spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিক'আল মাহমুদ পদক' অনুষ্ঠান : ব্যক্তিগত বয়ান

লিখেছেন : মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন

‘আল মাহমুদ পদক’ অনুষ্ঠান : ব্যক্তিগত বয়ান

  • মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন

  • সকল প্রশংসা কেবলমাত্র তাঁর,
  • দয়া ও করুণা যাঁর অসীম অপার।

নাবিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ,ঢাকা কতৃক আয়োজিত আজকের ‘আল মাহমুদ পদক ২০২৪’ প্রদান অনুষ্ঠানের প্রিয় সভাপতি কবি তাসনীম মাহমুদ, প্রধান অতিথি ড. মাহবুব হাসান, প্রধান আলোচক জনাব যাকিউল হক জাকী, পদকপ্রাপ্ত প্রিয়জন কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক সায়ীদ আবুবকর, পদকপ্রাপ্ত আরেক প্রিয়জন, যিনি বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী, ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ বিপ্লব, তিনি আসতে না পারায় তাঁর পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই কেউ এসেছেন, বিশেষ অতিথিবৃন্দ যথাক্রমে কবি মুজতাহিদ ফারুকী, কবি জাকির আবু জাফর, আবৃত্তিকার মাহবুব মুকুল, জনাব আবদুর রহমান, কবি আফসার নিজাম, শুভেচ্ছা বক্তব্য পেশকারি যথাক্রমে কবি সালেহ মাহমুদ, কবি সরদার আব্বাস উদ্দীন, প্রাবন্ধিক সীমান্ত আকরাম এবং সম্মানিত সুধীজন – আপনাদের সবার প্রতি প্রথমেই রইলো আমার সালাম ও আন্তরিক প্রীতি। সেই সাথে ‘নাবিক’-এর সকল নাবিকদের প্রতিও রইলো আমার প্রীতি, যাঁরা সৎ সাহিত্যের প্রতি আন্তরিক দায়বদ্ধতা থেকে এমন একটি আলোকিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। আর এ ক্ষেত্রে সম্পর্কসূত্র হিসেবে কাজ করেছেন বাংলার কবি, বিশ্বের কবি এবং বিশ্বাসের কবি আল মাহমুদ। সেজন্য তাঁকেও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

যেহেতু আজকের আয়োজনের এবং আপনাদের সাথে আমার আত্মার আত্মীয়তার সম্পর্কসূত্র আল মাহমুদ, সেহেতু তাঁর সম্পর্কে, তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে যদি কিছু না বলি, তাহলে সেই বলা শুধু অসম্পূর্ণই থাকবেনা, অপ্রাসঙ্গিকও হয়ে থাকবে।

আল মাহমুদের সাথে আমার সামান্য সম্পর্কসেতু কিভাবে স্থাপিত হয়, সে সম্পর্কে কিছু বলার আগে স্বীয় সাহিত্য সংলগ্নতা নিয়ে যদি কিছু না বলি, তাহলে পুরো প্রসঙ্গ বা পরিস্থিতিটাই কিছুটা কুয়াশার মতো মনে হবে। ফলে অনিচ্ছা সত্বেও কিছু ব্যক্তিগত কথা চলে আসবে। সেজন্য সূচনাতেই সবার কাছে বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসেন আমার শ্রদ্ধেয় বড় দাদু মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (র.)[আনুমানিক ১৮৮৫-১৯৬০)-এর নাম – নিজ সমকালে একজন বিশিষ্ট বিদ্বান, বুজুর্গানে দ্বীন ও আরবি-ফারসি কবি হিসেবে দেশে ও বিদেশে ছিলো তাঁর সুনাম ও সম্মান। তিনি সর্বোচ্চ লেখাপড়া করেছিলেন প্রথমে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর মাযাহির-এ-উলুম মাদ্রাসায় এবং সর্বশেষ দুনিয়াখ্যাত দেওবন্দ দারুল উলুম(বিশ্ববিদ্যালয়)-এ। তিনি ছিলেন উভয় বিদ্যাপীঠের সোনালি সময়ের ছাত্র। উভয় বিদ্যাপীঠে উল্লেখযোগ্য উস্তাদ হিসেবে তিনি যাঁদেরকে পেয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন জ্ঞান-আকাশের এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আধ্যাত্মিক পথের আলোকপিয়াসী যাত্রী। বিশ্বনন্দিত তো বটেই। যেমন শে’খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান (র.), সৈয়দ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি (র.), সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.), মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (র.), হাকিমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.) ও মওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী প্রমুখ। বড়দাদুর রূহানী রাহবার ছিলেন শে’খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান (র.)। বিশ্বখ্যাত তফসিরগ্রন্থ ‘তফসিরাতে মারিফুল কুরআনে’র রচয়িতা মুফতি মুহাম্মদ শফি (র.) ছিলেন তাঁর সহপাঠী ও সুহৃদ।

আমার জন্ম আনুমানিক ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মান্দারবাড়িয়া গ্রামে। বড়দাদু মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬০ সালে। সেই ছোট বয়সে তাঁর স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। তবে তাঁর প্রীতি ও দোয়ার কথা মুরব্বিদের মুখে শুনে শুনে আমার মনে একধরণের আধ্যাত্মিক আকুলতা দোলা দিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর দেখতাম, তাঁর মাযার যিয়ারত করার জন্য দেশের নানান প্রান্ত থেকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে আসতেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে আমাদের বাড়ি হওয়ায় মানুষজনের যাওয়া-আসার ব্যবস্থা ছিলো সহজ ও স্বাভাবিক। বড় বড় আলিম-মাশায়িখ ও কবি-সাহিত্যিকদেরও আগমন ঘটতো আমাদের বাড়িতে। একদিন আমাদের বাড়িতে ঢাকা থেকে যিয়ারত করতে আসা একজন বয়স্ক-যুবকের সাথে আলাপ করে জানতে পারি তিনি নজরুল-বন্ধু ও ‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়’-এর লেখক কবি সুফী জুলফিকার হায়দার। ততোদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে এবং আমি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণের পথে। তখন নজরুল ছিলেন আমার নায়ক। তাঁর বন্ধু সুফী জুলফিকার হায়দারকে কাছে পেয়ে তখন আবেগে আমার অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো। তাঁর কাছ থেকে নজরুলের, বড়দাদুর স্মৃতিকথা শুনতাম, কবিতা আবৃত্তি শুনতাম এবং নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করতাম। মুরব্বিদের মুখে শুনেছি, চল্লিশের অন্যতম আধুনিক কবি আবুল হোসেন চাকুরি উপলক্ষে যখন চট্টগ্রামে বাস করতেন, তখন বড়দাদুর দর্শন ও দোয়া লাভের জন্য প্রায়ই তাঁর দরবারে আসতেন। বড়-ছোট আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক আসতেন। একদিকে বড়দাদু আরবি-ফারসি কবি ছিলেন, অন্যদিকে তাঁর কাছে যাঁরা আসতেন তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ ছিলেন কবি, পাশাপাশি পল্লী প্রকৃতির কাব্যিক পরিবেশে বেড়ে উঠায় কেন জানি কবিতার প্রতি আমার সহজাত প্রেম জাগ্রত হতে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সেই প্রেম প্রণয়ে পরিবর্তিত হতে থাকে। এমনই হয়ে গিয়েছিলো হাল – আমি হয়ে পড়ি কবিতার কাঙাল। কিন্তু গ্রামে বাস করায় প্রতিভা প্রকাশের কোনো সূযোগ ছিলোনা। তখন নজরুল, জসীম উদ্দীনের কবিতাই আমাকে আকৃষ্ট করতো অধিক। বয়সের চঞ্চলতার কারণে রবীন্দ্রনাথের কবিতার গভীরতা তখনো স্পর্শ করতে পারিনি আমাকে। একবার প্রতিভা প্রকাশের সূযোগ পেয়েও প্রাচীন ধারার পদ্য লেখার কারণে সেটা হাতছাড়া হয়ে যায়। সেটা ১৯৭৮ সাল। তখন আমি নিজামপুর কলেজের (বর্তমানে সরকারি কলেজ) বিকম ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। কলেজে তখন সাংস্কৃতিক সপ্তাহ চলছে। একটি দিন নির্ধারিত ছিলো স্বরচিত কবিতা পাঠের জন্য। সেদিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রবীণ সাহিত্যিক আবুল ফজল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রাচীন ধারার পদ্য জমা দেওয়ার কারণে আমার কবিতাটি পাঠের জন্য অনুমোদন লাভে অসমর্থ হয়। কলেজের বাংলার অধ্যাপক হরিসাধন দাশ সেকথা জানালে মন মেঘলা হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। ঠিক হওয়ার কারণ, বন্ধু আবু জাফরের কবিতা পাঠের জন্য পায় অনুমোদন। আমার স্মরণশক্তি যদি এখনো থাকে ঠিক – তাহলে বলবো, তার কবিতাটি ভাবে ও ভাষায় ছিলো আধুনিক। শিরোনামটি ছিলো – ‘আমি এক প্রোটোপ্লাজমের বিন্দু’। যেন ভাবের সপ্তসিন্ধু! অনেকের আধুনিক কবিতা এর আগে পত্র-পত্রিকায় পড়লেও বিচ্ছিন্নভাবে – আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি কোনোভাবে। ব্যতিক্রম আল মাহমুদ। তাঁর কবিতা পড়ে আমি হয়ে যাই বুঁদ। পড়ার প্রেরণা পাই বন্ধু আবু জাফরের কাছ থেকে। সে-ই আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’ পড়ার পরামর্শ দেয় আমাকে। পরামর্শ ঠিক আছে, কিন্তু বই দুটি পাই কই? সে বছরই একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরি হলে চট্টগ্রাম শহর থেকে সংগ্রহ করি সেই দুটি বই। বই দুটো পড়ে নেচে উঠে বুকের বাম। মনে হলো – আগে পড়িনি এমন কালজয়ী কালাম। যতোই পড়ি ততোই লাগে ভালো। বন্ধুরা বলে – কি হলো! কি হলো! জবাবে বলি- কিছু হয় নাই। যদি হয়েও থাকে তা কিভাবে বোঝাই! কারণ কবিতা তো নয় যেনতেন ব্যাপার। ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার’!

সেই ১৯৭৮ সালে উত্তর পতেঙ্গাস্থ একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরি হয়ে যায় আমার। স্বজনরা বলতে লাগলো – চাকুরি তো হলো, এখন বউ দরকার! আমি বলি – সবাই যে বলছো বউ বউ, এমন বইপাগলকে কি পছন্দ করবে কেউ? অবশেষে ব্যাচেলর লাইফকে দিয়ে বিসর্জন – মর্জিয়া খানম নামের একজনকে করে নিই আপন। সেটা ১৯৮৩ সাল। এখনো ছায়ার মতো আমার সাথে তিনি আছেন বহাল। একদিকে চাকুরি, অন্যদিকে নতুন সংসার – দু’য়ের টানাটানিতে সাহিত্য খুঁজছিলো পথ পালাবার। কিন্তু পালাবে কিভাবে? আল মাহমুদের কবিতা শক্তি যোগাচ্ছিলো আমাকে প্রবলভাবে। পরিকল্পনা করি তাঁর ওপর কিছু করার। করতে গিয়ে সম্মুখীন হই প্রবল বাঁধার। তখন স্বৈরাচারী এরশাদের জামানা সবেমাত্র শেষ। সৃষ্টি হয় এমন এক পরিবেশ – কবি শামসুর রাহমান পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে পাঠিয়ে দেন একটি কালো তালিকা – কোথাও যেন ছাপা না হয় আল মাহমুদ গংদের কবিতা। চারিদিকে বয়কটের আহবান। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। তিনি দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায় একটি লেখা লিখে – বিরত থাকতে বলেন সবাইকে এহেন কাজ থেকে । পরিস্থিতি তখন ছিলো এতোটাই প্রতিকূল – কি করবো তার ভেবে পাচ্ছিলাম না কূল! কারো কারো সাথে সশরীরে গিয়ে করেছি বহুবার দেখা। সবার একইরকম জবাব – এহেন পরিস্থিতিতে সম্ভব নয় আল মাহমুদকে নিয়ে লেখা। বিজ্ঞাপন পাওয়ারও নেই সম্ভাবনা। তাই বলে হেরে যাবো – তা হবেনা। প্রত্যয় থাকলে পরাভব মানেনা প্রত্যাশা। আরম্ভ করে দিই কাজ আল্লাহর ওপর করে ভরসা। স্নেহভাজন সালাহউদ্দীন আইয়ুব তখন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তুখোড় ছাত্র। সে সংগ্রহ করে দেয় আল মাহমুদকে লেখা মননশীল মানুষদের মূল্যবান সব পত্র। সেগুলো শুধু পত্রই ছিলোনা, ছিলো তার চেয়েও বেশি। জহুরির কাছে মনে হবে- এ তো মূল্যবান জহরতরাশি। কথায় আছে- ইচ্ছে থাকলে হয় উপায়। কিছু লেখাও সংগ্রহ করে ফেলি অনেক চেষ্টায়। কিছু লেখা পুরনো হলেও মূল্যবান হওয়ার কারণে – নতুন লেখার সাথে সেগুলোও পাঠিয়ে দিই মুদ্রণে। অবশেষে অবসান হয় অপেক্ষার। ‘উপমা’- আল মাহমুূদ সংখ্যা আলো দেখতে পায় ঊষার। আমি ভাবতেও পারিনি, প্রকাশের সাথে সাথে – এতো সাড়া পাবো সারা দেশ থেকে! শতের ওপর কপি পাঠিয়েছিলাম কলকাতাতেও। প্রচুর সাড়া পেয়েছিলাম সেখান থেকেও। তখন বুঝতে পারি- ভালোবাসার কাছে টিকতে পারেনা বিদ্বেষ। তারি ফলশ্রুতিতে অল্পসময়ের মধ্যে ‘উপমা’-র সব কপি হয়ে যায় শেষ।

যখন দেখি, ‘উপমা’ নিয়ে চারিদিকে এতো উৎসাহ ও উপযোগীতা এবং প্রশংসার প্লাবন – প্রজাপতি হয়ে যায় মন – ধন্য মনে হয় এই জীবন। যখন ‘উপমা’ নিয়ে নিজের উপলব্ধি করেন প্রকাশ খোদ আল মাহমুূদ, তখন উসুল হয়ে যায় একসাথে আসল ও সুদ। যেমন ‘দশ দিগন্তে উড়াল’ নামক স্মৃতিচারণধর্মী এক ধারাবাহিক লেখায় – আল মাহমুদ আমার সম্পর্কে, আমার কাজ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা আমাকে আপ্লুত করে মুগ্ধতায়। তিনি লিখেছেন, “এর আগেও চট্টগ্রাম থেকে উপমা বলে একটা পত্রিকার আল মাহমুদ সংখ্যা বেরিয়েছিল। সেটা করেছিলেন নিযামুদ্দীন নামে এক সাহিতপ্রেমিক। ওই সংখ্যাটিতে আমার সম্পর্কে অনেক তথ্য তিনি সংযোজন করেছিলেন। যা দেশে-বিদেশে আমার ওপর জানতে চাওয়া লেখকগণের জন্য তৃপ্তিদায়ক হয়েছিল। আজ সেকথা স্মরণ করে আমি নিযামুদ্দীনের কাছেও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।”(দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮)। অন্যত্র এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছেন, “উপমা-র কাজ তো আমাকে চির জাগরূক রেখেছে। জনাব নিযামুদ্দীন, মানুষ যা পারেনা, সেটা আমাকে নিয়ে করতে গিয়েছিলো। তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। এ ধরনের কাজের কোনো তুল্য-মূল্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাইনা। পরে হয়তো অনেকে আমার ওপর বিশেষ সংখ্যা বের করেছেন। সবগুলোই সুন্দর, কিন্তু ঐতিহাসিক সম্মানটা সকলে নিযামুদ্দীনকে অর্পণ করেছে। আমি নিজেও।” (অবিনশ্বর – আল মাহমুদ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ঢাকা ; সম্পাদকঃ ফরিদা হোসেন, অতিথি সম্পাদকঃ মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, পৃ- ১৯৭)। আল মাহমুদ আমার সম্পর্কে, আমার কাজ সম্পর্কে প্রশংসা করেই থাকেননি থেমে। এমন মানুষ এখন কোথায় পাবো এই ধরাধামে? নিজের একটি বই উৎসর্গ করেও করেছেন আমাকে ধন্য, যদিও মানুষ হিসেবে আমি অতি নগণ্য। বইটি উৎসর্গ করেছেন আমি সহ চারজনকে। বাকিরাও আল মাহমুদকে নিয়ে কাজ করেছেন আন্তরিকভাবে প্রত্যেকে। তাঁরা হলেন সালিম হাসান, সাজ্জাদ বিপ্লব ও ওমর বিশ্বাস। তাঁদের ভালোবাসায়ও আল মাহমুদ করেন সদা বাস। যে বইটি উৎসর্গ করেছেন, ‘কবিশিল্পীদের মাতৃভূমি প্যারিস’ নাম তার। অক্টোবর ২০০২-তে বইটি বের হলে সানুরাগ সুদৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয় সবার।

উপমা- আল মাহমুদ সংখ্যার সাফল্যের পর এর আরো একটি সংখ্যা প্রকাশের চিন্তা আসে আমার মনে। সেকথা আমার কাছের লোক অনেকেই জানে। সেই লক্ষ্যে কিছু লেখাও সংগ্রহ হয় আমার। তার সাথে আগের অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত কিছু লেখা নিয়ে সমৃদ্ধ হয় সংগ্রহের ভাণ্ডার। কিন্তু পরিকল্পনাকে প্রকাশে রূপ দিতে গেলে তো চাই টাকা। কিন্তু আমার পকেট তো ফাঁকা! দ্বারেদ্বারে গিয়ে যে বিজ্ঞাপন চাইবো, সেই প্রতিভা আমার নেই যে হায়! তাহলে কি উপায়? কথায় আছে- চেষ্টা করলে উপায় একটা হবেই হবে। চেষ্টা ছাড়া সফল হয়েছে কি কেউ ভবে? সম্ভবত ২০১৪ সালের মাঝামাঝি, উক্ত প্রসঙ্গে কথা উঠলে শ্রদ্ধেয়া ফরিদা হোসেন – অকৃত্রিম আন্তরিকতায় এগিয়ে আসেন। তিনি প্রস্তাব দেন পরিকল্পনাটি তাঁর পত্রিকা ‘অবিনশ্বর’-এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার। সেই সাথে প্রস্তাব দেন আমাকে সংখ্যাটির অতিথি সম্পাদক হওয়ার। কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাও থাকবে আমার। যেখানে ব্যক্তিগতভাবে ও বিজ্ঞাপন সংগ্রহের মাধ্যমে তিনি বহন করবেন প্রকাশনার ব্যয়ভার, সেখানে চিন্তা করার আছে কি দরকার? অতএব ঝেড়ে ফেলে সকল দুশ্চিন্তা ও লাজ – দ্রুত শুরু করে দেওয়া চাই কাঙ্ক্ষিত কাজ। কাজ শুরু করে দিলে পরে – পরিশ্রম করতে থাকি রাতদিন এক করে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিশ্রমের ছিলো ভালো লেখা নির্বাচন ও প্রুফ দেখা। সবকিছু সামাল দিয়েছিলাম আমি একা। তখন এমন অবস্থা হয়েছিলো আমার – সময় ছিলোনা সংসারের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার। এরিমধ্যে ফরিদা আপা জানালেন আমাকে ফোন করে – ‘অবিনশ্বর’ আল মাহমুদ সংখ্যা প্রকাশিত হলে পরে – ঢাকায় একটি প্রকাশনা উৎসব করবেন তার – যাতে উপস্থিত থাকবেন সাহিত্যের যতো সমঝদার। আল মাহমুদকেও তাতে করবেন আমন্ত্রণ। এবং কবিই করবেন উৎসবের উদ্বোধন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই সৌভাগ্য হয়নি আর। ‘অবিনশ্বর’ – আল মাহমুদ সংখ্যা সূর্যালোক দেখার আগেই ২০১৯-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি শুভ শুক্রবার – প্রিয় কবি আল মাহমুদ আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান মৃত্যুর ওপার। রেখে যান সীমাহীন স্মৃতি ও প্রীতির বাহার। রেখে যান মৌলিক ও মননশীল মহৎ সৃষ্টিসম্ভার। যে একটি ভাঙা ট্রাঙ্ক নিয়ে একদিন তিনি এসেছিলেন ঢাকা শহরে – মাছ, গাছ, ফুল, পাখি, নদী, প্রকৃতি প্রভৃতি ছিলো তার ভেতরে। সেই স্বপ্নকে তিনি ভালোবেসে – ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারা বাংলাদেশে। গ্রাম নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন ঠিক, কিন্তু তাঁর পরিবেশনের পেয়ালাটা ছিলো একেবারে আধুনিক। কোনোরকম গ্রাম্যতা স্পর্শ করতে পারেনি সেখানে। তাই তো তাঁর কবিতা এতো সমৃদ্ধ গুণে ও মানে। তাঁর কবিতা জসীম উদ্দীন ও জীবনানন্দের প্রভাব থেকে পুরোপুরি পৃথক। স্বীয় কাব্যপ্রতিভার গুণে তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এমন অপূর্ব আনন্দলোক। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন যেসব উপাদান – তাঁর কবিতায় সেসবও সবল ও সাবলিলভাবে বিদ্যমান। কবিতার প্রতি দুর্বল হলেও দুর্বল কবিতা তিনি লিখেননি কখনো। কবিতায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কি তখনো, কি এখনো – নেই কোনো। তাঁর মতো সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রে মৃত্যু মানে নয় শেষ। মনে রাখতে হবে – আল মাহমুদ মানে আবহমান বাংলাদেশ। বাংলার মাটির গভীরে কাব্যের শেঁকড় যার – তাকে উপড়ে ফেলা বা উপেক্ষা করা সাধ্য কার? সেটা সম্ভব নয় কখনো। কারণ তাঁর সমকালে তো বটেই ,তাঁর পরেও এমন মৌলিক প্রতিভাধর কোনো কবি বাংলার জমিনে জন্মগ্রহণ করেনি এখনো। জন্মগ্রহণ করেও যদি কোনোদিন – শোধ করা যাবেনা তাঁর সৃষ্টির ঋণ। আমার নিজের অভিব্যক্তি যদি ব্যক্ত করি – অসম্ভব তাঁর সৃষ্টির ঋণ শোধ করি। শুধু এটুকু বলতে পারি – তাঁকে কখনো ভুলতে নারি। যখনই পড়ি আল মাহমুদ – তাঁর কাব্যের নান্দনিক নেশায় হয়ে পড়ি বুঁদ। এ এক এমন নেশা – ছাড়েনা সহজে। তাইতো সেই নেশায় মজি নিজের গরজে, যা কিনা তরঙ্গ তোলে মনে ও মগজে।

অনেকের ক্ষোভ, জীবদ্দশায় যোগ্য সম্মান প্রদান করা হয়নি আল মাহমুদকে। সবসময় একধরণে উদ্দেশ্যমূলক উপেক্ষা কাজ করেছে তাঁর বিরুদ্ধে। শুধু জীবদ্দশাতেই নয়, জীবনাবসানের পরও তাঁর কবরের জন্য জায়গা জোটেনি ঢাকার বুকে। জুটবে কিভাবে? তিনিতো পতিত সরকারের পদলেহন করেননি কখনো, প্রয়োজনে প্রতিবাদ করেছেন। আমি মনে করি, এ নিয়ে মন খারাপ করার বা মান করার কিছু নেই। কেননা, মেধাবী মানুষদেরকে চিরকাল এধরণের উপেক্ষা ও উপহাসের মধ্য দিয়ে এগুতে হয়। বাধা ও বদনামের মুখোমুখি হওয়া যেন তাদের নিয়তি। তাছাড়া স্বভাবে যে মাছি – ময়লাতেই তো সে করবে নাচানাচি! ফুলের সাথে তো তার চির দ্বন্দ্ব। কিভাবে বুঝবে সে গোলাপ ফুলের গন্ধ? হিন্দি কবি তো আরো সুন্দরভাবে বলেছেন-

   গলি গলিমে গরজ ফিরতা,
   মদিরা বইঠে বিকায় ;
   সতী নারীকো ধৌতী নেহি মিলে
   কমিনা পিনহে খাসা।

অর্থাৎ-

   দুধ বিক্রি হয় গলিতে গলিতে করে ফেরি,
   এক স্থানে বসে চলে মদের দোকানদারী।
    সতী নারীর জোটেনা পোশাক অঙ্গ ঢাকার,
    বারবনিতার অঙ্গে সে কি রূপের বাহার!

পৃথিবীতে প্রকৃত সাহিত্যের সাথে পণ্য সাহিত্যের যে দ্বন্দ্ব চলছে, সেক্ষেত্রে আল মাহমুদের পক্ষ নিয়ে আপনারা যে সাহস ও সততার পরিচয় দিয়েছেন, তা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃত সাহিত্যকে সমর্থন করারই সামিল। এই আলোকিত আয়োজনের পেছনে প্রজ্ঞা, প্রতিভা, পয়সা, পরিশ্রম ও সময় বিনিয়োগ করে আপনারা যে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য প্রশংসা করলেও তা কম হবে। আল মাহমুদ পদক-২০২৪ প্রদান করে আপনারা সত্যিই আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে ও আত্মার আত্মীয়তায় আবদ্ধ করলেন। সেজন্য আবারও আপনাদেরকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ উপস্থিত সবাইকে।

………..
২৮/০৯/২০২৪
স্থানঃ বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তন,
ঢাকা প্রেসক্লাব সংলগ্ন, পল্টন, ঢাকা।
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, বিকেল ৪টা

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ