মীর সালমান শামিল
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৮২ সালের লেখা আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান বন্দে মাতরম। ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গাওয়া হয় বন্দে মাতরম গানটি। গানটি পরিবেশন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীতে এই গান কংগ্রেস সংগীত, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলনসহ সব আন্দোলনে প্রথমে বাঙালি হিন্দু এবং পরে সর্বভারতীয় হিন্দুদের জাতীয় সংগীত হয়ে যায়।
উপন্যাস প্রকাশের পর থেকেই বাংলাভাষী মুসলমানেরা এই গান প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেস এই গানকে গ্রহন করলে সর্বভারতীয় মুসলমানেরা এই গান প্রত্যাখ্যান করে। কারন গানের লাইনগুলো মুসলমানদের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।
❝ দেশের প্রতি ভালবাসা থাকবে কিন্তু দেশ মা বলা, দেশকে ঈশ্বরের মত ভক্তি করে বন্দনা করা, উপসনা করা, দেশের পায়ে মাথা রাখা মুসলমানদের মূল বিশ্বাসের বিপরীত। ❞
মুসলমানেরা আহবান করে এমন কোন গান নির্ধারন করতে যেটা মুসলমানদের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তবে হিন্দুরা এই আহবানকে কোন গুরুত্ব দেয় না। তারা বন্দে মাতরমই ব্যবহার করতে থাকে।
ভারত ভাগ হলে ১৯৪৭ সালে তারা বন্দে মাতরমকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বন্দে মাতরম ছিল ভারতের জাতীয় সংগীত।
১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতের জাতীয় সংগীত করা হলে বন্দে মাতরম গানটিকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় স্তোত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়। এখনো ভারতের মুসলমানেরা এই গানকে গ্রহন করেনি।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই মাদ্রাজ হাইকোর্ট আদেশ দেয়, তামিলনাডুর সব স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার করে বন্দে মাতরম গাইতেই হবে। এই রায়ের পরেই সমগ্র ভারতের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন প্রতিবাদে ফেটে পরে। মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে এই রায় পরে প্রত্যাহার করা হয়।
গানটি লেখা সংস্কৃত ভাষায়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই গান বাংলায় অনুবাদ করে। গানের লাইনগুলো হল—
বন্দনা করি মায়!
সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা, চন্দন-শীতলায়!
যাঁহার জ্যোৎস্না-পুলকিত রাতি
যাঁহার ভূষণ বনফুল পাঁতি,
সুহাসিনী সেই মধুরভাষিণী–সুখদায়–বরদায়!
বন্দনা করি মায়!
সপ্তকোটির কণ্ঠনিনাদ যাঁহার গগন ছায়
চৌদ্দ কোটি হস্তে যাঁহার
চৌদ্দ কোটি ধৃত তরবার,
এত বল তার তবু মা আমার অবলা কেন গো হায়?
বন্দনা করি মায়!
২
১৯৭১ সালে ভারতীয় মুসলমানদের একটা অংশ— পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা পাকিস্তান থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ নাম ধারন করে। পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা বন্দে মাতরম গানের সবচেয়ে কঠোরভাবে বিরোধী ছিল। ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাঙালি জাতীয়তাবাদি নেতারা জাতীয় সংগীত নির্ধারন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান আমার সোনার বাংলা। যে গানের লাইনগুলো হল—
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে –
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে-
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি
৭১ এর পর বাঙলি জাতীয়তাবাদীদের প্রবল স্রোতের সামনে আলেমরা কিছু বলার সুযোগ পায়নি। আস্তে আস্তে আলেম সমাজ এই গানের বিরোধিতা করা শুরু করে। বুখারী শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদক শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, হাফেজ্জি হুজুর, মুফতি আমেনি, কামাল উদ্দিন জাফরিসহ সকল ধারার আলেম সমাজ এই গানের বিরোধিতা করে। কারন এই গান বন্দে মাতরমের চেয়েও উগ্র গান।
মুসলমানদের পার্সপেক্টিভ থেকে এই গান গ্রহনযোগ্য না। ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে মৌলিক প্রিন্সিপাল হল, মুসলমানেরা তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের সাথে ক্ল্যাশ হতে পারে এর ধারের কাছে যেতে পারবে না।
এই গানে সরাসরি দেশকে একটা গড-লাইক এনটিটি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানে এই দর্শনকে বলা হয় “Civic religion”।
ইসলামপন্থীদের বাইরে নাগরিক সমাজের অনেকে এই গানের বিরোধিতা করেন। কারন—
১। এই গানটি আসল(Original) গান নয়। এটি কবি গগন হরকরার আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যেরে গানের সুর এবং লাইন থেকে সরাসরি নকল করা।
২। এই গান লেখা হয়েছিলো বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে, বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময়। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন ছিল একটা উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক। বঙ্গভঙ্গ হলে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা এবং অন্য বর্ণের অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে যাবে এটা কোলকাতার উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সহ্য হয়নি। সে থেকে তারা এই আন্দোলন করে। অর্থাৎ এই গানটি সরাসরি বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী।
একটা নকল, সাম্প্রদায়িক গান একটা দেশের জাতীয় সংগীত কিভাবে হয়?
অর্থাৎ রিলিজিয়াস এবং সেক্যুলার, দুই পার্সপেক্টিভ থেকেই এই গান অগ্রহনযোগ্য।।