উত্তর :: বাংলারিভিউ-এর অনলাইন সংস্করণের সঙ্গে অতি সম্প্রতি পরিচিত হলাম। এটি যে ছাপার অক্ষরেও প্রকাশিত হয়, এও জানলাম দুটি সংখ্যা সম্প্রতি কুরিয়ারযোগে পেয়ে। অনলাইন ও ছাপা সংখ্যার সজ্জা, মুদ্রণসৌকর্য, বিষয় নির্বাচন বেশ সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক। আগামীতে এ কাগজের আরও রুচিঋদ্ধ অগ্রযাত্রা প্রত্যাশা করি।
২২/ ভবিষ্যতে কেমন পৃথিবী কামনা করেন?
উত্তর :: পরিপূর্ণরূপে বৈষম্যমুক্ত একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। হয়তো তা দুরাশামাত্র। তবুও মানুষের অপার কল্যাণীশক্তির ওপর মন আস্থা হারাতে চায় না।
আগস্ট ২২, ২০২৪। চট্টগ্রাম
…….
গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব