মং সিং ঞো
ভূমিকা
……..
বাংলা কবিতার বয়স যদি একহাজার বছর ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে, হাজার বছর ধরে তার পথ পরিক্রমায় নয়শত বছরই সে আচ্ছন্ন ছিল ঈশ্বর, দেব-দেবী, তথা অলৌকিকতার দ্বারা। এরপরে মানুষ হিশেবে যারা এসেছে তারা রাজা- জমিদার, সামন্ত প্রভু। সাধারণ মানুষ পাংক্তেয় হয়েছে আরও অনেক পরে। বাস্তব পৃথিবীনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশও সেই থেকে। ধর্মের নিয়ন্ত্রণ ও রাজা-জমিদারদের শাসনমুক্ত হয়ে সাহিত্য যখন আধুনিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে এলো, তখন থেকেই মানুষ যথার্থভাবে মানুষের কথা বলতে পারল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তির অধিকার মনের মুক্তি ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। সমাজ মূলত মননগত একটি ধারণা, পক্ষান্তরে ব্যক্তিমানুষ একটি অস্তিত্ব, চূড়ান্ত বাস্তব। সে অনুসারে একজন কবির সমগ্র পরিচয় যেমন মানুষ, তেমনই সেই মানুষটির বিশিষ্ট পরিচয়, কবি। অনেকে অবশ্য মনে করেন, যিনি জগতের একখানি যথাযথ চিত্রপট এঁকে দিতে পারেন, তিনিই যথার্থ কবি। অর্থাৎ কবি জগতের ভালোমন্দের যথাযথ চিত্র অঙ্কন করবেন। যারা তথাকথিত বাস্তব সাহিত্যপ্রিয় এবং যারা কবিকল্পনার দ্বারা প্রবঞ্চিত হতে চায় না, তারা এমত পোষণ করে থাকেন। কিন্তু কাব্যাদর্শ ও বাস্তবাদর্শ যে ভিন্ন ব্যাপার এটি ভুলে গেলে চলবে না। কাব্যের জগত বাস্তব জগতের যথাযথ চিত্র নয় বরং এটি এক প্রকার স্বপ্রতিষ্ঠ, স্বয়ম্বশ অখণ্ড জগত। সাহিত্য যদি বাস্তব জগতকে পরিবর্তিত করে দেয়, তবে কি তা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়?
সাহিত্যকে প্রকৃতির অনুকৃতি মনে হতে পারে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। প্রকৃতিতে যা আছে তাই সাহিত্যে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত, বিশেষায়িত ও সুন্দর হয়ে ওঠে। জগতের রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ বা আপনমনের ভাবনা-কল্পনাকে যে লেখক অনুভূতিস্নিগ্ধ, ছন্দোবদ্ধভাবে শিল্পসঙ্গত তনুশ্রী দান করতে পারেন তাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করতে পারি। আর মানুষের মনের ভাবনা-কল্পনা যখন অনুভূতিরঞ্জিত হয়ে যথাযথ শব্দসম্ভারে সুষমামণ্ডিত, চিত্রাত্মক ও ছন্দোময় রূপলাভ করে তখনই তার নাম হয় কবিতা।
প্রসঙ্গক্রমে এখন আমরা এই আলোচনার সঙ্গে সম্পর্কিত, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: ইতিহাস, বিশেষ করে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায় প্রবেশ করবো।
নির্মিত ইতিহাস, প্রকৃত ইতিহাস
…………
ইতিহাসকে অনেককাল ধরে ভাবা হয়েছে স্রোতধারার মতো এমন একটি স্রোতধারা যা এগিয়ে চলেছে আবহমান। যার কোনো পিছু টান নেই, যা দুর্বার ও দুরন্ত। ইতিহাসকে বহতা স্রোত ভাববার কারণে তার সঙ্গে প্রগতির বিকাশকেও মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইতিহাস বলতে একটি মাত্র ইতিহাসকেই ধরা হয়, তা হলো সভ্যতার ইতিহাস। বলাবাহুল্য, সভ্যতার ইতিহাস মানে পশ্চিমী সভ্যতার ইতিহাস। পশ্চিমী সভ্যতার ইতিহাসের ছকে পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসকে মাপা হয়েছে। যদিও পশ্চিমের বাইরেও পৃথিবী ও সভ্যতা আছে এবং ছিল; কিন্তু সেই পৃথিবী ও সভ্যতাকে ইতিহাসের উপাদান মনে করা হয়নি। পশ্চিমের ইতিহাস-প্রগতি-সভ্যতার ফ্রেম থেকে গোলার্ধের অনালোকিত কিংবা অপরিচিত কিংবা অনাবিষ্কৃত অংশ বাদ পড়ে গেছে। যাই হোক, ধাবমান ইতিহাসের সঙ্গে প্রগতির বিকাশকে এক করে ফেলার কারণে খোদ ইতিহাসেরই একটা সংকট তৈরি হয়েছে। অধুনান্তিকদের [Post modernist] মতে সেই সংকট উপেক্ষা করা যাবে না। পশ্চিমের ইতিহাস ও পশ্চিমের রচিত ইতিহাস, একটি কথাই জানাতে চায়, তাহলো ইতিহাস মুক্তিরই একটা প্রকল্প। কারণ ইতিহাস মেলে ধরে মানবিক প্রগতির আখ্যান এবং সেদিক থেকে ইতিহাস মানুষের মুক্তি অন্বেষা ও মুক্তিলাভের বিচারোর্ধ্ব এক ভাষ্য। ইতিহাসের কালবিভাজন, প্রগতি ও মুক্তির চেতনা অতঃপর আধুনিকতা নামক কনসেপ্টে বদলে যায়। ইতিহাস হয়ে ওঠে আধুনিকতারই এক ধারাবাহিক বৃত্তান্ত।
পশ্চিমের মনোভঙ্গিতে এভাবেই সুদৃঢ় হলো ইতিহাসবাদ। ইতিহাসবাদ মানে ইতিহাস নিয়ে ভাবনা, ইতিহাস আশ্রয়ী প্রগতির চৈতন্য, এক কথায় ইতিহাস সৃষ্টির জন্যে ইতিহাসের ব্যবহার। উত্তর-ঐতিহাসিক আধুনিকতার জন্যে ঐতিহাসিক-আধুনিকতার উপযোগ সন্ধান। কিন্তু দিনে দিনে দেখা যাচ্ছে, যে ইতিহাস নিয়ে পশ্চিমের বিরাট দম্ভ এবং উল্লাস, তার মধ্যে অনেক তামসীপট আছে। সেজন্যে ইতিহাস কেবল নিরবচ্ছিন্ন প্রগতি বা নির্বিবোধ আধুনিকতার ইতিহাস নয়। একই সঙ্গে তা হত্যা, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, সন্ত্রাস, সাম্রাজ্য এবং উপনিবেশবাদেরও ইতিহাস। উত্তর-আধুনিকরা বলেন : ইতিহাস কখনোই মুক্তির প্রকল্প হতে পারে না, কারণ বিংশ শতাব্দী প্রমাণ করেছে, বিপ্লব কিংবা যুদ্ধ কিংবা ব্যাপক মানবধ্বংস মানুষকে মুক্তি দেয়নি।
ইতিহাস নিয়ে ভাবনা পশ্চিমের মতো আমাদের দেশেও হয়েছে। ঔপনিবেশিক বাংলার উনিশ শতকী ভাবুকরাও ইতিহাস নিয়ে অনেক কিছু ভেবেছেন। অনেকের ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসও।
সাব-অলটার্ন ইতিহাসতত্ত্ব
…………
আজ উত্তর ঔপনিবেশিকপর্বে বঙ্গীয় ভাবুকরা এক নতুন ইতিহাসতত্ত¡ প্রস্তাব করলেন : সার্ব-অলটার্ন স্টাডিজ [Subaltern studies ] বা নিম্নবর্ণের ইতিহাস। কেননা বর্তমানে একথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, কেবল লিখিত ইতিহাসে জীবনের সকল স্তরের সমূহ বিবরণ ধরা পড়ে না তার বাইরেও ইতিহাস থেকে যায়। ইতিহাসের লিখিত বয়ানকে একমাত্র ইতিহাস ভাবলে অনেক সমস্যা তৈরি হয়। কেননা সরকারি নথিপত্রও ঐতিহাসিক বিবরণের একটা অংশ। কিন্তু তাকে অভ্রান্ত গণ্য করার ভেতর বিপদ রয়েছে বিস্তর। শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখলে দেখা যায়, ইতিহাসের যেসব মুহূর্তকে আমরা গৌরবময় মনে করি- যেমন : ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ- সরকারি অভিলেখ্যাগারে তার বিবরণ ও ব্যাখ্যা একেবারে ভিন্ন। সত্যপক্ষ যাকে মহৎ বিদ্রোহ বলে, সরকার পক্ষ তাকে নৈরাজ্য বললে অবাক হবার কিছু নেই। ইতিহাস নিয়ে সমস্যার প্রধান কারণ লিখিত বয়ানকে বিচারোর্ধ্ব ভাববার মনোভঙ্গি। সেজন্যে লিখিত টেক্সট-এর আভিজাত্যকে আর প্রাক্তন মূল্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সাব-অলটার্ন গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে ইতিহাস তাই কয়েক রকম :
(ক) যা লেখা হয়েছে, (খ) যা প্রবলপক্ষ নির্দেশ করেছে বা প্রবলপক্ষের নির্দেশে যার আকল্প বা উপকল্প নির্মিত হয়েছে, (গ) যা লেখা হয়নি অর্থাৎ নি¤œবর্গ/ অধস্তন/ ব্রাত্য/ অন্ত্যজ/ সাধারণ/ সাব-অলটার্ন জনপদ ও জীবনধারার ইতিহাস। অধ্যাপক রণজিৎ গুহের উদ্যোগে একদল চিন্তক যে সাব-অলটার্ন স্টাডিজ প্রস্তাব করেছেন, তার ভেতর যা লেখা হয়নি তার ইতিহাস উদঘাটনের বাসনা বিদ্যমান। সাব-অলটার্ন মূলত বিশেষজ্ঞদের রচনা হলেও এর ভিতর কর্তৃত্ববাদী আরোপণ, সরলীকরণ কিংবা যৌথ প্রযোজনার স্বতঃসিদ্ধতা লক্ষ করা যায় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিশ্লেষণের পরিসর বিস্তৃত বলে সাব-অলটার্ন স্টাডিজ কোনো একক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই কেবল পণ্ডিতবর্গ নন, তরুণ প্রজন্মের চিন্তকরাও এতে অভ্যর্থিত। রণজিৎ গুহ ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস প্রকল্পের সমালোচনায় নিম্নবর্গীয় ইতিহাস রচনার ভূমিকা হিসেবে লিখেছেন : ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দু’ধরনের উচ্চবর্গীয় অভিজাততন্ত্র এ-ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে : (ক) ঔপনিবেশিক অভিজাততন্ত্র (খ) বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী অভিজাততন্ত্র। এই দুই পন্থার নেপথ্যে আছে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের মতাদর্শগত প্রণোদনা।
এই প্রণোদনায় যে ইতিহাসের জন্ম, তার অনুকরণস্থল সাধারণভাবে ব্রিটিশদের লেখা ইতিহাস। এর বক্তব্য হলো ভারতীয় জাতি ও জাতীয়তাবাদের সামগ্রিক বিকাশের মূলে এলিটদের ভূমিকা সর্বাধিক। এই এলিটরা মূলত ব্রিটিশ প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান ও পলিসির সৃষ্টি। আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানের ‘উদ্দীপক’ এবং ‘সাড়া’ (স্টিমুলাস এন্ড রেসপনস) কথা দুটো দিয়ে এই উচ্চবর্গীয় ইতিহাসবাদকে ব্যাখ্যা করা যায়। কেননা লেখকেরা বলতে চেয়েছেন ব্রিটিশ প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান ‘উদ্দীপকে’র মতো কাজ করেছে এবং ভারতের এলিটরা সুবিধের খোঁজে ওসবে ‘সাড়া’ দিয়েছেন প্রাণপণে। সে কারণে ওদের ইতিহাস যে জাতীয়তাবাদের কথা বলে, তা মূলত একটা ‘লার্নিং প্রসেস’। অর্থাৎ ব্রিটিশদের ধরনে পড়াশোনা করে ব্রিটিশ পলিসিতে দীক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ জ্ঞানালোকে আলোকিত হয়ে ভারতীয় এলিটরা রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। অতএব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব কোনো মহৎ চিন্তার পরিণতি নয়। এর প্রধান আকর্ষণ ক্ষমতা, সম্পদ ও সম্মানের লোভ, ঔপনিবেশিক কৃপা এর অন্তর্মূলে, দেশশাসনের অভিলাষ এর আরাধ্য। অভিজাততন্ত্রী ইতিহাসের আরেকটা ধরন হলো : ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে কেবলমাত্র কতিপয় স্বদেশী এলিটের প্রবর্তনা হিশেবে দেখানো। স্বদেশী এলিটরা স্বজাতির স্বাধীনতার কথা বলেছেন, এই বক্তব্যে তারা দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষকে তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সেই প্রক্রিয়ায় ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ স্বদেশী এলিটদের মহৎ আদর্শ ও শুভ কামনার ফল। এভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস হয়ে উঠলো ভারতীয় এলিটদের আধ্যাত্মিক চরিতকথা।
মূলত এ ধরনের অভিজাতপন্থি ইতিহাস থেকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসংগঠন বোঝা যায়, ঔপনিবেশিক ক্ষমতার কলাপ্রকরণ বোধগম্য হয়, সে সময়ের উচ্চবর্গীয় মতাদর্শের চরিত্রও ওখান থেকে ওঠে আসে। ঔপনিবেশিক এলিট ও ভারতীয় এলিটদের সম্পর্ক ও সংঘাতের খতিয়ানও তা থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু এই ইতিহাস-আখ্যানে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব-বিকাশের সার্বিক বিবরণ নেই, কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে আমজনতার অংশগ্রহণ এবং নিম্নবর্গের ভূমিকা বিষয়ে এই আখ্যান সম্পূর্ণ নীরব। এই ইতিহাস-আখ্যানে জনগণের রাজনীতির বিবরণ পাওয়া যায় না। ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ এলিট এবং সহযোগী স্বদেশী এলিটের বাইরে বিপুল সাব-অলটার্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক সক্রিয়তার স্বাক্ষর রেখেছে : এই জনগোষ্ঠীর রাজনীতিই জনতার রাজনীতি। এই জনতা বা নিম্নবর্গ ছিল স্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণহীন, এদের ওপর কারও কর্তৃত্ব বা খবরদারি ছিল না, এলিট নেতৃত্বের ওপর এদের কার্যধারা বা সক্রিয়তা নির্ভর করেনি। এলিটরা অনুসরণ করেছে ব্রিটিশদের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ছক, অভ্যাস ও অনুশাসন, আর নিম্নবর্গ চালিত হয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্কে, জ্ঞাতিগোষ্ঠী-কম্যুনিটির তাগিদে, সহমর্মী অনুপ্রেরণায়। এলিটদের রাজনীতি সংবিধান ও শাসনতান্ত্রিক, আর নিম্নবর্গের সক্রিয়তা রূপ নিয়েছে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং নিয়মের বিরোধিতায়। এলিটদের রাজনীতি পরিকল্পিত, সুবিবেচিত, নিয়ন্ত্রিত। সাব-অলর্টান রাজনীতি অবিবেচিত, স্বতঃস্ফূর্ত, উদ্দাম। নিম্নবর্গের রাজনীতির চরিত্র, গুরুত্ব ও প্রবর্তনা ভালো করে বোঝা যাবে ঔপনিবেশিক ভারতের ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহের দিকে তাকালে। সাব-অলটার্ন স্টাডিজের লেখকেরা কৃষক বিদ্রোহকে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। নিম্নবর্গীয় রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এলিট কর্তৃত্বের প্রতিরোধ। নিম্নবর্গের মানুষেরা এলিটদের কাছে বিভিন্নভাবে প্রতারিত-প্রবঞ্চিত লুণ্ঠিত হয়েছে, তাদের রাজনীতিতেও তাই বঞ্চনা ও লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা একটা বড় উপাদান।
সাব-অলটার্ন স্টাডিজ ইতিহাসকে মনে করে আলোচনার একটি পরিসর। ইতিহাস তাদের দৃষ্টিতে ম্যাক্রোলেভেল [Macro level] থেকে মাইক্রোলেভেল [Micro level]-এ, অর্থাৎ আয়ত অভিজ্ঞতার বদলে অভিজ্ঞতার অনায়ত ভূগোলের ভাষ্য। একথা সত্য যে নিম্নবর্গের রাজনীতি এতটা লক্ষমুখি ছিল না যে তা থেকে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন একটা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রূপ নিতে পারে। নিম্নবর্গের একটা অংশ যদি শ্রমিকশ্রেণি, দেখা যাবে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি নিজের সামাজিক সত্তা এবং শ্রেণিগত অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন ছিল না। ফলে শ্রমিকশ্রেণির মিশনও সফল হতে পারেনি। যার কারণে নিম্নবর্গীয় চাষি, জনতা ও কর্মজীবীশ্রেণির বহু রকম বিদ্রোহ, আন্দোলন ও অভ্যুত্থান যথাযথ নেতৃত্বের অভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। ঠিক এই জায়গায় এসে রণজিৎ গুহ বলেন : ঔপনিবেশিক ভারতের এই এক দুঃখজনক ব্যর্থতা যে একজাতি সম্পূর্ণভাবে নিজের জাতি হয়ে উঠতে পারেনি। এই ব্যর্থতার ভেতর রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস প্রকল্পের সংকট। কোনো একটি মাত্র প্রক্রিয়ায় এই সংকট বোঝা যাবে না। সেজন্যে রণজিং গুহ বলেছেন : যদিও সাব-অলটার্ন স্টাডিজের লেখকের আরো অনেক বিক্ষিপ্ত প্রয়াস রয়ে গেছে এবং রয়ে যাবে, সেই প্রয়াসগুলোও এই প্রয়াসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে এবং অভিঘাতের দিক থেকে সকল উদ্যোগ একবিন্দুতে একত্রিত হতে পারে।
রণজিৎ গুহের সম্পাদনায় সাব-অলটার্ন স্টাডিজের প্রকাশনাসমূহ মাইক্রো-ইতিহাসচর্চার একটা পরিণতি। রণজিৎ গুহ ও তাঁর সহযোগী ভাবুকেরা বলতে চান, এতদিন পর্যন্ত যাকে ইতিহাস বলা হয়েছে ভারতে, তা মূলত এলিটিস্ট হিস্টরিওগ্রাফি বা উচ্চবর্গীয় ইতিহাস। এখন প্রয়োজন নিম্নবর্গীয় ইতিহাস সন্ধান। তারা ঐতিহাসিকদেরকে অভিজ্ঞতার আয়ত স্তর থেকে অনায়ত পর্যায়ে নামতে বলেন। ভারতবর্ষের উপনিবেশিকপর্বের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে নি¤œবর্গের সাধারণ মানুষদেরও যে ব্যাপক অংশগ্রহণ, ভূমিকা ও সক্রিয়তা ছিল, উচ্চবর্গীয় ইতিহাস প্রকল্পে তা স্বীাকার করা হয়নি। তার কারণ সেই ইতিহাস প্রবলভাবে ইংরেজ ও ইংরেজের উপনিবেশপুষ্ট। সে ইতিহাসে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ইংরেজি ও ইংরেজের প্রবর্তনা হিশেবে দেখানো হয়েছে। অথচ ভারতবর্ষে কৃষক বিদ্রোহ ও কৃষক চেতনা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, এই চেতনা নিম্নবর্গের, এই চেতনা ও বিদ্রোহ স্বতঃস্ফূর্ত ও অবিনাশী। এই চেতনা নিম্নবর্গের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দুঃখ ও যন্ত্রণা থেকে জন্ম নেয়া। এই অভিজ্ঞতা নিম্নবর্গকে বিদ্রোহী সক্রিয়তায় অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু অভিজাততন্ত্রী উচ্চবর্গীয় ইতিহাসে এই নিম্নবর্গের অস্তিত্ব কোথায়? যকিঞ্চিৎ যাও-বা আছে, তা বিক্ষিপ্ত এবং অপব্যাখ্যায় বিকৃত। নিম্নবর্গকে নিম্নবর্গের সংস্কৃতি দিয়ে বুঝবার চেষ্টা না করে এলিট ঐতিহাসিকেরা তাদের ইতিহাসকে ভুলভাবে বিচার করেছেন। ফলে নিম্নবর্গের ধর্মকে তাদের মনে হয়েছে কুসংস্কার, তাদের সংস্কৃতিকে মনে হয়েছে গ্রাম্য ও অমার্জিত, তাদের বিদ্রোহকে মনে হয়েছে অপরিকল্পিত আবেগের নৈরাজ্য ও অপরিণত উচ্ছ্বাস। সেজন্যে সাব-অলটার্ন স্টাডিজের রণজিৎ গুহ, দীপেশ চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, গায়ত্রী চক্রবর্তী, ডেভিড আর্নল্ড, সুমিত সরকার, অরবিন্দ দাশ, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, শাহিদ আমিন, অশোক সেন, অজিত চৌধুরী, এন. কে. চন্দ্র, স্টিফেন হেনিংহাম, রামচন্দ্র গুহ, স্বপন দাশগুপ্ত, তনিকা সরকার, বার্নার্ড কোহন এই উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে নি¤œবর্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করেন, বিচার করেন, ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের পাঠ থেকে ইতিহাসের কাঠামোটাই বদলে যায়, প্রচারিত সত্য হয়ে ওঠে মিথ।
মিথ হয়ে উঠে ইতিহাসের আসল আদল। সাব-অলটার্ন স্টাডিজের লেখকেরা একই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। দীপেশ চক্রবর্তী লিখেছেন ঔপনিবেশিক বাংলার কর্মজীবীশ্রেণির ইতিহাস (১৯৮১), গৌতম ভদ্র ময়মনসিংহের ও নারকেল বেড়ের কৃষক বিদ্রোহের ওপর স্বতন্ত্র গ্রন্থ (১৯৯৪), রণজিৎ গুহও লিখেছেন কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে পৃথক বই (১৯৮৩), ডেভিড আনর্ল্ড লিখেছেন দক্ষিণ ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সম্পর্কে (১৯৭৭), বার্নার্ড কোহন লেখেন ভারতীয় সমাজের পরিবর্তন এবং ভারতীয় সভ্যতার সামাজিক নৃতত্ত¡ বিষয়ে (১৯৮১), শাহিদ আমিন লেখেন গোরকপুরের চাষীদের ইক্ষুচাষ বিষয়ে (১৯৮৪), জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে লেখেন উত্তর প্রদেশের রাজনীতি সম্পর্কে (১৯৭৮), সুমিত সরকার লেখেন ভারতের গণআন্দোলন ও মধ্যবিত্তশ্রেণির নেতৃত্ব এবং বাংলার স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে (১৯৭৩ ও ১৯৮৩)।
কবিতায় সাব-অলটার্ন ইতিহাসবোধ
………
মূলত সাব-অলটার্ন স্টাডিজের ইতিহাসচর্চা এক মাইক্রোহিস্ট্রির [Micro history] প্রস্তাব করে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা কবিতায় আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতিকে সুচারু ও নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে কবি হাফিজ রশিদ খান নিম্নবর্গীয় দৃষ্টিকোণে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিকভাবে তেমনই একটি মাইক্রোহিস্ট্রি প্রস্তাব করেছেন। এবং নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চাকারীদের নামের তালিকায় তাঁর নামটি সসম্মানেই অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের আরও কিছু আলোচনা সেরে নিতে হবে। বাংলার প্রধান কবিদের মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস এই পাঁচজন ছিলেন পদাবলীর কবি। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয় গুপ্ত, ভারতচন্দ্র রায়- এই তিনজন ছিলেন মঙ্গলকাব্যের কবি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন মহাকাব্যের কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোমান্টিক কবি এবং জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে– এই পাঁচজন ছিলেন আধুনিক কবি। কেউ কেউ মনে করেন আধুনিক কবিতার আগে বাংলা কবিতা ছিল অপ্রাপ্তবয়স্কতার কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতাই প্রথম হয়ে ওঠে প্রাপ্তবয়স্কতার কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখের আলোচনা ও সংজ্ঞাগুলো থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার মোটামুটি একটা স্বচ্ছ মানচিত্র পাওয়া যায়।
গত বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে বাংলা কবিতা পাশ্চাত্যের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে শুরু করে। উল্লিখিত পঞ্চপাণ্ডবের হাতে আধুনিক কবিতার ডালপালা, শেকড়-বাকড় বাড়তে থাকে এবং এঁদের হাতেই সর্বোচ্চ বিকাশ ও ক্ষয়ও শুরু হয় আধুনিক লক্ষণাক্রান্ত কবিতার। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক মনস্কতায় সৃষ্ট এবং পাশ্চাত্যের শিল্পসাহিত্যের প্রতি ঐতিহ্যবাহী অনুসরণের লজ্জাকর পালা থেকে বাংলাদেশের ক’জন কবি সচেতনভাবে কৃমিদুষ্ট ও চিন্তাশূন্য, কাঁপা, কৃত্রিমতার দুর্গন্ধযুক্ত পশ্চাৎপদতা ঝেড়ে ফেলে এবং কবিতার সীমাবদ্ধ বৃত্ত ভেঙে উদ্বোধন ঘটিয়েছেন খাঁটি দেশজ কবিতার। আল মাহমুদ, আহসান হাবীব, ওমর আলী, মোহাম্মদ রফিক-এর কবিতায় দেশজ কবিতার এই আবহ তৈরি হতে থাকে। চল্লিশের দশক থেকে এ বাংলার কবিতায় দুটি ভিন্নমুখি স্রোত প্রবাহিত হলেও এবং তা একে অপরের প্রতিপক্ষতা সত্তে¡ও বলা যায় যে, এক আশ্চর্য ও আরোপিত জীবনবোধে তাড়িত কবিরা বিশ্বাস ও ভণ্ডামির যুগপৎ দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হয়েও সূক্ষ্ম সরলরেখার ওপর দিয়ে প্রগতির পথে বহমান ছিলেন। এ সময় ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার ধারার সঙ্গে মিলবার আকুতি যেরকম প্রবল ছিল, তেমনই এর প্রতিপক্ষ অন্যধারাটি ঠিক সে রকমভাবেই কর্তৃত্ব অর্জন করতে চেয়েছে। সাতচল্লিশে ভারতভাগের পর পূর্ববাংলার কবিতাস্রোতের দ্বিতীয় ধারাটি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। নতুন রাষ্ট্রের সপক্ষে ও একটি জাতিত্ববোধের অহং থেকে সমাজ, ধর্ম এবং রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলো উগ্রভাবে কবিতায় অনুপ্রবেশের ফলে সংকেটের সূচনা হয় এ সময়ের কবিতায়। অবিভক্ত বাংলায় পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে নজরুলের হাত ধরে যে ধারাটির সূত্রপাত, সেটি বিভাগোত্তর কবিদের মধ্য দিয়ে সেক্যুলার ও সার্বজনীন বাংলা কবিতার সখ্য ও শাসন মেনে নিয়েছিল। এই দ্বিধামুক্ত চিন্তার স্বাধীনতায় ও পৌরুষের অকুতোভয় অভীপ্সায় সিক্ত ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, জসীম উদ্দীন। ফররুখ আহমদের পশ্চাৎপদতা সত্তে¡ও একঝাঁক তরুণ কবির পদচারণ পঞ্চাশের দশককে অর্থবহরূপে গড়ে তোলে। প্রতীক, উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পের যে নৈপুণ্যভাস্বর আধুনিকতার পথ নির্মাণ করেছিলেন পঞ্চপাণ্ডব, সেই কাব্যকথনভঙ্গিকে সর্বপ্রথম এ বাংলার কবিতায় ধরতে পারলেন আবুল হোসেন। এই দ্রুত সময়ের পথ ধরে নতুন নিরীক্ষায় এগুলেন আহসান হাবীব। সৃষ্টি হলো এক সমাজসচেতন ও সমসমাজের অসাম্যের বর্ণনায় উন্মুখ কবিতার। সানাউল হক, সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গণি হাজারী, মাযহারুল ইসলামসহ আরও কজন সমাজসচেতনতার মাধ্যমে তীক্ষè শব্দচয়নের দ্বারা এ সমস্ত কবিতাকে পাঠক মনে পৌঁছে দিতে সক্ষম হলেন।
পঞ্চাশের শামসুর রাহমান এ-বাংলার কবিতায় এক নতুন কাব্যশক্তির উন্মেষ ঘটালেন। সমাজের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতাকে শামসুর রাহমান শৈল্পিক দক্ষতায় ও রূপকল্পের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় অর্থবহ একক শৃঙ্খলায় প্রকাশ করতে পেরেছেন। সত্তরে সামাজিক অস্থিরতার চেয়ে বড় যে সমস্যাটি তা হচ্ছে ক্রান্তিকালের স্বরকে কবিতায় ধরে রাখতে যে মেধাবী কবির প্রয়োজন ছিল, তা যেন এ সময়ের কবিদের ছিল না। সত্তরে যে ক্লান্তি বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে খানিকটা ভাটা এনে দিয়েছিল তাই আশি’র তারুণ্যের জোয়ারে ভেসে গেল। এই দশকটিতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সত্তর দশকের উন্মুল মানসিকতার জগত উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে যেতে থাকে। রাজধানীকেন্দ্রিকতার প্রতি মোহমুক্তির মাধ্যমে এ সময়ের সাহিত্য গোটাদেশের একটি সচেতন প্রবাহ হয়ে ওঠে। কবিতার তড়িৎপ্রবাহ দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই দশক সত্তরের ক্লান্তির মেঘ সরিয়ে বৃষ্টি নামায় সৃজনী মমতায়। বাংলাদেশে আশি ও নব্বই দশকের কবিতায় নগরকেন্দ্রিকতা যেমন আছে, তেমনি বহুকালের কৃষিজীবী ও আদিবাসী সংস্কৃতিও মিশেছে। বিভিন্ন লোককাহিনি, ছড়া, বাউলগান, মিথ, লোকপুরাণ, ধর্ম ও মঙ্গলকাব্যের ব্যবহার হতে থাকে বিভিন্ন কবির কবিতায়। এ সময় বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের কবিরা প্রান্তিক মানুষের ভাষাকে তাঁদের কবিতার শরীরে ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারে জমা পড়তে থাকে বহু নতুন-নতুন চকচকে শব্দমুদ্রা। গ্লোবালাইজেশনের ভাষাযুদ্ধে শামিল হলেও সাম্প্রতিক বাংলা কবিতাকর্মের ছত্রে ছত্রে এই সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয়। এই কবিতাকর্মের মধ্যে আঞ্চলিক ও অনালোকিত ভাষাগুলোকে আলোকিত করে তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা গেল। পাশ্চাত্যবাহিত সংস্কৃতির বিপ্রতীপ মানসিকতায় ও একটি সম্পন্ন জীবনের প্রত্যাশায় কেউ কেউ কৌমভাবনায় শিখা জ্বালাতে চেয়েছেন। কবি হাফিজ রশিদ খান তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য এবং তিনিই আদিবাসী জীবনের অলিখিত ইতিহাসকে কবিতায় ধারণ করেন সাফল্যের সাথে। যার কারণে আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার হিশেবে স্বীকৃতির বরমালাটি আমরা তাঁকেই দিতে পারি।
হাফিজ রশিদ খান কবিতার কমলবনে প্রবেশ করেছেন বিগত শতকের আশি’র দশকে। আদিবাসী জীবনের চেতনার উত্তাপ ও অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ প্রতিফলন তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কবিতার অনুষঙ্গে-প্রসঙ্গে, উপমা-রূপকে, চিত্রকল্প-রূপকল্প ও অলংকার প্রয়োগে আদিবাসী জীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে অনিবার্যভাবে। আদিবাসী অরণ্যের অনার্য সংহতি ও সারল্যের কথা তাঁর কবিতার পঙক্তিতে-পঙক্তিতে মঞ্জরিত হয়েছে। কবিতায় বিদ্যুতায়নের জন্যে তিনি হাত বাড়িয়েছেন আদিবাসীদের অফুরন্ত ও ঐশ্বর্যময় শব্দভাণ্ডারে। স্বকীয়তার এক রত্নভাণ্ডার আবিষ্কার করেছেন তিনি। কবিতার পাঠশালায় কবি হাফিজ আর নবীন নন, কবিকর্মীদের নির্দেশক স্থানীয়। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘জোছনা কেমন ফুটেছে’, প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। পরবর্তীকালে চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড় (১৯৮৮), লোহিত ম্যান্ডোলিন (১৯৯১),স্বপ্নখণ্ডের রোকেয়া বেগম রুকু (১৯৯৫),আদিবাসী কাব্য ১৯৯৭ (দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৭), টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড (২০০২), জুমপাহাড়ের ওম (২০০২), এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না আমাঙ : খুমি আদিবাসী শব্দ, অর্থ : স্বপ্ন, আদিবাসী কবিতাসংগ্রহ (২০১০), ঘূর্ণির গোয়েন্দা ঘেরা (২০১২), পড়শিওয়ালা জাগো (২০১৩), রোদের পোস্টার (২০১৪), লর্ড ক্লাইভের পথিকেরা (২০১৫), ডিঙা ভাসে দক্ষিণ সমুদ্রে (২০১৭), প্রত্নজীবনের রত্ন (২০১৭), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৯), রাতে আমার পেখম মেলে (২০২০), নির্বাচিত কবিতা : আদিবাসীপর্ব (২০২২), না দেখিলে পরান পোড়ে (২০২২), মোহের তিমিরে (২০২৪) প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘আদিবাসী কাব্য’, ‘জুমপাহাড়ের ওম’, ‘টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড’, ‘এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না’, ‘রোদের পোস্টার’- এই পাঁচটি কাব্য হাফিজ রশিদ খানের আদিবাসী জীবনবিষয়ক সাব-অলটার্ন স্টাডিজের মাইক্রোহিস্ট্রির কাব্যিক উপস্থাপনা।
আদিবাসী কাব্য : ‘উপ’ শব্দটিকে মাড়িয়ে
ঊর্ধ্বে তুলে ধরা আদিবাসী জাতিসত্তার পতাকা
………
গ্রন্থটিতে মুদ্রিত হয়েছে মোট ২৯টি কবিতা। শুরুতেই চোখে পড়ে ‘কাব্যসত্যবাদী’ কবির সহজ-সরল স্বীকারোক্তি : ‘সত্তর দশকের শেষদিকে একটি আদিবাসী তরুণীর প্রেমে পড়ি। বোমাং সার্কেলের রাজপুণ্যাহ দেখতে গিয়ে। সে ছিল পরমারূপসী আর অত্যন্ত মিষ্টভাষী। ফরারহব ষড়াব বা বেহেশতি প্রেমের সেই অনুভূতিগুলো আজও আমাকে ভাবায়। আমি সেই মেয়েটার স্বপ্নময়তায় আদিবাসী পল্লি এলাকায় অনেক ঘুরেছি। অনেকের তিরস্কার, অনেকের পুরস্কার পেয়েছি। আবার দুঃখ-দারিদ্র্যজীর্ণ অনেক আদিবাসী মানুষের অসম্ভব সুন্দর আর ভালোমনের প্রকাশও লক্ষ করেছি। আমার স্বীকার করতে ভালোলাগে : আগের জন্মে আমি আদিবাসীই ছিলাম। টিলার ওপর ছিল আমাদের ঘর। লাউয়ের খোলে করে জল আনতাম অনেকদূরের ঝরনা থেকে, জুমচাষে আসতো জীবিকা। ঙাপ্পি ও তরকারি পেলে সবচেয়ে ভালো মনে পেটপুরে খেতাম। বুনোহাঁস আর কালোহরিণের মাংসে আমাদের পালা-পার্বণগুলো বেশ জমতো। আমার সেসব স্পষ্ট মনে পড়ে– আমি তো জাতিস্মর’।
টানাগদ্যে লেখা কবির এ কথাগুলো কোনো কবিতা নয়, তারপরও কবিতা বলে ভুল না হওয়াটাই যেন অস্বাভাবিক। সুললিত ও ব্যঞ্জনাময় এ কথাগুলো যেকোনো কাব্যরসিককেই কাব্যরস পাইয়ে দেয়। আসলে কবিরা হচ্ছেন মানবজাতির জাতিস্মর। বহুকাল ধরে মানুষের চেতনার মধ্যে যে স্বপ্ন এবং অভিজ্ঞতা পুঞ্জীভূত রয়েছে কবি সেই অভিজ্ঞতা নিজের স্মরণপথে ও চেতনার মধ্যে ধারণ করেন। কবি পরিচর্যা ও নিরন্তর প্রকাশনার মাধ্যমে সেই ধারণক্ষমতাকে শাণিত ও তীক্ষ্ণ করে তুলতে পারেন। কবির বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শুধু তারকারাজি, নিহারিকাপুঞ্জ, সপ্তর্ষিমণ্ডল বা কৃষ্ণগহ্বর এবং আয়তনগত বিশালতা নয়, বরং মরণশীল মানুষের অবিনশ্বর চেতনা ও বেদনাবোধের অব্যক্ত পর্যায়সমূহও তাতে অন্তর্ভুক্ত। সন্দেহ নেই, ব্যক্তিপ্রেমের অন্বেষণে বেরিয়ে কবি হাফিজ রশিদ খান আবিষ্কার করেছেন একটি জনপদ এবং সংস্কৃতির যুগ্মসত্তাকে চিহ্নিত করে তিনি বিনির্মাণ শুরু করেছেন অন্যরকম কবিতার।
আমাদের সমাজ হলো শব্দ-বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। মানুষের অনবরত সংলাপ, জিজ্ঞাসা, ইচ্ছা, অহমিকা, বেদনা প্রভৃতি জীবনধারাকে ইঙ্গিতবহ করেছে। শব্দ চিরকাল সমাজ ও সভ্যতার স্মৃতিকে ধারণ করে। শব্দ হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও বিবেকের সাড়া। যিনি চিরকাল আকাশে স্বপ্ন ছড়াতে চান, তিনিও তাঁর শব্দকে মানবসমাজের আড়ালে নিতে পারেন না। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় যতটা অঞ্চল আমরা পরিভ্রমণ করি, শব্দরূপে আমাদের ইচ্ছাগুলো তার চেয়েও অধিক অঞ্চল পরিভ্রমণ করে। কিন্তু যেহেতু শব্দ সকল মুহূর্তেই সমাজের অনুভূতির উত্তাপ, তাই আমাদের সকল ইচ্ছা, কল্পনা ও স্বপ্ন আমাদের সমাজ এবং সভ্যতার উৎপ্রেক্ষা মাত্র। কবি-সমালোচক সাজিদুল হক মন্তব্য করেছিলেন : ‘শুধু স্বতন্ত্র কাব্যবোধ নয়, পৃথক জনগোষ্ঠীর ভাষার সংহত গঠনও ঈর্ষণীয়। জীবনযাপনের অন্তঃস্থির কাঠামোর নিজস্বতায় অনুরণন সৃষ্টি, সর্বোপরি স্বীকৃত জাতির সাংস্কৃতিক কাঠামোয় উপজাতীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবহেলিত সংস্কৃতিকে সমান্তরালভাবে অন্তর্ভুক্ত করার মতো দুঃসাহসী কাজটিও করেছেন বাংলা কবিতায় এই প্রথম কবি হাফিজ রশিদ খান’। কাজী নজরুল ইসলাম কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন ধর্মবোধের কারণে নয়, তাঁর আপন কবিসত্তার প্রয়োজনে। আলোচ্য বিষয়ের সত্যতাকে উজ্জ্বল করার জন্যে এবং ধ্বনি ও সুরের সম্মোহন বিস্তারের জন্যে এসব শব্দ নজরুলের কবিতায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী হয়েছে। কিন্তু নজরুলের হয়েছে বলেই যে সবার হবে এমন কোনো কথা নেই। সাধারণভাবে অন্যভাষার শব্দ সহসাই বাংলা শব্দের ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে খাপ খায় না। মানুষের ব্যক্তিত্বের মতো শব্দেরও নিজস্ব সত্তা রয়েছে। সে কারণে এক ভাষার শব্দ অন্যভাষায় স্বাভাবিক ব্যবহারে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত কবিতার মঙ্গল সূচিত হয় না। কিন্তু ‘আদিবাসী কাব্য’-এ হাফিজের হাতে যেন সেই মঙ্গলই সূচিত হয়েছে বলা যায়। কবিতা যেহেতু একই সঙ্গে হৃদয় এবং বুদ্ধির অনুশাসন মানে তাই বিজাতীয় শব্দ কবিতায় নির্বিবাদে আসতে পারে না। কখনও-কখনও ধ্বনিসাম্য বা ধ্বনি-তরঙ্গের প্রয়োজনে বিজাতীয় শব্দ ব্যবহৃত হয়, যেমনটা নজরুলের কবিতায় হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি ঘটেছে। তিনিও কবিতার জন্যে হাত বাড়িয়েছিলেন সংস্কৃত অপ্রচলিত শব্দভাণ্ডারে। ফরাসি প্রতীকবাদী কবি স্টেফান মালার্মের একজন শিল্পীবন্ধু একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন যে, তাঁর মনে খুব ভালো ভালো ভাবের সঞ্চার হয়, কিন্তু সেই সকল আইডিয়া তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না। তার উত্তরে মালার্মে বলেছিলেন, কাব্য শব্দের দ্বারা লিখিত হয়, ভাবের দ্বারা নয়। কিন্তু মালার্মের উত্তর তো অর্ধসত্য! কাব্য ভাবের দ্বারাও লিখিত হয় না, শব্দের দ্বারাও লিখিত হয় না। ভাব যখন ভাষার মধ্যে মিশে গিয়ে সংহত রূপলাভ করে তখনই কাব্যের সৃষ্টি হয়। যেমন সৃষ্টি হয়েছে কবি হাফিজ রশিদ খানের ‘আদিবাসী কাব্য’র কবিতাগুলোতে।
কবি ও গল্পকার মহীবুল আজিজ ‘আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার : হাফিজ রশিদ খান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন : ‘আদিবাসী জীবনের প্রতি মুগ্ধতা ও আন্তরিকতা হাফিজের প্রধান সম্বল। ‘ম্রো’ বা মানবমহিমার সামগ্রিক দৃষ্টি থেকে কবি আদিবাসীদের দেখেন, ফলে কোনো সংকীর্ণতা, কোনো মুরুব্বিয়ানার ভাব সেখানে অনুপস্থিত। বমরমণী লনচেয়ো’র মঙ্গোলীয় চোখের ইশারা কবির সত্তার পুরোটাই নাড়িয়ে দিতে সক্ষম… ‘উপ’ কিংবা ঊনতা থাকে না সেই আন্দোলনে। ফলত হাফিজের আদিবাসী মানুষ ‘উপ’ শব্দটিকে পায়ে মাড়িয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে নিজ নিজ জাতিসত্তার পতাকা।’ …
‘আদিবাসী কাব্য’ নিয়ে একজন কবি আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের সুষমামণ্ডিত কার্পাসমহল। নব্বই দশকের প্রারম্ভে আকস্মিক পিতার ইন্তেকালে দিশেহারা কবি ইন্টারভিউ দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন কনিষ্ঠ শিক্ষক হিশেবে পার্বত্য বান্দরবানের মিশনারি স্কুলখ্যাত ডনবসকোতে। থাকতেন স্কুলের বাঁশের দরমাঘেরা শিক্ষকনিবাসে। শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বাইরের লম্বা করিডোরে এসে বসতেন। এ রকম এক ভোররাতে হঠাৎ শুনলেন বিলম্বিত টানে চিকন অথচ স্পষ্টস্বরে এক বয়স্কা রাখাইন মহিলার গলা : ‘রে ফ্রি সা মু…।’ থেকে থেকে ওই একটা শব্দ ক্রমশ কাছে চলে আসে। এক সময় দেখলেন স্কুলের সামনে খুব ধীরে কপাল হয়ে পিঠে ঝুলে থাকা থুরঙ নিয়ে এক মহিলা এসে দাঁড়ালেন। ল্যাম্পপোস্টের অস্পষ্ট আলোয় দাঁড়িয়ে মহিলা আবার আওয়াজ তোলেন : রে ফ্রি সা মু …।’ এতক্ষণে বাক্যটা স্পষ্ট শুনলেন। নব্বই বছর বয়সী বুড়িটির কেউ নেই। নিজের রুজি জোগাড় করেন কলাপাতায় মোড়ানো চালের গুঁড়ায় তৈরি পিঠা বেচে যা পান তা দিয়ে। মুখে তার অসংখ্য বলিরেখা, জীবনের ভারে নুয়ে পড়েছেন সামনের দিকে। শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে। অনেকদূরে শঙ্খনদী অর্থাৎ রেগেখ্যঙ-এর ধারে তার মাচাঙঘর। শিশু-কিশোরদের কাছে তাঁর পিঠার কদর আবার সবচেয়ে বেশি। সবাই ওকে ডাকে ‘অবংগ্রী’ অর্থাৎ দাদি বা নানি বলে। কবির কাছেও তার পিঠা কদর পেয়েছিল। একদিন কবি শুনলেন, বুড়িটি আর বেঁচে নেই। সারাজীবন সুস্বাদু রে ফ্রি সা মু (চিরুনি আকৃতির পিঠা) বানিয়ে ভোররাত থেকে সকাল অবধি যে নারী ঘুরে বেড়াতেন গোটা বান্দরবানের পাড়ায়-পাড়ায়, মানুষের দুয়োরে দুয়োরে, তাঁর জন্যে কবির মন কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সেই শ্রমজীবী, আত্মসচেতন মহিলা, সকলের অবংগ্রীর জন্য রচিত হলো কবির একটি আন্তরিক এলিজি :
সোনালি তলপেট মুক্ত করেছে শীতের সকাল
দু-চোখে ঘুম নেই রাত্রি সরেছে সে অনেক কাল
সুদূর ও-পাড়ার রেগেখ্যঙ তীরে ছোট্ট মাচাংঘর
ভয়াল শীতরাতে প্রতারক ওম ঘিরে গ্রীষ্মে কেটেছে জ্বর
কুয়াশা বুকে গেঁথে থুরঙের চাপে ভারে অবংগ্রী ওই যায়
দেখে না দুই চোখে স্পষ্ট আকারে তবু হাঁকে রাস্তায় :
রে ফ্রি সা মু … রে ফ্রি সা মু
চিরুনি পিঠা নিবি, চিরুনি পিঠা কেউ…
(রে ফ্রি সা মু)
সিয়ামপুই বম লনচেয়ো হচ্ছে একজন বম আদিবাসী তরুণী। তার ভাঙা-ভাঙা বাংলা উচ্চারণ কবির কাছে কেমন মিষ্টি আর আদুরে লাগত। প্রত্যেক বিকেলে তাদের দেখা সাক্ষাত। দেখা হলে নম্রভঙ্গিতে মাংসলপদ্মের মুদ্রায় দুহাত কপালে ঠেকিয়ে উচ্চারণ করতো মেয়েটা ‘নমস্কার স্যার’। এক জোছনার বন্যায় প্লাবিত ঝকঝকে রূপোলি রাতে কবির মনে পড়ে গিয়েছিল সেই তরুণীকে। তরুণীর ভিরুতা যেন রূপান্তরিত হলো খরগোশের নম্র আর কোমল স্বভাব বা চলনের মধ্যে। সবুজ সবুজ দূর্বাঘাসে শাদা আর নানারঙের খরগোশের ভীরু ভীরু বিচরণ। ঠিক যেমনটি পেয়েছিলেন কবি বম তরুণীটির আচরণে। সেই ঘাসেছাওয়া লনে নানারকমের ফুল ফুটেছে এবং তার অনেকগুলো মাটির ওপরে ঝরে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে কুসুমের পরগণা। তার দূরবর্তী ভালোবাসার কাছে বিচ্ছেদ আর বিরহের অনুরণনে কবির আধফোটা তাপিত উচ্চারণ: ‘নমস্কার।’ কেননা সবুজ দূর্বাঘাস আর ফুল দুটোই সিয়ামপুই লনচেয়োর হাতে :
কচিঘাসের নেশায় খরগোশ
ভ্রস্ত চোখ
শাদা আর এলোমেলো রঙে …
সুন্দরী সিয়ামপুই বম লনচেয়ো
বুনোফুলের প্ররোচনায়
প্রেমে খাবি খাওয়া তোমার আশেক
আদরের কেশর ফোলায়…
তুমি
সারামুখে সন্ন্যাসিনী-হাসি
মাংসল পদ্মের মুদ্রায়
দূর-দেবতার চোখে চোখে
সাজালে পরমা
একটা কোমল নমস্কার….
(বুনোফুলের প্ররোচনায়)
রোমাং পরগনাকে ঘিরে মারমা জনগোষ্ঠীর রয়েছে এক স্মৃতিময় অতীত, যার ‘আশপাশ ঘিরে/ বয়ে গেছে নদী রেগেখ্যঙ/ সুন্দরী সুরেলা অসংখ্য রিনিখ্যঙ …।’ মারমা মানুষের ‘কৈশোর-যৌবন এইভাবে ধীরে ধীরে/ মেলেছে পাখনা বোমাং পরগনায় …।’ বোমাঙ পরগনার রাজা বোমাংগ্রীর স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই, স্মৃতিকণাগুলো যেন তাঁর হীরের মুকুট থেকে খসেপড়া মূল্যবান দানাগুলির মতো অন্ধকারে ঝিলমিল করে উঠছে :
আজ বোমাংগ্রীও নেই এইতো সন্ধ্যায়
নিভেছে চিতার আলো তার
অন্ধকারে শেয়ালেরা পা’য় পা’য়
ছাই ঘেঁটে খোঁজে হীরের মুকুট
থেকে খসেপড়া মূল্যবান দানাগুলি কোথায় কোথায় …
(বোমাং পরগনায়)
পার্বত্য চট্টগ্রাম বা কার্পাসমহলের একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রোরা। অতীতে ম্রোদের কোনো ধর্মগ্রন্থ ছিল না। মানবতাই তাদের ধর্ম। কেননা ম্রোরা শব্দের অর্থও মানুষ। সমস্ত পৃথিবীজুড়ে যে অখণ্ড মানবজাতির বসবাস তারই একটি ক্ষুদ্র অংশ-খুবই শান্ত ও নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির জনগোষ্ঠী হচ্ছে ম্রো। নির্জনতাপ্রিয় এবং কোলাহলবিমুখ স্বভাবের ম্রোরা মৌখিক বা কথানির্ভর সংগীতের চেয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়-সমারোহ থেকে সৃষ্ট সুরমূর্ছনায় নিজেদের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে ভালোবাসে। ম্রোরা একধরনের বাঁশি ব্যবহার করে, যাকে ‘প্লুং’ বলা হয়, তাতে ওরা মনোহর সুরের অভিব্যঞ্জনা যোগ করে অপার্থিব সাংগীতিক আবহ তৈরি করে। কবির অন্তহীন আহ্বান ও অনির্বাণ জিজ্ঞাসা :
চুড়োয় ডাকছি
ছোটো-ছোটো ঘর ঢালুর নিসর্গ
আস্তানায়
কেউ নেই …
ম্রো পল্লির যুবক ম্রো পল্লির যুবতী
দাঁতে রঙ মেখে ফুল গুঁজে চুলে
প্লুঙের সঙ্গীত কোথায় বাজাচ্ছো…
(চুড়োয় ডাকছি আমি বড়ো একা)
বেশ কয়েক বছর আগে মেনলে নামক একজন ম্রো যুবক-ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ধর্ম প্রবর্তন করে। যার নাম ‘ক্রামাদি’। ম্রোরা এখন ক্রামাদি ধর্মে বিশ্বাস করে। স্রষ্টাকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘থুরাই’। সে কথা এসেছে কবিতায় এভাবে :
মহামতি মানুষের অপর নাম ম্রো
প্রভু থুরাই কল্যাণ করো
জগতের
মানুষের
সকলের
শিশ্নের বীর্যজিভ
যোনির রজস্বিতায়
অপরাধী অপরাধী আজ ….
পাড়ার নাচের ঘরে পড়শিজনের ভিড়ে
প্রাণী দিতে হবে বলি
সদকার প্রয়োজনে
দেখবে আকাশ দিনের ধারালো চোখে
ক্রামাদি-বিশ্বাসী দু’জন যুবক-যুবতী
কান্নায়-কান্নায় শ্লোক
উচ্চারণ করি :
মানুষ হবো না আর
জন্মান্তরে
ম্রোরা হবো না কভু…
(মানুষ হবো না আর ম্রো হবো না)
হাফিজ রশিদ খানের কোনো-কোনো কবিতা পড়লে মনে পড়ে ইমপ্রেশনিস্টদের ছবির কথা। যে দৃশ্য শিল্পী আঁকছেন তা যেন তিনি একঝলকে দেখে নিয়ে রং, আলোছায়া যেমনটি দেখেছেন তেমনটি এঁকে বসিয়ে দিতে চান। এ জন্যেই এ ছবিগুলোর খণ্ডাংশের কোনো অর্থ হয় না, সব মিলিয়ে একটা সামগ্রিক আবেদন সৃষ্টি করাই এর লক্ষ। ইমপ্রেশনিস্ট ছবি যেমন কাছ থেকে কিছুই বোঝা যায় না দূরে গেলেই তার আদ্যন্ত রূপটি অকস্মাৎ ভেসে ওঠে আর তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় একটা আলো কখনও স্নিগ্ধ, কখনও প্রভাময়, ঠিক তেমনই তাঁর কবিতা প্রথমপাঠে মনে হয় কিছুই বোঝা গেল না, অসংলগ্ন ছেঁড়া-ছেঁড়া রেখার টানের মতো, কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি বলেও মনে হয় কিন্তু পাঠ-পরবর্তী একটা গুঞ্জরণ মনের মধ্যে বেজে উঠতে থাকে। সেই গুঞ্জরণই শেষ পর্যন্ত রেখাগুলোকে সংলগ্ন করে পৌঁছে দেয় অর্থের উপক‚লে :
উপত্যকায় পার্বত্য দুহিতারা নাচে ….
পাথরের কঠিন জঠরে শুনি
ঋষি নাগার্জুনের গোঙানি;
কোথাও কি মৃত শিশুদের হাতও
মুষ্টিবদ্ধ
দোলনার দাবিতে অটল?
ঝুলনামা চোখের পাতায় টোটেম-পুরুষ
প্রায়িঙের খোয়াবে স্মৃতির খণ্ডে শোনে
জুমের কৈলাসে
মাদল-মাদল বাজে …
গৌরপার্বতীর দল বগলের ম ম গন্ধে
কনিষ্কের সূর্যকাল
চোখের সাজিতে ভরে…
(কনিষ্কের সূর্যকাল)
তাঁর কবিতায় ইতিহাসচেতনা একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। প্রাচীন ভারতবর্ষের বৌদ্ধদার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক সম্রাট কনিষ্ক প্রভৃতি এই কবিতার ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ। আদিবাসী কাব্যে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহরে ভাষা থেকে শব্দচয়ন করে কবিতার মৌচাক গড়ার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন। কবি আদিবাসী ভাষার শব্দগুলোকে বাংলাভাষার বহির্ভূত শব্দ বলে অবহেলা করেননি। তাঁর অর্জিত কাব্যভাষায় প্রধানত জেগে উঠেছে মারমা জীবন। এছাড়া চাকমা-ত্রিপুরা-ম্রো-বম-লুসাই জীবনের অনুষঙ্গসমূহ বাংলাভাষার বিপুল শোষণক্ষমতার মধ্যে নমনীয় হয়ে উঠেছে :
১. স্তনের চুড়োয় রাত্রি এলে উষ্ণতর
দুনিয়ার নাগরিকদের ডেকে বলি :
খুইমা আরো খাঙ লুমা আম্যো খাঙ … (কার্পাসমহল : এক)
২. আত্মার মাগফিরাত রাওলাতা তিঙপ্লিতে
আলাদা-আলাদা মুখমণ্ডলের ধারা
নিরঙ্কুশ ভোট দিয়েছে আমাকে
প্রাণের উচ্ছল সাড়া …
(রাওলাতা তিঙপ্লি)
৩. সবুজশস্যের পাতে হৃদয় রক্তিম দোলে
মাইলাঙমা মাইলাঙমা বলে…
অক্ষত যোনির বিশ্বাসে যুবতী অনাঘ্রাত তুমি
আমিও নতুন পুরুষ, নতুন জিন্দেগানির কার্পাসভূমি
(অনাঘ্রাত যুবতীর প্রতি)
৪. আবার বরেোতে হবে মোনঘরে রাত কাটাবার
সোনালি রঙের নারী ছিবদঙ সঙ্গে নিয়ো আর
তুমি এলে জুমক্ষেতে রেদো জুনিপুক জ্বলিবাক
নাঝি-নাঝি গীত গেবঙ চারপাশে ফুল ফুদিপাক …
(যখন জুমচাষ)
জুমপাহাড়ের ওম : সংস্কৃতির যুগ্মসত্তা বিনির্মাণ
………..
এ কাব্যগ্রন্থটি কবি হাফিজ রশিদ খানের সংস্কৃতির যুগ্মসত্তা বিনির্মাণের একটি শিল্পিত প্রয়াস। এতে মুদ্রিত হয়েছে মোট ৪৮টি কবিতা। বিশিষ্ট লেখক মহীবুল আজিজ গ্রন্থটির ফ্ল্যাপে লিখেছেন : ‘আদিবাসী একটি ভিন্ন ধারনা, ভিন্ন সংস্কৃতি, কিন্তু তা বিচ্ছিন্ন নয়, সমান্তরাল। আমাদের সৌভাগ্য, বহুকাল ধরে প্রসন্ন প্রতিবেশীত্ব দিয়ে যাচ্ছে আমাদের’। … অধিকাংশ কবিতাতেই গেঁথে রয়েছে আদিবাসী জীবনের প্রেম-প্রীতি, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রভৃতি। কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে মৈন (পাহাড়), মোনঘর, জুমচাষ, জুমিয়া মেয়ে, ফারা (গৌতম বুদ্ধ), কঙরাঙ পাখি, গঙ্খেুলি, কার্পাসমহল, খ্রখ্রেং প্রভৃতি অর্থময় নান্দনিক শব্দাবলি। এই কাব্যগ্রন্থের পরতে-পরতে ছড়িয়ে আছে আদিবাসী সমাজের লোকজ ঐতিহ্য, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, পুরাণ প্রভৃতি। যেমন :
একজন মুরং মানুষ ছড়ালো বিন্নির ধান;
চাকমা মহিলা জুম থেকে ফেরার বিকেলে
সবটা কুড়িয়ে নিল থুরঙে, সযত্নে।
লুসাই ও চাকপাড়ার মেয়েরা মিলেজুলে
সাফসুফ করে নিল থুরঙের ধান …
একজন বম মানুষ কলের ঘরে ভাঙালো
বিন্নির দানাগুলো
অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটে
ত্রিপুরা মেয়েরা আধো অন্ধকার বারান্দায়
ঝেড়ে-বছেে আলাদা আলাদা করে নিল
খুদকুঁড়ো ও বিন্নির চাল
চুলোয় ফুটলো অতঃপর রক্তকরবীর মতো রঙে
আঠালো বিন্নির ভাত
কেওক্রাদাঙ চুড়োয় উড়তে উড়তে কিছু খেলো এক
কঙরাঙ পাখি
কঙরাঙ পাখিটি আমার ঘরে আয়
বসতে দেবো সেগুনকাঠের পিঁড়ি… (আয় কঙরাঙ পাখি)
কবিতা ও দর্শন উভয়েই রহস্য উন্মোচন করতে চায়। কিন্তু এদের প্রণালী সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনুভূতি ও ভাবাবেগই কবিতার উপজীব্য। কিন্তু দর্শন বিচারমূলক বিশ্লেষণের সাহায্যে জগত ও জীবনের যুক্তিগত স্বরূপটি উদ্ধার করতে চায়। দার্শনিক জীবনকে জ্ঞিাসার দ্বারা, বিচারের দ্বারা গ্রহণ করেন। দার্শনিক ভাবেন, কবি অনুভব করেন। তবে একথা সত্য যে, কবি ভাব-কল্পনাকে অনুভূতিস্নিগ্ধ করে পরিবেশন করতে জানেন। সেরূপ আবার কোনো-কোনো দার্শনিকও তার ভাবনাচিন্তাকে অনুভূতিস্নিগ্ধ করে যখন প্রকাশ করেন, তখন তারা আবার কবির আসনে উন্নীত হন। কবি হৃদয়বৃত্তিকে বড় করে দেখেন, দার্শনিক বড় করে দেখেন বুদ্ধিবৃত্তিকে। কিন্তু কবি যেখানে প্রতীক ও রূপকল্পনায় নিজের অনুভূত সত্যকে প্রকাশ করেন, দার্শনিক সেখানে অমূর্ত বিশুদ্ধ চিন্তাধারায় নিজেকে প্রকাশ করেন। কবির মুখ্য উদ্দেশ্য সৌন্দর্যসৃষ্টি, দার্শনিকের মুখ্য উদ্দেশ্য বিশ্বের অন্তর্লীন সৌন্দর্যের ভাবগত অদ্বৈতসত্তার আবিষ্কার। শ্রেষ্ঠকবি দার্শনিক সত্যকে পর্যন্ত রূপকান্ত করে তোলেন। যা বশিুদ্ধ, অর্মূত, সত্যস্বরূপ ছলি তাই তার কাছে রূপাত্মক বর্ণনায় বিভূষিত হয়। কোনো-কোনো কবি আবার জীবনদর্শনকে বড় করে তোলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা দার্শনিক হতে পারেন, ত্যাগের উপাধিতে তাদের ভূষিত করা যায় না। শ্রেষ্ঠ কবিতায় দর্শন ও কবিতার হরগৌরী মিলন মোটেই অসম্ভব নয়। যেমনটি ঘটেছে ‘বর্ষাবাস’ কবিতায় :
বর্ষাবাস তেজ এনেছে চোখে;
দেখছি জগতে বাসনামাত্রই দুঃখময়
মাথামুণ্ডন করেছি, পরেছি গেরুয়া কাপড়
কর্ণসুবর্ণ গ্রামের টলটলে দিঘির পাশ দিয়ে
পর্যটক বাতাস
কাঁপন তুলে যায় বনের আখড়ায়
এখনও অনেক পথ
এখনও অনেক বড় হৃদয়ের সঙ্গে
প্রকৃত কথোপকথন বাকি;
তবু এক নুলোভিখিরি খুঁড়োতে-খুঁড়োতে আসে
হাত তুলে আমি বলি :
বৎস! দুনিয়ার বাসনাসমূহে বিবাগী হও!
অথচ আকাশের আশপাশে ঠিক তক্ষুণি
জটিল-বখিল মেঘেদের মধ্যে চলছিল
উদ্ধত, অদ্ভুত সব বপ্রক্রীড়া!
আমরা বলতে পারি, কবির বেদনাবিদ্ধ ক্ষতচিহ্নিত হৃদয়ই হচ্ছে কবিতার জন্মভূমি। অর্থাৎ সময়বিশেষে কোনো একটি বিশেষসূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা যখন প্রকাশের পথ পেয়ে যায় তখনই জন্ম ঘটে কবিতার। জীবনের বেদনার্ত আবেগ ও বিস্ময়কে আস্বাদ্যমান রসমূর্তিদান করাই কবির কাজ। ব্যক্তিগত বেদনার ধুতুরাসম বিষপুষ্প হতে কবি যখন কল্পনার সাহায্যে আনন্দমধু আস্বাদন করতে পারেন, তখন বেদনা পর্যন্ত রূপান্তরিত ও অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে। বেদনার যিনি ভোক্তা, তিনি এর দ্রষ্টা হতে না পারলে তার দ্বারা কাব্যসৃষ্টি সম্ভব হয় না। কবির কর্তব্য হলো মানুষের মনের তরঙ্গ-বিক্ষোভ, স্রোতোধারা এবং গভীর অতলতাকে চিত্রিত করা। তিনি পৃথিবীর দৈন্য ও দীপ্তিকে প্রকাশ করেন উপযুক্ত শব্দের মাধ্যমে, যে ভাষার ঐশ্বর্য, তার সকল উচ্চারণের আভরণকে একটি সুনিশ্চিত অধিকারে তিনি তার উপলব্ধির বাঙ্ময় প্রতীক করে তোলেন। বেদনাবিদ্ধ মানুষের বিশ্বাস এবং গভীরতম চেতনাপ্রকৃতির বিবিধ বিকাশ কবির শব্দ ও সুরে ঊষাকালের সূর্যোদয়ের মতো প্রতি মুহূর্তেরই বিস্ময় শিখা।
‘গিদিতা রেমার জন্যে’ কবিতার কেন্দ্রমূলে প্রোথতি রয়েছে একজন আদিবাসী নারীর বেদনাময় করুণ কাহিন।ি যার ছোটবোনকে সম্পত্তির লোভে অপহরণ করা হয়েছিল এবং ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল গিদিতা রেমাকে। আদিবাসী ও নারী উভয়পদই নির্দেশ করে ঐতিহাসিকভাবে নিম্নবর্গের পর্যায়ভুক্ত মানুষদের। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আদিবাসীরা হচ্ছে সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সবচাইতে প্রান্তিক অবস্থানে চলে আসা জনগোষ্ঠী। সংখ্যালঘুতা দিয়ে নয়, মূলত আদবিাসীদরে প্রকৃত সমস্যা বুঝতে হবে উপনিবেশিকতার ইতিহাস দিয়ে। সেটা হতে পারে ইউরোপীয় উপনিবেশিকতা বা অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিকতা। এমনও অনেক দেশ আছে (যেমন : বলিভিয়া, গুয়াতেমালা প্রভৃতি) যেখানে আদিবাসীদের সংখ্যা মোটেই কম নয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু উপনিবেশিকতার ইতিহাসের ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তারা অধস্তনতা, শোষণ-বঞ্চনা ও মর্যাদাহীনতার শিকার। যেমনটা ঘটে গিদিতা রেমাদের জীবনে :
গিদিতা রেমার দোষ নেই কোনো
গিদিতা রেমাও ছিল একজন বাংলাদেশের
গারো আদিবাসী নারী ছিল রেমা
গিদিতা রেমার গল্পটা শোনো :
হত্যা হলো সে নিরীহ রমণী
ভালোবেসেছিল মাটির জরায়ু
মাটির দয়ায় ফল ও ফসল
মাটির উদরে মানুষের পরমায়ু
ঘাতকের কোনো প্রিয় পরিচিতি নেই
সে তো মানুষের চেনা দুর্ভোগ
রুধিরে রাঙানো আদিবাসী নারী
গিদিতা রেমার পুনর্জন্ম হোক … (গিদিতা রেমার জন্য)
পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রকে প্রথমবিশ্ব, তৃতীয়বিশ্ব ইত্যাদি বর্গে ফেলার পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসীদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য অনেকে ব্যবহার করেছেন নতুন একটি বর্গ : চতুর্থবিশ্ব। প্রথমবিশ্বের যেসব পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশ বর্তমানে বাংলাদেশের মতো তৃতীয়বিশ্বভুক্ত দেশের আদিবাসীদের প্রতি বাহ্যিক সহানুভূতি দেখায়, তাদের নিজেদের ইতিহাস যে মোটেই উজ্জ্বল নয়, তা বলাবাহুল্য। বরঞ্চ বলা চলে, তাদের প্রদর্শিত পথ ধরেই তৃতীয়বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো আদিবাসীদের অধিকার হরণ করে চলেছে আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের নামে। ইকোপার্ক, ইকো ট্যুরিজম প্রভৃতি মানুষের চিড়িয়াখানা বানানোর যেসব ধারণা সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে গারো, খাসিয়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, সেগুলো পশ্চিমাদেরই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলো বনজসম্পদ ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ, যেগুলো আহরণের দিকে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর শকুনি-দৃষ্টি রয়েছে। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় আদিবাসীরা বাস করে আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকায়। এসব ক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়তে পারে আদিবাসীদের জীবনে। ভূরাজনীতির দাবাখেলায় তারা পরিণত হতে পারে ‘ঘুটি’-তে। তথাপি ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’, ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের উচ্চবর্গীয় গোষ্ঠী যখন স্বনিয়োজিত অভিভাবকের অবস্থান থেকে আদিবাসীদের সম্পর্কে কথা বলে তখন তাও গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সারাবিশ্বজুড়ে আদিবাসী মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, নির্যাতন-নিপীড়নের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ৫০০ বছরেরও বেশি আগে যখন কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করে তখন থেকে আদিবাসী মানুষের ওপর অন্যায়-অত্যাচার শুরু হয়েছিল। তারপর একের পর এক বিভিন্ন দেশে চলতে থাকে আদিবাসীদের সবকিছু ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ১৮৫৪ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সিয়াটলে বসবাসকারী আদিবাসীদের সেই এলাকা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল আধুনিক শহর গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ‘শাদা সর্দার’ সম্বোধন করে সিয়াটল আদিবাসী প্রধান লিখেছিলেন :
‘এই ধরিত্রীর প্রতিটি অংশই আমার লোকদের কাছে পবিত্র। এই পাইনগাছের প্রত্যেকটি চকচকে ডগা, বালুকাময় প্রতিটি সমুদ্রতট, অন্ধকার বনভূমিতে জমে থাকা কুয়াশা, প্রতিটি প্রান্তর, প্রত্যেকটি পতঙ্গের গুনগুন- আমার লোকদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিতে পবিত্র। প্রতিটি বৃক্ষের ভিতর দিয়ে যে বৃক্ষরস প্রবাহিত হচ্ছে তারা লাল মানুষের (আদিবাসী) স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে।’ এটি একটি লম্বা চিঠির ক্ষুদ্র অংশমাত্র। কিন্তু এক অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় কথাগুলো যেন অস্তিত্বের মূল থেকে ওঠে আসা ফোঁটা-ফোঁটা রক্তবিন্দু। ভাষার কাব্যিক ব্যঞ্জনার অন্তরালে বর্ণিত হয়েছে নির্মম নিষ্ঠুরতা। বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবনও যেন এই চিঠিটিরই প্রতিধ্বনি। ‘গারো পাহাড়ের পাখিগুলো : ১’ কবিতায় কবির উচ্চারণ :
গারো পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের ভাঁজে
গাছেদের শাখায়-শাখায়
বুনোঝোপের ভেতরে ছিল
অনেক পাহাড়ি বাহারি পাখির ঝাঁক
ওরা কখন সীমান্ত পার হলো
পরিযায়ী হয়ে বেদনাবধিুর পরিবেশ নিয়ে এলো
মানুষের গরেস্তালি জীবিকায়
কেউ জানে না এখন।
পাখিপ্রেমী কিছু অদ্ভুত মানুষ তবু
পাখিদের ঠিকুজি খুঁজলো গ্রাম-গ্রামান্তরে
রাতদিন চষে বেড়ালো গম্ভীর
গারো পাহাড়ের চারপাশ
তারা দেখলো : পালকখসা জুবুথুবু কিছু পাখি
বড়-বড় ভয়মিশ্রিত নয়নে আরও দূর গভীর জংগলে
খোঁড়াতে-খোঁড়াতে পালালো; উদ্বাস্তু
জীবনের নানা গøানি
মানুষকে আর দেখাবে না বলে …
গণতন্ত্রের সাথে অধিকারের প্রশ্নটি সম্পর্কিত। গণতন্ত্র এবং অধিকারের সাথে সম্পর্কিত নাগরিক সমাজ। এই তিনটি শব্দ পরস্পর সংলগ্ন। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় আদিবাসী মানুষের সাথে গণতন্ত্র, অধিকার এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলন যতটুকু গভীর হবার কথা ছিল ততটুকু গভীর হয়নি। আদিবাসী মানুষের সঙ্গে গণতন্ত্র, অধিকার এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে বিপুল ব্যবধান বিরাজ করছে। ১৯৬৫ সালের পিইএন কংগ্রেসে কবি পাবলো নেরুদা বলেছিলেন : ‘ Speak in the name of those who can not write, if the poet did not make himself the spokesman of the human condition, what else was there or him to do.
কবি পাবলো নেরুদা সৃজনশীল মানুষদের মানবিক শর্তের মুখপাত্র বানিয়েছেন। যদিও দায়িত্বটা কঠিন, যথাযথভাবে পালন করা দুরূহ, তারপরও এই দায়িত্ব শুধুমাত্র সৃজনশীল মানুষের নয়, ব্যাপকভাবে নাগরিক সমাজের, যে নাগরিক সমাজ ভালোমন্দবোধকে নিজের ভেতরে ধারণ করে গণমানুষের চেতনাকে শাণতি ও প্রদীপ্ত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যে নাগরিক সমাজ সংকটে এগিয়ে আসে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের অনুল্লেখের বিপরীতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেনি আজও। এদেশের জনসমাজের বহুত্ববাচকতাকে প্রত্যাখ্যান করে উচ্চবর্গীয় অংশের কর্তৃত্ব অপরাপর নিম্নবর্গীয় মানুষের ওপর নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে তাদেরকে অস্তিত্বের সংকটে নিপতিত করার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের তরফ থেকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছিল প্রত্যাশিত; কিন্তু তা দুঃখজনকভাবে খুবই ক্ষীণ, অসংলগ্ন ও অসংগঠিত। নাগরিক সমাজের এই বর্তমান অবস্থা কবি হাফিজ রশিদ খান তাঁর ‘সিভিল সোসাইটি’ নামক কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন :
ভীত হরিণীর আর্তনাদে ভেসে ওঠে সুন্দর মনের আসল আদল
আরণ্যিক সন্ত্রাসে
হরিয়াল আর শালিকের
ময়ূর ও ময়ূরীর
পাখি ও পাখিয়ালের
পলকা শরীর লুটোয়, লুটিয়ে পড়ে
ছোটো ছোটো অজানা ঝিরির পাড়ে
ওদিকে বিরক্তিকর ট্রাফিকজ্যামের মধ্যে পড়ে
বিন্যস্ত সিভিল সোসাইটি
হাই তোলে
পেট্রোলের ডিজেলের গন্ধ-েগন্ধে নাক চাপা দেয়
মূল্যবান সুবাসিত রুমালে-রুমালে …
এডওয়ার্ড সাইদ তাঁর ‘অরিয়েন্টালিজম’ (১৯৭৮) গ্রন্থে জ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন- পশ্চিমের জ্ঞান কিভাবে পশ্চিমের ক্ষমতা তৈরি করে, সেই ক্ষমতা কিভাবে উপনিবেশ বানায়, সেই উপনিবেশ কিভাবে একটা বৈধ স¤প্রসারণবাদে পরিণত হয়। প্রাচ্যকে উপনিবেশ বানাতে হলে প্রাচ্যকে জানতে হবে; কিন্তু জানতে হবে একেবারেই নিজের মতো করে, তারপর নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সেই প্রাচ্যকে উপস্থিত করতে হবে। প্রাচ্যকে প্রাচ্যের মতো জানলে হবে না, প্রাচ্যকে পাঠ করতে হবে পশ্চিমের চোখে। প্রাচ্যতাত্তি¡করা এইভাবে প্রাচ্যকে জেনেছেন, সেই জানার বিবরণই দু-শতাব্দী ধরে অরিয়েন্টালিজম নামে পরিচিত। অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব হলো একটা বৃহৎ প্রবেশপথ।
এই প্রবেশপথ দিয়ে ইউরোপীয়রা সমগ্র নিকট প্রাচ্যে ঢুকে পড়ে এবং দখল করে নেয়। এক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শক্তি হিশেবে পুরোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, অবশ্য রাশিয়া ও জার্মানিও পালন করেছিল একই ভূমিকা। উপনিবেশ তৈরির প্রধান শর্ত স্বার্থের হিশেব-নিকেশ এবং স্বার্থের সুযোগ সৃষ্টি। স্বার্থ বাণিজ্যিক, যোগাযোগ সম্পর্কিত, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবই হতে পারে। প্রাচ্যতত্ত্ব পশ্চিমের একটি বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানপ্রকল্প। এডওয়ার্ড সাইদ এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে পশ্চিমের আধুনিকতাকে বিপন্ন করেছেন। তিনি তদন্ত করেছেন পশ্চিমে কিভাবে জ্ঞানের সাথে ক্ষমতা, পাণ্ডিত্যের সাথে সাম্রাজ্যবাদ এবং বিদ্যার সাথে যুক্ত হলো উপনিবেশিকতা। পশ্চিমের অরিয়েন্টালিজমকে তিনি দেখেছেন একটা প্রজেক্ট বা প্রকল্প হিশেবে, যে প্রকল্প ঐতিহাসিক, জ্ঞানময়, পাণ্ডিত্যপূর্ণ। কিন্তু একই সঙ্গে তা পশ্চিমের সমকালীন রাজনীতি, ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কেন্দ্র ও প্রান্ত নাম দিয়ে যদি পৃথিবীর বিভাজন করি তাহলে তার বইটিকে প্রান্তের সমর্থক ও প্রান্তদেশীয় গোলার্ধের প্রতি পক্ষপাতমূলক বক্তব্যের প্রেরণাময় অভিসন্দর্ভ বলা চলে। তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোতে যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে, তার সঙ্গে সাইদের বইটির অভ্যন্তর চেতনার মিল খুব বেশি। যে ধরনের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী চেতনা রয়েছে ‘উত্তর উপনিবেশবাদ’ কবিতাটিতে :
চাই না পুরোনো দিন পুরোনো রাতের ঘরে
পুরোনো কথার মধ্যে প্রাচীনরে প্রতি টান
চাই নতুনের মর্মে প্রকৃত রোদের আলো
হৃদিভাসানো মমতা, ডুবসাঁতারের গান
চাই না বটের তলে ক্লান্ত রাখালের সুর
দূরের মায়াবী সুরা, অটল মহিমা তার
চাই প্রশস্ত রাস্তায় বিসারী বৃক্ষের ডালপালা
ছায়াভরা কারুকাজ গতি এনেছে চাকার
আটচালা ঘর নয়, বহুতল অট্টালিকা
তাহার ভেতরে মুখর বাংলাদেশের নারী
গাইছে বৈশাখ-চৈতে জীবনের পাদটীকা
ভীষণ উল্লাসে কাঁপা নতুনের অভিসারী …
টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড :
‘চোখের আলোক আমি জ্বলি …
……….
এ কাব্যে মুদ্রিত হয়েছে মোট ৪৭টি কবিতা। এই কাব্যগ্রন্থটির নামের সাথে টিএস এলিয়টের একটি বিখ্যাত নাটক ‘মার্ডার ইন দি ক্যাথিড্রাল’-এর একটা আশ্চর্য মিল লক্ষ করা যায়, যা হয়ত কাকতাল মাত্র। কাব্যগ্রন্থটির কভারের ফ্ল্যাপে গাল্পিক রাজীব নূর লিখেছেন :
‘লোহিত ম্যান্ডোলিন হাতে হাফিজ রশিদ খান কবিতার ভুবনে নিজের আগমনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটা ১৯৯১ সালের ঘটনা। এর অনেকদিন আগে ১৯৮২ সালে কবিতার সঙ্গে গরেস্তালি শুরু করার সময়ে তিনি জানতে চেয়েছিলেন ‘জোসনা কেমন ফুটেছে’। মেলেনি উত্তর। না মেলাই স্বাভাবিক, কেননা, চাঁদ যে গেছে বেনোজলে ভেসে। পাহাড় আর সমুদ্রঘেরা চট্টগ্রামের সন্তান হাফিজ রশিদ খান অতঃপর সমুদ্র গভীরে লুকিয়ে থাকা ‘চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড়’ সন্ধান করতে গেলেন, সাফল্যও পেলেন কিছুটা। তবে একেবারে স্বকণ্ঠ নির্মাণে আরও কিছু সময় লেগেছে। অপেক্ষা করতে হয়েছে ‘লোহিত ম্যান্ডোলিন’ প্রকাশ পর্যন্ত। এরপর একে একে বেরুল ‘স্বপ্নখণ্ডের রোকেয়া বেগম রুকু, ‘আদিবাসী কাব্য’ ও ‘জুমপাহাড়ের ওম’। বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজ এবং ওই সমাজের সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলো তাঁর কবিতায় পরমযত্নে একটা আয়তন তৈরি করে নেয়। কেননা, পৌরাণিক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে অবচেতনে আমরা এখনও শকিারি সমাজরে র্চযাই বহন করে চলেছি।
‘টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড’ কবিতা সিরিজ এবং একাব্যে মুদ্রিত অন্যান্য কবিতায় এক গহন মনোলোকে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়কে অক্ষরমালায় গেঁথেছেন হাফিজ রশিদ খান। এ বিপর্যয় মনোদেশের হলেও তা আদপে পৃথিবী নামক আমাদের প্রিয়গ্রহটির ভূখণ্ড থেকে ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়া মানুষেরই নির্বোধ আস্ফালনের কাব্যিক রূপকতা, বুঝতে পাঠকের দেরি হয় না। দানবীয় শ্বেতসন্ত্রাসের বিশ্বব্যাপী পাখা বিস্তার, তার প্রতিরোধে গড়ে ওঠা ততোধিক অসহিষ্ণু অথচ জাতিগত অহমিকার উত্থান- এসব অনুষঙ্গ কবি এখানে এনেছেন গভীর অবচতেনরে ডুবুরি হয়ে। হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে যেমন কখনও-সখনও সভ্যতার ভ্রুণ পুষ্পিত হয়, তেমনই রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়েই সভ্যতার অট্টালিকা ও নির্মিতিসমূহ ধূলিসাৎ ও চুরমার হয়। ‘টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ডে’ যুবপ্রতীকের উপস্থাপনে বুড়োটে সর্দারজির সমূহ অবনমন এক নতুন কাব্যবোধের কবাট খুলে দেয়।’
অনেকটা বিজ্ঞাপনের ঢঙে লেখা হয়েছে, তারপরও একধরণের ব্যঞ্জনা পাওয়া যায় কথাগুলোর মধ্যে। টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড কবিতাগুচ্ছ আলাদা-আলাদা কবিতা নয়, বরঞ্চ বলা যায়, একটি দীর্ঘকবিতা। কবিতাগুলোতে অন্ধকার চিত্রিত হয়েছে গোপন ষড়যন্ত্রের প্রতীক হিসেবে। এটি আবার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে পরাজয়, হতাশ্বাস, লাঞ্ছনা এবং গ্লানিময় জীবনযাত্রার। আবার কখনোবা প্রতীক হয়ে উঠতে পারে অন্যায় আচরণ, নিষ্ঠুরতা, মলিন ও অসমর্থিত সম্পর্কের। এই অন্ধকার হচ্ছে অতলস্পর্শী, ভয়াবহ এবং যন্ত্রণাময় অপরিসীম তমসার চিত্র। কবিতাগুলোতে প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা সংঘটিত হতে দেখা যায় গভীর অন্ধকারের ভেতর। রূপহীন অসদ্ভাব ও বিশৃঙ্খলা যেন অন্ধকারেই সবচেয়ে বেশি শক্তিমান। অন্যদিকে ‘চোখের আলোক’-কে স্পষ্টভাবে জয়, আশ্বাস, অপরিসীম সম্ভাবনা এবং সৃজনশীলতার প্রতীক হিশেবে তুলে ধরা হয়েছে। আলোচ্য কবিতাগুলোতে ‘চোখের আলোক’ যেন নিকষ কালো অন্ধকারের ভেতর জোনাকির রঙে ঝিলমিল করে ওঠা।
কবি হচ্ছেন পৃথিবীর তৃতীয়চক্ষু। কিন্তু এই ‘তৃতীয়চক্ষু’ গ্রকিপুরাণের দানব সাইক্লপসের মতো কখনোই ‘একচোখা’ নয়। বরঞ্চ তিলোত্তমাকে দেখতে গিয়ে ইন্দ্র যেমন সহস্রচক্ষু প্রাপ্ত হয়েছিলেন সেরকমই বহুদর্শী! কেননা আমরা যা দেখিনি তা কবির অনুগ্রহে বুঝতে পারি। অনেক জায়গায় কবি আমাদের চোখ খুলে দেন। কখনও আমাদের চোখের ওপর যদি কোনো ময়লা-আবর্জনার আবরণ জমে থাকে, তা তিনি মুছে দেন। কখনোবা আমাদের চোখের ওপর একটি চশমা বা দুরবনি জাতীয় একটা কিছু অবলোকনের যন্ত্র ধরিয়ে দেন। কোলরিজের মতে, ‘কবির সজ্ঞান চিন্ময়োবস্থা কাছে ও দূরের, নিত্য ও অনিত্যের, বিশেষ ও নির্বিশেষের, বাস্তব ও অবাস্তবের, সত্য ও অসত্যের, ক্ষণকাল ও চিরকালের বাস্তব আদর্শের ভাব বা বস্তুসত্তাকে চাক্ষুষ করে রূপের সাহায্যে পাঠকের মনে তার অনুরূপ ভাব-ব্যঞ্জনা সঞ্চার করতে পারে।’
কবির অবলোকনকে আমরা সম্পূর্ণ অবলোকন বলতে পারি। কারণ তার দৃষ্টির মধ্যে চিত্ত, চক্ষুপ্রসাদ, রূপ এবং আলোক– এ কয়েকটি প্রত্যয় সম্মিলিতভাবে থাকে। চক্ষুপ্রসাদ ছাড়া রূপদর্শনে চিত্ত অক্ষম। আবার চিত্তের উপলব্ধি ছাড়া চোখ একাকী দেখতে পায় না। শুধুমাত্র চোখকে আশ্রয় করে স্মৃতি-বিস্মৃতি, কুশল অকুশল কোনো কাজই হতে পারে না। দর্শন, শ্রবণ, আঘ্রাণ, স্পর্শন, আস্বাদন এবং সকল প্রকার প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে চিত্তের মননকৃত্য সম্মিলিত হয়ে যে উপলব্ধি জাগ্রত করে তাই হলো একজন কবির সফলকাম অবলোকন :
অন্ধকারের ভেতর দ্বীপপুঞ্জে
চোখের আলোক আমি জ্বলি
আমি অন্ধ নই
চারপাশ কার্পাসের চাষের মধ্যে
মানিনীর গভীর আয়তক্ষেত্রের জো
তবু আমি ডেকে বলি, সর্দারজি
পশুপতি প্রভুর ফরমান :
আমার স্নায়ুর কেন্দ্রে আমি ভগবান … (টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড : ১)
মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। সে নিজেকে দেখতে চায় মানুষের মধ্যে, অপরের মধ্যে সে আপনাকে পেতে চায় এবং পেতে চায় বলে সেও নিজেকে প্রকাশ করতে চায় ভগবানের মতো। ভগবান যেমন ‘বহুস্যাম’-বহু হবো বলে সৃষ্টির আনন্দে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, মানুষও তেমনই নিজের ভাব-কল্পনাকে বহুরূপে পরিগ্রহ করিয়ে তার মাধুর্য উপভোগ করতে চায়। এভাবে আত্মপ্রকাশের জন্যে মানুষের মনে রয়েছে তীব্র আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয়ত মানুষ কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। একান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী মানুষও জন্ম হতেই পরনির্ভরশীল। জন্মের পর হতে মানবশিশু পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন এবং পারিপার্শ্বিকতার ওপর নির্ভরশীল। সমাজের নানাজন নানাভাবে মানুষকে গড়ে তোলে। তাই সে তার পারিপার্শ্বিকতা, তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, জাতি ও প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে চলতে পারে না। বাস্তব পারিপার্শ্বিকতার সাথে সম্পর্কহীন মানুষ আত্ম-সংকুচিত, দীন। মাটির মানুষ ক্ষুধা-তৃষ্ণার দাবি মিটিয়ে আরেকটি কাল্পনিক জগতের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
বাস্তব জীবন ছাড়াও আরেকটি জগতের মোহ তাকে পেয়ে বসে। কারণ বাস্তব জগতে তার সকল আশা-আকাক্সক্ষা পরিতৃপ্ত হয় না। তাই কল্পনার জগতে সে জীবনের অপূর্ণতার বৃত্তাংশকে পরিপূর্ণ করে পায়। তার অপ্রাপ্তির ইতিহাস কল্পনার জগতে মূর্ত হয়ে ওঠে এবং সাহিত্যে তা তার স্বপ্নপূরণরূপে দেখা দেয়। জীবনের বাস্তব ভাগ্য অনেক সময় মানুষের পক্ষে পীড়াদায়ক। এর হাত থেকে মুক্তিলাভ করে লেখক কল্পনাসর্বস্ব একটি সুন্দর জগত সৃষ্টি করেন। যা জীবনে পাওয়া গেল না, তাই কল্পনায় পেয়ে লেখক আশ্বস্ত হয়ে কল্পনাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। বন্ধন জর্জরিত কবিচিত্ত তাই বিশ্বের স্বর্ণযুগ কল্পনা করেন। বেদনালাঞ্ছিত কবি সৌন্দর্য ও সত্যের অভিন্নতাকে প্রত্যক্ষ করেন, মরণের পরও অমৃতের স্বাদ আস্বাদন করেন। মানুষ স্বভাবতই রূপবিলাসী, সর্বোপরি স্রষ্টা। এইজন্যে স্বকীয় ভাবনা-কামনাকে রূপাশ্রয়ী করার ইচ্ছা তার সহজাতবৃত্তি। মানুষ বলেই হয়তো সে রূপমুগ্ধ, সে যা চায় তাকে সে রূপের মধ্যে দেখতে চায়। টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড কবিতাগুচ্ছের পঙ্ক্তিমালা যেন ঘন সন্নিবেষ্টিত তাম্রলিপির মতো চেতনার রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছেে এবং ঝলসে উঠছেে সৃজনশীল নান্দনিকতা :
১. রক্তের ফোয়ারা দ্বীপপুঞ্জের প্রভাত বেলায়
সূর্যের কুমার পুত্রগণ
ঘাটে ঘাটে
অরণ্যের ফাঁকে
ফসল ও সবুজ ফলের মধ্যে
সোনালি বীর্যের মন্ত্র পাতে… (টো. রা. হ. কা. ২)
২. আকাক্সক্ষার হত্যাকাণ্ড শেষে
একঝাঁক পারিবারিক হরিণীর পাল
দ্বীপপুঞ্জের ছাউনি থেকে
তৃষ্ণার্ত জিভের শব্দে
ফোয়ারার ফেনিল রক্তস্রোতে
জল জল খুঁজে… (টো. রা. হ . কা. ৩)
৩. কার্পাসের শুদ্র বনে
সেই শুধু জেনেছে শালীন
নিবিড় দ্বীপপুঞ্জের গভীর মালিনী-
গন্ধভরা শেওলায় জড়ানো
আমার কণ্ঠস্বরের বিভিন্ন নিনাদ
গোত্রের দুন্দুভি কই…
বন হতে বের হওয়ার রাস্তায় দুইজন দুইদিক থেকে
চেতনাবর্ত্মের পথে-পথে
মুক্তো ছড়ালাম … (টো. রা. হ . কা. ৮)
৪. ফুরফুর পউষের আবহে সহযোদ্ধাগণ, এসো
আরণ্যবেষ্টনে
মরুভূত নগরসমূহে
আমাদের পায়ের অবিনশ্বর দাগ
আগামী প্রত্নবিদ্যার… (টো. রা. হ. কা. ৫)
৫. সোনালি র্তজনী তুলে যে-ঘর দেখালো
দিনের সেনানী
সেখানে দেখছে ওরা
বুড়োটে সর্দারজি একা-একা
ভয়াল নখের আঘাত-আঘাতে
খুবলে খুবলে খাচ্ছে কেবল নিজেরই মাংসপণ্ডি
আর্দ্র রক্তের প্রবাহে
চাটছে মাটি ও পৃথিবীর
ছোট ছোট শস্যের হিরণ্য দানাগুলো … (টো. রা. হ . কা. ৬)
অতঃপর একটি সিদ্ধান্ত
……….
আলোচনা শুরুর এক পর্যায়ে আমরা অধ্যাপক রণজিৎ গুহের একটা কথা তুলে ধরেছিলাম। তিনি বলেছিলেন : যদিও সাব-অলটার্ন স্টাডিজের লেখকের আরও অনেক বিক্ষিপ্ত প্রয়াস রয়ে গেছে এবং রয়ে যাবে, সেই প্রয়াসগুলোও এই প্রয়াসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে এবং অভিঘাতের দিক থেকে সকল উদ্যোগ একবিন্দুতে একত্রিত হতে পারে। কবি হাফিজ রশিদ খানের আদিবাসীবিষয়ক তিনটি কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতাপাঠ ও পর্যালোচনা করে বলতে পারি, বাংলা কবিতায় আদিবাসীদের সমৃদ্ধ জীবন, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নান্দনিক উপস্থাপনা সাব-অলটার্ন স্টাডিজেরই একটি নবতম প্রয়াস এবং তাঁর এই প্রয়াস অন্যান্য প্রয়াসের সাথে অবশ্যই মিলিয়ে দেখার দাবি রাখে এবং অভিঘাতের দিক থেকে তাঁর উদ্যোগও অন্যান্য উদ্যোগের সাথে একবিন্দুতে একত্রিত হবে এবং এক্ষেত্রে নিম্নবর্গীয় আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার হিশেবে বাংলাদেশে স্বীকৃতির বরমালাটি তাঁরই প্রাপ্য হবে।
প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিগুলোর সূত্র
………
১. আদিবাসী কাব্য– হাফিজ রশিদ খান; ফ্ল্যাপে বিধৃত কবির ভাষ্য; প্রকাশক : শৈ অং প্রু, প্রকাশকাল : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ : পুষ্পকরথ, চট্টগ্রাম
২. সাজিদুল হক : ‘কবি হাফিজ রশিদ খান ও বিপ্রতীপ ভাবনা’; পঙক্তিমালা; সম্পাদক : আকতার হোসাইন, পৃ. ৫১, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০১,
চট্টগ্রাম
৩. মহীবুল আজিজ : ‘আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার : হাফিজ রশিদ খান’; কথাসাহিত্য ও অন্যান্য; বলাকা প্রকাশন পৃ. ৭৭, প্রকাশকাল :
নভেম্বর ১৯৯৯, চট্টগ্রাম
৪. হাফিজ রশিদ খান : ‘কবিতা এলো কোন্ পথে’; আমাদের কবিতা ও আদিবাসী প্রসঙ্গ; প্রকাশক : কাজী মূসা, উপবন প্রকাশনী; পৃ: ৮০,
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০১, চট্টগ্রাম
৫. ঐ : পূ: ৭৬
৬. রাজীব নূর : ‘টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড’ কাব্যের ফ্ল্যাপে বিধৃত ভাষ্য; প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০২, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা
অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থ
……….
১. আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় : দীপ্তি ত্রিপাঠী; নভেম্বর ১৯৫৮; কলকাতা,
২. কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা : সৈয়দ আলী আহসান; পৌষ ১৩৭৫, ঢাকা
৩. সাংস্কৃতিক জিজ্ঞাসা : সালাহ উদ্দীন আইয়ুব; বাংলা একাডেমি, ঢাকা
৪. সাহিত্যসন্দর্শন : শ্রীশচন্দ্র দাশ; ঢাকা
৫. উত্তর আধুনিকতা, নতুন অন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিত : এজাজ ইউসুফী; ফেব্রুয়ারি ২০০১, চট্টগ্রাম
৬. কাব্যতত্ত্ব অন্বেষা : নরেন বিশ্বাস; আগস্ট ২০০২, ঢাকা
……….
:: মং সিং ঞো : কবি-প্রাবন্ধিক, সমালোচক।