অমিতাভ সরকার
আশি পাতার বই ‘সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে’। কবি উৎসর্গ করেছেন জীর্ণ সময়ের তরুণ অক্ষর সৈনিকদের। সত্তরেরও অধিক কবিতার সংকলন রয়েছে এই বইতে। বইয়ের নামকরণ হয়েছে ‘ধ্বংস বেশ বাজনা বাজাচ্ছে’ কবিতার শেষ লাইনে।
‘প্রত্যাশার বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছি / অন্ধকারের দেশে/ আমার নীরবতা ক্ষুণ্ণ করছে হাওয়া /উগ্র কোনো সন্নিধানে থেমে যাচ্ছে প্রেরণা / কী করে কথা হবে?’-(অন্ধকারের দেশে)
নয়ের দশকের কবি তৈমুর খানের ‘সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার কয়েকটা লাইনে পড়তে গিয়ে একটুখানি থামলাম। কবিতা কি শুধুই পড়ার জিনিস? অসুখ সময়, সমকালের অস্থিরতা, ভাঙা-গড়ার দ্বন্দ্ব, অমানবিকতা এই বইয়ের বিভিন্ন কবিতার ছত্রে ছত্রে নানা ভঙ্গিমায় নানা ব্যঞ্জনায় খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ফুটে উঠেছে। সব কবিতাগুলোই অসাধারণ।
সহজ সরল কথায় শব্দের ঠাসবুননে মানুষের সংগ্রাম, কষ্ট ,অবক্ষয়ী সময়, স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কবিতাগুলোর বিভিন্ন ছত্রে নানাভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন—
শত্রুতাও রাজনীতি/ বন্দুকবাজও দেশপ্রেমিক/ ধর্ষকও প্রেমিক/সংবিধান পাল্টে গেলে/ স্বৈরতন্ত্রও গণতন্ত্র—হাঃ হাঃ,
কত কত মানুষেরা শিয়াল হয়ে যাচ্ছে/ আর আমরা ভয় পাচ্ছি/ ঘুমোতে পারছি না/ লোকালয়ে তারাও থাকে/ সকাল-সকাল হাঁটতে বেরোয়/
সেলুনে দাড়ি কাটে, স্লোগান দেয়/
আমাদের ছোট্ট বাংলা ভাষার উঠোন/ মেঘ-রোদ্দুরের সঙ্গে দাঁড়ায় এসে রবীন্দ্রনাথ/
শিয়ালেরা রূপ বদল করে/
তাদের ঘাতক দাঁতে কাঁপে বক্র হাসি–শেয়াল,
মৃত্যুর কলোনিতে ভোর এল/
জেগে উঠছে মৃতেরা আবার–ভোর,
বিষাদের দেশে সন্ধ্যায় এল/
ভাঙা তরঙ্গগুলি থেকে/
আমাদের নিঃশেষ মূলধন
অবলুপ্ত হবে। –বিষাদের দেশ,
এখন খুব বজ্রপাত হয়/
তবু তো বাড়ি ফিরতে পারি/
এই পৃথিবীর একটা বাড়ি।
বজ্রপতও নাকি রাজনীতি/
কার যে কখন মৃত্যু আসে!/
মৃত্যুও বিষাদ মাখা পাখি।—বজ্রপাত,
চকিতে শীৎকার ওঠে/
সঙ্গমের তীর্থে বহে স্রোত/
আমার প্রত্যাশী যুবতীরা/
নিবিড় শয্যায় তবে উন্মীলিত হোক–মন্থন,
ফাগুনে শুধু অশ্রুফুল/
ঝরে গেছে মনের উঠোনে।/
বৈরাগ চাইনি কাজল,/
চোখে চোখে তুমি আছ-/
চোখের ভাষা আড়াল করে/
দেখতে চেয়েছ/
শোকারণ্যে আমি কার শিকার হয়েছি! –শিকার
ঘোরের ভিতর একটি ঘোড়া/
সময়ের আস্তাবলে ঢুকে যাচ্ছি-
একে একে চলে গেছে সমস্ত সুপরামর্শরা… –সময়ের আস্তাবলে ঢুকে যাচ্ছি
শ্রদ্ধেয় কবির শব্দ অন্বেষণ, চিন্তনে যে গভীর আত্মপ্রত্যয় লুকিয়ে রয়েছে তার অন্তরঙ্গে পৌঁছানো এক নিবিড় সাধনার ফল। সামাজিক পরিস্থিতিতে তিনি প্রচণ্ড ভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু এই সবকিছু তাকে দমিয়ে দিতে পারে নি। তার প্রতিটাই শব্দই এখানে চাবুক।
তাই সমস্ত দৈন্যতা, দুঃখ, গ্লানির পরেও কবি বলতে পারেন,
আমাদের কর্মপন্থাগুলি/ আমাদের ধর্ম পন্থাগুলি/ দীক্ষিত হোক/
মানববাগানের ফুল ফুটুক/
সারস্বত আনন্দের প্রজাপতিগুলি
উড়ুক আজ -উড়ুক -উড়ুক।–মানব বাগান
‘অসাধারণ’ লেখাটি আটটি পর্বে নিবিষ্ঠ একটি ধারাবাহিক লেখা।
কবির কথাতেই আলোচনা শেষ করি,
অভাবের পৃথিবীতে এত দুঃখ নিয়ে জন্মেছিলাম, কিন্তু দুঃখকে কখনও ভালবাসতে শিখিনি। এক অসাধারণ সব, সব শিখিয়ে গেল। এখন দুঃখ যন্ত্রণা অভাব আমার বন্ধু। তারা আমার সঙ্গে থাকে আর অসাধারণের চলে যাওয়া উপভোগ করে। শিশির মাখা পদ্ম ফুলের মত আমি ফুটে উঠি মানস সরোবরে।–অসাধারণ
এইরকম লেখা মনে হয় বিদ্রোহী কবি শ্রদ্ধেয় তৈমুর খানের পক্ষেই এই লেখা সম্ভব, যিনি কোন সুখের কবি নন, জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করে, অনেক পরিশ্রম করে বড় হয়েছেন। আসলে আমাদের কবির জীবন মানেই কষ্টের জীবন, সেটা মননেই এবং শরীরেও। তার মধ্যেই চলে সত্য অন্বেষণের চরম সাধনা। এরকম অনবদ্য কাব্য সৃষ্টির জন্য কবিকেও ধন্যবাদ এবং আমার মত শিক্ষানবিশ কবিও অনেক কিছু শিখতে পারে।
এইরকম বইয়ের আলোচনা লিখতে বসে
কাব্যের নান্দনিকটায় আপ্লুত বোধ করছি। পাঠকরাও পড়ুন, খুবই ভালো লাগবে।
………….
কাব্যগ্রন্থ : সভ্যতা কাপে বিস্ময়ের জ্বরে
কবি : তৈমুর খান,
প্রকাশক : বার্ণিক প্রকাশন,
প্রথম প্রকাশ : আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা, ২০২২,
মূল্যঃ ১৬০ টাকা