তাজ ইসলাম
৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য দিন।এদিন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে প্রায় সাড়ে আট শত বছর পর। কোন দেশের শাসকের পলায়ন ইতিহাসে উল্লেখ করার মতো ঘটনা হয়েই থাকে। অত্যাচারী রাজা লক্ষণ সেন পালিয়ে যাওয়ার পর শত শত বছরের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় ঘটনা এই ভূ অঞ্চলে।
জয় পরাজয়,উত্থান পতনের ইতিহাস আছে। পরাজয়ের ইতিহাস শেখ হাসিনার ললাটেই জুটেছে।অথচ তিনিসহ তার নেতানেত্রীরা অহংকার করে বলতো ‘ পালাব না’। তারাই শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেল।
জুলাই বিপ্লবের সমাপ্তি টেনে দিয়েছিল শেখ হাসিনার পলায়ন।
সেদিন ঢাকা শহরে লাখে লাখে,কোটি জনতার জোয়ার নেমেছিল।পালিয়ে যাওয়া ছাড়া শেখ হাসিনার সামনে আর কোন বিকল্প অবশিষ্ট ছিল না। লক্ষ কোটি জনতা সেদিন ঘেরাও করেছিল খুনি হাসিনার গণভবন খ্যাত সরকারী বাসভবন। মানুষের মনে ছিল পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। বিক্ষুব্ধ জনতা হাসিনাকে না পেয়ে তার বাসভবনে প্রবেশ করে।উল্লাস প্রকাশ করে নানাভাবে। জুলাইয়ের গণহত্যা ছাড়াও বিগত পনর বছর তার শাসনামল ছিল দুঃশাসনের অন্ধকার যুগ। টানা পনের বছরে হাসিনা লুট করেছিল মানুষের ভোটের অধিকার। হরণ করেছিল কথা বলার স্বাধীনতা। দুর্নীতির আখড়া হয়েছিল প্রশাসন। হত্যা,গুম,বিদেশে অর্থ পাচার করে দেশকে করেছিল পঙ্গু। দেশ কার্যত হয়ে গিয়েছিল প্রতিবেশীর করদ রাজ্য। দেশবাসী ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জন বিস্ফোরণ ঘটল। জনতার দ্রোহ থামাতে হাসিনা রক্তের বন্যা বইয়ে দিল। শত শত তাজা প্রাণ বুলেটে নিঃশেষ করে দিল।লেলিয়ে দিল স্বৈরাচারের খুনি পুলিশ,সন্ত্রাসী লীগারদের। রক্তের বন্যায় ভেবেছিল থেমে যাবে আন্দোলন। না থামেনি।থেমেছে তারা জালেম যারা। হাসিনার অত্যাচারে, তার নির্মমতায় ছাত্র আন্দোলনটি হয়ে গেল সরকার পতন আন্দোলন।সর্বস্তরের জনতা সে আন্দোলনে একাত্ম হলেন। কবি,সাহিত্যিক,সাংবাদিক,সাংস্কৃতিক কর্মী সবাই দ্রোহ করলেন। শিল্পী তার গানে, সাংবাদিক তার প্রতিবেদনে,বিপ্লবী তার শ্লোগানে প্রকাশ করলেন দ্রোহ।তারা নিজ নিজ অঙ্গনে কাজ করেছেন এবং মাঠে ময়দানে হাতে হাত মিলিয়ে বজ্রকণ্ঠে স্লোগাণও তুলেছেন।
কবিরা সাধারণত কবিতা লিখেই প্রতিবাদ করেন।এবার কবিদের বিশাল অংশ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে ছিলেন সক্রিয়। কবিতাও লিখেছেন।
কবিরা লিখেছেন দ্রোহের কবিতা।এসব কবিতায় আছে দ্রোহ, আছে পতিত সরকারের জুলুম নির্যাতন,অনিয়ম,অত্যাচারের কথা।কবিগণ লিখেছেন বিপ্লবীদের সাহসের কথা, ত্যাগের কথা।তাদের কবিতায় চিত্রিত হয়েছে খুনি হাসিনার পুলিশ,বিজিবি, র্যাব, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবের কথা। কবিদের কবিতায় আছে ছেলে হারা মায়ের আর্তনাদ, আবার মিছিলে ছেলের পাশে দাঁড়িয় সাহস দেওয়া সংগ্রাসী মায়ের প্রশংসা।
প্রায় দেড় শতাধিক কবির কবিতা নিয়ে সীমান্ত আকরাম করেছেন এই প্রেক্ষাপটে রচিত কবিদের কবিতা নিয়ে একটি সংকলন। নাম দিয়েছেন ‘দ্রোহের কবিতা’।
‘দ্রোহের কবিতা ‘ শুধুমাত্রই কবিতার সংকলন। গণবিপ্লব ২০২৪ এর কবিতা সংকলন। এই সকলনে প্রায় দেড় শতাধিক কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। ‘২৪ এর গণবিপ্লবের কবিতা সংকলনে শুরুতেই স্থান পেয়েছে প্রখ্যাত কবি,রাষ্ট্র চিন্তক ফরহাদ মাজহার’র কবিতা।কবিতাটি বিপ্লবের। এই ধরণের কবিতা মূলত চিরকালীন বিপ্লবের কবিতা। নির্ধারিত বিপ্লব,নির্দিষ্ট সময়কে এসব কবিতা অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণের আওতায় চলে যায়। সে হিসেবে এই সংকলনে স্থান দেওয়া ঠিক আছে। তবে যেহেতু স্লোগান আছে ‘গণবিপ্লব ২৪ এর কবিতা সংকলন সেমতে এগুলো এড়িয়ে যাওয়াই বেহতর ছিল।
২৪ এর বিপ্লবকে কেন্দ্র করে লেখা কবিতা স্থান পেলে সংকলনের জৌলুশ বৃদ্ধি পেত। এখানে দুইটা কথা।
১. দ্রোহের কবিতা।কথা এই হলে এই সংকলনে দ্রোহের কবিতা হলেই হল। সুতরাং যেকোন কালে যেকোন দ্রোহকে কেন্দ্র করে রচিত কবিতা এই সংকলনে গ্রন্থিত হতেই পারে।
২. গণবিপ্লব ২০২৪- এর কবিতা সংকলন। কথা এই বলে এই সংকলনের সময়কে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ‘২৪ এ যত কবি যত কবিতা লিখেছেন তত কবির,তত কবিতা নিয়ে সংকলনই সুন্দর। এই ক্ষেত্রে একটু আলাদা টাইটেল ব্যবহার করে সিনিয়রদের পূর্বে লেখা কবিতা ছাপা যেতেই পারে। আরও উত্তম হত তড়িঘড়ি না করে সিনিয়রদের কাছ থেকে একটি করে কবিতা লিখিয়ে নিতে পারলে।
ফরহাদ মজহার’র কবিতাটি বিপ্লবীদের কাছে এমনিতেই প্রসিদ্ধ। তার কবিতার নাম
‘ আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে’। আছে কবি আল মুজাহিদীর কবিতা ‘ স্বাধীনতা,জেগে আছো?’ কবি মাহবুব হাসান, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজের কবিতার পর কবিতা আছে বিপ্লবের লাল কমরেড আবদুল হাই শিকদার’র কবিতা। তার কবিতার শিরোনাম, আমরা মানুষ আমরা এসেছি ‘।’ আমরা এসেছি জুলুম রুখতে দুর্বার আবাবিল/ আমরা মানুষ আমরা এসেছি দশ দিগন্ত থেকে’। কবিতাটি আমরা এসেছির সৌন্দর্যময়। হাসান হাফিজ,জাফরুল আহসান, চৌধুরী গোলাম মাওলার পর সতর্কবার্তা নিয়ে এসেছেন সোলায়মান আহসান। সোলায়মান আহসান তার পাঠকদের বলে দিচ্ছেন ‘ আমাদের লড়াইটা শেষ হয়নি’। তিনি আরও বলেন, ‘ আমরা রাজপথে গলি উপগলি ক্যাম্পাসে সর্বত্র হাজির থাকব/ আবার বলছি– আমাদের লড়াইটা শেষ হয়নি।’ হাসান আলীম তার কবিতায় সমন্বয় করেছেন ইতিহাস ও বর্তমানকে।তার কবিতার শিরোনাম ‘ সতেরো সওয়ারী: দ্বিতীয় স্বাধীনতা ‘। তিনি লেখেন,’ অবশেষে খিলজীর সতেরো সওয়ারী এলো বঙ্গ ভবনে,/ এলো সতেরো উপদেষ্টা –…।’ মোশাররফ হোসেন খান লিখলেন ‘ চব্বিশের কবিতা’। শরীফ আবদুল গোফরান,মুজতাহিদ ফারুকী,আশরাফ আল দীন,রহমান হেনরী,নাসির হেলাল,সাজ্জাদ বিপ্লব,
নূরুল হক,মাহমুদউল্লাহ লিখেছেন কবিতা। মাহমুদউল্লাহ মূলত ছড়াকার।তিনি ছড়া লিখেন।গ্রন্থিত লেখাটিও ছড়াই।
কবিতা থেকে ছড়াকে আলাদা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হতো।শহীদুল্লাহ ফরায়জী,বকুল আশরাফ,ফারুক হোসেন,আহমদ মতিউর রহমানের কবিতা আছে এই সংকলনে।
যে সাংবাদিক,বুদ্ধিজীবী কবি ও শিল্পী/ চোখের সামনে জুলুম,হত্যা এবং রোমহষর্ক ধর্ষণ দেখেও/ উটপাখির মতো মাথাগুঁজে পড়ে থাকে উন্নয়নের ঢিবিতে,/ অভিশাপ দিচ্ছি ইডিপাসের মতো– আপন মায়ের শয্যাসঙ্গী হয় যেন তারা,/( অভিশাপ দিচ্ছি: হাসনাইন ইকবাল)।’ হাসনাইন ইকবাল তার কবিতায় আরও অভিশাপ দিচ্ছেন খুনি পুলিশকে। তার প্রতিটা অভিশাপই ভিন্নরকম,ভিন্ন ব্যঞ্জনাময়।হাসনাইন খুনি পুলিশকে অভিশাপ দিচ্ছেন তার ঔরসে সময়ের সাহসী সন্তান আবু সাঈদের মতো কোন বীর যেন না আসে। অভিশাপ দেওয়া ঠিক কিনা এই প্রশ্নের বাইরে চূড়ান্ত কথা হল কবি অভিশাপ না দিলেও তারা অভিশপ্ত। খুনি পুলিশ,খুনি সেনা,বিজিবি স্বৈরাচারের দোসর,ফ্যাসিস্টের প্রেতাত্মারা নিঃসন্দেহে অভিশপ্ত। কবি শব্দের সৈনিক।বাক্য তার তীর। তার বক্তব্যই বুলেট।সুতরাং কবিতায় অভিসম্পাতই তার অস্ত্র।
জুলাই বিপ্লবের সময় উত্তপ্ত ছিল বাংলাদেশ।
এই সময় সমগ্র বাংলাদেশ ছিল দুই ভাগে বিভক্ত।একভাগে আওয়ামীলীগ।অপর অংশে সমগ্র বাংলাদেশ। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দেশকে মৃত্যু পুরিতে পরিণত করেছিল। রাজপথ ছিল তপ্ত। মিছিল,স্লোগানময় সারাদেশ। ছাত্র জনতা ছিল নিরস্ত্র। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের হত্যা করেছে নির্বিচারে। জন- মানুষের পক্ষের কবি,সাহিত্যিক সাংবাদিকগণও সোচ্চার ছিলেন নিজ নিজ জায়গা থেকে।এবারের আন্দোলনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তৎপরতা ছিল অভাবনীয়। কবিরাও তুমুলভাবে সক্রিয় ছিলেন কবিতায় কবিতায়। দেশে বিদেশে সকল বাংলাভাষী কবিগণের ছিল সরব উপস্থিতি। জুলাই বিপ্লবীদের ভাষায় সমাপ্ত হয় ৫ আগস্টে, ৫ আগস্ট তাই ছত্রিশ জুলাই । বিষয় বিপ্লব।তবে লিখেছেন প্রত্যেকে তার নিজস্ব বোধ বিশ্বাস থেকে। কবিতার বয়ানে,বক্তব্যে ভিন্নতায় কবিতা সৌন্দর্যময় হয়ে ধরা দেয়।
জুলাই বিপ্লবের নায়ক হয়ে হাজির হয়েছেন আবু সাঈদ,মুগ্ধ প্রমুখেরা। অধিকাংশের কবিতাতেই তারা এসেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। কবিতা পাঠ করলে জুলাইয়ের নানা চিত্র উপলব্ধি করা যায়। অনুধাবন করা যায় সরকারের দমন চরিত্রও।
‘ স্লোগানের উপর নেমে আসছে/ একদল হিংস্র লাঠি/ গরম জলের আক্রমণ/ সুসজ্জিত হেলমেট( স্লোগান : তাজ ইসলাম )। আফসার নিজাম’ র কবিতাটি একটু ভিন্ন রকম।কবিতার বক্তব্যে উৎকীর্ণ আছে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের চিত্র।আওয়ামী দুঃশাসনের আয়নাঘর চিত্র কবিতার ছত্রে ছত্রে। কবি আমিন আল আসাদ,মোস্তফা মাহাথির, তাসনীম মাহমুদ ধারণ করেছেন সময়কে। ফরিদ ভূঁইয়া’র কবিতা ‘তুমি ও বাংলাদেশ’, এই বাংলাদেশকেই কবি ইমরান মাহফুজ বলেন,বাংলাদেশটা আজকে কারাগার’। এভাবেই কবিতায় কবিতায় ভরে উঠেছে সংকলনের ভলিউম।
ছড়ার ভাষা সহজ, বক্তব্য সরাসরি। ছড়া যেকোন বিষয়কে ধারণ করে সহজে।বার্তা পৌছে দেয় সরাসরি।এই সংকলনে ছড়া লিখেছেন
নূরুজ্জামান ফিরোজ,নাসিরুদ্দীন তুসী, মাহফুজুর রহমান আখন্দ,আতিক হেলাল,রেদওয়ানুল হক,বিলাল হোসাইন নূরী,ফরিদ সাইদ,আরিফ বখতিয়ারসহ এ সময়ের সাহসী ছড়াকারগণ।
আমরাতো আর ডরাই না/…
নিরস্ত্র প্রাণ মারতে গুলি/
করছো হেলিকপ্টারে/ এমন ঘাতক কে দেখেছে/ ইতিহাসের চ্যাপ্টারে/…
আমরাতো আর ডরাই না/ সত্য বলার সাহস রাখি/ অহংকার আর বড়াই না/( মুন্সি বোরহান মাহমুদ)
রাকিবুল এহছান মিনার,ওয়াজ কুরুনী সিদ্দিকী,আবদুল হাই ইদ্রিছী,জনি হোসেন কাব্য,শাহরিয়ার শাহাদাত, শফিকুর রহমান সবুজ,জুবায়ের বিন ইয়াছিন,সাইফুর রহমান লিটন,জালাল জাবির,শেখ বিপ্লব হোসেন,নূরুল ইসলাম নাযীফ প্রমুখের ছড়া পঙক্তিতে শোভিত সংকলনের পাতা।
সীমান্ত আকরাম একটি ভালো কাজ করেছেন।এক মলাটে এই সময়ের বহু কবি ছড়াকারের লেখাকে একত্র করে হাজির করেছেন পাঠকের সামনে। পরবর্তী সময় ও প্রজন্মের কাছে সময়কে পৌছে দেওয়ার উপযুক্ত পদক্ষেপ। আমরা বিশ্বাস করি কাল তার যথাযথ উপহার দিবে সময়ের প্রতিনিধিকে।
‘ দ্রোহের কবিতা’
গণবিপ্লব ২০২৪-এর কবিতা সংকলন
সম্পাদক : সীমান্ত আকরাম
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২৪ সাল
মূল্য ২০০ টাকা
প্রত্যেকের সংগ্রহে রাখার মতো একটি সংকলন।আপনিও সংগ্রহ করুন।
আলোচনাটি ঋদ্ধ হয়েছে।
কবি, আলোচক তাজ ইসলামকে ধন্যবাদ জানাই।