মাহমুদ নোমান
কবিতা হয়ে গেছে বলাটা সহজ হলেও, কবিতা হয়নি বলাটা খুব কঠিন। অথচ, হয়ে গেছে বা হয়নি এ দুইয়ের মাঝখানে যা ঝুলে থাকে, সেটাই আমার কাছে কবিতা। ধরা দিবে, ধরা দিবে না। কবি লিখবে এক তরিকায় আর পাঠক যাবে অন্য তরিকতে ঢুকে। সেখানে খোদ কবিও আগন্তুক! জলসাঘর থেকে হঠাৎ অন্ধকারে নিপতিত হবে! আবার মিশমিশে কালোর অন্ধকার থেকে হঠাৎ জলসাঘর; এভাবেই একটি কবিতার পুনর্জন্ম, এভাবেই একটি সার্থক কবিতার অনির্ণীত বাহাস। ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’ পাঠশেষে আমার লিখতে হচ্ছে, আমাদের সময়ে তাঁর কবিতার প্রথম বইয়েই কয়েকটি সার্থক কবিতার জনক ইমরান মাহফুজ। কঠিনকে সহজ করে বলার মধ্যে, খুব আন্তরিকতায় আমাদের চেনা জানা পরিবেশকে শিল্পীত সুন্দর রূপ দেওয়ার কবিতা। শব্দের কোনো টানাহেঁচড়া নেই, পাঠকের মনে হবে পাঠকের জগতে হাসেন-কাঁদেন-ভাবেন আর সত্যের সন্ধান দেন। ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’ ইমরান মাহফুজের প্রথম কবিতার বই ভেবে ঠেস-গুঁতা দিতে কেউ প্রস্তুত হলে দারুণভাবে ভুল করে ফেলবেন। আদতে যাঁরা কবি তাঁরা কবি হয়েই জন্মে। এ ধরাধামে কেবল পঠন-পাঠনে বোধকে শাণিত করে। নিজের জগৎকে পরীক্ষালব্ধ সত্য করে তোলে। ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’ কবিতার বইটি কেবল একটি সকালকে উপজীব্য করে দুপুরের আগে আগে জীবনটাও শেষ করেছেন। এটা তাঁর অত্যন্ত শক্তিশালী বোধের দিক। এ সকালকে আবার তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : মাধ্যমিক সকাল, উচ্চমাধ্যমিক সকাল, সম্মান সকাল। এমন চমকপ্রদ সূচি পাঠকের সামনে উপস্থিত হলে, পাঠকমাত্র নড়েচড়ে কবিতার বইটি পাঠ করতে বাধ্য। আবার কবি যখন বলেন ‘-শতকসমগ্রে ইঁদুরের ভিড়ে আশার বিলাপ ঘুমিয়ে পড়েছে স্বপ্নযাত্রা! চাঁদ ও নক্ষত্রের অগ্রিম চাওয়া পাওয়ায়- ধূমকেতুর ছায়াপথে মেধাহীন অন্ধকার। তোমাদের মহাকাল আমার ছাদের নিচে!
-তোমাদের মহাকাল আমার ছাদের নিচে; ৩৩ পৃ.)
উপর্যুক্ত কবিতাটির আগের লাইনগুলোসহ পাঠের পর পাঠক আলাদা ঘোরে স্তম্ভিত হয়ে যাবে নিশ্চিত। নড়নচড়ন তেমন থাকবে না, কেননা মহাকাল কীভাবে একটি সকালে শেষ করেছেন নিজের ছাদের নিচে! কী রকম দুঃসাহস বা উড়নচণ্ডী ভাব মনে হতেও পারে, সমগ্র গ্রন্থটি পাঠ করলে পাঠক বুঝবেন, সকালের ভেতরগত তিনটি রূপ অর্থাৎ, তরিকত, হাকিকত ও মারেফতের অপরূপ পাঠদান। তাহলে, শরিয়ত গেল কোথায়? এখানে শরিয়ত হলো- ধীরে ধীরে, অন্তরে অন্তরে কবিতার বীজ বপন!
সাম্প্রতিককাল মানে আমাদের সময়ে কবিরা যখন নিরীক্ষার নামে শক্ত ইট-পাথুরে শব্দে পাঠকের দাঁত ভাঙার আয়োজন করছেন; তখন নীরবে সমাজ সচেতনতার বীজ বুনছেন ইমরান মাহফুজ। আধুনিকতায় অতি উৎসাহী হয়ে যখন মানুষ দিগভ্রান্ত; তখন কবি তাঁর কবিতায় তুলে ধরছেন- নষ্ট সমাজের আসল চিত্র। যেখানে একজন মানুষের কাছে মানুষের মূল্য নেই, বানোয়াট ভালো মানুষ সাজার কসরতে কবির চরম বিরক্তি। বাজারের থলে নিয়ে হেঁটে যেতে ছিন্নমূলের শিশুরা লালা ঝরায়ে চেয়ে আছে, সে বাজার ঘরে এনে কুকুরকে দিচ্ছে। যে বুকে থাকবার কথা মানুষ; সেখানে থাকছে বিড়াল। এই যে মানুষের ভালোবাসার দায় মানুষের মাঝে নেই, এটাই বলতে চেয়েছেন বারবার। এই নগরের যন্ত্রণায়, মিথ্যে খোলসে নিভৃতে সবুজ-শ্যামল গ্রামের সরল যুবকপ্রাণ। ‘দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা’ কবিতার বইয়ে বেশ কয়েকটি কবিতায় এদিকটা সরাসরি নয়তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে চেয়েছেন। হয়তো একমুখী বিকল মনের অধিকারী মানুষের শহরে সবাই গোসসা করবে কবির প্রতি, সে ভাবনায়। এক্ষেত্রে ‘বিড়ালকাব্য’ কবিতাটি স্মরণযোগ্য, অশুভ সংকেতের ইঙ্গিত দেয়। বোধোদয়ের জন্য আকুতি ‘-অথচ ভাবছো একবার- বিড়ালটি হিংস্র হলে তৃতীয় সূত্রের প্রয়োগে বুকের অবস্থা কেমন হবে!’
-বিড়ালকাব্য, ৫৯ পৃ.।)
নাগরিক যুগযন্ত্রণা বিষাদবাষ্পে কাতর বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, দেশের বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে তিক্ততা- ‘অসুখী নদীতে ঢেউ নেই কণ্ঠে পাখির গান নেই, সুরে নেই আবেগ চোখে নেই স্বপ্ন, মায়ের কানে সোনাও নেই সব হারিয়ে সিটিগোল্ড বাংলাদেশ!’
-বাংলাদেশ; ১৯ পৃ.।)
এসবকিছুর মধ্যে নিজের কথা বলেছেন অকপটে ভীষণ রকম বাস্তবতায়। বুকের ভেতর এসব কথা বললে কাঁচি দিয়ে কাটে; পাঠকের কাছে কোনো ছলনার ধার ধারেননি। এখানেই ইমরান মাহফুজের বিশিষ্টতা ‘-ইমরান মাহফুজ- এক বটবৃক্ষের নাম, তাকালে দৃষ্টি বাড়ে কর্পোরেটদের আগ্রহ- না বৃক্ষ কারো একার না!’
-পরিচয়; ১৩ পৃ.।)
সুস্পষ্ট নিপুণতায় মাধ্যমিক সকাল ভাগে অর্থাৎ তরিকতে বলেছেন ‘-ঠোঁটজোড়া বন্ধ রাখার সুবিধা বুঝে গেছি বিষাদের চিৎকারে অলিখিত রোজনামচায়- কাটাপায়েও হাঁটতে শিখে গেছি- বেশ আগেই আমি বুঝে গেছি- অধরা বোধে তলহীন নৃত্য করার আনন্দ! ইমরান তুই পালিয়ে যা -খরায় শুকনো মটরশুঁটি হয়ে থাকি আমি!’- মুখোশপরা পাঠশালা ; ১৫ পৃ.।
ইমরান মাহফুজের কবিতা সহজাত শব্দের ক্যারিশমায় শাণিত বোধের আধ্যাত্মিকতার সমাধান। অথচ পাঠকের বুঝতে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হয় না। কেননা কবিতার প্রতিটি শব্দ আত্মাধীন ঘোর ও রিদম তৈরি করে। এখানেই আলাদা পরিবেশ তৈরি করা হয়। কবিতার মাঝে এতো তিক্তরস পরিব্যাপ্ত অথচ সবসময় একটা আনন্দ নাচন ইমরান মাহফুজের কবিতা পাঠে। এখানেই কবিতার সার্থকতা, আধুনিক কবিতা মানে ঠেসাঠেসির সামষ্টিক ব্যবহার। উপস্থাপনায়, বোধে আমরা পৃথক হয়ে যাই। যেটাকে আমরা বলি, সুররিয়ালিজম। আর সেখানেই ইমরান মাহফুজ ভিন্নতর এক জায়গায়, বক্তব্যে একেবারে সরাসরি অর্থাৎ পাঠকের প্রতি খুব আন্তরিক। উপমা ব্যবহারে খুব শক্তিশালী আর চিত্রকল্পে দারুণ মুন্সিয়ানা গদ্যছন্দের বুননে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জালে দুর্দান্ত বিচরণ, যেখানে নির্যাতন, শোষণ সেখানেই কবি।