মজিদ মাহমুদ
হেলাল হাফিজের কবিতা নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমি বেশ মুশকিলে পড়ি। একই সঙ্গে পাঠক-প্রিয়তার দুর্বহ চাপ অপরদিকে কাব্যের শিল্প বিচারের দায় পীড়িত করতে থাকে। কারণ সমকালে জনপ্রিয় সাহিত্য সর্বদাই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। যদিও একটি কথা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়, সমকালে যে সাহিত্য পাঠকের সমীহ আদায় করতে পারেনি পরকালে তার গতি হয়েছে কমই। কবি হেলাল হাফিজের ব্যাপারে আমার সন্দেহ তার জনপ্রিয়তা নিয়ে নয়; আমি ভাবি– এমন দেব-দুর্লভ কাব্যপ্রতিভা নিয়ে যিনি ধরাধামে এসেছিলেন– হেলায় তিনি কাটিয়ে দিলেন অলস পাঠকের আনন্দধামে ইতস্তত ঘোরাফেরা করে। কী নির্মম রে বাবা! জীবদ্দশায় একজন কবি কীভাবে নিশ্চিন্ত বাস করেন নিষ্ফল প্রেতলোকে; আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন– নিজের অমৃতের ছানাপোনা। আর দিনান্তে পরিশ্রান্ত ঘর্মাক্ত লেখকদের প্রতি যেন কটাক্ষ হেনে বলতে থাকেন– আমি তো লেখার দাস নই; আমি হলাম লেখার আনন্দ সঙ্গী; ছাপান্নটি কবিতা ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে পৌঁছে দিয়েছি। তারা কষ্টে থাকা মানুষের শুশ্রূষা হয়ে, প্রেম-কাতুরে মানুষের জন্য ভালোবাসা হয়ে, বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে যুদ্ধে যাওয়ার ডাক দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তাই তো জীবনে কাব্যের প্রয়োজনীয়তা কতখানি; যার ভালো লাগে তার লাগুক গে। কেবল লেখার দ্বারা লেখকের বিস্মৃতির ভেতর বাসের চেয়ে পাঠকের স্মৃতির মধ্যে বসবাস জরুরি। প্রতিদিনের জীবন-যাপনের জন্য, আটপৌরে বসবাসের ক্লিষ্টতার মধ্যে যে কবিতা একটু শ্লোকের মতো দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে ঝরে পড়ে তার মূল্যও তো সংসারে কম নয়। বাংলা সাহিত্যের বয়স নিছক কম নয়। এ ভাষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের জন্ম হয়েছে- তারা অনেক গভীর ও রহস্যঘেরা কবিতা লিখেছেন; জীবন-জগতের অনেক দর্শন তারা উপস্থাপন করেছেন; কিন্তু আটপৌরে জীবনের দীর্ঘশ্বাসগুলো খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে। সহজ মানুষ প্রেমের মানুষ কামের মানুষ খেটে খাওয়া মানুষ ব্যর্থ মানুষ সেই সব কবিতাকে খুব অবলম্বন করতে পারেনি। তিরিশের কবিতার যে দুর্বোধ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিল, চলেছে তারই ধারাবাহিকতা– কবিতা লিখতে হলে পারম্পার্যের হতে হবে দাস। কিন্তু হেলাল হাফিজ সেসব না মেনেই ষাট দশকের কবিতা ধারায় নিজের আলাদা ঠাঁই করে নিয়েছেন।
হেলাল হাফিজ লেখার দ্বারা এবং না লেখার দ্বারা বাংলা সাহিত্যে প্রাতিস্বিক হয়ে উঠেছেন। কেবল বাংলা সাহিত্যে নয় বোধকরি অন্য ভাষার সাহিত্যেও তার যমজ মেলা ভার। একটি মাত্র উপন্যাসের লেখক জীবনে আর একটি লেখা না লিখেও বিখ্যাত হয়েছেন অনেকে। কিন্তু একটি মাত্র কবিতার বইয়ের লেখক আর কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ না করেও সারা জীবন ধরে বিখ্যাত থেকেছেন তার উদাহরণ প্রায় বিরল। হেলাল হাফিজ মূলত একটিই বই লিখেছেন কবিতার; পরে আরো কিছু কবিতা লিখেছেন– সেগুলো না লিখলেও ইতরবিশেষ হতো না। তার খ্যাতি ও প্রাপ্তি এবং নিজস্ব প্রকাশের চূড়ান্ত ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থে সীমাবদ্ধ। তিনি নিজেকে যেমন অতিক্রমণের আর চেষ্টা করেননি তেমনি পাঠকের পীড়ন তার দ্বারা অধিক সংঘটিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যেও এমন অনেক কবি আছেন যারা প্রথম বই লিখেই খ্যাতির চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছেন; কিন্তু একজন লেখকও নেই যিনি দ্বিতীয় বই না লিখে খ্যাতিমান থেকেছেন। হয়তো তা সম্ভব হলেও হেলাল হাফিজের মতো হেলায় কেউ কলম সরিয়ে নেননি। এটিকে একজন কবির দুর্ময় সাহস ছাড়া আর কিছু বলেই অভিহিত করা যায় না। আত্মহত্যা কিংবা আত্মবিশ্বাস তার জন্য এ ক্ষেত্রে সমার্থকই বলা যায়। কিন্তু তিনি জয়ী হয়েছেন এবং অগ্রজদের সকল ট্যাবু ভেঙে দিয়ে অনুজদের পাতালে প্রলুব্ধ করেছেন। কে আছে যে সাহিত্যের ময়দানে এই ঝুঁকি নিতে সক্ষম। নিজের সৃষ্টিকর্মের প্রতি এমন আত্মবিশ্বাসী আর ক’জন লেখকই বা এই বাংলা ভূমিতে জন্মেছেন।
অবশ্য তার এই আত্মবিশ্বাসকেই আমি লেখকদের জন্য নিন্দার্হ বিবেচনা করে এসেছি। সমকালীন কবি জগতে কারই বা হেলাল হাফিজের কবিখ্যাতি স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে না। তাদের জন্য আত্মহননের পরামর্শ হতে পারে– বেশ তো একটি বই লিখুন আর নিজেকে সরিয়ে নিন, মৃতদের জগতে প্রবেশ করুন– তারপর ভাষার পাঠকদের দূর থেকে দেখুন আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলুন। সব রোমান্টিক কবির ধরনই এমন– সে কিটস হোক শেলী হোক বায়রন হোক নজরুল হোক। প্রেম পরিণয়ে বাধা হলে, মানবিক বিপর্যয় দেখা দিলে প্রেমিক থেকে বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। বাঙালির যখন যুদ্ধ জয়ের সময় ছিল– তখন নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় লিখেছিলেন তিনি। অনেকেই বলেন– সে তো স্লোগান, দেয়াল লিখন। স্মরণযোগ্য সকল চরণের পরিণতি তো তেমনই জীবনের অস্তিত্বের প্রয়োজনে, প্রেমে-ক্রোধে ব্যবহার হয়ে থাকে। যে তরুণ ভীতু-যুদ্ধে যেতে পারে না, কষ্ট সইতে পারে না জীবনবাজি রাখতে পারে না- সে কীভাবে প্রেমিক হতে পারে না! আর বিপ্লব থেমে গেলে প্রেমের আশনাই মিটে গেলে মহাস্থবিরতার আনন্দ লাভ। রোমান্টিক কবিকুল বেশি দিন ধরে ওই একই প্যানপ্যানানির মধ্যে থাকতে নারাজ। হেলাল হাফিজের রোমান্টিকতা যুগের কবি মানসিকতার সঙ্গে আধুনিকতার মূলবোধ মেনে চলেছেন।
আমার ধারণা কাব্য-তার্কিকগণ হেলাল হাফিজের সাহিত্যিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পাঠকরা বহুদিন তার কবিতার সঙ্গে থাকবেন।
দুই.
হেলাল হাফিজ অনেক দিন থেকে অসুস্থ। মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগে কিংবা পত্র-পত্রিকায় খবর দেখে মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। যদিও হেলাল হাফিজ লেখালেখি থেকে অনেকটাই বিরত, তবু তার কবি জীবনের উপস্থিতি কবি মহলে আনন্দের অনুভূতি দেয়। হেলাল হাফিজ যত কমই লিখুন না কেন, তিনি একটি সময় ও কালের উদাহরণ হিসেবে বেঁচে আছেন। কিন্তু কবিদের জীবন যতই লোকপ্রিয়তার দ্বারা তাড়িত হোক, বাস্তবতা তাদের প্রতি উপেক্ষাও কম নয়। জাতীয় কবি বাকরুদ্ধ হওয়ার পরে ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন, তার পক্ষে আর লেখালেখি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ৪৩ বছরের সক্রিয় জীবদ্দশায় মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে বিশের অধিক কাব্যগ্রন্থ, নতুন ধারার গোটা তিনেক উপন্যাস, গোটা দশেক নাটক, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছোটগল্প এবং জনপ্রিয় পাঁচ সহস্রাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছিলেন– যা বাংলা ও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, কৃষক স্বরাজ পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা, এমএলএ নির্বাচনে প্রার্থী এবং জীবন বিপন্নকারী চল্লিশ দিনের অনশন, জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক। এতদসত্ত্বেও তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রায় কেউই তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। এমনকি দেখতেও আসেননি, মুষ্টিমেয় সুহৃদ ছাড়া। যে নারীরা নজরুলের কাছে বসে গান শিখেছিলেন, আক্ষরিক অর্থে অনেকে কোলে বসে, হতে পারে কাননবালা, অঙ্গুরবালা, কমলা ঝরিরা, যুথিকা রায়, প্রতিভা বসু, নজরুল ছাড়া যাদের পরিচয় গড়ে উঠত না, তারাও কবি অসুস্থ হওয়ার পরে তাকে চোখের দেখাটাও দেখতে আসেননি। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে আব্বাসউদ্দীন, শেরে বাংলা, রণদা প্রসাদ সাহা কাউকেই নজরুলের সান্নিধ্য আসতে দেখা যায়নি। বরং অনেকে অসুস্থ কবির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিলেন। যে নজরুল ঘরের বাইরে বেরুলে রাস্তায় জ্যাম লেগে যেত, পুলিশকে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে হতো, যে নজরুল জনসভায় গেলে আয়োজকদের লোক সংগ্রহের চাপ নিতে হতে হতো না। তার যে সব হিন্দু ভক্ত মনে করত শ্রীকৃষ্ণ ধরায় রূপ ধরে এসেছেন, মুসলমান ভক্তরা মনে করত ইসলামের সেবার করার জন্য আল্লাহপাক স্বয়ং তাকে পাঠিয়েছেন, তাদেরও সেদিন নজরুলের পাশে দেখা যায়নি। এনমকি যেসব মেয়ে নজরুলের জন্য আত্মহত্যা করতেও প্রস্তুত ছিলেন, যেসব তরুণ আত্মঘাতী বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সেদিন তারাও অনুপস্থিত ছিলেন নজরুলের অসুস্থ শিয়রে। টাকা নেই বলে অসুস্থ কবিকে ডাক্তারের কাছে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
শুরু হচ্ছে উপরতলা বাড়িওয়ালার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। লুম্বিনী হাসপাতালে শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হচ্ছে, শক দেয়া হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ১৫ লাখ পাওয়ারের পেনিসিলিন শরীরে পুশ করা করা হচ্ছে। তার জন্য নিরাময় কমিটি, সাহায্য কমিটি গঠন করা হচ্ছে, কিন্তু পাঁচ মাসের বেশি তা স্থায়ী হচ্ছে না। এমনকি অনেকে সাহায্য তুলে আত্মসাৎ করছে। তার কিছুদিনের মধ্যে লোকজন প্রায় ভুলেই গেলেন নজরুল নামে এমন একজন কবি ছিলেন। কারণ তখন হিন্দু মুসলমান দেশ ভাগাভাগিতে ব্যস্ত। কবির অসুস্থ হওয়ার প্রায় এগার বছর পরে ১৯৫৩ সালে স্বাধীন দুই দেশের সরকার মিলেও তার বিদেশে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের ৫ হাজার টাকা, রাজ্য সরকারের ৩ হাজার টাকা, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ৫ হাজার টাকা, নানা সুহৃদের দান-ধ্যানেও টাকার অভাবে অসুস্থ কবি ও কবি পত্নীকে বিমানের বদলে জল জাহাজের কষ্টকর যাত্রায় বিলাত পাাঠাতে হচ্ছে। ফেরার পথে কবিপত্ন ও কবিকে বিমানে পাঠানো হলেও সহকারীদের জাহাজে আসতে হচ্ছে। এই হলো সমকালীন বিশের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও আমাদের জাতীয় কবির সেবা-যতেœর হাল। এই অবস্থার ততক্ষণ পরিবর্তন হয়নি, যতক্ষণ না বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি তাকে এ দেশে নিয়ে না এসেছে।
সেদিক দিয়ে বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কবি হেলাল হাফিজ নজরুলের মতো অসুস্থ না হলেও ৩৪ বছরের বেশি সময় ধরে লেখালেখিতে নীরব রয়েছেন। এমনকি তার আগের ৪৩ বছরেও খুব একটা লেখার ঝামেলায় থাকতে চাননি। না গান না গল্প। আর কোনো সৃষ্টিকর্ম না থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের তরুণ-তরুণীর কাছে সমধিক প্রিয়, তারাও স্বপ্ন দেখে হেলাল হাফিজের মতো একদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন। কিন্তু হেলাল হাফিজের জাদুটি তাদের অজানা, তার কাব্যশৈলী ভিন্ন, যে দু’একখানা রাগ-রাগিনী তিনি সৃষ্টি করেছেন, তার সুর ও লয় পৌঁছে গেছে কাব্য-পাগল বাংলার তরুণ-তরুণীর কাছে। আমার বিশ্বাস এই দুর্দিনে কষ্টের ফেরিওয়ালার কাছে তারা তাদের কষ্ট জানাতে ছুটে আসবেন।
(জন্ম তারিখ ৭ অক্টোবর ১৯৪৮)