আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে যারা ভারতে সরকার পরিচালনা করে আসছেন, তাদের সম্পর্কে একটি কৌতুক আছে। ভগবান রাম যখন পিতৃ আদেশ পালন করতে স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে দ্চৌদ্দ বছরের বনবাসে রওয়ানা হন, তখন অযোধ্যার বহু লোক তাদের অনুসরণ করে। শহরের উপকণ্ঠে পৌছে রাম তাঁর ভক্তকূলের দিকে ফিরে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন:
“প্রিয় অযোধ্যাবাসী নরনারীগণ, আপনারা আমাকে আর অনুসরণ করবেন না। আপনারা নগরীতে ফিরে যান। অযোধ্যাবাসী পুরুষ ও নারীরা ভগবান রামের কথা মেনে অশ্রুসজল নয়নে তাদের বিদায় জানায়। চৌদ্দ বছর বনবাসের মেয়াদ শেষে রাম যখন সীতা ও লক্ষ্মণকে সাথে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসছিলেন, তখন দেখতে পেলেন যেখানে তিনি নগরবাসীকে বিদায় জানিয়েছিলেন, সেখানে একদল লোক বসে আছে। তারা নিকটে পৌছলে লোকগুলো উঠে দাঁড়ায় এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করে। রাম জানতে চান যে, তারা কে এবং এখানে কি করছেন।
লোকগুলো নিবেদন করে যে, “চৌদ্দ বছর আগে আমরাও অন্যান্য অযোধ্যাবাসীর সঙ্গে আপনাকে অনুসরণ করে এখানে এসেছিলাম। আপনি যখন অযোধ্যাবাসীদের বিদায় দেন তখন কেবল “অযোধ্যাবাসী নরনারী’দের ফিরে যেতে বলেছিলেন। আমরা ‘নর’ বা ‘নারী’ নই, আমরা হিজড়া। আপনি আমাদের কথা উল্লেখ না করায় আমরা নগরীতে ফিরে না গিয়ে চৌদ্দ বছর ধরে আপনার আগমণ প্রতীক্ষা করছি।” ভগবান রাম তাঁর প্রতি হিজড়াদের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে তাদেরকে এই মর্মে আশীর্বাদ করলেন, “১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করবে এবং তখন থেকে তোমরাই ভারতবর্ষ শাসন করবে।” অতএব, স্বাধীনতা লাভের পর থেকে রামের আশীর্বাদ ধন্য হিজড়ারাই ভারত শাসন করছে।’
কথাটি ভারতের ক্ষেত্রে কৌতুক হলেও বাংলাদেশের শাসকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে হিজড়াদের দ্বারাই যে দেশটি পরিচালিত হয়েছে, তা বার বার এবং সবচেয়ে বেশি প্রমাণ করেছেন দেশের ‘মহান’ সব রাজনীতিবিদরাই। অরাজনৈতিক সরকারগুলো যারা চালিয়েছেন, তারাও হিজড়াসুলভ আচরণের বেশি কিছু করতে পারেননি। দেশের বয়স ৫৩ বছর এবং ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের এক বছরসহ প্রায় ২৫ বছর দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। ‘হাজার বছরের সেরা বাঙালি’র এবং গণতন্ত্রের মানসপুত্র ও মানসকন্যাদের পুরোপুরি নিজস্ব বা ঘরোয়া গণতন্ত্র যদি ২৫ বছরেও বাংলাদেশকে একটি সুনির্দিষ্ট সরকার ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তাহলে সে দায় কাকে দেওয়া যাবে?
দলটির একচ্ছত্র গণপরিষদ সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে সংসদীয় ব্যবস্থার বিধানপত্র সংবলিত সংবিধান রচনা করে সেই পদ্ধতিতে নির্বাচন করে তিন বছরের মাথায় সংবিধান পাল্টে একদলীয় পদ্ধতি চালু করেও বলে ‘ইহাই আদি ও অকৃত্রিম গণতন্ত্র’ এবং ‘সংসদীয় গণতন্ত্র কাজের কিছু নয়’। আসলেও তো তাই, সংসদীয় গণতন্ত্রে কোন মধুটা আছে? কবি ইকবাল বহু আগে বলে গেছেন:
“জমহুরিয়া এক তরজ-এ-হুকুমত হ্যায়, কি জিস মে
বান্দোকো গিনা করতে হ্যায় তওলা নেহি করতে।”
(গণতন্ত্র এমন এক ধরনের সরকার ব্যবস্থা, যেখানে
গণনা করা হয় মানুষের সংখ্যা তাদের গুণকে নয়।)
আওয়ামী লীগের তাবৎ নেতা আগে ছিলেন ‘হিজ মাস্টার’স ভয়েস,’ পরে হয়ে গিয়েছিলেন ‘হার মিসট্রেস’স ভয়েস’। এই ‘হিজ’ ও ‘হার’ এর বাইরে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এই ‘হিজ’ ও ‘হার’ ই তাদের আরাধ্য ও নমস্য। তাদের কাছে তারা তাদের মাথা, হৃদয়, বিবেক সব বন্ধক দিয়ে দেন। পেছনের কথা বলে খুব লাভ নেই, আওয়ামী ধরনের ঘিলুওয়ালাদের জন্যই সম্ভবত আল্লাহতা’য়ালা কোরআনে বলেছেন, “ওরা মূর্খ, বধির ও অন্ধ। ওরা সত্যের পথে ফিরে আসবে না,” সুরা বাকারা : ১৮ (সুুম্মুন বুকমুন উমইয়ুন ফা হুম লা ইয়ারযিয়ুন)। এই শ্রেনির মূর্খতার জন্যই সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি বার বার ‘শেখের বেটি পালায় না, পালায় না,’ মর্মে দম্ভ করেও পালিয়েই গেলেন, তিনি ২০২৪ এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে পারেন, “বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে কথা ঠিক নয়। বাংলাদেশ সক্রিয় গণতান্ত্রিক দেশ। জনগণ যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে কি না সেটিই বড় বিষয়।”
কোন জনগণ? অবশ্যই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর সংসদ নির্বাচনে ভোট না দেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নয়। এটাই আওয়ামী গণতন্ত্র এবং এটাই আওয়ামী গণতন্ত্রের “সৌন্দর্য্য!” তাই যদি না হতো, তাহলে দেশ, জনগণ, দলের নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের ইঙ্গিত না দিয়ে, কারও মাধ্যমে কোনোভাবে দলীয় নেতাদের কাছে “আমি পালাচ্ছি, তোমরাও যে যার মতো পালিয়ে জান বাঁচাও” ধরনের বার্তা রেখে যাননি। অবশ্য আওয়ামী লীগের ইতিহাস হলো, যা তারা করেনি, তা দাবি করে বসা। ১৯৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণার কথাই ধরা যাক। বিডিআর অয়্যারলেস এ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার দাবী। ওই আমলে যদি অয়্যারলেসে একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা পাঠানোর কথা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়, তাহলে এই আমলে এত ধরনের মাধ্যমের কোনো না কোনোটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ২ লাখ ২৪ হাজার উম্মত, সাহাবা, খলিফা, তাবেইন, তাবেতাইনের কাছে পালানোর বার্তা পৌছানো হয়েছিল মর্মে দাবী করা কঠিন কিছু হবে না।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সমর্থকরা ওপর থেকে ওহি লাভ করেন এবং তাই বলেন ও করেন। অতএব, গত জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে কিছুই ঘটেনি। আইনশৃংখলা রক্ষাকারীরা গুলি ছোড়েনি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি, তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি আমেরিকার কথা শোনেননি, তাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে ইত্যাদি। দেশে ফেরার পথে শেখ হাসিনার কথাই বার বার মনে পড়েছে। তিনি গতবছর জুন মাসে বলেছিলেন, “বিশ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে, আটলান্টিক পার হয়ে, ওই আমেরিকায় না গেলে কিচ্ছু আসে যায় না। পৃথিবীতে আরো অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে। সেই মহাদেশের সাথে মহাসাগরেই আমরা যাতায়াত করবো।”
তিনি অতীব খাঁটি কথা বলেছেন! এবার আমাকে দেশে ফিরতে বিশ ঘন্টা নয়, ২৮ ঘন্টা লেগেছে। নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৬ ঘন্টা পর বিমান আকাশে পাখা মেলেছে। দুবাই পৌছতে সাড়ে ১২ ঘন্টা লাগার কথা, কিন্তু এবার লেগেছে সাড়ে ১৩ ঘন্টা। দুবাইয়ে নির্ধারিত কানেকটিং ফ্লাইট ধরা যায়নি। অপর কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে আরও বেশি সময় লেগেছে। অতএব কিসের আমেরিকা! বাংলাদেশের এক বিজ্ঞ মন্ত্রী বলেছিলেন, “আমেরিকায় দেখার কি আছে? কিছু দূর পর পর এক একটি শহর, একই ধরনের অট্টালিকা। এই তো আমেরিকা!”
তাইতো, আমেরিকার কি আছে? সবকিছু আছে আমার দেশে! ‘ইনহাস্ত ওয়াতানাম!’ এই তো আমার দেশ! সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাম শস্যশ্যামলা মাতরম!