spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআসাদ চৌধুরী : শ্রদ্ধা

লিখেছেন : আহমাদ মাযহার

আসাদ চৌধুরী : শ্রদ্ধা

আহমাদ মাযহার 

এমন সহজ ও সাধারণ একটা ভঙ্গি ছিল যাপিত জীবন ভঙ্গিতে যে কবি আসাদ চৌধুরীকে দেখে কখনো মনে হতো না তিনি জীবনে টিকে থাকার জন্য কোনো সংগ্রাম করছেন। 

তাঁর সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয়ের আগে থেকেই তাঁকে চিনতাম কণ্ঠসূত্রে! বাংলাদেশ বেতারে তিনি একটা সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন। সেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাঠানো অখ্যাত লেখকদের লেখা পাঠ ও আলোচনা করা হতো। তিনি আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সে অনুষ্ঠানে পঠিত লেখা নিয়ে তাঁর অনুকম্পায়ী ও মমতাময় আলোচনার জন্য। তাঁর কণ্ঠের যুগপৎ মন্দ্রতা ও মিষ্টতা ছিল আমার খুবই প্রিয়। পরে যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তখন তাঁর প্রসন্ন ও নিরহঙ্কার ব্যক্তিত্বও আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একদেশদর্শিতা সে সময়ের অন্যান্য লেখকদের মধ্যে দেখতাম; কিন্তু আসাদ চৌধুরী নিজে আধুনিকতামুখি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দেখতাম উদার মনোভঙ্গির। কবিতা রচনায়ও তিনি ছিলেন উদার আধুনিক। তরুণতরদের সম্পর্কেও খোঁজ রাখতেন। 

সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সাহিত্য ও সংস্কৃতিধর্মী একটা ধারাবাহিক অনুষ্ঠন করতেন তিনি ‘প্রচ্ছদ’ নামে। একটা সময় সে অনুষ্ঠানে একটা পর্ব রাখতেন স্বরচিত ছড়া পাঠের। ১৯৮৩ সালে তাঁর আমন্ত্রণে আমি প্রথমবারের মতো স্বরচিত ছড়া পাঠ করেছিলাম বাংলাদেশ টেলিভিশনে। সে সময় এ রকম সুযোগ আমাকে সাহিত্য চর্চায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। তরুণতররা তাঁর কাছ থেকে এ রকম প্রশ্রয় পেত সব সময়! 

মনে পড়ছে আসাদ ভাই বাংলা একাডেমিতে দেখা হলে একদিন আমাকে বললেন, আমার সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষার সেরা রূপকথা’ বইটি পড়ে তাঁর ভালো লেগেছে। যে আমি তাঁকে বইটি উপহারও দিইনি বা জানাইওনি যে এমন একটা কাজ আমি করেছি। বাংলা রূপকথা নিয়ে তাঁর লগ্নতার কথা আমি জানতাম। আনন্দের কথা সেই সূত্রেই কোনোভাবে তাঁর হাতে পড়েছিল বইটি। আমার সম্পাদিত সংকলনটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশনার স্বাভাবিক বিপণন ও পঠন প্রক্রিয়ার অংশ হলেও সংকলনের বিশিষ্টতাকে অগ্রজদের মধ্যে একমাত্র তিনিই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শনাক্ত করে আমাকে আস্থাশীল করে তুলেছিলেন। বিশেষ করে তিনি প্রশংসা করেছিলেন আমার লেখা ভূমিকার। আমার করা বাংলা রূপকথার মধ্যেকার সংরূপবৈচিত্র্যের বিন্যাস যে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন সেটা ছিল আমার অকিঞ্চিৎকর কাজের সার্থকতা।

আশির দশকে বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে আসাদ ভাইই আমাকে সচেতন করেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উর্দু কবিতা পাঠের আসর ‘মুশায়রা’-র আয়োজনে তাঁর সঙ্গে আমিও ছিলাম কিঞ্চিৎ সহযোগী। সেই সূত্রেই উর্দু কবিতার বিশিষ্টতা ও সৌন্দর্যে আমি সামান্য অবগাহন করতে শিখি। 

একদিন বাংলা একাডেমির বইমেলার মাঠে তাঁর সঙ্গে দেখা! বললেন, ‘আমার একটা কবিতার বই বেরিয়েছে। বইটার নাম ‘এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা’! বইটা দেখো কিন্তু!’  আমি ভেবেছিলাম, বই নিয়ে চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠানে যেন আমি দেখাই তার জন্য জানিয়ে রাখলেন। তাই প্রকাশনা সংস্থার নাম জানতে চাইলাম। প্রকাশনা সংস্থাটিও তখন ছিল নতুন। আমার অপরিচিত। পরে উল্টে পাল্টে দেখতে গিয়ে দেখলাম, বইটা একত্রে বকুলকে আর আমাকে উৎসর্গ করেছেন তিনি! 

নিউ ইয়র্কেও দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলাতেই। সেটাই ছিল শেষবারের মতো বইমেলায় তাঁর যাওয়া! 

আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের স্মৃতি। কত আড্ডা, কত প্রসঙ্গের কত আলোচনা! তাঁর অন্তিম দিনে কথার পিঠে পিঠে কেবল বেরিয়ে আসছে লাটাইয়ে পেঁচিয়ে থাকা সূতোর মতো। সেসব কথা লিখতে অনেক সময় লাগবে। 

আসাদ ভাই, আমাদের স্মৃতিতে ও সংবেদে আপনি থাকবেন সবসময়! আপনার জন্য সব সময় থাকবে আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প
নয়ন আহমেদ on যুদ্ধশিল্প
কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন