spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলতেন 'আমি বাংলা ভাষাই জানি'

লিখেছেন : মুনীরা বশীর

বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলতেন ‘আমি বাংলা ভাষাই জানি’

[ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং মোসাম্মৎ মরগুবা খাতুনের ১১৪তম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে ]

মুনীরা বশীর

বর্ষণমুখর সন্ধ্যা! পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা বিএ অধ্যয়নরত তরুণ যুবা, পিতা মফিজ উদ্দিন আহমদ এবং মাতা হরুন্নেছা খাতুনের আদেশে স্বপরিবারের বিয়ের জন্য যাত্রা করেছেন। গ্রামের কাঁচা রাস্তা তার উপর মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বরসহ বরযাত্রীদের নাজেহাল অবস্থা। কন্যাপক্ষের বাড়িতে যখন পৌঁছালেন, একেবারে কাঁকভেজা না হলেও লেজেগোবরে অবস্থা। অনেক বরযাত্রীকে তাদের পায়ের জুতা হাতে নিয়ে নগ্ন পায়ে বিয়ের আসরে ঢুকতে দেখে কন্যাপক্ষের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। কন্যাপক্ষ বলতে লাগলো “এ কোন ছোটলোকেরা বিয়ের আসরে জুতা হাতে নিয়ে খালি পায়ে বিয়ে করতে এসেছে।” এরই মধ্যে মৌলভী সাহেব অন্দরমহল গিয়ে কনের রেজামন্দি মানে ‘কবুল’ শুনে যখন বরের রেজামন্দি নিতে এসে দেখেন, বরপক্ষ এবং কন্যাপক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে এবং এক পর্যায়ে বরের বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ, ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের কর্মকর্তা প্রচন্ড রেগে গিয়েছেন এবং বরকে বলছেন “উঠে এসো এ বিয়ে হবে না।” এ পরিস্থিতিতে বর বিবাহ মজলিস হতে উঠে আসতে বাধ্য হন। যদিও কন্যাপক্ষ এই অশোভন আচরণের জন্য তার পিতার কাছে ক্ষমা চান এবং বরকে অর্থের প্রলোভন দেখাতে লাগলো কিন্তু তিনি বললেন “আমি পিতার কুপুত্র নই। পিতা যে বিয়েতে রাজি নয়, আমিও সেখানে রাজি নই।” বর সেই বিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন। বিয়ে ভেঙ্গে যায়! এদিকে কন্যা ‘কবুল’ বলে ফেলেছেন! 

ব্যক্তিগত জীবনে তরণ যুবা ছিলেন নিরহংকার ও সাদামাটা ধরনের। জীবনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বপরিবারের বিয়ের আসর থেকে উঠে চলে আসলেন। মফিজ উদ্দিন আহমদ ছেলের বিয়ের জন্য সবান্ধব এসেছিলেন। বিমর্ষ মনে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামলাবেন কিভাবে তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এই সময় বরযাত্রীদের মধ্যে থেকে তার এক বন্ধু বলে উঠলেন “আমার ১১ বছরের একটি কন্যা আছে। তোমার আপত্তি না থাকলে আমার মেয়ের সাথে তোমার ছেলের বিয়ে দিতে আমি সম্মত আছি।” এরপর তরণ যুবা বর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯১০ সালের ১০ অক্টোবর ২৪ পরগণা জেলার বারসাত মহকুমার অন্তর্গত ভাসলিয়া গ্রামের বনেদী জমিদার মুন্সী মুহম্মদ মুস্তাকিম সাহেবের কন্যা মোসাম্মৎ মরগুবা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রসিকতা করে বলতেন “আমার জীবনে ১০ সংখ্যাটি খুব ঘনিষ্ঠ। আমার জন্ম তারিখ ১০ জুলাই, আমার বিয়ের তারিখ ১০ অক্টোবর (ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১০ম মাস), ১৯১০। 

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কে ছিলেন তা হয়তো এই প্রজন্ম জানে না, বা আমাদের আরো পরের প্রজন্ম এই ক্ষনজন্মা মনীষীকে স্মরণ করবেন কিনা অথবা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবেন কিনা তা ভবিতব্য জানে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব, বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক। ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, আয়ত্ত করেছিলেন বাইশটি ভাষা। তিনি বাংলা, উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী, সংস্কৃত, পালি, আসাম, উড়িয়া, আরবী, ফার্সী, হিব্রু, আবেস্তান, ল্যাটিন,তিব্বর্তী, জার্মান, ফরাসী, প্রাচীন সিংহলী, পশতু, মুন্ডা, সিন্ধী, মারহাটী, মৈথালী ইত্যাদি ভাষা জানলেও ভাষার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলতেন, “আমি বাংলা ভাষাই জানি।”

সৌভাগ্যবশত আমি এই মনীষীকে খুব কাছে পেয়েছি। যদিও তাঁকে চেনার বা জানার বয়স তখন আমার হয়নি। কিন্তু তাঁর কোলে চড়ার মত দুর্লভ মুহূর্ত আমার জীবনের প্রাপ্তি হয়ে আছে। কেননা আমি তাঁর নাতনি, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমার দাদা হন এবং এই মনীষীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীর আমার বাবা হন। আমার ঘরোয়া নাম যুঁই আমার দাদার দেয়া যা আমাকে গৌরবান্বিত করেছে। 

ইদানীং এক শ্রেণি নিজেদের নিজস্ব ফতোয়ার মাধ্যমে ইসলামের সুপ্রমাণিত বিষয়গুলোকে জনসাধারণের মাঝে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। তারা বলছে শবে বরাতের হাদিসগুলো সহীহ নয়, এ রাতে ইবাদত করা বিদআত।  ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়, সৈয়দ আব্বাস আলী মক্কী নামে এক কামিল দরবেশ চতুর্দশ শতকে দক্ষিণ বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন। পীর গোরাচাঁদ নামেও তিনি পরিচিত। ১২৬৫ সালে পবিত্র মক্কানগরে এই সাধকের জন্ম। কারো কারো মতে তিনি হযরত শাহজালাল (রহ) এর ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম। হাড়োয়ায় পীর গোরাচাঁদের মাজার অবস্থিত। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র আদি পুরুষ শেখ দারা মালিক এই দরবেশ সাহেবের প্রধান খাদেমরূপে হিন্দুস্থান থেকে এ দেশে আগমন করেন এবং তাঁর দরগাহের বংশানুক্রমিক খাদেমরূপে বহাল হন। তিনিও একজন কামেল দরবেশ ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র পিতা মফিজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পীর গোরাচাঁদের দরগাহের খাদেম। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র রক্তে এই কামেল দরবেশের রক্তধারা এবং পীর গোরাচাঁদের রুহানী ফায়েজ প্রবাহিত হয়েছিল। পৈতৃক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। তাছাডা তিনি পশ্চিমবঙ্গের ফুরফুরা পীর সাহেবের খলিফা ছিলেন। তাঁর হাতে অনেক অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং তাঁর পরিবার শবে বরাত পালন করতেন। শবে বরাতের রাতে তিনি ঢাকায় নীলক্ষেত বাবুপুরায়, বাককু শাহ মাজারে অবস্থিত পারিবারি কবরস্থানে তাঁর মা হুরুন্নেসার কবর জিয়ারত করতে যেতেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগেও তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরকে শবে বরাতের রাতে তাঁর মার কবর জিয়ারত করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সমাজে একজন বুরজুক ও আলেম বলে পরিচিত ছিলেন। উনার বেগমসাহেবা আমার দাদী মরগুবা খাতুন শবে বরাতের রাতে নিজ হাতে রুটি-হালুয়া বানাতেন।

ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র গভীর জ্ঞান ও দূরদর্শিতা যে ছিল তার একটি উদাহরণ হলো: 

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র কনিষ্ঠ পুত্র চিত্রশিল্পী আমার বাবা মুর্তজা বশীরের কাছে শুনেছি, ১৯৬০ সালে লাহোরে থাকাকালীন সময় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ করাচিতে এসেছিলেন। তখন তিনি করাচিতে উর্দু ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের চিফ এডিটর রুপে কর্মরত ছিলেন। মুর্তজা বশীর তাঁর পিতাকে বললেন “আমি ছবি আঁকি এবং মুসলমান হিসাবে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হই।” মুর্তজা বশীর জানতে চান ইসলামে ছবি আঁকা নিষেধ কী না? ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’ জবাব দেন – “যদি সেই প্রতিকৃতি দেখে মনে কোনো রকম ভাবের সৃষ্টি হয়, সেটা শিরক হয়ে যায় এবং তা গুনাহ।” তখন সৌদি আরবে ডাকটিকিট, ব্যাংক নোট ও মুদ্রায় কোনো প্রাণীর ছবি ছাপা হতো না। কিন্তু আজকে সৌদি আরবে ডাকটিকিট, ব্যাংক নোট ও মুদ্রায় বাদশার ছবি ছাপা হচ্ছে।

বাবার কাছে শুনেছি “আমার জ্ঞান হওয়ার পর যা দেখেছি তা বাবুর (পিতাকে বাবু বলতেন) সাথে ছিল কিছুটা দূরত্বের। একমাত্র সকালে ও সন্ধ্যায় নামাজ পড়া ছাড়া তার সাথে দেখা হতো না। তিনি সে নামাজের ইমামতি করতেন এবং সে নামাজে সন্তানদের উপস্থিতি থাকাটা ছিল বাধ্যতামূলক। আমার মাকে কেন্দ্র করেই ছিল আমাদের জীবন। প্রতিটি রবিবার এবং মাসে একদিন আমার বাবু যেদিন বেতন পেতেন আমাদের কাছে সেই দিনটি ছিল উৎসবমুখর। কারণ ছেলেবেলায় দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাসের প্রথম দিন বেতন পেয়ে তিনি টেবিলে সমস্ত টাকা বিছিয়ে দিতেন এবং সন্তানদের বলতেন, যার যা খুশি তুলে নিতে। আমার মা তখন সেখানে থাকতেন না। মা থাকতেন ঘরের বাইরে দরোজার আড়ালে। আমরা ভাইবোনরা যখন একেক জন বেড়িয়েছি মা তখন হাত থেকে সেই টাকা তুলে নিতেন এবং তার কাছে থাকত একেকটি ছেলের নামে ছোটো কাঠের বাক্স, যেখানে সেই টাকা জমা রাখতেন। সেই টাকাগুলো দিয়ে মা পরবর্তীকালে ২৪ পরগনায় আমাদের দেশের বাড়ি পেয়ারায় একটি ফলের বাগান কিনেছিলেন যেখানে নানারকম ফলের গাছ ছিল। আমরা গরমের বন্ধে কিংবা অন্য কোনো সময় মার সঙ্গে দেশের বাড়িতে যেতাম সেই বাগান থেকে আমরা ইচ্ছামতো ফল পাড়তাম, নষ্ট করতাম, এর জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হতো না। কেননা যৌথ পরিবারের অনেক সময় হতো কাঁচা আমটা পেড়েছি সেজন্য বকুনি খেতে হয়েছে অথবা ডাব খেতে চেয়েছি সেটা পাইনি। মার আভিজাত্যে এটা লাগতো।

আর রবিবারে বাবু তাঁর সন্তানদের সাথে বিলাতি সাহেবী কায়দায় খাবার খেতেন। ডিনার সেট, কাঁটাচামচ এবং ন্যাপকিনে সজ্জিত খাবার টেবিলের নির্দিষ্ট কিছু শিষ্টাচার শিখাতেন। বলতেন অন্যের সঙ্গে একই টেবিলে খেতে বসলে হাত-মুখ ধুয়ে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি অবস্থায় খেতে আসবে। কাঁটাচামচ থাকবে বাম হাতে আর চামচ বা ছুরি থাকবে ডান হাতে, কিভাবে তা ধরতে হয় তা নিজে হাতে ধরে সন্তানদের শিখিয়ে দিতেন। ন্যাপকিনটি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তাও দেখিয়ে দিতেন। মুখভর্তি খাবার নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করতেন এবং খাবার খাওয়া এ পানি পান করার সময় শব্দ করতে মানা করতেন। খাবারের অব্যবহৃত অংশ টেবিলের না ফেলে বোনপ্লেটে ফেলার জ্ন্য নির্দেশ দিতেন। আর সবটাই দরজার আড়াল থেকে তদারকি করতেন আমার মা। বাবুকে তার সন্তানরা খুব একটা কাছে পেতেন। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। যা কিছু আবদার ছিল মায়ের কাছে।”

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’কে নিয়ে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে উনি ভীষণ রকম রক্ষণশীল মনের মানুষ। আদতে তা তিনি ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্যক্তি জীবনে নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তিনি বলেছিলেন ‘হিন্দু মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে কিন্তু তাহা যে করিতেই হইবে।’ তার আশা ছিল ভবিষ্যতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলিত বাঙালি জাতি বিশ্বসভায় ফরাসি, জার্মান জাতির মতো আপন সম্মানজনক স্থান অধিকার করবে। ‘আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে পারিবে’। আরও বলেছিলেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ এঁকে দিয়েছেন যে মালা তিলক টিকিতে বা টুপি লুঙ্গি দাঁড়িতে তা ঢাকবার জো নেই’। বাবার কাছে শুনেছি আমার দাদা উদার মনের অধিকারী ছিলেন বলেই পিতা হিসেবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চেয়েছিলেন সামাজিক ও পরিশীলিত হয়ে সন্তানরা বেড়ে উঠুক। মুর্তজা বশীর শিল্পী হোক তা চাননি। প্যারিসে থাকার সময় তিনি দেখেছিলেন শিল্পীদের জীবন কত মানবেতর ও কষ্টসাধ্য। কিন্তু মুর্তজা বশীর তখন শিল্পী হওয়ার সিদ্ধান্তে অবিচল। ছেলের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে কঠিন দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হলেন বাবা। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘বেশ। তবে সিনারি এঁকো।’ হাতে তুলে দিলেন ভর্তির টাকা। এই বাবাই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিবস্ত্র রমণীর ছবির বই। কারণ, তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, অন্যদের কাছে যেটি নেকেড, ছেলের কাছে সেটি ন্যুড।

আমার বাবা মুর্তজা বশীর আজকে যে খ্যাতি বা যশ পেয়েছেন তা প্রত্যক্ষ ভাবে আমার দাদার অবদান না থাকলেও পরোক্ষ ভাবে আছে। দাদা তাঁকে বলেছিলেন নটোরিয়াস বা ফেনাস হবে, মিডিওকার হয় তা আমি চাই না। দাদার এ কথার পর থেকেই নিজে আপন নামে পরিচিত এবং স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার ছেলে মুর্তজা বশীরকে বলেছিলেন তিনটা ডব্লিউ থেকে বিরত থেকো – ওম্যান, ওয়ার ও ওয়াইন। মেয়ে মানুষ, বিবাদ আর মদ সব ধ্বংসের মূল। 

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হননি। তাঁর ছাত্র এবং বন্ধুরা উপাচার্য হয়েছিলেন এমন কী তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিজীবনে পূর্ণ অধ্যাপকও হননি। তিনি রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) রূপে অবসর গ্রহণ করেন। এমন কী তাঁর স্বপ্নের ফসল বাংলা একাডেমির সভাপতি পদে তাঁকে আসীন করা হয়নি ও বাংলা একাডেমির পুরস্কারও তাঁর কপালে জুটেনি। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অশুভ রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এই জ্ঞানতাপস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান’ এবং ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাঁকে ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স’ পদকে ভূষিত করেন। ১৯৮০ সালের সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পদক এবং ২০০২ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন।

বাবার কাছে শুনেছি আজীবন উদ্যমী আমার দাদা সর্বদা ছিলেন কর্মচঞ্চল। ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন এই জ্ঞানানন্দ প্রবাদপুরুষ। জীবন সায়াহ্নে যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন ডান হাতের লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘ভাল হয়ে নিই, আমার বাম হাতে লেখার অভ্যাস করবো।’ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর। ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয়া মাতা হরুন্নেছা খাতুন এবং প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মোসাম্মৎ মরগুবা খাতুনের মাঝ খানে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র ঐতিহাসিক পারিবারিক কবরস্থান, নীলক্ষেত বাবুপুরা, বাককু শাহ মাজারে চির নিদ্রায় শায়িত হতে চেয়েছিলেন। আমার দাদার ওসিয়ত উপেক্ষা করে ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ১৯৬৯ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র মৃত্যুর এক কি দুদিন আগে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার ‘শেষের পাতা’র কলামে হেদায়েত হোসেন মোর্শেদের একটি লেখা বেরিয়েছিল। সেখানে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি জাতির উদ্দেশে কি কিছু বলবেন। তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে যে কথাটি বলেছিলেন, তা তাঁর আজীবনের সাধনা বাংলা ভাষায় নয়, ছিল ইংরেজিতে – আই উইল সুন বি ফরগটেন’। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে তাঁর জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালন করে না!

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. Your comment is awaiting moderation
    মুনীরা বশীর কে অভিনন্দন তাঁর এ চমৎকার লেখার জন্য। আমি মোর্তোজা বশির এর উপর দৈনিক ইত্তেফাকে একটি লেখা লিখেছিলাম। বিশেষ করে তাঁর শিল্পকর্ম ক্যালিগ্রাফি নিয়ে। এ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কে নিয়ে বহু লিখেছি। আজকের লেখাটি ভিন্ন ধর্মী এবং বেশ অজানা তথ্যে ঠাঁসা।

    Reply

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ