প্যালেস্টাইন
………….….
উৎসর্গ : বুলবুল সরওয়ার, যিনি সুস্থ হয়ে উঠে প্যালেস্টাইনের জন্য কলম ধরবেন
………………
আমার মা ইলশা নামক গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম
শহরে ঢুকেছিলেন সল্টগোলা নৌকা ঘাট ধরে
আমি তখন চার বছর মায়ের অন্তর্মুখী আনন্দ
উদ্বেগ মনে হয় আজকেও টের পেয়ে যাই
মনে আছে বাংলাদেশ বলতে আমি আরও
পরেও কিছু বুঝিনি পৃথিবী বুঝে গিয়েছিলাম
বন্দরের শত শত জাহাজগুলো এক
পারলৌকিক কাঙ্ক্ষিত ভয়ের সাথে আমার
বিস্মায়াবিষ্ট চোখে বলেছিল, পৃথিবীতে এসে
পড়েছো হে শিশু!
তখনও নৌকার স্মৃতি চোখের পাড়ায় মৃদু হেলে হেলে
চলেছে,আজও চলে, ক্ষুদ্রাতি নৌকার
সমুখ গলুইয়ে যখন দাঁড়িয়েছিলাম এই প্রথম
পানিকে আমি ভয় পেয়েছিলাম প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ
পানি অভাবিত ব্যাখ্যাতীত জাহাজের গায়ে
ধাক্কা খেয়ে অপমানে আমাদের গ্রাম ছেড়ে
আসা সাম্পানের সাথে তার আক্রোশ
ঝাড়তেছিল, পিতা বলে,শক্ত করে ধর
পরে আমি কুলে এসে শক্ত করে ধরার কথা
মনে রাখিনি
আমার মাও অগাধ মমতার শরীর অশক্ত করে
আমাদের জন্য বিছিয়ে দিয়েছিলেন আমরা
অজস্র ভাই বোন তাঁর জটর খুলে নেমেছি
পৃথিবীর হাটে
একবারও বলেনি স্কুলে যা কেবল রুটি
বানাতেন মাসে একবার দেশী মুরগির প্রচলন
করেছিলেন কীভাবে হায় পিতার মাসিক ছয়শ
টাকা বেতন হয়েছে
পৃথিবীর জীবনে এসে একটুকরো দু’টুকরো
গ্রামের স্মৃতি – দল বেঁধে বানু জারিয়া খালা
বেলাল ভাই অনেক ঝাপসা আত্মীয় স্বজন এক
করুণ জোছনা বিদুর রাতে আমাদের গ্রাম
ছাড়ার দিনে মোশারফ মিঞা বাজার ঘাটে
ফেলে গিয়েছিল–
জাহাজের ভয়ে ভয়ে চোখের পাড়া ছেড়ে চলে
যেত ক্রমে আমাদের নতুন জীবন হস্তগত হল
সেই গ্রাম ছেড়ে পৃথিবীমুখী নৌকার সমুখ গলুই
আমার জন্য কবিজীবন বেছে দিয়েছিল আমার
মা ছিলেন কবি কেননা দিনরাত পরম মমতায়
রুটি ও পরোটা বানাতেন কীভাবে জানি না
আমার পিতার তখন বেতন ছয়শ টাকা হয়েছে
মাঝে মাঝে সেই সল্টগোলা ঘাটের কাছে
ক্যাফে শুককুর থেকে আমি নানরুটি কিনে
নিয়ে যেতাম এইসব বৈভব আমাদেরই জীবনে
হয়েছে বাস্তব আর খুশীতে পৃথিবীতে ছড়িয়ে
যেতাম তখন একদিন এল সেই বিষাদের রাত
মুসা কাকার ঘরে আমরা ঝাঁক ধরে টেলিভিশন
দেখতে যেতাম ফলে একদিন সেই মহাবিস্তার
বেদনার রাত নিয়ে ফজলে লোহানী আমার
কানে রেখে দিল, প্যালেস্টাইন!
আমি আজও জানি না সেই মহাকালীন দুঃখের
সাথে আমি কীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম
সীমাহীন ব্যাখ্যাহীন রক্তের প্রকৃত ঠিকানার
মতো অথচ অগম্য রুদ্ধ
আমার মা গ্রামভিটা ছাড়ার ক্ষতবোধ আর
শহরজীবন নিয়ে সংশয় আর অনটন দূর হবার
স্বপ্ন নিয়ে পরপার হয়ে গিয়েছেন তিনি জানতেন
না আমার কানে প্যালেস্টাইন স্থির হয়ে ছিল
আর চোখে কিছু রক্তরাগ কিশোরের
উল্কাপিণ্ডের মতো ধাবমান লক্ষ্য নিচয়
আমার মা’য়ের সাথে ইলশা গ্রাম থেকে এক
জোছনা আলোক রাতে আমি পৃথিবীর পারে
এসেছিলাম
পরিমিত অন্ন যোগাড়, অনটন দূর হবার স্বপ্ন
অপূর্ণ রেখে মা গিয়েছে পরপার
আমার জীবন আজও
রক্তরাগ অপরিমেয় পথ প্যালেস্টাইন