খসরু পারভেজ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই।একটু সুযোগ পেলেই, ফাঁক-ফোকর গলিয়ে সেসব অভিযোগ ডালপালা মেলতেই থাকে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি বহুল উত্থাপিত অভিযোগ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন। শিক্ষিত লোকদেরকেও বলতে শুনি। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকা, সোসাল মিডিয়ায় তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকে। কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে এই অভিযোগ নতুন মাত্রা পেয়েছিল। সত্যিই তিনি বিরোধিতা করেছিলেন? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখালেখির কারণে কতবার যে আমাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার হিসেব রাখা কঠিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিরোধিতা করে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছিলেন, ‘’মূর্খদের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়? এরা তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না!’’ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আমার যৎসামান্য যেটুকু পড়াশুনা, তাতে তাঁর কোনো প্রবন্ধ,বক্তৃতা বা চিঠিপত্রে এমন ধরনের কোনো তথ্য আমার সামনে আসেনি, যেখান থেকে কোনো উদ্ধৃতি আমি পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারি। তাহলে এ অভিযোগ কেন? কারা এসব উত্থাপন করে রবীন্দ্রমুখে কালিমা লেপন করে সুখ অনুভব করে? কী উদ্দেশ্যে তাদের? বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।
প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা করা যাক। এ প্রসঙ্গ অবতারণার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে আসবে বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গ। যা বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের আগে থেকেই বাংলার সঙ্গে উড়িষ্যা ও বিহারের সংযোগ ছিল। পলাশীর যুদ্ধের পরও বৃহত্তর এই রাজ্য ব্রিটিশদের শাসনাধীন ছিল কিন্তু প্রসাশনিক কারণে এটির বিভাজন জরুরি হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পূর্ববাংলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন একটি প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করেন গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে বাঙালি হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। শুরু হয় আন্দোলন। বিরোধিতা ও আন্দোলনের মধ্যেও ব্রিটিশ শাসকরা তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বাংলাকে ভাগ করে নতুন প্রদেশ ঘোষণা করে। এটিই ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত।
প্রথমত বঙ্গভঙ্গের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ নিরব ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি এর বিরোধিদের শামিল হন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় ও কবিতায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলা হয়, এই সময়ে তিনি ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উগ্র জাতীয়তাবাদের কুফল অনুধাবন করে তিনি ক্রমে ক্রমে ঝুঁকে পড়েন আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে।
একটা পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন, জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য ধরে রাখা অসম্ভব।
প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলাকে ভাগ করলেও এর পেছনে ব্রিটিশদের ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। জাতিগত বিভাজনকে উস্কে দেওয়াই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। পূর্ব বাংলা ও আসামকে এক করে ঢাকাকে পূর্ব বঙ্গের রাজধানী করলে সাম্প্রদায়িক কারণেই মুসলিদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু অভিজাত হিন্দুরা এটির বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় স্বদেশী আন্দোলনে। এক পর্যায়ে তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়ে দুই বাংলাতেও। আগে থেকে বিভিন্ন কারণে পশ্চাৎপদ ছিল বাংলার মুসলিম সমাজ। বিশেষত ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের অনাগ্রহ ছিল পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। বঙ্গভঙ্গের কারণে তারা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু হিন্দু রাজনীতিকদের বিরোধিতার কারণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জাতিগত বিভাজন। কলকাতার জমিদার শ্রেণি, শিক্ষক-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমাজ, এমনকি আমলা-বিচারকরাও বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা শুরু করেন। শুরু হয় মিছিল, সভা, প্রতিবাদ সমাবেশ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যোগ দেন এসব প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে। আমরা জানি, বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে তিনি অনেক গান পর্যন্ত লেখেন। আমাদের আজকের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ –এই গানটিও এই প্রেক্ষাপটে রচিত।
গোটা ভারতবর্ষে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাদের দাবি মেনে নিয়ে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে নতুন প্রদেশ বাতিল ঘোষিত হয়। এর নাম বঙ্গভঙ্গ রদ।
বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ আশাহত হয়। ঢাকাকে নতুন রাজধানী করে যারা নব উন্নতি বা নব সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছিল, তারা ক্ষুব্ধ হয়।
সুযোগ সন্ধানী ব্রিটিশ সরকার মুসলিম সমাজকে খুশি করার পথ খুঁজছিল। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মোহামেডান এডুকেশন কনফারেন্সের ২০তম অধিবেশন। নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে এই সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। সম্মেলনে কনফারেন্সের অনারারি জয়েন্ট সেক্রেটারি ব্যারিস্টার খান সাহেবজাদা আফতাব আহমেদ তাঁর বক্তৃতায় ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে তা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে ধরেন।
সুযোগসন্ধানী ব্রিটিশ সরকার আশাহত এই মুসলিম সমাজের সমর্থন পেতেই কলকাতার মতো ঢাকাতে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কেন্দ্র থেকেই ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জকে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয়। ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারের স্যার সলিমুল্লাহসহ অন্যান্য সদস্যগণ এবং শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক প্রমুখের প্রচেষ্টায় গঠিত হয় নাথান কমিশন। যে কমিশনের সুপারিশে সুগম হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ। অতঃপর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শুধু বনেদী মুসলমানরা নন, বনেদী হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে মধ্যবিত্তদের আর কষ্ট করে কলকাতায় গিয়ে পড়তে হবে না ভেবেই ঢাকার বালিয়াটির (মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়া) জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে প্রচুর অর্থদান করেন। এ কারণে একটি হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরী (যার নামে জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত)- এর নামে।
এই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি।
এবার আমরা দেখব, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কারা বিরোধিতা করেছিলেন। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফর শেষে কলকাতায় পৌঁছালে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট রাজনীতিক ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচরণ করে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধিতা করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘ঢাকার স্মৃতি’ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘’ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সরাসরি আশুতোষ বাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন। শেষ পর্যন্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন প্রফেসর পদ সৃষ্টির বিনিময়ে বিরোধের অবসান ঘটান।’’
বিশিষ্ট রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, পিয়ারীমোহন মুখোপাধ্যায়ও ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। এদের অনেকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ওঠাবসা ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে বিরোধিতা করেছিলেন, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন- “লক্ষ্য করা যায় তিন ধরনের লোকজন বিরোধিতা করেছিলেন —
১. পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে!
২. পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান–তারা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে।
৩. পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে হাজারে ২/১ জন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে। হিন্দুদের সুবিধা বেশী হবে। পূর্ববঙ্গে মাদ্রাসা, প্রাইমারী এবং হাইস্কুল হলে সেখানে পড়াশুনা করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়বে। আগে সেটা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় হলে; যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় চান নি।”
মাওলানা আকরম খাঁও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করলে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দানের ক্ষেত্রে অর্থের ব্যবস্থা করবেন না। তিনি মুসলমানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অপেক্ষা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। অনেকেই সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের পক্ষে ‘বিলাসিতা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মৌলভি আবুল কাশেম, মৌলভি লিয়াকত হোসেন প্রমুখ।
তৎকালীন মুসলিমদের অনেকের ধারণা ছিল প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান, ফলে বাংলার মুসলমানদের জন্য তা বিশেষ সুবিধাজনক হবে না । জানা যায়, চব্বিশ পরগণার জেলা মোহামেডান এসোসিয়েশন ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তাদের পক্ষ থেকেও কম বিরোধিতা হয়নি।
যদিও ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বারবার বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের জন্য নয়, এটি সকল সম্প্রদায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সে যাই হোক, একটা শ্রেণি ঘুরে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের নামটি বারবার উচ্চারণ করেন। কেন?
২০০১ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক আহমদ শরীফ ‘রবীন্দ্র-উত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতার প্রমাণের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রানুরাগী ও রবীন্দ্রস্নেহভাজন অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তার ত্রুটি-নিন্দা-কলঙ্কের সাক্ষ্য প্রমাণ সতর্ক প্রয়াসে অপসারিত বা বিনষ্ট করতেন।’’
আহমদ শরীফের এই উক্তির প্রেক্ষিতে প্রাক্তন সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তাঁর ‘দুর্ভাবনা ও ভাবনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে’ (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯) গ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথ ও সাম্প্রদায়িকতা‘ অধ্যায়ে লিখেছেন:
‘’গবেষণামূলক প্রবন্ধে এ ধরনের বক্তব্যের সমর্থনে অবশ্যই সূত্রের উল্লেখ করতে হয়। অধ্যাপক শরীফ এ বক্তব্যের ওপর ১০ নম্বর পাদটীকা বসান। আমি খুশি হয়ে ১০ নম্বর পাদটীকাতে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন, অন্নদাশঙ্কর রায়ের উক্তিটি কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না। গুজবভিত্তিক বক্তব্যে খিস্তিখেউর লেখা যায় কিন্তু যুক্তিভিত্তিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখা সম্ভব হয় না।’’
দুঃখজনক যে আহমদ শরীফের মতো বুদ্ধিজীবীরা পরের মুখের কথা শুনে গুজব ছড়িয়ে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। যে তথ্যের কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না, সেটা নিতান্তই গুজব বৈকি!
কোনো কোনো লেখায় উল্লেখ দেখি, নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তাঁর ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এন আননোন ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থে নাকি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু গবেষকরা তন্নতন্ন করে খুঁজে নীরদ সি চৌধুরীর আত্মজীবনীতে রবীন্দ্রনাথ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, এমন কোনো মন্তব্যের সন্ধান পাননি। নীরদচন্দ্র চৌধুরী রবীন্দ্রবিদ্বেষী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজির মতো এত নিম্নমানের ইংরেজি নোবেল পুরস্কারের জন্য কীভাবে মনোনীত হয়, এমনতর অনেক অভিযোগ আছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কোনো ভূমিকা ছিল এটা তিনি কোথাও বলেননি।
কেউ কেউ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কলকাতার গড়ের মাঠে যে প্রতিবাদ সভা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ সেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন। একটি গ্রন্থে বর্ণিত আছে, “১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বও সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন হিন্দু সমাজ তথা হিন্দু মনমানসিকতা ও হিন্দু চেতনা ও হিন্দু ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একজন হিন্দু স্বভাবকবি।’
[আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ — মেজর জেনারেল এম এ মতিন। ] সমালোচকের এই বক্তব্য সঠিক নয়।
১৯১২ সালের ২৮ মার্চ এ ধরনের সভায় রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্ব করা দূরের কথা, তাঁর উপস্থিত থাকা সেখানে সম্ভবই ছিল না। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ কলকাতা থেকে কবির ‘সিটি অব প্যারিস’ জাহাজে ইংল্যান্ড যাত্রার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর আগের দিন জাহাজে তাঁর মালপত্র তুলেও দেওয়া হয়। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার কারণে তিনি জাহাজে উঠতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বর্ণনা দেন, তা প্রশান্তকুমার পাল সম্পাদিত রবিজীবনী (১৯৯৩)-এর ষষ্ঠ খণ্ডে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেন:
‘জাহাজ ছাড়বার আগের দিন রাত্রে স্যার আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে বাবার নিমন্ত্রণ। কেবল খাওয়াদাওয়া নয়, সেই সঙ্গে ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। দীনেন্দ্রনাথ বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করলেন। অসুস্থ শরীরে বাবাকে অনেক রাত অবধি জাগতে হলো। আমরা ঘরে ফিরলাম বেশ রাত করে। বাকি রাতটুকু বাবা না ঘুমিয়ে চিঠির পর চিঠি লিখে কাটিয়ে দিলেন। ভোরবেলা উঠে বাবার শরীরের অবস্থা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, ক্লান্তিতে অবসাদে যেন ধুঁকছেন। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে পাঠানো হলো।….জাহাজ আমাদের জিনিসপত্র সমেত যথাসময়ে পাড়ি দিল, কিন্তু আমাদের সে যাত্রা আর যাওয়া হলো না।’
রবিজীবনীর ষষ্ঠ খণ্ড থেকে জানা যায়, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মিত্রকে লেখেন—
‘আমার কপাল মন্দ—কপালের ভিতরে যে পদার্থ আছে, তারও গলদ আছে—নইলে ঠিক জাহাজে ওঠবার মুহূর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? অনেক দিনের সঞ্চিত পাপের দণ্ড সেইদিনই প্রত্যুষে আমার একেবারে মাথার উপরে এসে পড়ল। রোগের প্রথম ধাক্কাটা তো একরকম কেটে গেছে, এখন ডাক্তারের উৎপাতে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।’ এরপর একটু সুস্থ বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শে ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে শিলাইদহ গমণ করেন। এর প্রমাণস্বরূপ প্রশান্তকুমার পাল ঠাকুরবাড়ির ক্যাশ বহির হিসাব উল্লেখ করেন। ২৫ মার্চ তিনি শিলাইদহ পৌঁছে কাদম্বিনী দেবীকে এবং ২৮ মার্চ জগদানন্দ রায়কে চিঠি লেখেন। শুধু চিঠি নয়, ওই দিন থেকেই তিনি গান ও কবিতা লেখা শুরু করেন। তার ‘গীতিমাল্য’ কাব্যগ্রন্থে ‘স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি’ কবিতাটির নিচে লেখা আছে ‘শিলাইদহ ১৫ই চৈত্র ১৩১৮’ (২৮ মার্চ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ)। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ আছে একই তারিখে তিনি গানও লিখেছেন। উল্লিখিত তারিখে শিলাইদহে বসে তিনি গান – কবিতা লিখেছেন, তাঁর পক্ষে একই দিনে কলকাতার গড়ের মাঠে বক্তৃতা দেওয়া কী করে সম্ভব?
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধিত হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডি-লিট ডিগ্রি অর্পণ করা হয়। যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকাশ্যে বা অন্য কোনো উপায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতেন, তাহলে কি এত অল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসব প্রাপ্তি সম্ভব ছিল!
বিশিষ্ট গবেষক আমিনুল ইসলাম ‘রবীন্দ্রমানস ও মুসলিম সমাজ’ (২০১১) গ্রন্থে লিখেছেন,
”ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সেদিন পথে নেমেছিল হিন্দু সংবাদপত্রগুলি, হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতাগণ। গিরিশচন্দ্র ব্যানার্জি, রাসবিহারী ঘোষ এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে বাংলার এলিটগণ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারকলিপি দেন লর্ড হার্ডিঞ্জকে। রবীন্দ্রনাথ এই সময় মৌন ছিলেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কোনো উচ্ছ্বাসসূচক লেখা বা মন্তব্য পাওয়া যায়নি; এ কারণে ধরে নিতে হবে তিনি এটির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন?
তাঁর মৌনতার ব্যাপারে অনেকের ধারণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন রবীন্দ্রনাথ ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে হিন্দু-অধ্যুষিত বোলপুরে বিশ্বভারতীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে আসছিলেন। তাই স্বাভাবিক কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মৌন ছিলেন। এ ধারণাও কি সঠিক? রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শান্তি নিকেতনের প্রতিদ্বন্ধী ভাবতে পারেন, এতখানি হীনমন্য তিনি ছিলেন, এটা অতি বড়ো নিন্দুকও মানতে চাইবেন না।
®©[ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পরিবারের অবদান ছিল সমধিক; তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল সুগভীর। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন:
‘নতুন প্রদেশ বাতিল হওয়ার পর সলিমুল্লাহ শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বস্তুত, জাতীয় রাজনীতিতে তিনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। বেশিরভাগ সময় ধর্ম-কর্ম নিয়ে থাকতেন,… সভা-সমাবেশে বিশেষ যেতেন না। শুধু রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর কবিকে অভিনন্দন জানাতে আয়োজিত একটি সভায় ঢাকা বার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন অল্প সময়ের জন্য।’ [পৃ.৫৭]®
{এ বর্ণনা থেকে ধারণা করা সম্ভব রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিরোধিতা করলে
নিশ্চয়ই নবাব সলিমুল্লাহ রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানাতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যেতেন না। }
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বার লাইব্রেরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ, হিন্দু-মুসলিম সেবা সংঘ, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এত বিপুলভাবে সংবর্ধিত, আদৃত হতে পারতেন না।
—-
প্রবন্ধে উল্লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থ, প্রবন্ধ এবং অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত তথ্যের আলোকে।
অসাধারণ একটি আলোচনা।