spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবিদায় কবি রত্নেশ্বর হাজরা (১৯৩৭--২০২৪)

বিদায় কবি রত্নেশ্বর হাজরা (১৯৩৭–২০২৪)

তৈমুর খান

চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের আরও উজ্জ্বল নক্ষত্র রত্নেশ্বর হাজরা। ছাত্রজীবনেই তাঁর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখনো মনে আছে—
“ভাত ছিল
ভাত দেবার লোকও ছিল
শুধু ইচ্ছেটা ছিল না ভাত দিতে”
কবিতার শেষটুকুতে লিখেছিলেন—
“যে ভাত দেবে সেই লোকটি
যেতে যেতে বলে গেল
তোর খিদেটিদে কিচ্ছু নেই
তুই ভীষণ মিথ্যুক”
কবিতাটি নাম ছিল ‘মিথ্যুক’। আটের দশকের সেই সময়টিকে এই কবিতায় তিনি ধরেছিলেন।
‘আমি স্বাভাবিক’ আরেকটি কবিতায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে লিখেছিলেন—
“অমৃত করেছি পান দুই হাত পেতে
বিষ যে খাইনি তা-ও নয়—
অমর হইনি—-
কিন্তু মৃত্যুও আসেনি ডেকে নিতে
জ্বর হয় শীত করে ঠা-ঠা রোদে গরমে ঘামাই…
এক পা দুয়ারে রাখি অন্য পা উঠোনে
মৃত্যুকে সমীহ করি
সংসারের ধর্মে হেঁটে যাই—”
মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়েই সংসার ধর্মে অবিচল ছিলেন।তবু উঠোন আর দুয়ারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন মৃত্যুর।
বাংলা কাব্যজগতে ছয়ের দশকের কবি রত্নেশ্বর হাজরার জন্ম গ্রহণ করেন অবিভক্ত ভারতের বরিশাল জেলার ভরতকাঠি গ্রামে, ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে। মাত্র ১২ বছর বয়সে পিতৃহারা বালক বাঁধনহারা হয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন।
১৯৪৬-৪৭-এর দাঙ্গার অভিঘাতে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসেন কলকাতায়, আত্মীয়ের আশ্রয়ে শুরু হয় নতুন জীবন। স্কুলজীবন শেষ করে চাকরির উদ্দেশ্যে মোটর মেকানিজম শিখতে শুরু করেন। এরপর বৃত্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থার্মোমিটার তৈরির একটা কারখানায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু দুটিই ছিল অসমাপ্ত, তাঁর উপযোগী ছিল না। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে চাকরিতে যোগ দেন এবং সেখান থেকেই অবসর।
কলেজ-জীবন থেকে কবিতাচর্চার শুরু। লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া তখনকার ‘ভারতবর্ষ’ ও ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রভৃতি ঐতিহ্যশালী পত্রিকাতেও তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিষণ্ণঋতু’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। এর পর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে’লোকায়ত অলৌকিক’,’জলবায়ু’, ‘গতকাল আজ এবং আমি’, ‘এদিকে দক্ষিণ’, ‘রাজি আছি’, ‘উপত্যকায় একা’, ‘আছি নির্বাসিত’, ‘নিজস্ব মানচিত্র’, ‘শেখানো ছবিগুলো’, ‘ধুলোস্নান’ প্রভৃতি। লিখেছেন ছোটদের জন্য ছড়া/কবিতার বই— ‘মেঘের দিদা বরফদানা’, ‘রত্নমালার যাদুকর’, ‘সবুজ পরিকে নেমন্তন্ন’, ‘মাটির ঘড়া স্বপ্নে ভরা’, ‘অলীকপুর একটু দূর’ প্রভৃতি। অনুবাদ করেছেন জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ ও কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’। প্রকাশিত হয়েছে দুই খণ্ডে ছয়টি কাব্যনাটকের সংকলনও।
রত্নেশ্বর হাজরার কবিতায় আছে আঙ্গিক-সচেতনতা,সময় ও ইতিহাস চেতনার উপাদান, রহস্যময় ভৌগোলিক পরিবেশ,দার্শনিক উপলব্ধির এক ভিন্ন জগৎ, প্রতিবাদী সত্তার টানটান শিরদাঁড়া এবং
জীবনের ভগ্নস্বর ও দীর্ঘশ্বাস। যতিচিহ্নহীনতা তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ছোটদের জন্য লেখা কবিতায় পাওয়া যায় গ্রামবাংলার জলকাদার গন্ধ,নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন, শোনা যায় সুপুরিবাগানের ঘুঘুর উদাস-করা ডাক, ছবি হয়ে ওঠে বনপিপুল, অম্লবেতস, আমলকী, শতমূলী প্রভৃতি গাছপালা ঝোপঝাড় দৃশ্যের অনুষঙ্গ।
বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন কবি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির অভিজ্ঞান পুরস্কার, মহাদিগন্ত
পুরস্কার, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত স্মৃতি সম্মাননা, শিশুসাহিত্য পরিষদ পুরস্কার প্রভৃতি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ