তাজ ইসলাম
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। সোনার বাংলাকে এদেশের মানুষ ভালোবাসে সবসময়। তবে কেউ কেউ ভালোবাসে ভিন্নভাবে। একপক্ষ থাকে জনতার কাতারে। অন্যপক্ষ সরকারের কাতারে। সরকারী লোকেরাও ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসায় স্পষ্ট থাকে গদি। তাই জনতার পক্ষে যারা সোনার বাংলাকে ভালোবাসে সরকার বাহিনী তাদের বুকে বুলেট চালাতে দ্বিধা করে না। এই ভূখণ্ড তার নজির দেখল সর্বশেষ ২০২৪ এ। হাল সময়ে এসেও যারা জনতার পক্ষ ছিল তাদের বিপক্ষ ছিল ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতাসীনদের সাথে যেসব কবি, সাহিত্যিক,সাংবাদিক,বুদ্ধিজীবী ছিলেন তাদের জনতার পক্ষরা সরাসরি বলেন ‘গণশত্রু’। এই গণশত্রুদের ৭১ এর ভাষায় বলা হয় স্বাধীনতা বিরোধী। বলা হয় হানাদারদের দোসর। ২৪ এ ফ্যাসিবাদ,স্বৈরাচার হটানোর পর বলা হয় অর্জিত হয়েছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার বিপক্ষে যারা করেছে ফাইট তারাও ২৪ এর রাজাকার। আমাদের এই যুদ্ধে অর্জিত হয়েছে মুক্ত চিন্তার,রূদ্ধ কথার অনর্গল বলার স্বাধীনতা। নিজেদের অধিকার আদায় এবং অধিকারের কথা বলার স্বাধীনতা। আধিপত্যবাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করার স্বাধীনতা।এর আগে আমরা আমাদের একটি পতাকা ও মানচিত্র পেয়েছি। নিজের দেশকে পৃথিবীর জমিনে মানচিত্রের রেখা টেনে নিজস্ব করে নিয়েছি। সীমান্তরেখা পর্যন্ত আমার দেশ।এইটা আমার দেশের সীমানা। এই অর্জনে ব্যয় হয়েছে রক্ত,প্রাণ,ত্যাগ তিতিক্ষা। অস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি তখনও হয়েছে কালচারাল যুদ্ধও। কালচারাল যুদ্ধে ২০২৪ এ যেমম গণশত্রু চিহ্নিত হয়েছে ৭১এও তেমনি চিহ্নিত হয়ে আছে গণশত্রুদের নাম। একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও আরও ইতিহাস থাকে। ২৪ কে যদি স্বাধীনতা ধরেন তাহলে বলা যায় বৃটিশ ভারত থেকে এটি আমাদের চতুর্থ ধাপ। ১৯৭১ হল তৃতীয় ধাপের বিজয়। ভূখণ্ড পৃথকীকরণের হিসাবে এ ভূখণ্ড তৃতীয় ধাপে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরব। প্রতিবারই স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ ছিলই। সববারই প্রতিপক্ষের পরিচয় একই।যে নামেই ডাকেন কথা একই।রাজাকার বলেন,গণশত্রু বলেন,স্বাধীনতা বিরোধী বলেন বিষয়তো একই। ৭১ এ যারা বিরোধিতা করেছিল তারা মোটা দাগে পরিচিত।২৪ এর বিরোধীরাও ধীকৃত। তার আগে ১৯৪৭ সালে এদেশ ভাগ হয় বৃটিশের পরাধীনতার জাল ছিন্ন করে। গোটা বৃটিশ ভারতীয় অঞ্চল ভাগ হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে।তখনকার বিরোধীদের পরিণতি আরও ভয়াবহ।যারা পাকিস্তানের বিরোধীতা করেছিল তারা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে ছিল কিনা সন্দেহ আছে।যারা ভারতের বিরোধিতা করেছে তারাও ভারতে রয়নি। ইতিহাসের সত্য হল বিরোধীতা না করার পরও শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেও ভারত ছেড়ে চলে আসছে বহু মুসলমান ও পাকিস্তানে থাকেনি অনেক হিন্দু।
১৯৪৭ এর আগেও এই ভূখন্ড নিজেদের অধিকার ও সুযোগ সুবিধা পেতে বিভক্ত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। প্রশাসনিক সুবিধার জন্যই এই বিভক্তি। সেই বিভক্তি ইতিহাসে পরিচিত বঙ্গভঙ্গ নামে। এই অঞ্চলের মানুষের সুযোগ সুবিধার বিরোধীতা করেছিল কলকাতা কেন্দ্রীক এলিট শ্রেণী। বঙ্গভঙ্গকে মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ হিসেবে ক্রন্দনরত ছিল তারা। সেই শোক প্রকাশ করতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”।
এবার আমরা কিছু যুক্তিতে আসি।২৪ এ যারা ছাত্র জনতার বিরোধীতা করেছে তাদেরকে ছাত্র জনতার পক্ষের লোকেরা বলি ফ্যাসিবাদের দোসর।সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যারা বিরোধী তাদেরকেও ফ্যাসিবাদের দোসরই বলি।তাদের ঐ সময়ে রচিত তাদের কবিতা, গান, নাটক আমরা ছাত্র জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলেই ধরে নিই।
৭১ এ যারা এদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছে তাদেরও আমরা স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবেই উল্লেখ করি।স্বাধীন সরকার তখনকার সময়ে বিপক্ষ কবি বা সাহিত্যিকদের কালো তালিকায় রেখে দিয়েছেন নির্বিঘ্নে।
আমরা জোর দাবী তুলি অখণ্ড পাকিস্তান যারা চেয়েছিল তারা যেন জাতীর কাছে ক্ষমা চায়। মেনে নিতে চায় না স্বাধীনতার পক্ষে যারা।
৪৭ এ যারা পাকিস্তান চায়নি তারা ভারত চলে গেছে।যারা ভারতে থেকে পাকিস্তান চেয়েছে তারা ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে এসেছে।
এবার ১৯০৫ সালে ফিরি।
১৯০৫ সালে যে আমার ভূখণ্ডের সুযোগ সুবিধার বিরোধীতা করল। যে আমার ভূখণ্ডকে পৃথক হতে বাঁধা দিল। আন্দোলনের নামে চক্রান্ত করে বঙ্গভঙ্গ রদ করল।আমার অধিকারের বিরোদ্ধে কবিতা লিখল সে বিষয় কি আলোচনা হতে পারে না?
কেউ কেউ যুক্তি দিবেন অখণ্ড বাংলা চাওয়া দোষের কিছু না।কেন, কীভাবে গুণের হয়? আমার সোনাড বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।আমিও ভালোবাসি।রবীন্দ্রনাথও ভালোবাসতেন।তবে রবীন্দ্রনাথ আমার বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন না।রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন তার বাংলাকে। তার বাংলা ছিল পূর্ব বাংলার প্রভূ বাংলা।আমার বাংলার দাবী ছিল ঢাকা কেন্দ্রীক শাসনের বাংলা। এই যে আপনি আমি সংগ্রাম করে ফ্যাসিবাদ তাড়িয়েছি।আমরা ভালোবাসি এই বাংলাদেশকে।বিতাড়িত ফ্যাসিবাদও ভালোবাসে এই বাংলাদেশকে।তো খানিক পার্থক্য আছে।আমি এই বাংলাকে ভালোবাসতে গিয়ে ঢেলে দিই বুকের রক্ত।ফ্যাসিবাদ ঝরায় আমার ভায়ের বুকের রক্ত।আর ফ্যাসিবাদের দোসর শিল্পীরা হুকুম করে ছাত্রদের গায়ে ঢালতে গরম পানি। ১৯০৫ সালের আমার পূর্বপুরুষের অধিকার ছিনিয়ে নিতে তখনকার বিরোধীতাকারীরা আমার পূর্বপুরুষের জন্য শীতল জলের আয়োজন করেনি।মনের শোকে তাদেরই নেতৃস্থানীয় কবি লিখেছিলেন ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” এই ভালোবাসায় ছিল পূর্ববঙ্গের ছাষাভূষাদের প্রতি ঘৃণা। আপনি একাত্তরের অখণ্ড পাকিস্তান দাবীদারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অপরাধী রায় দেন।তাহলে ১৯০৫ সালের অখণ্ড বাংলা দাবীদারকে গুণী বলেন কোন যুক্তিতে।৭১ এ যারা এদেশের বিরোধীতা করেছে তাদেরকে বলেন পাকিস্তানি রাজাকার। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধীকে বৃটিশ রাজাকার বললে অতুক্তি হবে কী? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী কবি,বাংলাদেশী কবি না।বৃহৎ বৃটিশ নাগরিক কবি হলেও ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ বিরোধী কবি। ১৯০৫ সালে আমার বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে হয়তো আমাকে ৭১ পেতে হতো না। ৪৭ এ দেশকে পূর্ব পাকিস্তান হতে হতো না।হয়তো তখন ভারত ভাগ হতো তিনটি ভাগে।এর একটি হত বাংলাদেশ।এবং এর আয়তন হত আরও বড়।
তারপরও আমরা রবীন্দ্রনাথকে মান্য করি কবি হিসেবে।বাংলা ভাষার কবি হিসেবে তার অবদানকে স্মরণ করি শ্রদ্ধার সাথে। স্মরণ করি বলেতো বিস্মরণের অতলে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না ইতিহাসকে। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় পরিচয়,নাগরিক বা জাতীয়তার পরিচয়ের চেয়ে তার ঐতিহাসিক বিষয়টির গুরুত্ব অনেক। ২০২৪ এ ছাত্র জনতার বিপক্ষে লেখা কবির কবিতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, ১৯০৫ সালে আমার ভূখণ্ডের মানুষের বিরুদ্ধে লেখা কবিতা ইতিহাস বারবার আমার সামনে বেদনাদায়ক স্মৃতি হিসেবে ভাসে। বিজয়ীর ইতিহাস রচিত হয় গৌরবগাঁথা দিয়ে। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথরা বিজয়ী ছিলেন।সৌভাগ্য তাই তাদের সঙ্গী। আমার সোনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত আছে থাকুক।সেই সাথে জারি থাকুক সেই কবিতা লেখার প্রেক্ষাপটের ইতিহাস।ইতিহাস ভুলে গেলে একটি জাতি ভুলে যায় নিজের পরিচয়।
প্রচ্ছদ : শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী