spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধঅতুলনীয় একজন ফিরোজা বেগম

লিখেছেন : আমিনুল ইসলাম

অতুলনীয় একজন ফিরোজা বেগম

আমিনুল ইসলাম

ফিরোজা বেগম চেলে গেছেন সম্রাজ্ঞীর মতো, পড়ে আছে সিংহাসন এবং ‘শূন্য আজি গুলবাগিচা যায় কেঁদে দখিন হাওয়া।’ ফিরোজা বেগম সেই ক্ষণজন্মা প্রতিভা যার হাতে নজরুলসঙ্গীতের সোনালি পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সম্রাজ্ঞী নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন নজরুলের গানগুলোকে নতুনভাবে রেকর্ড করার এবং শ্রোতার কাছে যথাযথভাবে পুনঃউপস্থাপনের গুরুভার। আবার তিনি নিজের উদ্যোগে সেই সময়ের কোলকাতার বহু বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পীকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছেন নজরুলের বহু গান। প্রত্যাবৃত্ত জোয়ারের মতো আবারও জেগে উঠেছে নজরুলের গান। ফিরোজা বেগমের প্রবল ব্যক্তিত্ব, মোহনীয় সৌন্দর্য, লম্বা-চওড়া রাজকীয় চেহারা, আপোষহীন নৈতিকতা, এবং অক্লান্ত ও নিরবচ্ছিন্ন শ্রম ও সাধনা, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সুরকার কমল দাশগুপ্তের যথাযোগ্য সহযোগিতা এবং বিধাতা প্রদত্ত একটি ভরাট-সুরেলা-উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন-নমনীয় স্বর্ণকণ্ঠ তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরশিল্পী করে তুলেছিল ।

ফিরোজা বেগম একটি প্রতিষ্ঠানের নাম–একটি শিরোনামহীন সংগ্রামের নাম। বহুবিধ কারণে পশ্চিমবঙ্গে যখন নজরুলের গান বিকৃতির ও বিস্মৃতির স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলো, বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এর শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রবীন্দ্র-বিরোধিতা বানচাল করার জন্য রবীন্দ্র-জোয়ার সৃষ্টি করতে গিয়ে অন্যায্যভাবেই এবং হয়তো-বা কিছুটা বেখেয়ালে, উপেক্ষা করে যাচ্ছেন নজরুলসৃষ্টিকে, বুদ্ধিজীবীরা যুক্তিসংগত কারণেই আঁকড়ে ধরছেন রবীন্দ্রসংগীত কিন্তু অযৌক্তিকভাবেই উপেক্ষা করে যাচ্ছেন নজরুলসঙ্গীতকে, তখন ফিরোজা বেগম অনেকটা একাই এবং এককভাবে এগিয়ে আসেন নজরুলে গানকে পুনরুদ্ধারপূর্বক যথাযোগ্য আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে। তিনি একাজে স্বামী কমল দাশগুপ্তকে সঙ্গে পেয়েছিলেন। অধিকন্তু বহু বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী এগিয়ে আসেন তাঁর সহায়তায়। আবার এটাও সত্য যে নজরুলপ্রীতির জন্য তাঁকে নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হতে এবং বহুবিধ ঝামেলাও পোহাতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। তিনি স্বামীসহ এই দেশে চলে এসেও নানা ধরনের হয়রানী ও অসহযোগিতার মুখোমুখী হয়েছেন। ভিন্নধর্মের মানুষকে বিয়ে করাটা মেনে নিতে পারেনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার; সেটা ভালোভাবে মেনে নেয়নি পশ্চিমবঙ্গেরও অনেকেই। তাঁকে সরকারি তরফ থেকে কতভাবে যে হয়রান করা হয়েছে, এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কত মানুষও যে তাঁর প্রবল উপস্থিতি ও অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন, সে কথা লিখতে গেলে লেখাটাই বিষিয়ে উঠবে। অনেকটা নজরুল-প্রমীলার মতো ফিরোজা-কমলদাশ জুটিকে সামাজিক ও ধর্মীয় ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমৃত্যু। কিন্তু জীবনে এবং মরণেও জয়ী হয়েছেন প্রমীলা-নজরুল জুটির মতোই ফিরোজা-কমলদাশ জুটি। ফিরোজা বেগম নজরুলের গানের সোনালি পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন এবং ন্যায্যভাবেই লাভ করেছেন সংগীতসম্রাজ্ঞীর আসন। যারা শর্টকাটে মিডিয়াবাজির বদৌলতে আলোচিত হচ্ছেন,সেলিব্রেটি হচ্ছেন, খড়ের আগুনের মতো ক্ষণিকের তারকা বনে যাচ্ছেন, তাদের জন্য নয়, ফিরোজা বেগম তাদের জন্যই মডেল, যারা নিজেকে শ্রম ও সাধনাবলে দিনেদিনে যোগ্য থেকে যোগ্যতর করে তুলতে চান, যারা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে জয়ী হতে চান মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির মতো।

ফিরোজা বেগম তাঁর জীবনাচরণেও অনেকটা নজরুল-অনুসারী ছিলেন । নজরুল ব্যক্তিজীবনে বিয়ে করেছেন ভিন্নধর্মের মানুষকে । অসাম্প্রদায়িকতাই শুধু নয়, চেয়েছেন সবধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সেই বিশ্বাসকে তুলে ধরেছেন নিজ সৃষ্টিতে। তার জন্য সংগ্রামও করেছেন। হাজার বাধা-বিপত্তি-জেল-জুলুম-বই বাজেয়াপ্তি নজরুলকে তাঁর আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফিরোজা বেগম বিয়ে করেছেন ভিন্নধর্মের মানুষ কমল দাশগুপ্তকে । এই বিয়ে হিন্দু-মুসলিম কোনো সম্প্রদায়ের মানুষই ভালোভাবে মেনে নেয়নি–একথাও সত্য। একবার কোলকাতা একবার ঢাকা– এইভাবে কেটেছে ফিরোজা বেগমের জীবন। কত বাধা–সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভেতর থেকে এবং রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে। কিন্তু ফিরোজা বেগম এতটুকু টলেননি তার লক্ষ্য ও সাধনা থেকে। ফলে সাফল্য এসেছে ব্যাপকভাবে এবং অতুলনীয় মর্যাদাসহ।

শিল্পীজীবনে ফিরোজা বেগম একটি অঘোষিত প্রতিষ্ঠানের নাম। সংগীত হচ্ছে সাধনার বিষয়। সেই সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মূর্ত প্রতীক ফিরোজা বেগম। তিনি বছরের পর বছর নজরুলসংগীতের সাধনা করেছেন অক্লান্ত শ্রমে ও গভীর নিবিড় ভালোবাসায়। এসেছে বহু বাঁধা ও বিঘ্ন। তিনি জয় করেছেন সেসব। কেবল তারপরই এসেছে সোনালি সাফল্য। সংগীতের জন্য দরকার বিধাতাপ্রদত্ত সুরেলা কণ্ঠ। প্রিন্সেস ডায়নার যেমন রূপের ঝলক, নায়িকা মধুবালার যেমন সৌন্দর্যের মায়ামাধুরী, মাইকেল জ্যাকসনের যেমন নাচের ক্ষমতা, মেঘনার যেমন প্রাণের জোয়ার–তেমনি ফিরোজা বেগমের কণ্ঠের জোর– এবং এসবই বিধাতাপ্রদত্ত। ফিরোজা বেগম বিধাতা প্রদত্ত সুরের সাম্রাজ্য কণ্ঠে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ফিরোজা বেগম নিজেই একটি সুর-সাম্রাজ্যের নাম। ফিরোজা বেগমের কণ্ঠ মানেই সুরের এক বিস্তারিত ভুবন।

সংগীত হচ্ছে শুদ্ধ সুরেলা উচ্চারণের আর্ট। একজন সংগীতশিল্পীর অন্যতম অপরিহার্য় যোগ্যতা হচ্ছে বিশদ্ধ উচ্চারণ-ক্ষমতা। উচ্চারণ শুদ্ধ না হলে তার পক্ষে গুণী সংগীতশিল্পী হওয়া সম্ভব নয়। ফিরোজা বেগম শুদ্ধ উচ্চারণের মডেল কণ্ঠ। নজরুলের গান বৈচিত্র্যে তুলনাহীন। আধুনিক গান, ক্লাসিক গান, রাগপ্রধান গান, লোকসংগীত, ইসলামী গান, শ্যামাসংগীত, প্রেমসংগীত, রণসংগীত, মার্চের গান, দেশপ্রেমের উদ্দীপনামূলক গান, সাঁওতালী গান, ঝুমুর গান, বেদেদের গান, ভাটিয়ালি গান, হামদ নাত, আরবী-ইরানী-তুর্কি-কিউবান-ইংরেজি সুরের গান,–কত বিচিত্র ধরনের ও আঙ্গিকের গান তিনি রচনা করেছেন! গানের ধরন অনুসারে ব্যবহার করেছেন দেশী-বিদেশী- লোকায়ত- প্রমিত-হালকা- গুরুগম্ভীর শব্দরাজি। ‘আয় বনফুল ডাকিছে মলয়/ এলোমেলো হাওয়ায় নূপুর বাজায়’ যেমন আছে, তেমনই তার পাশে আছে, ‘গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু/নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভূ’’।‘সৃজন-ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ হে মহাকধ্ব’ যেমন আছে, তেমনি আছে ‘বাজলো কি রে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার-পুরে’। নজরুলের গান যথাযথভাবে গাইতে দরকার সবধরনের শব্দ শুদ্ধভাবে এবং সঠিক ব্যঞ্জনায় গাওয়ার ক্ষমতা। খুব কম সংখ্যক শিল্পীরই এই ক্ষমতা থাকে। ফিরোজা বেগম এক্ষেত্রেও অতুলনীয় সক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তিনি গান গাইবার সময় গানের প্রতিটি শব্দকে তার নিজস্ব চরিত্রে শুদ্ধভাবে এবং তাদের সাংকেতিক ও সাংগীতিক অর্থ-ব্যঞ্জনার অনুকূলে উচ্চারণ করেছেন। তাঁর উচ্চারণে কখনোই শ,স, ষ , ন, ণ, র, ড় এবং অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ বর্ণের বিভ্রাট ঘটেনি। তিনি লোকায়ত শব্দকে লোকায়ত ভঙ্গিতেই উচ্চারণ করেছেন, প্রমিত শব্দকে প্রমিত উচ্চারণে উচ্চারণ করেছেন, প্রতিটি আরবি-ফারসি-উর্দু-ইংরেজি এবং অন্যান্য উৎসের শব্দকে তার নিজ ভাষার ধনি-ব্যঞ্জনা অনুসারে উচ্চারণ করেছেন। আমরা উদাহরণস্বরূপ ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে ‘দেশে দেশে গেয়ে বেড়াই তোমারি নামের গান’,–এই গানটি যদি শুনি, দেখতে পাবো তিনি ‘তকদির’, ‘হুকুম’, ‘মশগুল’, ‘আজান’, ‘ফরমান’, ’আসর’, ‘নামাজ’, রোজা’, ‘মিনার’ শব্দগুলোকে তাদের ফারসি-আরবি উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে উচ্চারণ করেছেন। ফলে গানে সেই শব্দের ব্যঞ্জনা ও মাধুর্য দু-ই সমানভাবে ফুটে উঠেছে। অনুরূপভাবে যখন তিনি ‘পদ্মার ঢেউ রে আমার শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা যা রে’ গেয়েছেন, ‘রে’ বর্ণটি এমনভাবে উচ্চারণ করেছেন যে ঐ একটি শব্দাংশের বা ধ্বনির মধ্যে প্রিয়তমের দূরের অবস্থান এবং পেমাস্পদের হৃদয়ের ব্যাকুলতাভরা আকুলতা আকাশবাতাসব্যাপী বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। অনুরূপভাবে ‘লাইলী তোমার এসছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোলো’ গানটির ‘এতদিনে’, ‘মজনু গো’, ‘দোলো’, ‘ও গো বুলবুল’ ‘ফুটন্ত’, ‘ঝুরিয়া ঝুরিয়া’ প্রভতি প্রতিটি শব্দ ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে আনন্দ-বেদনার আকুলতা-ব্যাকুলতা-আবেদন-নিবেদন-দীর্ঘশ্বাস-প্রত্যাশা ভরা চিত্রকল্প/কল্পচিত্র হয়ে উঠেছে এবং শব্দগুলোর সুর-মাধুর্য-বেদনা-হাহাকার- উচ্ছ্বাস-হতাশা ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। যদি আমরা শুধু ‘ফুটন্ত সেই গুল-বাগিচায় দোলো’ চরণটি শুনি,‘ফুটন্ত’ এবং ‘দোলো’ শব্দদুটির উচ্চারণ আমাদের বিহ্বল করে দেয়। আমার জানামতে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জাব্বার চলচ্চিত্রের এবং আধুনিক গানে শব্দকে এভাবে তার অন্তর্নিহিত শক্তির, নাটকীয়তার ও ব্যঞ্জনার পরিস্ফুটন ঘটিয়ে উচ্চারণ করেছেন।

ফিরোজা বেগমের অতুলনীয় কণ্ঠশিল্পী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে, শব্দের ভেতরের শক্তি সম্পর্কে তাঁর পরিস্কার ধারণা এবং গান গাইবার সময় শব্দের সেই শক্তিকে প্রস্ফটিত করে তোলা। বস্তুর ভেতরে গতি ও মহাকর্ষ থাকার মতো শব্দের ভেতরে গতি আছে, নৃত্য আছে, ছন্দ আছে, ধ্বনি আছে,ভর আছে, বল আছে, বেদনা আছে, উচ্ছলতা আছে, ক্রীড়া আছে, মহাকর্ষ আছে, মাধুর্য আছে, ঘ্রাণ আছে, স্বাদ আছে, মেলোডি আছে, সাংকেতিকতা আছে, ব্যঞ্জনা আছে। শব্দের এই শক্তি ও সম্পদ এবং সে অনুসারে শব্দের সঙ্গে শব্দের পার্থক্য ও মিল বিষয়ে যে-আবৃত্তিশিল্পী এবং যে-কণ্ঠশিল্পী যত বেশি সজাগ ও সক্রিয় থাকেন, তার আবৃত্তি ও গায়কী ততো বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফিরোজা বেগম এক্ষেত্রে প্রায় ষোলআনা সফল এক শব্দশিল্পী। নজরুলের গান মানেই বিচিত্র ধরনের ও বিচিত্র মেজাজের গান– বেদনার গান, বিরহের গার, মিলনের গান, আনন্দের গান, বিষাদের গান, সংগ্রামের গান, প্রকৃতি-মুগ্ধতার গান, নৃত্যের গান, বসে বসে গাইবার গান, পালতোলা নাওয়ের গান, নির্মাণ শ্রমিকের ছাদপেটার গান, হাসির গান, পরিহাসের গান, ব্যক্তির গান, সমষ্টির গান–ইত্যাদি। গানের ধরন অনুসারেই শব্দ ব্যবহার করেছেন নজরুল। ফিরোজা বেগম গান গাইবার সময় প্রতিটি শব্দকে তার শক্তি ও সম্পদের বৈশিষ্ট্যে উচ্চারণ করেছেন। তিনি যখন ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়/পল্লী-বালিকা মেঠোপথে যায়, একেলা মেঠোপথে যায়’ গেয়েছেন, তখন ‘চমকে চমকে’ শব্দের মধ্যে যে-ক্রীড়াপরায়ণতা, ‘যায়’ শব্দের মধ্যে যে-গতি, ‘ঝুমুর-ঝুমুর’ শব্দের মধ্যে যে-ধ্বনিব্যঞ্জনা, তা ফুটিয়ে তুলেছেন যুৎসইভাবে। তিনি যখন ‘ও রে নীল যমুনার জল, বল রে আমায় বল্ কোথায় ঘনশ্যাম’–গানটি গেয়েছেন, তখন ‘ও রে’ শব্দটির মধ্যে যে-আকুলতা এবং ‘কোথায়’ শব্দটির মধ্যে যে দূরত্ববাচকতা এবং যে-সন্ধান-তৃষ্ণা রয়েছে, তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন সফলভাবে। তিনি যখন ‘খেলা শেষ হলো, শেষ হয় নাই বেলা’ গেয়েছেন, তখন ‘‘কাঁদিও না, কাঁদিও না’’ শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন এমনভাবে যে তাঁর কন্ঠে কান্না ঝরে পড়েছে। তেমনিভাবে আমার যদি তাঁর কন্ঠে ‘ও রে শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা বনের বিধবা মেয়ে’ গানটি শুনি, তবে বুঝতে পাির, ‘ও রে’ শব্দটি একইসঙ্গে কতটা বেদনা, কতটা ব্যথা, কতটা সহমর্মিতা ধারণ করতে পারে তার এতটুকু পরিসরে; কতটা হাহাকার ধারণ করে ‘নাহি পেয়ে’ শব্দ-দুটির মেলবন্ধন! আবার তিনি যখন গেয়েছেন,‘আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি,অভিশাপ’, তখন ‘অভিশাপ‘ শব্দটিকে এমনভাবে উচ্চারণে করেছেন যে তার ভেতরে-থাকা ভয়াবহতার ইঙ্গিৎ বাঙ্মময় হয়ে উঠেছে। তিনি যখন নজরুলসংগীতের বাইরের অন্য কোনো গীতিকারের গান গেয়েছেন, তখনও একইভাবে শব্দের ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন ‘ভুলি নাই, ভুলি নাই/নয়নে তোমারে হারায়েছি প্রিয়া, স্বপনে তোমারে পাই’- গানটি তাঁর অনন্য উচ্চারণশৈলীতে হৃদয়ছোঁয়া আধুনিক গান হয়ে উঠেছে। ‘ভুলি নাই, ভুলি নাই’ শব্দগুলোর হৃদয়ছোঁয়া উচ্চারণ শ্রোতাকে করুণ আবেগে বিমুগ্ধ করে দেয়। ‘হারায়েছি’ শব্দটির ভেতরে যে-বদনা,যে-হাহাকার’ ফিরোজা বেগমের উচ্চারণ সেই বেদনাকে– সেই হাহাকারকে গভীরভাবে বাঙ্মময় করে তুলেছে। অতঃপর গানের ভেতরের ‘কে যেন আমায় আজো পিছু ডাকে/ বারে বারে তাই ফিরে চাই’, অথবা ‘তার সুরভি যে প্রাণে ছড়ালে/ যে বীণা বাজালে তারি সুরে আজি/গানের মধ্বাটি গেঁথে যাই’ প্রভৃতি চরণসমূহ গাওয়ার সময় তিনি বেদনার এমন অফুরন্ত যাদু-মাদকতা, বিমুগ্ধতার এমন অনিঃশেষ মধু-মাধরী সৃষ্টি করেন যে- গানটি যতবার শোনা যায়, ততবেশি করে শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাঁর দরদভারা সুরেলা উচ্চারণ উন্নীত হয় সুরের নেশায়–বাণীর মায়ায়। এই জাদুময়তা–এই মধুমাধরী-এই মাদকতা– সৃষ্টিতে ফিরোজা বেগমের জুড়ি নেই। একারণেই তিনি সুরসম্রাজ্ঞী বা মেলোডি কুঈন।

ফিরোজা বেগমের এতটা সফল হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল গানের ভেতরে যে-সংলাপ আছে, শব্দের অধিক যে-অর্থব্যঞ্জনা আছে, সেটিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করে উচ্চারণে তাকে বাঙ্মময় করে তোলা। ফিরোজা বেগম সেই নাটকীয়তা, সেই অর্থব্যঞ্জনাকে ধারণ করেছেন তাঁর উচ্চারণে। তিনি ‘‘ওরে শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা বনের বিধবা মেয়ে’’ গানটি গাইবার সময় গানটির প্রত্যক্ষবচন ‘‘দেবতা আমারে লইবে কবে’’ এমনভাবে উচ্চারণ করেছেন যে সেটি শিল্পীর কণ্ঠধ্ব নিতে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রকৃতির বিধবা মেয়ে রজনীগন্ধার প্রত্যক্ষ অসহায়-ঊক্তি হয়ে উঠেছে। তিনি যখন ‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে আসলে প্রাতে পুষ্পচোর’ গানটি গেয়েছেন, তখন গানের ভেতের থাকা “গোল করো না গুল-ডাকাত’’, ‘‘বউ গো জাগো, আর ঘুমায়ো না রাত্রি ভোর’’, ইত্যাদি ডায়লগধর্মী উচ্চারণগুলো সুরমাধুর্য অক্ষুণ্ন রেখে ডায়লগের মতো করেই উচ্চারণ করেছেন। ‘জাগো’ শব্দটির মধ্যে যে-আহবান, যে-সতর্কতাজনিত সংকেত, যে-আবেদন, ফিরোজা বেগমের উচ্চারণে তার সমস্ত ব্যঞ্জনাই মূর্ত হয়ে উঠেছে । আবার যখন ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায় কে যেন আমারে ডাকে’ গেয়েছেন, তখন সেই গানের ভেতের ‘সে কী তুমি?’-‘এই শব্দগুলো কয়েকবার করে গেয়েছেন–‘সে কী তুমি? সে কী তুমি? সে কী তুমি?’ এবং প্রতিবাই ভিন্ন এবং বাড়তি ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। তিনি গানের মর্মবাণীর ভেতের প্রবেশ করেছেন, প্রতিটি শব্দের এবং প্রতিটি চরণের নিজস্ব অর্থব্যঞ্জনা এবং তাদের সম্মিলিত ব্যঞ্জনার বিষয়টি ফুটিয়ে তুলে গানের বাণীর উচ্চারণকে গানের আকর্ষণ বৃদ্ধিকরণে সার্থকভাবে কাজে লাগিয়েছেন । তিনি যখন গেয়েছেন ‘ প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথায়’–এই গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য এমনভাবে উচ্চারণ করেছেন যে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনা-প্রত্যাশী একজন নারীর মনোদৈহিক কামনা-বাসনা এবং মিলন-সম্ভাবনার দেধ্বাচল ভরা সুখদ আকুলতা শব্দার্থের অধিক ব্যঞ্জনাসহ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। মনে হয় তিনি শুধু বাণীবদ্ধ গানটি গাননি, যে-আনন্দানুভূতি, যে-ব্যাকুলতা, যে-সম্ভাবনা শব্দনির্ভর ভাষা ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেনি, তিনি সেসবও পূর্ণরূপে বাঙ্ময় করে তুলেছেন সুরের কারুকাজ আর উচ্চারণের উচ্চারণ-অতিরিক্ত সাংকেতিকতায় ঠিক যেভাবে চিত্রশিল্পে রঙের কাজ ফটিয়ে তোলে রেখা ও ছবির অতিরিক্ত ছবি। অর্থাৎ তিনি শব্দগুলো গেয়েছেন, সরটুকু গেয়েছেন, একইসঙ্গে গেয়েছেন–অর্থের ব্যঞ্জনা, শব্দের সংকেতময়তা এবং সুরের মাধুরীখানিও।

পদর্থিবিজ্ঞানে একটি কথা আছে, ‘ভারকেন্দ্র’। কোনো বস্তুর যে-বিন্দুতে মহাকর্ষ-অভিকর্ষজনিত মোট ওজন ক্রিয়া করে বা সবচেয়ে বেশি বলপ্রযোগজনিত ত্বরণ সৃষ্টি করে, তাকে ঐ বস্তুর ভারকেন্দ্র বা সেন্টার অব গ্রাভিটি (Centre of Gravity) বলা হয়। ফিরোজা বেগম গান গাইবার সময় কিছু কিছু শব্দকে তাঁরের সুরের ও মাদকতা সৃষ্টির ভারকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি ‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই’ গানটি গেয়েছেন অতুলনীয় আবেগের দান ও সুরের মাধুরী মিশিয়ে। ‘তুমি আসিবে বলে সুদূর অতিথি/ জাগি চাঁদের তৃষ্ণা লয়ে কৃষ্ণা তিথি/কভু ঘরে আসি, কভু বাহিরে যাই’-এই অংশটুকু গাওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠে মিলন-আকাঙ্ক্ষার মধুর দোলাচল বোধগম্য মাত্রায় এবং উপভোগ্যরূপে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ‘কভু ঘরে আসি কভু বাহিরে যাই’-এই অংশটির যখন পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং ‘আসি’ শব্দটিকে একটু লম্বা করে উচ্চারণ করেছেন, তখন তার মধুর ব্যঞ্জনা শারীরিক স্পর্শের ও শিহরনের অনুভূতিকে জীবন্ত করে তুলেছে। ’আসি’ শব্দটি সুরমাধুরীর ভারকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার যখন ‘মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজায়’–অংশটি গেয়েছেন, তখন তাঁর কণ্ঠে একজন নারীর নিজেকে পরিপূর্ণ মিলনের জন্য শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলার ছবিটি ইন্দ্রিয়ঘন আবেগ ও রিরংসার ব্যঞ্জনাসহ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। তাঁর গাওয়া ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ গানটি সম্পর্কেও একই ব্যাখ্যা প্রয়োজ্য। আবার তিনি যখন ‘বঁধু মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়’ গেয়েছেন, ভালোবাসাবাসির মধুরতা এবং ভালোবেসে সবটুকু সাধ না-মেটার আকুলতা এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে ভালোবাসাবাসির জন্য পুনর্জন্মলাভের বাসনাটি শ্রোতার হৃদয়ে-মনে-বিচারবোধে গ্রহণযোগী আবেদন সৃষ্টি করেছে সফলভাবে। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত “তাই আবার বাসিতে ভালো আসিবো, আসিবো ধরায়’’ কথাগুলো বিশেষ করে ‘আবার’ শব্দটি এমন আবেদন সৃষ্টি করে যে ভালোবাসার প্রয়োজনে ‘আবার’ জন্মলাভের প্রয়োজনটাই অপরিহার্য হয়ে উঠতে চায়। এইখানে ‘ভালোবাসিয়া’ এবং ‘আবার’ শব্দদুটি সুরের ও আবেদনের ভারকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে তাঁর গাওয়া ‘বনের তাপস কুমারী আমি গো সখি মোর বনলতা’ গানটিতে বেশকটি শব্দে –‘আমি গো’, ‘কথা’, ‘বনদেবতা’, ‘ছেড়ে দে’ সুর ও আবেদনের আকর্ষণবিন্দু সৃষ্টি হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে– “আমার পরাণে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো তোমার চরণ-মঞ্জিরে”। গানের শব্দের ভেতরে ও আড়ালে গানের যে-প্রাণ,– সেটিও কণ্ঠে ধারণ করতে হয় শিল্পীকে। সেজন্য শুধু গানগুলো বিচ্ছিন্নভাবে জানলেই হয় না, গানের রচয়িতা এবং তাঁর প্রধান প্রধান সৃষ্টি সম্পর্কেও পরিস্কার ধারণা থাকার প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ওয়াকিফহাল না থেকে কেউ যদি শুধু কন্ঠের জোরে তাঁর গানগুলো গান, তবে তিনি অংশত অকৃতকার্য হতে বাধ্য। তার কন্ঠে ‘আমি হৃদয়ে যে পথ কেটেছি, সেথাই চরণ পড়ে তেমার সেথায় চরণ পড়ে’ গানের মর্মবাণীর ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না । নজরুলকে এবং তাঁর সাহিত্য ভালোভাবে না জেনে যারা নজরুলসংগীত গাইতে যান, তাদের সাফল্যও আংশিক হতে বাধ্য। ফিরোজা বেগমের এতটা সাফল্য লাভের অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি সমগ্র নজরুলকে ধারণ করেছিলেন ধ্যানে, জ্ঞানে, ভাবনায় ও ভালোবাসায়। ফিরোজা বেগমের প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারে নজরুল- জীবনদর্শন ও নজরুল-সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর পরিস্কার জ্ঞান থাকার এবং সেসবের সাথে একাত্ম হওয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে ফুটে উঠতো। তিনি সমগ্র নজরুলকে অন্তরে ও বিশ্বাসে ধারণ করেছিলেন। তাঁর নিজের ব্যক্তিজীবনও নজরুলের ব্যক্তিজীবনের মতো আনন্দে-বেদনায়-বিতর্কে পরিপূর্ণ ছিল। একারণে নজরুলের গানে সম্পূর্ণরূপে আত্মলীন হওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হয়ে গিয়েছিল। আপন রক্তাক্ত হৃদয়ের ক্ষরণ-উৎসারিত প্রেম, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির ভাবনা, গভীর দেশপ্রেম, গরীব খেটে খাওয়া এবং কথিত নিম্নশ্রেণির মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, নারীমুক্তির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান, সমাজের গঞ্জনা, শাসকশ্রেণী প্রদত্ত যন্ত্রণা এবং প্রাতিস্বিক সৌন্দর্য চেতনা—নজরুলের এসমস্ত অভিজ্ঞতা ও বিষয় সম্পর্কে ফিরোজা বেগমের জ্ঞান ও উপলব্ধি ছিল গভীর। তিনি নিজে সে-সমস্ত ভাবনার অংশীদার এবং সে-ধরণের যন্ত্রণার ভাগীদার ছিলেন। সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নজরুল ও নজরুল সৃষ্টির প্রতি তাঁর অতুলনীয় দরদ ও ভালোবাসা। একারণেই কি বেদনার গান, কি আনন্দের গান, কি শান্তির গান, কি সংগ্রামের গান, কি ব্যক্তি-উপলব্ধির গান, কি সকলের সাধারণ স্বার্থের গান, কি দেশপ্রেমের গান, কি নারীজাগরণের গান–ফিরোজা বেগম গানটির মর্মবাণী বুঝতে পারতেন সম্যকভাবে এবং সেভাবেই নিজকণ্ঠে গানটিকে প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন অতুলনীয় সার্থকতায়। অর্থাৎ গানের ভেতরের যে-মর্মবাণী এবং আনন্দের-বেদনার-সংগ্রামের-হতাশার-বিমুগ্ধতার যে-ব্যঞ্জনা,– সবকছিুকেই যথোপযুক্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কথায় ও সুরের আবৃত্তিতে। সেকারণেই ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে ‘আমি চাঁদ নহি, অভিশাপ’, ‘বধুঁ, আমি ছিনু বুঝি বৃন্দাবনের রাধিকার আঁখিজলে’, ‘খেলা শেষ হলো, শেষ হয় নাই বেলা’, ‘যত ফুল তত ভুল কন্টক জাগে’–জাতীয় গানগুলি এমন অভূতপূর্ব সুর ও বাণীর নান্দনিক মালা হয়ে উঠেছে। একইকথা প্রযোজ্য তাঁর গাওয়া ‘নুরজাহান, নুরজাহান, সিন্ধুনদীতে ভেসে এলে মেঘরামতির দেশে’, ‘চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা চাঁদের চেয়েও দামী’, ‘আমি ফুরব দেশের পুরনারী’-গানগুলো সম্পর্কেও। নারীর শক্তি ও স্বাধীনতা, নারীর সম্মান ও মর্যাদা, নারীর পরাধীনতা ও গ্লানি বিষয়ে নজরুলের মতোই ফিরোজা বেগমের সহমর্মী সক্রিয় মনোভাব ছিল। সেজন্যই তিনি এ গানগুলো নজরুলীয় ব্যঞ্জনায় ধারণ করতে পরেছেন কণ্ঠে অনুপম উচ্চারণশৈলী ও সুরের সৌকর্যে। গানগুলো গাওয়ার সময় ফিরোজা বেগমের কণ্ঠ রণক্ষেত্রের গায়কের মতো ধারণ করেছে অফুরন্ত শক্তি, সাহস, উচ্ছাস ও উচ্ছ্লতা।

নজরুলের গান মানে রক্তাক্ত হৃদয়ের গান। নজরুলের গান মানেই অশ্রুভেজা অনুভূতির গান। ফিরোজা বেগম নজরুলের গানের বেদনার সাথে নিজেকে আত্মলীন করে ফেলেছেন। কারণ, তাঁর নিজের বেদনা ছিল অনেক, তদুপরি নজরুলের গানের বেদনা এবং ব্যক্তি-নজরুলের বাক্হারা জীবনের বেদনা তাঁকে নজরুলের গানের প্রতি বেশি মাত্রায় সহমর্মী করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে,‘মিলবে না কি তার বেদনা মোর বেদনাতে/ গঙ্গাধারা মিশবে না কি কালো যমুনাতে গো’। গায়িকা ফিরোজা বেগম আর গীতিকার নজরুল এই গঙ্গা-যমুনার মতো মিশে গিয়েছিলেন ভাবনায় ও বেদনার উপলব্ধিতে। দুটোর মিলন ফলে উঠেছে সমুদ্রগামী মেঘনার মতো নতুন সৃষ্টিতে। ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুলসংগীত হয়ে উঠেছে ফিরোজা বেগমের গান। বিশেষ করে নজরুলের কাব্যগীতিগুলো এমন অনন্যতায় ও অতুলনীয় সাফল্যে গেয়েছেন ফিরোজা বেগম যে সেসব গান আর কারও কণ্ঠে সেভাবে পুরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে না। ফিরোজার গাওয়া ‘আমি চাঁদ নহি, অভিশাপ’, ‘বঁধু, আমি ছিনু বঝি বৃন্দাবনের রাধিকার আঁখিজলে’, ‘খেলা শেষ হলো শেষ হয় নাই বেলা’, ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়’, ‘ভেসে আসে সুদূর স্মৃতির সুরভি হায় সন্ধ্যায়’, ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো’, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায় কে যেন আমারে ডাকে’, ‘বঁধু মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়’, ‘পদ্মার ঢেউ রে’, ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’ প্রভৃতি গানে নজরুলের হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ, তা যথাযথ বেদনায় ও ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে যা আর কোনো শিল্পীর কণ্ঠে এই মাত্রায় ফুটে ওঠেনি। শব্দ যা প্রকাশ করেছে এবং যা করতে পারেনি অথচ নজরুল বলতে চেয়েছেন, তার সবই ধারণ করছে ফিরোজা বেগমের অশ্রুভেজা প্রবল কণ্ঠ। এভাবে গীতিকার ও শিল্পীর যৌথ ব্যথার দান হচ্ছে ফিরোজার গাওয়া গান । ফলে সেসব গান হয়ে উঠেছে অতুলনীয়ভাবে সুন্দর ও সফল সৃষ্টি। উদাহরণস্বরূপ তাঁর গাওয়া ‘আমি চাঁদ নহি অভিশাপ‘ গানটির কথা বলা যায়। গানটি মূলতঃ কয়েকটি চিত্রকল্পের সমন্বয়ে রচিত। এই গানটি বেদনার, বিক্ষুব্ধ বেদনার, এবং একইসঙ্গে মধুর বেদনার ও অসহায় বেদনারও। চাঁদ তার কলংক নিয়ে কষ্ট পেলেও সেই কলংকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আনন্দের স্মৃতি, চুম্বিত হওয়ার শিহরণ। সেদিনের ভালোবাসার চুম্বন আজকের কালোদাগ। ফলে জীবন তাঁর কাছে একইসঙ্গে বেদনার ও আনন্দের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান। অ-সাধারণ বা ব্যতিক্রধর্মী মানুষের পার্থিব জীবনও তাই। নজরুল-প্রমীলার জীবন ছিল অনুরূপ। ফিরোজা-কমলদাশ জুটির জীবনই তেমনই ছিল। ফিরোজা বেগম গানটি গাওয়ার সময় এই নৈসর্গিক জীবনের আনন্দ-বেদনার টানাপোড়েন এবং সেই জীবনের প্রতি মানুষের দুর্বার আকর্ষণ–এসব বিষয়কে চমৎকারভাবে, বলা চলে জীবন্ত ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে ‘কলংক হয়ে বুকে দোলে মোর তোমার রূপের ছায়া/ এত জোছনায় ঢাকিতে পারি না তোমার মধুর মায়া’–এই চরণদুটি তিনি এতটা দরদ, এতটা আনন্দ-বেদনার পরশ দিয়ে উচ্চারণ করেছেন যে– রূপ ও কলংক, প্রেম ও বিচ্ছেদ, সুখ ও দুঃখ প্রভৃতি মানবীয় কামনা-বাসনার নিবিড় রঙে একাকার হয়ে উঠেছে। মনে হয় এই তো জীবন! এই তো চাওয়া নর-নারীর! এরই নাম ব্যথার দান। অনুরূপভাবে তিনি তাঁর অন্তরের দরদ আর ব্যথার দানে মর্মস্পশীভাবে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন ’বধুঁ, মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়’, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’, ‘মুসাফির মোছ রে আাঁখিজল ফিরে চল্ আপনারে নিয়া’, ‘ও রে শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা বনের বিধাব মেয়ে’ প্রভৃতি বিরহ-বিচ্ছেদকেন্দ্রিক সঙ্গীতগুলো। আর শুধু নজুরুলের গানই নয়, অন্য আর যেসব গীতিকারের গান তিনি গেয়েছেন, একইভাবে সেসব গানকেও ফুটিয়ে তুলেছেন বাণীর মর্মার্থ আর সুরের মাধুর্যের পূর্ণ প্রকাশ ঘটিয়ে।

ফিরোজা বেগম আরেকটি ক্ষেত্রেও অসামান্য কৃতিত্বের দাবিদার। তিনি নজরুলের গানকে শুদ্ধ বাণীতে গেয়েছেন। নজরুলের বাকশক্তিহীন হয়ে পড়ার পরপরই তাঁর গানের বাণী বিকৃতিকরণ এবং তাঁর গান চুরি করে অন্যের নামে প্রচারের অপকর্ম প্রবল হয়ে ওঠে। ‘কথার কুসমে গাঁথা গানের মালিকা কার/ভেসে এসে হতে চায় গো আমার গলার হার’–এর মতো নজরুলের অনেক আধুনিক গান প্রণব রায় এবং অন্যান্য গীতিকারের নামে রেকর্ড ও প্রচার হয়। অনুরূপভাবে তাঁর গানের বাণীর বিকৃতিসাধন ভয়ংকর আকার ধারণ করে। অনেকটা অপ্রতিরোধ্য রোগের মতো বিকৃতিকরণের ধারা এখনও অব্যাহত আছে। এমনকি আজও বাংলাদেশের স্বনামধন্য কিছু নজরুলসংগীত শিল্পীও দুঃখজনকভাবে এধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়ে যাচ্ছেন। ‘নয়নভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল’, ‘আমার নয়নে নয়ন রাখি পান করিতে চাও কোন্ অমিয়’, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায় কে যেন আমারে ডাকে’, ‘জনম জনম গেল আশা পথ চাহি’, ‘তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম’ প্রভৃতি গভীর কাব্যসমৃদ্ধ এবং দারুণভাবে জনপ্রিয় গানের বাণীরও বিকৃতি সাধন করা হচ্ছে। যেসব শিল্পী এই পর্যায়ে এসেও নজরুলের গানের বাণী বিকৃত করার মানসিকতা পোষণ করেন, তাঁরা নজরুলের এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল কি না সে প্রশ্ন ওঠা অবান্তর নয়। কিন্তু এই অপকর্মটি ফিরোজা বেগম কখনো করেননি। ‘কথার কুসমে গাঁথা গানের মালিকা কার/ভেসে এসে হতে চায় গো আমার গলার হার’—গানটি যে নজরুলের , সেটা তিনিই প্রথম প্রমাণসহ দাবি করেছেন যদিও তাঁর স্বামী ও শিক্ষক কমল দাশগুপ্ত গানটির সুরকার হিসেবে সেটি গীতিকার প্রণব রায়ের লেখা বলে রেকর্ড ও প্রচারিত হওয়ার মতো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়। উল্লেখ্য, প্রণব রায়কে গীতিকার দেখিয়ে গানটি বেচুদত্তকে দিয়ে গাওয়ানো ও রেকর্ড করানো হয়েছিল বাণীর বিকৃতিসহ। কিন্তু ফিরোজা বেগম গেয়েছেন অবিকৃত লিরিকে। নজরুল ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি ফিরোজা বেগমের একনিষ্ঠ অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তাঁকে সে-গানের শিল্পী ও কর্মী হিসেবে অতুলনীয় হয়ে ওঠায় সহায়তা করেছে।

ফিরোজা বেগমের আরেকটি দান হচ্ছে গানে প্রয়োজনীয় আবেগ ঢেলে প্রাণ সৃষ্টি করা। তিনি গান গাইবার সময় বিধাতা প্রদত্ত কণ্ঠসুধা, প্রশিক্ষণলব্ধ কৌশল প্রয়োগ করতেন যেটি অন্যসব শিল্পীরাও করে থাকেন। কিন্তু সে-সবের সাথে তিনি আরেকটি জিনিস মিশিয়ে দিতেন গানের কথায়, সুরে ও ব্যঞ্জনায়– তা হচ্ছে নিজের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার দরদ ও আবেগ। ফলে তাঁর কণ্ঠের গান সুর ও বাণীর মহামিলন এবং তার সাথে বাড়তি যোগ আবেগ। তাঁর কণ্ঠের গান শোনা মানে হচ্ছে– আবেগ-অনুভূতির ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত কোনোকিছুর অশরীরী স্পর্শ লাভ করা। ফিরোজা বেগম বুকভরা ভালোবাসা, মনভরা সংবেদনশীলতা ও হৃদয়ভরা বেদনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিটি সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর কণ্ঠে ও কথায় আবেগ উপচে পড়তো। তিনি গান গাওয়ার সময় এই আবেগনিবিড় সংবেদনশীলতা ও আনন্দ-বেদনাকে গানের ভেতর জুড়ে দিতে পারতেন এবং দিয়েছেন। দরদভরা সাধিত কণ্ঠ, শুদ্ধ উচ্চারণ ও প্রমিত সুরের সঙ্গে এই আবেগ যুক্ত হয়ে তাঁর গাওয়া গানগুলোকে করে তুলেছে প্রাণপ্রাচুর্যময় সংবেদনশীল সত্তা। এই প্রাণ সৃষ্টির কাজটি অধিকাংশ শিল্পী করতে পারেন না। অনেক শিল্পী আছেন যাদের কণ্ঠ সুরেলা, উচ্চারণ শুদ্ধ, অনুশীলন পর্যাপ্ত এবং সুরের ওপর দখলও সন্তোষজনক এবং যথাযথ কথায় ও সুরে গাওয়া সত্ত্বেও শুধু আবেগের দানের অভাবে তাদের পরিবেশনজনিত সৃষ্টি অনেকাংশে নিষ্প্রাণ ব্যকরণসর্বস্ব কণ্ঠকর্মে পর্যবসিত হয়ে যায়। তাদের গান পূজোর মনোহর প্রতিমার মতো,–সর্বাঙ্গসুন্দর, নেই শুধু প্রাণ। ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে গান হয়ে উঠেছে প্রাণময় সত্তা। প্রাণ সৃষ্টি করাটাই একজন কণ্ঠশিল্পীর সর্বোচ্চ দায়িত্ব এবং সাফল্য। এই পয়েন্টেও ফিরোজা বেগম অন্যদের নিকট একটি প্রতিষ্ঠানের মতো। তাঁর গায়কী থেকে এই জিনিসটা শিখে নেয়ার চেষ্টা করা যায়। আমরা যদি তাঁর ‘তুমি শুনিতে চেও না আমার মনের কথা’ গানটি শুনি, বুঝতে পারি–গানে প্রাণ সৃষ্টি করা কাকে বলে। তিনি ‘তুমি শুনিতে চেও না আমার মনের কথা’ চরণটি যখন রিপিট করেন, তখন শব্দগুলোর ভেতরে আবেগ ঢেলে দেন এতটা নিখুঁতভাবে যে তা আমাদের শ্রবণকে বশ করে হদয়ের অন্তঃস্থল ছুঁয়ে ফেলে। একই কথা প্রযোজ্য তাঁর গাওয়া ‘বধুঁ মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়’ , ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’ গানগুলো সম্পর্কেও। তাঁর কণ্ঠে যখন ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ শুনি, ‘শিয়রে বসে চুপিচুপি চুমিলে নয়ন’, ‘হায় নিলে না সে ফুল’- প্রভৃতি চরণের পুনরাবৃত্তি এত আবেগ ধারণ করেছে যে- শোনামাত্র আমাদের অনুভূতি ও অনুভব- উত্তেজনায় আর আনন্দে টনটনে হয়ে ওঠে। অনুরূপভাবে তাঁর গাওয়া ‘মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে নেচে যায়’ গানটির ‘দুলে দুলে দোলে সুদূর’ , ‘মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে’–চরণগুলির গতিময় ছন্দ-নৃত্য আমাদের কানে উচ্ছল ঝর্ণার ধ্বনিব্যঞ্জনা ও নৃত্যচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। গানের প্রাণ কি ? বিরহের গানের প্রাণ বেদনার ব্যঞ্জনা, মিলনের গানের প্রাণ আনন্দের গভীর অভিব্যক্তি, নৃত্যের গানের প্রাণ ছন্দময় গতি, অভিমানের গানের প্রাণ আবেদন-কাম-অভিযোগের আকুলতা, শারীরিক মিলন-বাসনার গানের প্রাণ মনোদৈহিক রিরংসময়তার নিবিড় প্রকাশ এবং ধর্মীয় গানের প্রাণ নিবিড় ভক্তিভাবের জীবন্ত ব্যঞ্জনা। ফিরোজা বেগম এই বেদনার বিহ্বলতা, আনন্দের অভিব্যক্তি, ছন্দময় গতি চাঞ্চল্য, আবেদন-কাম অভিযোগের আকুলতা, রিরংসাময়তা, ভক্তি—সবই তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেন প্রমিত পরিমাণে এবং গানের প্রকৃতি অনুসারে। ফলে তাঁর কণ্ঠে সবধরনের গানই লাভ করেছে অফুরন্ত প্রাণ, হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত চিন্ময়-মৃন্ময় সত্তার যৌথতা।

ফিরোজা বেগমের সবচেয়ে বড়সম্পদ ছিল বিধাতা প্রদত্ত একটি অতুলনীয়ভাবে উন্নত কণ্ঠ। নারীর কণ্ঠ যতখানি ভরাট ও ওজনদার হওয়া সম্ভব ও সংগত, ফিরোজা বেগমের কণ্ঠ ছিল ততেখানি ভরাট ও ওজনদার। তার সাথে তাঁর কণ্ঠ ছিল প্রবল ও গতিশীল। একইসাথে তা ছিল অত্যন্ত মিষ্টি ও মাধুর্যময়। তিনি সুসাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি যতদিন গেয়েছেন, কোনো রোগবালাই তাঁর কণ্ঠকে কাবু করতে পারেনি। তাঁর কোনো শ্বাসকষ্ট ছিল না; উচ্চারণে আড়ষ্ঠতা ছিল না; তিনি ইচ্ছামতো এবং গানের প্রয়োজন মাফিক কণ্ঠকে উচ্চগ্রামে ওঠাতে এবং নিম্নস্কেলে নামাতে পারতেন। তাঁর কণ্ঠ এতটাই প্রবল, গভীর, গতিশীল, নমনীয় ও সুরেলা ছিল যে তিনি কণ্ঠকে কখনো মাধবকুণ্ডের বর্ষার ঝর্ণাধারায়, কখনো আশ্বিনের শান্তস্রোতা যমুনায়, কখনো-বা জোয়ারের মেঘনায় রূপান্তরিত করতে পারতেন। কখনো তা পূর্ণিমারাতের জোয়ারে প্লাবিত কল-কল্লোলিত সুন্দরবন হয়ে উঠতো, কখনো হয়ে যেতো জোছনার উত্তাল সমুদ্র। কোনো অবস্থাতেই তাঁর দম ফরাতো না; কোনো অবস্থাতেই তাঁর কন্ঠের মাধুর্য শুকিয়ে আসতো না। বাতাসের গুঞ্জরণ, শিশুর চঞ্চলতা, হরিণীর চপলতা, পাতার মর্মর, ঝর্ণার উচ্ছ্বলতা, সমুদ্রের গভীরতা, জোয়ারের প্রবলতা, বেহালার কান্না, বাঁশের বাঁশির মাধুর্য, হারমোনিয়ামের সুরেলা স্রোত, নৃত্যের ছন্দ, তবলার তাল–তাঁর কণ্ঠে সুসমবেত হয়েছিল অসম্ভবপ্রায় অনন্যতায়। বৈচিত্র্যে, পরিমাণে ও গভীরতায় তাঁর কণ্ঠসম্পদ অফুরন্ত- অতল ছিল বলেই তিনি সত্যিকার অর্থেই মেলোডি কুঈন ছিলেন। ফলে শুধু নজরুলে গানই নয়, আধুনিক গান, গজল, দেশের গান, অন্যান্য ভাষার গান— তিনি যা-ই গেয়েছেন, হয়ে উঠেছে অনন্যসুন্দর সৃষ্টি। তাঁর কন্ঠে নজরুলের ‘মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম’ গানটি হয়ে উঠেছে মেলোডি-রিভার বা সুরের যমুনা; তাঁর কণ্ঠে ‘বঁধু আমি ছিনু বুঝি বৃন্দাবনের রাধিকার আঁখিজলে’, ‘মুসাফির মোছ রে আঁখিজল ফিরে চল আপনারে নিয়া’ গানগুলো হয়ে গেছে হৃদয়ের তলদেশ ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া অশ্রুর নদী ; তাঁর কণ্ঠে ‘মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে নেচে যায়’, ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়’ গানগুলো হয়ে উঠেছে শব্দ ও সুরের জীবন্ত নৃত্যমঞ্চ; তাঁরকন্ঠে ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর’ গানটি পরিণত হয়েছে মধুর আনন্দের ঝর্ণাধারায়; তাঁর কণ্ঠে ‘ভেসে আসে সুদূর স্মুতির সুরভি হায় সন্ধ্যায়’ হয়ে উঠেছে নিরালায় বসে সুরে সুরে কেঁদে যাওয়ার নিঃসঙ্গ বেহালা; আবার তাঁরই কণ্ঠে ‘নুরজাহান- নুরজাহান– সিন্ধুনদীতে ভেসে, এলে মেঘলামতির দেশে’, ‘চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা চাঁদের চেয়েও দামী’, ‘আমি পূরব দেশের পুরনারী’, ‘আমি নহি বিদেশিনী’, ‘মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল’ গানগুলো মাধুর্য ও শক্তিমণ্ডিত শব্দ ও সুরের সম্মিলিত মধুর জোয়ারের রূপ ধারণ করেছে। আর যদি তাঁর কণ্ঠেই শুনি ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো’, মনে হয় পৃথিবীর সকল আনন্দ ও বেদনা, অশ্রু ও হাসি, তৃপ্তি ও হাহাকার, শক্তি ও অসহায়ত্ব, প্রাণচাঞ্চল্য ও মৃত্যু, আশীর্বাদ ও অভিশাপ, মমতা ও নিষ্ঠুরতা–একটিমাত্র গানে ধারণ করতে চেয়েছেন নজরুল আর নজরুলের সেই স্বপ্নকে হাসি ও কান্না মাখা কণ্ঠের শব্দ-সুরের তুলিতে প্রাণপ্রতিমা করে তুলেছেন সংগীত সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম। আবার বেদনার ভাষা ও সুর কতটা মধুময় হয়ে উঠতে পারে তা উজ্জ্বল উদাহরণ ফিরোজা বেগমের কণ্ঠেমোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘‘ভুলি নাই, ভুলি নাই’’ গানটি। ফিরোজার কণ্ঠমাধুর্য ও আবেগের দানে তার কণ্ঠে এই গানের কথাগুলো বেদনার সুধাসমুদ্র হয়ে উঠেছে। শুনে তৃপ্ত হয় কান, মাতাল হয় হৃদয়। মনে হয় কবি পি. বি. শেলীর সেই বিখ্যাত উক্তি “Our sweetest songs are those that tell of the saddest thoughts’’. আমাদের মধ্যে সেই গানগুলো মধুরতম যা অতি দুঃখজনক ঘটনাসমূহ ব্যক্ত করে।

ফিরোজা বেগম প্রমিত সুরের শিল্পী। বাণীর সর্বোচ্চ প্রকাশ যতখানি সুরলীলা দাবি করে, তিনি ততখানি সুরে গাইতেন। তাঁর গায়কীতে সুরের অনটন ছিল না কখনোই। আবার তিনি ওস্তাদী আতিশয্যকেও এড়িয়ে চলেছেন। এমন শিল্পী আছেন যারা নজরুলের একটি গান এমনকি কাব্যগীতিও গাইতে গিয়ে বেশি বেশি লোভী হয়ে ওঠেন। এক ধরনের বাহাদুরী বা অনন্যতা দেখানোর লোভ পেয়ে বসে তাদের। গানের সুর নিয়ে এত বেশি কণ্ঠ-কসরৎ করেন যে গানের আসল মাধুর্যটাই নষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় তারা যেন সুরের সঙ্গে কুস্তি-লড়াই করেন। আবার কিছু শিল্পী আছেন যারা নজরুলের একটি ক্লাসিকাল ধাঁচের নিয়ন্ত্রিত সুরের গানকেও লোকগীতি বানিয়ে ফেলেন। ফিরোজা বেগম এই উভয়বিধ অযোগ্যতাকেই অতিক্রম এবং জয় করতে পেরেছিলেন। তিনি বিধাতাপ্রদত্ত একটি উন্নত কণ্ঠের অধিকারী হয়ে সেই কণ্ঠকে পুরোপুরি প্রস্তুত করেছেন অনুশীলন ও শিক্ষণের মাধ্যমে; অতঃপর এক ধরনের সহজ সাবলীলতায় ও মধুর প্রবলতায় পরিবেশন করেছেন শিক্ষালব্ধ গান। ফলে তাঁর গান প্রমিত সুরের গান হয়ে উঠেছে; কিন্তু স্বরলিপির খোয়াড়ে ঘুরপাক খেয়ে মরেনি। তাঁর গান সুরের ব্যাকরণ মেনে নিয়েই সুরের পাখায় ভর করে পাড়ি দিয়েছে মুক্তির আকাশে। এ যেন সমুদ্রজোয়ার—সমুদ্রকেই চূড়ান্ত ঠিকানা জেনে ও মেনে স্রোত ও ঢেউয়ের উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে-বেদনায়-ব্যাকুলতায় উপচে পড়েছে সৈকতে-উপকূলে-নদীতে-তীরভূমিতে এবং তার স্রোতেলা অনুরণন ছুঁয়ে ফেলেছে উর্ধ্বাকাশের সীমানা। এমনটি খুব কম কণ্ঠশিল্পীই করতে পারেন।

ফিরোজা বেগম উদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী। বিস্ময়কর ব্যাপার এইযে ফিরোজা বেগম প্রমিত সুরের শিল্পী হয়েও একইসঙ্গে উদাত্তকণ্ঠের শিল্পী। তাঁর কণ্ঠ সুরেলা, প্রবল, গভীর এবং খেলা। তিনি সুরের বাঁধন কণ্ঠে নিয়েই গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন। আমাদের দেশের সংগীতের আদি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে–আমাদের গান মানেই খেলা গলার গান। ঘাটে-মাঠে-নদীতে-বাথরুমে-যাত্রাপালায় সর্বত্র এদেশের মানুষ গলা ছেড়ে গান গাইতে ভালোবাসে। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, আলকাপ, যাত্রাপালা–সবই মূলতঃ খেলা গলার গান। ফিরোজা বেগমও খোলা গলার গানের শিল্পী। তিনি গান গেয়েছেন জোয়ারের প্রবাহের মতো গলা খুলে দিয়ে। কিন্তু কণ্ঠের পর্যাপ্ত অনুশীলন ও সুরের ওপর সবখানি দখল থাকায় তাঁর খোলা গলার গানও প্রমিত সুরেরগান হয়ে উঠেছে। এটি তাঁর গানের ও গায়কীর একইসঙ্গে সফল ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম প্রধান কারণ।

নজরুলের কথা, ফিরোজার কণ্ঠ–এ দুয়ের সাথে যোগ ঘটেছিল আরেকটি নান্দনিক শক্তির। সেটা হচ্ছে কমল দাশগুপ্তের সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং সংগীত পরিচালনা । কমল দাশগুপ্ত অতুলনীয় সুরকার ছিলেন। ফিরোজার গাওয়া নজরুলের বেশকিছু গানের অংশের সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। তাছড়া তিনি ছিলেন সুদক্ষ সংগীত পরিচালক এবং ফিরোজার সংগীতশিক্ষকও বটে। কাজী নজরুল ইসলাম+ফিরোজা বেগম + কমল দাশগুপ্ত = অতুলনীয় সংগীত। ফিরোজা বেগমের ফিরোজা বেগম হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কমল দাশগুপ্তের অবদানকে কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না।

ফিরোজা বেগমের সম্পর্কে একটি মৃদু অনুযোগ শোনা যায় যে তিনি তাঁর গানের কোনো শিষ্য বা উত্তরাধিকার তৈরী করতে পারেননি, বা রেখে যাননি। আমি বলি অনুযোগটি তথ্যনির্ভর বটে, তবে একইসঙ্গে সেটি এক ধরনের অজ্ঞতারও ফসল। ফিরোজা বেগম সংগীতসম্রাজ্ঞী ছিলেন । তাঁর মৃত্যুতে খালি হয়ে গেছে সিংহাসন। সেই সিংহাসনে বসার মতো যোগ্য কেউ নেই। তিনি চেষ্টা করলেও তাঁর মতো আরেকজন সম্রাজ্ঞী বা সম্রাট তৈরী করে যেতে পারতেন না। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি নগদানগদী তৈরী হওয়ার কথা নয়। ক্লিওপেট্রার যোগ্য উত্তরসূরি কে ছিল? কে ছিল সম্রাটের আকবরের যোগ্য উত্তরসূরি? কে হতে পেরেছেন মুহম্মদ রফির কিংবা মেহেদি হাসানের যোগ্য শিষ্য? কিংবা উত্তম কুমারের যোগ্য অনুসারীইবা কে হয়েছে? আবদুল আলীমও দুবার জন্মগ্রহণ করেন না। ফিরোজা বেগমও তাই। বিধাতার মজুদ রেজিস্টারে সম্পদের কোনো অভাব না থাকলেও তাঁর এলোটমেন্ট রেজিস্টার কোনোভাবেই সবার ইচ্ছা-পূরণের খাতা নয় ।

জয়তু ফিরোজা বেগম!

জয়তু নজরুলসংগীত!!

——–০০০———

**********
আমিনুল ইসলাম

কবি ও নজরুল গবেষক

ঢাকা।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ