তাজ ইসলাম
কবিতার বইয়ের নাম ‘শোভন সংস্করণ’ , কবির নাম কাজী শোয়েব শাবাব। শোয়েব শাবাবের জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ নওগাঁ জেলার নজিপুরে। এই বইটি ২০২৪ এ অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত। তার কবিতার বইয়ের নামে পাঠক সচকিত হয়,চমকিত হয় । ২০১৮ তে প্রকাশ হয় তার কবিতার বই এলুমিনিয়াম চাঁদ।২০২০ এর কবিতার বইয়ের নাম আইডেন্টিটি ক্রাইসিস।
শোভন সংস্করণে প্রথমেই তিনি সংস্কারে হাত দিয়েছেন শালবনের পরেই যে আলতাদিঘি রয়েছে তার।
‘ যার পায়ে হাঁটা পথ মেপে কাটা হল দিঘি/ কেউ জানে না আজ নাম সে রানির/ শুধু তার পায়ে মাখা আলতার নামে/ মহিমান্বিত আজও আলতাদিঘি…( আলতাদিঘি)।
কবিতার শেষে তিনি দাঁড়ি চিহ্ন প্রয়োগ না করে স্থাপন করেছেন (…) ডট চিহ্ন। প্রতীয়মান হয় কবির বক্তব্যটি শেষ হয়নি। আপাতত তিনি নাম উল্লেখ করেছেন দিঘিটির।পরে সংস্কারের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবেন। তার আগেই তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে চান গাঁদাবাগান এর কথা।গাঁদাবাগানে যেতে যেতেই তার চোখে পড়ে ‘ খেতের পাশে বসে গেরুয়া বাউল’ গলা ছেড়ে আপন মনে গান ধরে আর তিনি শোনেন তন্ময় হয়ে ‘ ঘরপোড়া বাউলের গান’।
‘তারপর একদিন কৃষকের দল/ মাঠের হৃদয় থেকে রোদরাঙা ধান তুলে নিয়ে যায় ঘরে।/ স্মৃতিতে তোলা থাকে বাউলের সুর।’
কবিরা মূলত এমনই। প্রচলিত শব্দের সাথে আরেকটি শব্দ যোগ করে বিষয়কে করেন রঙিন। অন্য দশজন যখন কৃষকের লাঙলে চাষ করেন জমিন কবি তখন দেখেন ‘ মাঠের হৃদয়’। হৃদয় থেকে তুলে নেন ঘরে ‘ রোদরাঙা ধান’।
সাধারণের চোখ দেখে ধান অলস শোয়ে থাকে গোলাঘরে।
কবির বর্ণনায় ফুটে ওঠে ধানের কর্ম, ভূতভবিষ্যৎ।
কবি বলেন, ‘ ধানেরা গোলাঘরে প্রার্থনারত: / পরের মৌসুমে বীজধান হবে/ নরম কাদাজলে শেকড় ডুবিয়ে/ আবার শুনবে মাঠে/ ঘরপোড়া বাউলের গান..( ঘরপোড়া বাউলের গান)।
কাশ্মীর পৃথিবীর ইতিহাসে এক আলোচিত ভূখণ্ডের নাম। পৃথিবীর স্বর্গ এই ভূখণ্ড। কিন্ত রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচে অস্থির,অশান্ত। কবি তার পাঠকদের সামনে কাশ্মীরি কন্যাকে হাজির করেন,’ কাশ্মীরি কন্যা মেহরোজ এসে রোজ/ ডুব দেয় চকচকে ঝিলাম নদীর বুকে।/স্রোতের উল্লাস/ পাহাড়ি বাতাস-/
ছড়িয়ে দেয় প্রিয় উপত্যকায়।/ এটি সুখ বর্ণনা। কিন্ত এই সুখ কাশ্মীর ও তার জনগণের কপালে স্থায়ী থাকতে পারেনি দখলদারের দাপটে। তবে দখলদারও কাশ্মীর কন্যা কিংবা এই ভূস্বর্গের সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হয়।
কবিই বলেন, ‘ তাকে দখল করতে এসে সহস্র রাইফেল/ গিটার হয়ে ঠায় পড়ে থাকে ঘাসে/ কাশ্মীরে স্বর্গীয় সকাল আসে…( কাশ্মীর)।
কাজী শোয়েব শাবাব অল্পকথায় বেশি বলার প্রাজ্ঞতা নিয়ে কবিতা লেখতে পারদর্শী। খুব সংক্ষেপে বলেন ‘ অন্ধকারে ছোট্ট সাপও সারা ঘরজুড়ে/ ভয়ানক আজদাহা/ আবার সমাপ্তিও টানেন একইভাবে।’ আলো জ্বালালে দেখা যায় কর্নারে -/
নির্বিষ হেলে সাপ শুয়ে আছে চুপচাপ।/(ভয়)।
জীবন ও বাস্তবতা চিত্রিত করা কবির কাজ। শুধু কল্পনার অলিকতা ছড়ানোতে কৃতিত্ব থাকতে পারে। তবে জীবনবোধ থাকে অনুপস্থিত। শোয়েব শাবাব জীবনবোধের কবি।আছে বাস্তবতার রূঢ় অভিজ্ঞতাবোধ। তাই তিনি অবলীলায় বলতে পারেন,
‘ কাফনে মোড়ানো বাবা শেষ ঘুমে খাটিয়ায়/ লাশ রেখে দুই ছেলে খুলে বসেছে/ দলিল দস্তাবেজ,খাতা- খতিয়ান।/ ( ভাগ)। ভাগ নিয়ে ভাগাভাগি, রাগারাগির চিত্র কত ভয়ানক তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। ভয়ানক হলেও অবাস্তব নয়। একজন কবি জীবনের এমন বিষয়কে কবিতায় উপস্থাপন করতে পারাই সৃষ্টির সার্থকতা।
হাওয়াশিশুরা, থ্রিডি মাংস,
শান্তির সাদা ঘোড়া,মেঘের পেটে মাতৃত্বের দাগ,সিলিংয়ে ঝুলছে গলায় ফাঁস দেয়া দীর্ঘশ্বাস।’পোষমানা ময়ূর, এরকম শব্দ ও শব্দগুচ্ছের আলো ঝলকানো উপস্থিতি কবির কল্পনা শক্তি কিংবা মেধার উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম।
ক্ষুদ্র কবিতা লেখায় শোয়েব শাবাব পরিপক্ব। উপমা ও চিত্রকল্পসমেত দু লাইনে শেষ করেন নিজের কথা।এবং শেষ করেন তাও এক বাক্যে। ” বুকের দুধ ছাড়ানো শিশুর মতো/ দূরে সরালেও আজও তোমাকে ভালোবাসি।( সম্পর্ক)
কাজী শোয়েব শাবাব বিচিত্র বিষয় নিয়ে ভাবেন। বিষয়ের বৈচিত্রতায় তার কবিতা হয়ে ওঠে অন্য এক দ্যোতনার স্মারক। মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে তিনি লিখেছেন কবিতা। আবার হাসান আজিজুল হকও তার কবিতার চরিত্র। এমসিকিউ কিংবা ম্যানিকিন তার কবিতার শিরোনাম। গন্ধ ও গিটার অবস্থান করে পাশাপাশি। শোয়েব শাবাব বিষয় থেকে বিষয়ে স্থানান্তরিত হন। লিখেন,
‘ নিলামে কেনা বাড়িতে থেকে তুমি শান্তি পাবে না।/ঘরহারা মানুষের চাপ চাপ অভিশাপ ঘুমাতে দেবে না।/ আটকে আসবে শ্বাস/ বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখতে পাবে-/ সিলিংয়ে ঝুলছে গলায় ফাঁস দেয়া দীর্ঘশ্বাস।( নিলামে কেনা বাড়ি)।’
কবিরা সচেতন হন,হন দুরদর্শি। শোয়েব শাবাব তরুণ কবি।তারুণ্যের প্রতিনিধি। তরুণরাই এখন এই রাষ্ট্রের সংস্কারক। রাষ্ট্র যে সংস্কার করতে হবে এই ভাবনা উদয় হয়েছিল শাবাবের চিন্তায়।তাই তিনি লেখতে পেরেছিলেন,
‘ জঞ্জাল জমে গেছে ‘ রাষ্ট্র শব্দটায়/ উড়ছে মাছি আর পেট ফোলা পলিথিন।( রাষ্ট্র)। ‘
রাষ্ট্র,সমাজ,কওম বা জাতীর চিন্তা তার কাব্য রচনার অনিবার্য কেন্দ্র। কেন্দ্র থেকে তিনি ছুটেন চতুর্দিকে। ঘুরতে ঘুরতে ভাবেন। এক সময় উপলব্ধি করেন তার আত্মপরিচয় সংকটের। সংকটকে চিত্রিত করেছেন কবিতার বই ” আ ই ডে ন্টি টি ক্রা ই সি স ‘ এ। এই বইয়ের প্রকাশকাল ২০২০। আমরা অন্য সময় আলোচনা করব তার ভিতর বাহির নিয়ে।
‘শোভন সংস্করণ ‘ কাজী শোয়েব শাবাব।প্রকাশ করেছে ঘাসফুল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। চার ফর্মার বইটির মুদ্রন মূল্য ১৯৫ টাকা। আপনি কিনুন অন্যকে কিনতে উৎসাহিত করুন।