spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধসেলিম সারোয়ারের কবিতা : অলীক হরিণের খোঁজ

লিখেছেন : মাসুদুল হক

সেলিম সারোয়ারের কবিতা : অলীক হরিণের খোঁজ


মাসুদুল হক

ষাটের দশকের নিভৃতচারী কবি সেলিম সারোয়ার। বুদ্ধিবৃত্তিক-তাত্ত্বিক-অভিজ্ঞতাপ্রবণ এই কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ “বেজে ওঠো মাতাল মল্লার”। ষাটের দশক থেকে কবিতা লিখলেও তার এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৭ সালে প্যাপিরাস প্রকাশনী থেকে। গ্রন্থটিতে ১৯৬৬ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত সময়ের কবিতা উঠে এসেছে। দীর্ঘ সময় পর্বের সব কবিতাতেই সেলিম সারোয়ারের নিজস্বতার চিহ্ন বিদ্যমান। বিশেষ করে তার ভাষা ও বাক্য সংগঠনের শৈলী বাংলা কবিতার তিরিশ পরবর্তী বুদ্ধিবৃত্তিক মানবতাবাদী ধারার গঠন ও চিন্তাকে সংস্থাপিত করে। ১৯৬৬ সালের একটি কবিতা লক্ষ্য করা যাক :
আমরা বিষন্ন নই উজ্জল সূর্যের মুখে যদি
ছায়া ফেলে কালো কাক; অমঙ্গল; ম্যাডোনার চোখ
বেশ্যার ইশারা হয়ে ঝলকায়, গানের ধ্রুপদী
বন্ধ করে কানেস্তারা যদিবা বাজায় কিছু লোক;

কিংবা যদি কফিনের মুখ খুলে শিশুর নিষ্পাপ
রক্তহীন শব দেখে গোরখোঁড়া মজুরের দাঁতে
হাসির ঝিলিক ওঠে, খোঁজে যদি কামের উত্তাপ
মদ্যপের ক্লিন্ন ঠোঁট ধর্ষিতার রক্তাক্ত গ্রীবাতে।

আমরা বিষন্ন নই: আমার নিমগ্ন চেতনাও
জুড়ে আছে কালো কাক, ধর্ষকের অশ্লীল প্রলাপ;
আদম-ঈভের স্বর্গচ্যূতি, আদি অপরাধ তাও,
রেখে গেছে অবচেতনায় কালো বৈকল্যের ছাপ।

আমরা পতিত আত্মা, পতিত এ পৃথিবীর বিষ
গিলে বেঁচে আছি এই জীবন্ত নরকে অহর্নিশ।
(আমরা বিষন্ন নই)
সনেটাশ্রয়ী এই কবিতায় তৎকালীন সময়ের মধ্যবিত্ত সমাজমানসের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক জীবন সংগ্রামের শ্লেষ ও দ্রোহ তিরিশ দশকের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারায় উন্মোচিত। টি.এস. এলিয়ট যেমন কবিতায় ঐতিহ্যরোধের কথা উল্লেখ করেন, ষাটের কবি সেলিম সারোয়ারও কবিতায় ইউরোপীয় মানসজাত ঐতিহ্যবোধের সঞ্চারণ ঘটান। আমরা লক্ষ্য করি, তার সমকালের ম্যাডোনা কামের উত্তাপে মদ্যপের ক্লিন্ন ঠোঁট ও ধ্রুপদী গানের ঐতিহ্যিক পরম্পরায় উপস্থিত হয়ে তারই কবিতায় উত্তরাধুনিক চেতনার জগত নির্মাণ করেছে। ঠিক এই কবিতাটাকে মনে রেখে আমরা যদি ফিরে আসি ২০০৪ সালে প্রকাশিত তার একটি কবিতায়; সেখানেও দেখা যাবে নাগরিক প্রতিবেশে রবার্ট ফ্রস্টের কাক আর জীবনানন্দের বুড়ি প্যাঁচা। একটা ইউরোপীয় মননদীপ্ত আধুনিক মানুষের প্রতিছায়া কাজ করে তার কবিতায়। যেটি ষাটের দশকে শুরু হয়ে একুশ শতকের সূচনা লগ্নেও অব্যাহত। কবিতাটির কয়েকটি লাইন লক্ষ করা যাক:

ফিরে এসো আজ রাতে–বড়ো বেশি প্রয়োজন ফের,
রবার্ট ফ্রস্টের কাক, বুড়ি প্যাঁচা জীবনানন্দের
আবার আকাশে সেই পঞ্চমীর চাঁদ,
তুষারে আবৃত ভূমি, নিষ্পত্র গাছের ডালপালা,
পেছনে আবার সব আততায়ী অতীত প্রমাদ,
নষ্ট ব্যর্থ দিবসের জ্বালা।

অপার ক্লান্তির নদী প্রত্যেক শিরায়,
মগজের প্রতি কোষে ঘাষফুল নীল বিষন্নতা,
হয়তো সমুদ্র গাঢ় আছে মর্গে বেহুঁশ নিদ্রায়,
শক্ত রূঢ় জমি ঢেকে বরফের গলিত নম্রতা।

শেষ পরিণতি তবে সত্যিই কি অমাময়ী নিশা?
আকন্দ-ধুন্দুল বনে নিভে গেছে শেষ জোনাকিরা?
শুশ্রুষার জলে জানি মিটবেনা গরলের তৃষা;
মৃত জ্যোছনায় জ্বলে কঙ্কাদের ধবল অস্থিরা।
(কাক ও প্যাঁচার উপাখ্যান)
আশ্চর্য লাগে তার কতিার গড়ন ও ভাষার ম্যাচুরিটি চল্লিশ বছর ধরে একই ধারায় পর্যবসিত। মিথ ও ঐতিহ্যিক শব্দ প্রয়োগে তার পারঙ্গমতার প্রকাশ অদ্বিতীয় মহত্ত্ব (Sublime) তৈরি করেছে। কবিতা শুধু কল্পনা নয়, এ বাস্তব স্বেদাক্ত, প্রাত্যহিকতায় স্পৃষ্ট, মিথ ও ঐতিহ্যিক চেতনায় অবচেতন স্মৃতির অনুবর্তন। এই মিথ ও ঐতিহ্যিক চেতনাতেই সেলিম সারোয়ার তার অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতাকে কবিতার নান্দনিক বিকাশে বেঁধে নিতে পারেন। এই নন্দনবোধ, যা আবার ঐতিহ্যিক চেতনায় প্রেমের অভিব্যক্তিও বটে। সেলিম সারোয়ারের উচ্চারণে প্রেম-চেতনা বর্ণিত হয় এইভাবে :
তবু তুই চিরকাল দূরে দূরে রয়ে গেলি মায়াবী হরিণী!

যে রাতে অমিতাচারী আকাশ ছড়ায় চারদিকে
জ্যোৎস্নার মাতাল বেলফুল,
বৃক্ষপত্রে নেচে ওঠে স্বর্গভ্রষ্ট সবুজ কিন্নরী,
তেমন রাতেও তোর বন্ধ পাষাণের দরজায়
কম্পন জাগেনি, ফিরে এসেছে আমার সেরিনেড
অসহায় ঠোঁট ঘষে তোর জানালার নীল কাঁচে।

কতবার সযত্নে দিয়েছি পেতে রক্তিম কার্পেট,
রঙিন নিশান হাতে রাস্তার দু’পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি
রক্তে রক্তে খেলা করে যে সব সুন্দর শিশু তার সমুদয়,
বেজেছে সঙ্গীত লাল জরির পোষাক-পরা বাদকের হাতে,
কিন্তু তুই, ভ্রষ্টা মহারাণী,
ঠোঁট পাল্টে অন্য পথে চলে গেলি একা!

কখনো দেহের সব ক’টি লোমকূপ
রেখেছি গরাদহীন জানালার মতো খুলে যাতে
তোকে পাই দুরারোগ্য উপদংশ জীবানুর মতো
ত্বকের নিবিড়ে,
তবু তুই চিরকাল,
চিরকাল দূরে দূরে রয়ে গেলি ছেনাল হরিণী!
(তবু তুই চিরকাল)

অথবা :

ভালোবাসা ঈশ্বরের সবুজ আঙুল থেকে ঝরে-পড়া লাল শস্যকণা,
ভালোবাসা ঈশ্বরের বিশাল দু’চোখ থেকে নীল বৃষ্টিপাত,
এপ্রিলের রক্ত-মুখ চন্দ্রোদয়, সূর্যোদয়,
ভালোবাসা ঘনঘোর বর্ষাকালে সম্রাজ্ঞীর মতো মেঘমালা;
মদিরাক্ষী সপ্তদশী মন্দিরা বসুর
দুর্বিনীত স্তন যাকে লুকোবার মতো
পর্যাপ্ত আঁচল নেই।
(ভালোবাসা)
প্রেম-চেতনায় দেহজ উপলদ্ধির এক নঞর্থক মহিমা সেলিম সারোয়ারের কবিতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যা আমরা অবলোকন করছি “তবু তুই চিরকাল” কবিতায়। আবার ‘ভালোবাসা’ কবিতায় প্লেটোনিক চেতনার আবেগ লক্ষণীয়। আমরা জানি সংবেদনশীল যে কোনো মানুষই বস্তবিশ্ব, মানববিশ্ব ও পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ অনুভব করে থাকে। যে পার্থিব জগতের আবেষ্টনির সঙ্গে সে গভীরভাবে সংযুক্ত, প্রকৃতি তার একটি বড় অংশ। সে প্রকৃতি হতে পারে গ্রামীণ কিংবা নগরকেন্দ্রিক। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যোগাযোগও বিভিন্ন মানবিক সম্পর্কের মতোই সত্য; প্রকৃতিকে বাদ দিলে তাই জীবনের স্বরূপকেই খণ্ডিত করা হয়; বাস্তবের চিত্র সম্পূর্ণ পরিস্ফুট হতে পারে না। প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের এই নিবিড় সম্পর্কের জন্যই যেকোনো কবি-প্রতিভাই প্রকৃতিকে তার মনোভাব প্রকাশের বাহন করে তোলে। কবিতার চিত্রকল্পে নির্মাণ করে বহুবর্ণিল রূপ। সেলিম সারোয়ারের কবিতায় মূলত নগরকেন্দ্রিক ও গ্রামীণ প্রকৃতির চিত্রকল্পের নান্দনিক শোভা পরিলক্ষিত হয়। দৃষ্টান্ত :
কে জানতো এদেশের জল-হাওয়া, লাজুক শ্যামলী ঘাসপাতা
জন্ম দিতে পারে ফসফরাসের মতো
নির্বাণ-অসাধ্য এক দুর্ধর্ষ আগুন!
অকস্মাৎ দেশলাই জ্বালতেই বাঙলার প্রত্যেকটি দরিদ্র উঠোন
বিস্ফোরিত হয় যেন সহস্রাব্দ সঞ্চিত বারুদ;
জননী এশিয়া কাঁদে, বিশ্বশান্তি তার মনোরম
কাঁচঘরে বসে দেখে বাঙলাদেশে জ্বলছে বিপ্লব!
যেন সেই দুপুরেও অন্ধকার, সোঁদা-গন্ধ মাখা কাঁচা ঘর,
তার স্যাঁতসেতে মেঝে, বর্ষায় ধ্বসে যাওয়া পিঁড়ে,
মলিন পুরনো কাঁথা, তাল পাখা, ন্যাকড়ার পুতুল,
মাটির মটকায় রাখা ধানের বিছন,
মুলিবাঁশ বাখারির জরাজীর্ণ বেড়া,
দাদার সহস্তে পোঁতা বুড়ো জামগাছ–
সব কিছু ভয়ানক দাহ্য এক পদার্থে নির্মিত।
গ্রামের ইস্কুলে পড়া অনুজ্জ্বল কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর,
কালচে গোফের রেখা ঠোঁট,
অপ্রতিভ সর্বদাই, পারে না গুছিয়ে বলতে নিজের কথাকে,
এখনো ভুতের বড়ো ভয় তার,
এখনো মায়ের হাতে খেতে ভালোবাসে,
কি এক নিশির ডাকে সন্মোহিত, যাবে নিরুদ্দেশে!
যখন আসবে ফিরে, বুকে তার বিস্ফোরণ ঠাসা,
চোখ তেজষ্ক্রিয় আর প্রত্যেক আঙুল জানে শুক্র হত্যার কৌশল।
কে জানতো একদিন মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর ঈশ্বরের মতো
জ্যোতির্ময় বৃদ্ধ চাষী পাবে রূপান্তর
জিউসের বজ্র হাতে ক্ষিপ্র-পেশি দক্ষ গেরিলায়!
কে জানতে এদেশের শান্ত ডোবা, নিরীহ পুকুর,
সংসারের অনাদৃতা বৌটির মতন চুপচাপ,
একদা সশস্ত্র হবে, তুলবে কঠিন প্রতিরোধ,
যুঝবে শত্রæর সঙ্গে যেন প্রশিক্ষিত মুক্তিসেনা!

এদেশে চারণ গায় সংবৎসর মেঘের মর্সিয়া,
এদেশের রূপসারী শরীরে ধারণ করে পলির সান্দ্রতা,
গভীর তৌহিদবাদী এদেশের বিশ্বাসীরা, তবু
দিকে দিকে পূজা আজ বিপ্লবের অগ্নি দেবতার!
সূর্য-উপাসক নয় তারা, তবু তাদের পতাকা
রক্তলাল এক ভোর বুকে ধরে কী গর্বিত আজ!
(কে জানতো)
সেলিম সারোয়ারের কবিতায় প্রকৃতি, প্রতীকবাদের আড়ালে দার্শনিক ভাবনার বিস্তার ঘটায়। ‘কে জানতো’ কবিতায় তিনি বাংলাদেশের গ্রামীণ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভেতরে নৃতাত্ত্বিক চেতনার সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গিটি উন্মোচিত করেছেন।

Subjective ভাবনার কবি সেলিম সারোয়ার “ম্যানিফেষ্টো” নামক দীর্ঘ কবিতায় কবি ও কবিতা সম্পর্কে তার ভাবনা প্রকাশ করেছেন। কবিতা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন :
“কবিতা অর্থ্যাৎ এক অলোক-সামান্য ভার্জিন
প্রতিটি সঙ্গম শেষে কুমারীত্ব ফিরে আসে যার;
আজীবন সুদূর্লভা পরনারী দূরূহ শঙ্খিনী
যার মন পেতে হলে যেতে হয় মানচিত্রহীন
অগস্ত্যযাত্রায় একা; কবিতা অর্থ্যাৎ
বিষম-আসনারূঢ়া সাহসিকা প্রথমা লিলিথ
স্বপ্নাদিষ্টা চাষীকন্যা আর্কের জোঅন
এক সন্ন্যাসিনী যার বিনম্র কুর্নিশ,
নাৎসী স্যালুট কিংবা প্রণিপাত-কিছুই আসেনা।”

একই কবিতায় কবি ও কবিতা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন :
“কবিতা ঈভের জিভে নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ, অন্তর্ঘাত, দীক্ষা আর দ্রোহ
আর কবি মানেই বিদ্রোহী।”

সেলিম সারোয়ারের কবিতার পৃথিবী তর্কাতীতভাবে এক রোমান্টিক পৃথিবী। তার অনুভবে জীবনানন্দীয় ধূসর বিষাদ, ক্লান্তি, বিষন্নতা, না-জানা দূরত্বের জন্যে হাহাকার ও কান্না যেমন লক্ষণীয়; তেমনি রাবিন্দ্রীক পরিসরের প্রকৃতি ও ভাবনা গভীর আচ্ছন্ন মগ্ন হয়ে রয়েছে। তিনি জানেন নীল মধ্যরাতে দগ্ধ সিগারেট বিদ্ধ করা এ্যাসট্রের নাগরিক উপাচারের মধ্যে কামদীপ্ত উরুসন্ধি কীভাবে প্রেমিকার রক্তমাংসময় কামনাকে উদ্বেলিত করে কবির মন। ফলে অন্তর্লোকের সঙ্গে বহির্জগতের, শুভর সঙ্গে অমঙ্গলের, দুঃখানুভূতির সঙ্গে আনন্দানুভূতির, রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনার সঙ্গে পাশবিক বস্তু-পৃথিবীর দ্ব›দ্ব সংঘাতের মধ্যে দিয়ে তিনি তার প্রেম চেতনাকেই প্রকাশ করেন। তিনি স্বগত সন্ধান করেন এভাবে :
এই নীল মধ্যরাতে, এখন একুশতম দগ্ধ সিগারেটে
বিদ্ধ করে এ্যাশট্রের অনিচ্ছুক ঊরু-সন্ধি, আমি,
পূর্বপুরুষের দ্বারা পরিত্যক্ত রাজপুত্র, আমি
তোমাকে, বিশ্বেস করো, তোমাকেই খুঁজছি, রাধিকা।
জ্বলন্ত মিছিল, মৃত সুহৃদের স্মৃতিসভা,
শব্দহীন পাঠাগার, রবীন্দ্র-সঙ্গীতের আসর,
দুপুরে যখন শ্বেত-তপ্ত রোদে গলে যাচ্ছে ত্বক,
সন্ধ্যায়, যখন হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই বলে
ফিরে আসছি কবিতার বইয়ের দোকান থেকে একা,
বস্তুতঃ তোমাকে খুঁজছি সর্বত্র, সর্বক্ষণ, স্বাতী।

আসলে সুদূর সেই তেরোশো আটান্ন থেকে তোমার সন্ধান,
লীলাবতী। নকল নীলকমল বেরিয়েছি শ্যামল শৈশবে,
পার হয়ে যাবো শাদা শষ্পহীন তেপান্তর, কালো নদ-নদী।
হিরন্ময় প্রজাপতি, উঠে গেছো পাতাবাহারের ডাল ছেড়ে
নিজেকে বিমুক্ত করে নর্তকীর মতো সুকৌশলে

আমার আঙুল, আহা কম্পিত আঙুল থেকে একদিন,
ব্যগ্র প্রসারিত হাতে ছুটে গেছি তোমার পেছনে,
কিন্তু তুমি, হিরন্ময় প্রজাপতি তুমি,
উধাও হয়েছো ঘন বনতুলসীর কালো ঝোপে।
[….]
কোনো কোনো আলোকিত রাতে
দেখি তুমি শকুন্তলা সুদর্শন দুষ্মন্তের হাত ধরে শুধু
উঠে যাচ্ছো, মস্ত গোলাকার সিঁড়ি বেয়ে,
সুঠাম নিতম্বে ঢেউ তুলে দ্রুত পায়ে
ক্রমাগত উঠে যাচ্ছো যেনো সাদা মেঘলোকে যাবে।
“শোন, শকুন্তলা শোন”, এই বলে আমার ব্যাকুল
সেরিনাদ, ব্যর্থকাম, ফিরে ফিরে আসে
তোমার সুছাঁদ খোঁপা, তোমার মসৃণ কাঁধ ছুঁয়ে।

নীল পক্ষীরাজ নেই, মায়াবী অঙ্গুরী
কবে কোন সস্তা হোটেলের বাথরুমে
খুইয়ে এসেছি, ছাই মনেও পড়েনা,
দাঁড়িতে কর্কশ মুখ, দুর্গন্ধ ভীষণ
জানিনা বগলে নাকি উরুতে না রাত পাজামায়,
অনিদ্রা জ্বেলেছে চোখে রক্তলাল বিপদ সঙ্কেত,
প্রবল ব্রঙ্কাইটিস বুকে নিয়ে
তবু নীল মধ্যরাতে সাদা মোমবাতি জ্বেলে আমার টেবিলে,
তোমাকে, বিশ্বেস করো, তোমাকেই খুঁজেছি, শ্যামলী।
(স্বগত সন্ধান)

সেলিম সারোয়ার শৈল্পিক অভিজ্ঞতা, প্রগাঢ়তা ও তীব্রতা নিয়ে রোমান্টিক কবিতা ভাবনার খুব গভীরে প্রবেশ করেছেন ষাটের দশক থেকেই। জগত ও জীবনের বিষয়–আশয়ের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে সরাসরি স্পর্শ করে তাকে শব্দশিল্পে কবিতার বিষয় করে তুলেছেন। আর কাব্যজিজ্ঞাসার–“অনিশ্চিত আকাঙ্খার তাড়নায় আমরা ক’জন শিকারি সর্তক চোখে”- সতত ক্রিয়াশীল থেকেছেন।
কবিতায় শব্দপুঞ্জ এবং চরণের সমন্বয়ী রূপ কবিতার রূপকল্প নির্মাণে কবিকে সহায়তা করে। এ শব্দপুঞ্জ কবি কোন কোন ক্ষেত্র থেকে তার কবিতায় ব্যবহার করবেন, তা নির্ভর করে কবির ইচ্ছা ও মানসচৈতন্যের উপর। আর এ মাসনচৈতন্য নির্ভর করে কবির অভিজ্ঞতার উপর। স্বাভাবিকভাবেই সেলিম সারোয়ারের মনোযোগ সবটুকুই পড়েছে এই অভিজ্ঞতার দিকে। তার অনেক কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটা উন্মাদনা সৃষ্টির উৎকন্ঠা। যেমন : ‘জীবন যাপন’, ‘অন্তর্গত অভিশাপ’, ‘সায়ংচিন্তা’, ‘মগ্ন-মৃত্যু’, ‘আমরা কেউ কারো জন্য’, ‘অন্তর্যাত্রা : মল্লিকার দিকে’, ‘ফেরা’ প্রভৃতি কবিতাসমূহে এই লক্ষণ স্পষ্ট। তাই তার কবিতায় সুন্দর ভাষা, চিত্রকল্পের প্রতি তার অনুরাগ প্রেমিকার মতই। কবিতার মধ্যে তিনি একটা চমৎকার আতিশয্য, সুন্দরের স্পর্শ তৈরি করে পাঠককে শুধু উন্মুখই করে রাখতে চান না, বরং তা দিয়ে তাদের হৃদয়ের অতৃপ্ততারও অনুসন্ধান চালান যা আমাদের অনেক সময় শামসুর রাহমানীয় কবিতাবিশ্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়। তার মৌলিকত্ব এখানে যে, তিনি তার অভিজ্ঞতার শব্দপুঞ্জকে গদ্য-পদ্যের সীমায় বিভাজিত না করে চমৎকার নৈপূণ্যের সঙ্গে কবিতার বাক্যবিন্যাসে প্রয়োগ করে এক নতুন অর্থদ্যোতনা সৃষ্টি করেন। যেমন ‘হরিণ’কে এক নতুন অর্থদ্যোতনার দার্শনিক ভাবনায় উপনীত করেছেন এভাবে তিনি তার কবিতায়:

অলীক হরিণ খুঁজি জনাকীর্ণ শহরে বন্দরে
অনিশ্চিত আকাঙ্খার তাড়নায় আমরা ক’জন
শিকারি সতর্ক চোখ। ছলনায় মিহি কণ্ঠস্বরে
ডাকি মৃগয়াকে, চষি নাগরিক হিংস্রতার বন।

অলীক হরিণ খুঁজে পর্বতের দূর্গম খাড়াই
তাও ভাঙি ক্লান্ত পায়ে; কখনো তাঁবুর অন্ধকারে
চকমকি ঠুকে ঠুকে উষ্ণতার স্পর্শ পেতে চাই;
সমাচ্ছন্ন চেতনায় বাঘিনীরা ডাকে বারেবারে।

কখনো পাইনি দেখা, অথবা কখনো পাব কিনা
নিশ্চিত জানিনে তাও। নিষ্ফলা নগর-কেন্দ্র হতে
কালিদহ শঙ্খিনীর তীরে এক যাদুকরী বীণা
ডেকে ডেকে নিয়ে গেছে গন্তব্য-বিহীন সেই পথে।

আমরা কি সত্যি তবে খুঁজে যাব অলীক হরিণ
অনন্ত প্রহর ধরে, যদিও পাব না কোনদিন?
(অলীক হরিণ খুঁজি)
এক অলীক হরিণের সন্ধানে বাংলা কবিতার ষাটের দশকের এই নিভৃতচারী কবি ইউরোপীয় মনন দীপ্ত পঠন-পাঠনের সঙ্গে বাংলার জনজীবনের ঐতিহ্যিক মেলবলুন ঘটিয়েছেন কবিতায়। তার কবিতায় প্রচুর ইউরোপীয় শব্দ ও টার্ম যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, তেমন আমাদের ঐতিহ্যিক ও মিথিক্যাল শব্দের ব্যবহার হয়েছে সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে।

সেলিম সারোয়ারের কবিতার আরেকটি বিশেষ দিক কবিতাগুলোতে ইতিহাস-চেতনা প্রকাশের পাশাপাশি তার কবিসত্ত্বায় জাতিস্মর-চেতনাও প্রবাহিত হয়েছে। যেমন “প্রত্যাবর্তনের কথা” কবিতায় তিনি অগস্ত্যমুনির মিথিক চরিত্রে নিজের জাতিস্মর চেতনার অবলোকন করেছেন। লক্ষণীয় :
তোমরা আমাকে বলো ফিরে যেতে– বলো বন্ধুগণ,
কার কাছে ফিরে যাবো? কার প্রাণবাহী
অনুপম নিবিড় আশ্রয়ে, ঊষ্ণ অন্তরঙ্গতায়?
ফিরে যাবো পুনরায় শৈশব নামের সেই লোল-চর্ম ডাইনির কাছে?
দু’চোখে পড়েছে ছানি, বড়ো বেশি অস্পষ্টতা তার
কষ্টকৃত উচ্চারণে, ধুলো অধ্যষিত তার স্মৃতির কোটরে
জমেছে জটিল কালো ঊর্ণাজাল। তাছাড়া কি জানো,
আমার শৈশবে কোন শ্যামশোভা গ্রাম
নিরিবিলি নদীতট, নিসর্গের দৃশ্যপট নেই।
জ্বলন্ত পিচের ধূমে অন্ধকার ধোঁয়াটে শৈশবে,
জলছবি না-পাবার দুঃখাক্রান্ত অসুখী শৈশবে,
লরির চাকায় পিষ্ট সুহৃদের মুখাঙ্কিত রক্তাক্ত শৈশবে
ফিরে যাই, বন্ধুগণ, তোমাদের এইকি বাসনা?

কৈশোরের কঙ্কাবতী কবিতার কাছে
ফিরে যেতে পারি– হায় তার কণ্ঠে পূর্বতন সেই
সজল মল্লার নেই, হাতে নেই নিবিড় কদম …
অবৈধ সম্ভোগে গর্ভবতী নাকি শ্বৈরিণী কবিতা
সম্প্রতি ভুগছে এক ভয়াবহ রক্তহীনতায়!
কিংবা সঙ্গীতের কাছে, হৃদয়ের একূল ওকূল
দুকূল ভাসানো সেই সঙ্গীতের কাছে ফিরে যাবো?
আমার ঘর্মাক্ত মুখ, রুক্ষ চুল, মলিন পাঞ্জবি
বড়ো বেশি লজ্জা দেয়– এবেশে কি করে
সঙ্গীতের আলোকিত স্বর্গে যাবো– বড্ড বেমানান!
ফিরে যাবো প্রেমিকার স্তনের নিবিড়ে?
মাতাল, সম্রাট, ভাঁড় স্বপ্নাহত কবি
যেখানে আশ্রয় নেয় সবশেষে বিত্তহীন উদ্বাস্তুর মতো,
শেষতম সেই ইথাকায় ফিরে যাবো?
হায় যে মেয়েকে রোজ হীরে পান্না শব্দে গেঁথে প্রেমপত্র লিখি,
স্বপ্ন জাগরণে বলি– ভালোবাসি, সখি, ভালোবাসি,’
জানি তার আছে আরো কতিপয় প্রবল প্রেমিক।
আমার সকল প্রত্যাবর্তনের পথে হে বন্ধুরা
কর্দম, কন্টক, কালো শঙ্খিনীর ফণা:
একাকি অগস্ত্য আমি, এই যাত্রা গন্তব্য-বিহীন!
(প্রত্যাবর্তনের কথা)
এই অবলোকনের মধ্য দিয়ে কবি সেলিম সারোয়ার পাঠককে কবিতার ভেতরে এক ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ায় টেনে নিয়ে যান। পরিবেশের এমন বর্ণনা দেন কবিতায়; যেখানে কৈশোরের রূপকথার ঘোরের সম্মোহনে আধুনিক মানুষের মানসলোকে জাতিস্মরের উন্মোচন ঘটিয়ে ফেলেন নিমিষে। তার কবিতা হয়ে ওঠে লোকায়ত বাংলার আধুনিক মননদীপ্ত সত্তার প্রকাশ। সাধুবাদ জানাই তাকে! চলতে থাক তার কবিতায় অলীক হরিণের খোঁজ।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ