আবু তাহের সরফরাজ
যে কোনো শিল্প-মাধ্যমের স্মরণযোগ্য মোজেজা হচ্ছে, ওই শিল্প সবসময় মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের ধারাকে উন্মোচিত করে। পথ নির্দেশ করে সত্য ও সুন্দরের। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও মানুষের চিন্তার বৈচিত্র্যে সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো বদলে যায়। কিন্তু সত্যের স্বরূপ সকল সময়ে একই রকম থাকে। মানুষের সাথে আঁঠার মতো লেগে থাকতে মিথ্যে একেক সময়ে একেক রকম ভেক ধরে। কিন্তু সত্যের সে দায় নেই। সত্য স্থির ও চিরন্তন। এই সত্যের ভেতর দিয়েই মানুষকে পথ খুঁজে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আশির দশকের কবি তমিজ উদদীন লোদীর কবিতায় সত্যের পুনর্নিমাণ আমাদের চোখে পড়ে। যাপিত বাস্তবতায় যেসব ঘটনার ভেতর দিয়ে মানুষ যায় সেসব ঘটনাকে তিনি শাশ্বত সত্যের নিরিখে দেখার চেষ্টা করেন। তার এই দ্যাখা সাধারণ মানুষের দ্যাখা নয়, কবির চোখ দিয়ে দ্যাখা। ‘আগুনে জ্বলছে কিশোরীর হাড়’ কবিতাটি পড়া যাক:
দুঃখের ফেনা থেকে বেরিয়ে আসছে পুরনো ক্ষতের দাগ। বেরিয়ে আসছে হরর ছবির মতো ধোঁয়াশার ভেতরের চাঁদ। আর চিৎকারে ফাটিয়ে দিচ্ছে একাধিক নেকড়ে বাঘ।
জঙ্গুলেপনার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে তারা। লাঙলে বিভৎস রক্তের ছোপ। কারা যেন নামিয়ে দিয়েছে অস্পষ্টতার চাদর। দৌড়াচ্ছে হায়েনা ও ফেউ। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে প্যাঁচা ও ইঁদুর।
সাঁতরে পার হচ্ছে নদী, ডাঙায় ফিরতে চাইছে কুমির। রক্তের নোনা স্বাদ গড়িয়ে নামছে জলে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হচ্ছে চারপাশ আর আগুনে জ্বলছে কিশোরীর হাড়।
টানা গদ্যের ফর্ম্যাটে লেখা এই কবিতা। কয়েকটি বাক্যে একটি ভীতিকর অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বাক্যগুলো পড়তে পড়তে পাঠকের ভেতর ভীতির সঞ্চার হয়। কবিতার ভেতর দিয়ে ভীতিকর যে জগৎ লোদী তৈরি করেন সেই জগৎ আসলে আমাদের বাস্তবতারই জগৎ। যে সময় আমরা পার করছি সেই সময়ে অতীতে ঘটে যাওয়া মনুষ্য-সৃষ্ট নিষ্ঠুরতা আবার নতুন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। এই সত্যকে পুনর্নিমাণ করা হয়েছে কবিতায়। ভীতিদৃশ্যের ভাঁজে-ভাঁজে সত্য যেন ক্যামোফ্লেজ। আবরণ খুলে সত্যকে চিনে নেয়ার আত্মবোধ পাঠককেই ভেতর থেকে উত্থিত করে তুলতে হবে। কবিতাটিকে আরেকভাবেও আমরা চিহ্নিত করতে পারি। ধরা যাক, এটি একটি চিত্রনাট্য। ভাষার বর্ণনায় প্রতিটি বাক্যে যে দৃশ্য আঁকা রয়েছে সেই দৃশ্য ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করি। এরপর পর্দায় দেখতে গিয়ে দেখবো যে, এটি আসলে একটি হরর শর্ট ফিল্ম। তবে প্রতিটা দৃশ্যের আড়ালে প্রতীকী হয়ে লুক্কায়িত রয়েছে আমাদের যাপিত বাস্তবতার ভীতিকর দৃশ্যপট। কবিতার প্রতীকী মোজেজাগুলো ধরতে পারলে লোদীর অন্তর্শিল্পের সূক্ষ্মবোধ পাঠক উপলব্ধি করতে পারবে।
সময় ধাবমান। মহাকালে স্রোতে সবকিছুই খড়কুটোর মতো ভেসে চলে যায়। যা-যা নিয়ে মানুষের দম্ভ ও অহমিকা, সেসবও লীন হয়ে যায় মহাকালের বেগে। চিরন্তন এই সত্য যুগে যুগে অসংখ্য কবি নানাভাবে কবিতায় তুলে এনেছেন। এই সত্যকে লোদী তার কবিতায় এইভাবে ধারণ করেছেন: ‘কী দ্রুত আনন্দ যায়, বিষাদ যায়, অহমিকা, দাপট যায়/বিত্ত, বৈভব, চেয়ার ও সুরম্য বাগান পড়ে থাকে/রাতারাতি গোটা মানুষটাই চলে যায়।’ এই সত্য খুবই সরল ও সাদামাটা। এরপরও সময়ের নির্মম এই অভিঘাত আমরা বেমালুম ভুলে যাই। সাম্প্রতিক সময়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশের মানুষকে পুতুল বানিয়ে তাদেরকে নিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি খেলেছেন। কী অহঙ্কার তার! প্রবল গণ-বিপ্লবে যখন তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলেন তখন গণভবনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে মানুষ। লেকের পাড়ে বয়স্ক একজনকে কাঁদতে দেখে একটি ছাত্র কাছে গিয়ে কারণ জানতে চাইলো। বয়স্ক লোকটি বললো, বছর দুই ধরে তার ছোট মেয়েটি ইলিশ মাছ খেতে চাইছে। তিনি কিনে দিতে পারছেন না। অথচ হাসিনার ফ্রিজে তিনি দেখলেন বড় বড় সাইজের অনেকগুলো পাঙ্গাস ও ইলিশ মাছ। কেবল তিনিই কেন, দেশের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষের জাটকা ছাড়া বড় সাইজের ইলিশ মাছ কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নেই। সুরম্য গণভবন পড়ে আছে। শেখ হাসিনা নেই। সময়ের এমনই থাবা। অথচ চিরন্তন এই সত্য হাসিনাও জানতেন। কিন্তু মানতেন না। ভাবতেন, চিরদিন তার আমার-আয়েশেই কেটে যাবে।
যাপিতজীবনের সুখ-দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাত ও অন্তর্চেতনার বহু বর্ণিল চিত্র আমরা দেখতে পাই লোদীর কবিতায়। তার শব্দের বুননও বেশ নিখুঁত। গ্রামের নারীরা যেমন সুই-সুতোর খুব মিহি সেলাইয়ে নকশিকাঁথা বোনেন, লোদীও ঠিক একইভাবে শব্দের সুই-সুতো দিয়ে তার অন্তর্বোধের প্রকাশ ঘটান কবিতায়। সেসব কবিতা আশ্লেষে পাঠকও তাড়িত হয় শিল্পের ঘোরে। বস্তুত, শিল্পের ঘোর তৈরি করা যে কোনো শিল্পীর জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। লোদী সেই কাজটি দক্ষতার সাথে করেন কবিতার ভেতর। ‘আমাদের বিস্মৃতির ভেতর’ কবিতার প্রথম দিকের কয়েকটি বাক্য পড়া যাক:
আমাদের বিস্মৃতির ভেতর কে জানি চেঁচিয়ে বলছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে
অথচ আমাদের উঠোনে কয়লা স্তূপাকার
বাতাসে উড়ছে মরামাস, ইঁদুর খুঁড়ছে মাটি।
পুরনো পোড়োবাড়ি, দেয়ালে পেরেক ঠোকার দাগ
পলেস্তারা খসে পড়ছে অবিরাম
ছাদ ফুটো, জল ঝরছে, জল ঝরার তান।
এই কবিতায় দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার চিত্র এঁকেছেন তমিজ উদদীন লোদী। আমাদের যা-কিছু আছে সবকিছুই এখন ধ্বংসস্তূপ। ধ্বংসের চিহ্নগুলো আমাদের ঘর-গেরস্থে প্রকট হয়ে আছে। এ অবস্থায় ভেঙে পড়ছে আমাদের আত্মবিশ্বাস। দীর্ঘদিন ধরে লালন করা আমাদের বিশ্বাসগুলোও ধ্বংসের তাণ্ডবে টলে যাচ্ছে। অপমৃত্যু, আত্মহত্যা ও গুম এখন প্রতিদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। স্বজনের আর্তনাদে কেঁপে ওঠে বাতাস। এতকিছুর পরও ধসে যাওয়া স্থাপনার ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের বিস্মৃতির ভেতর থেকে কারা যেন বলে যাচ্ছে, সবকিছু ঠিক আছে। কিচ্ছু হারায়নি, নষ্ট হয়নি। একদিকে ধ্বংস, আরদিকে আশ্বাস। এটাই হয়তো মানুষের জীবন। সবকিছু হারিয়েও নতুনভাবে বেঁচে ওঠার শক্তি সঞ্চয়ের অনুপ্রেরণা। কবিতার ভেতর দিয়ে এইভাবে নানা রকম অনুপ্রেরণা পাঠকের ভেতর লোদী সঞ্চারিত করেন। ফলে তার কবিতা কখনো কখনো জীবনের সঞ্জীবনী সুধা হয়ে ওঠে।
জীবন যে কুৎসিত, এ তো আমরা সকলেই জানি। শিল্পের কাজ হচ্ছে কুৎসিত জীবনের সমান্তরালে আরেকটি জীবন নির্মাণ করা। যে জীবন সুন্দরের, আকাঙ্ক্ষার। আশির দশকের বেশির ভাগ কবির কবিতাতে আমরা এই ধারা লক্ষ্য করি। কিন্তু লোদীর কবিতা তাদের থেকে একটু ব্যতিক্রম। কারণ, লোদী কেবল সমান্তরাল জীবন নির্মাণ করেই তার শিল্পী-সত্তার দায়িত্ব শেষ করেন না। এরই পাশাপাশি তিনি কুৎসিত জীবনের ভেতর দিয়ে কিভাবে আমরা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবো, সেই শিল্প-কৌশল বাতলে দেন। মানে, আমাদেরকে জীবননিষ্ঠ হয়ে বাঁচতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি লেখেন, ‘আগ্রাসী লোভ এবং মৃত্যুভয়/এ দুটোকে যারা অতিক্রম করতে শিখে নেয় তাদের ভয় দেখিয়ে লাভ কি?’ বাক্যটি ঠিক যেন টনিক, আমাদের শিড়দাঁড়া টান রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতে উৎসাহী করে তোলে।
সমাজে যেসব মানুষের সাথে আমরা চলাফেরা করছি তাদের স্বরূপ কী রকম? বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে নিতে আমাদের পড়তে হবে তার লেখা ‘বিধ্বস্ত ম্যাটাডোর’ কবিতাটি।
ষাঁড়ের শিঙে বাঁধা লাল কাপড়
দৌড়াচ্ছে অন্ধ, ক্রুদ্ধ ষাঁড়—
যেন গ্ল্যাডিয়েটর ছুটছে প্রতিপক্ষ হানবে বলে।
কখনো প্রতিপক্ষহীন দৌড়ায় সে
প্রাকৃত অভ্যাসবশত
স্তব্ধবাক, বিষাদগ্রস্ত শ্রমিকের ওভারঅল পরা
মানুষ দৌড়ায় সাথে বিনোদন, উল্লাসে।
বিধ্বস্ত ম্যাটাডোর
ষাঁড়ের চোখে আগুন
প্রতিপক্ষ না থাকলেও সে ঘষে স্তব্ধ দেয়ালে শিঙ।
হন্যে ষাঁড় তবু খোঁজে শত্রু, খোঁজে প্রতিপক্ষ, ক্ষোভে, রোষে
শুধু পাশ থেকে মানুষ হারিয়ে যায়, ষাঁড় থাকে, ফোঁসে।
কবিতাটিতে লোদীর শিল্প-কুশলতার স্বকীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্ধ ও ক্রুদ্ধ ষাঁড় দৌড়চ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবে বলে। আবার কখনো তার কোনো প্রতিপক্ষও থাকে না। স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যেই সে দৌড়তে থাকে উন্মত্ত হয়ে। তার এই দৌড় মানুষের কাছে বিনোদন। মানুষ মজা পায়। তাই ষাঁড়ের পাশে মানুষও দৌড়ায়, আর উল্লাস করে। ষাঁড়ের এই উন্মত্ত অবস্থায় জেরবার হয়ে পড়েছে ম্যাটাডোর। সে দ্যাখে, প্রতিপক্ষ না থাকলেও ক্রদ্ধ ষাঁড় দেয়ালে ক্রমাগত তার শিঙ ঘষছে। ষাঁড় উন্মত্ত, লড়াই করতে খুঁজতে থাকে প্রতিপক্ষ। ক্রোধে ফুঁসতে থাকে। বিনোদন নেয়া শেষ হলে ষাঁড়ের পাশ থেকে সটকে পড়ে মানুষ। ষাঁড় তবু শান্ত হয় না, ফুঁসতেই থাকে। ষাঁড়ের চরিত্রটি এখানে আসলে প্রতীকী। মানুষের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা কোনো কারণ ছাড়াই ষাঁড়ের মতো উন্মত্ত থাকে সবসময়। কারণ ছাড়াই তারা আরেক মানুষকে প্রতিপক্ষ মনে করে আক্রমণ করে। রক্তাক্ত করে। এরপরও তারা শান্ত হয় না। আরও প্রতিপক্ষ খুঁজতে থাকে। যেন এটাই তাদের নেশা। মানুষের রক্ত না পেলে তাদের উন্মত্ততা প্রশমিত হয় না।
আমাকে মানুষের মুখ আঁকতে বলা হয়েছিল।
কিন্তু আমি আঁকতে গিয়ে টের পাই পৃথিবীর অন্যতম কঠিন একটি কাজে
আমার অজান্তেই আমি হাত দিয়ে ফেলেছি।
বরং শৈত্যপ্রবাহের ভেতর বরফ কুড়ানো কিংবা মরুভূমির
তপ্ত বালুর উপর হাঁটা ঢের ঢের সহজ কাজ।
কপোল, চোখ ও থুতনি আঁকতে গিয়ে টের পাই
এদের নানা ভঙ্গি ও অভিব্যক্তি অভিন্ন রহস্যের চাদরে ঢাকা।
মুখ আঁকতে গিয়ে দেখি মুখের আড়ালে আরো আরো মুখ আছে
যেন একটি দূরধিগম্য টানেল
অপার অন্ধকার ছাড়া যার সামনে আর কিছুই নেই।
মানুষের মুখ আঁকতে গিয়ে অবশেষে
আমি প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই আঁকতে পারিনি।
মানুষের মুখ
এই কবিতা পাঠের পর তমিজ উদদীন লোদীর দার্শনিক উপলব্ধির গভীরতা আমাদেরকে চমৎকৃত করে। আমরা ভাবতে শিখি মানুষের মুখ বিষয়ে। আমাদের চারপাশে প্রত্যেক মানুষের পকেটে লুকনো রয়েছে নানা আকৃতির ও বর্ণের অদৃশ্য এক-একটি মুখোশ। সময় ও সুযোগ বুঝে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে এরা সুবিধেমতো কোনো একটি মুখোশ পকেট থেকে করে টুপ করে মুখে পরে নেয়। ওই মুখোশকেই আমরা ওই মানুষের মুখ ভেবে তার সাথে মেলামেশা করি। যখন তার মুখোশ খুলে পরতে দেখি তখন অবাক হয়ে যাই। আর নিজের ঠকে যাওয়া সত্তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকি। মুখ ও মুখোশের এই দুনিয়াকে চমৎকার ও সাবলীল উপায়ে কবিতায় চিত্রিত করেছেন লোদী। মানুষের প্রকৃত স্বরূপ কিংবা মুখ চেনা যে কত্ত কঠিন কর্ম, সেটা ভুক্তভোগী মানুষমাত্রই জানে। যে মানুষকে আমরা দেখি তা আসলে ওই মানুষের মুখোশ। কবি যাকে প্রতিবিম্ব বলেছেন।
লোদীর কবিতা পড়ার এই এক মজা। তিনি জীবনের নানা বৈচিত্র্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মানুষের অন্তর্জগতের বৈচিত্র্যকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে আনেন তার কবিতায়। কবিতা নির্মাণে যেসব শব্দ তিনি ব্যবহার করেন সেসব শব্দে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। জোর জবরদস্তি নেই শব্দের ওপর। শব্দেরা তার কবিতায় স্বাধীনভাবেই দাঁড়িয়ে যায় এবং বাক্য তৈরি করে। সেসব বাক্য যে ম্যাসেজ পাঠকের কাছে পৌঁছে দ্যায় সেসব ম্যাসেজে পাঠক জীবন ও জগৎকে দ্যাখার নতুন দৃষ্টি পায়। লোদীর কবিতায় উপমা ও উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। খুব বেশি বিমূর্ত বিষয়কে তিনি পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেন না। বরং পাঠকের পরিচিত জগৎকেই তিনি শিল্পের মোড়কে নতুন রূপে উপস্থাপন করেন। জীবনযাপনের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ তার কবিতাকে পাঠকের খুব কাছাকাছি এনে দ্যায়। লোদীর কবিতা আস্বাদন করতে পাঠককে শব্দকে চিবিয়ে নির্যাস বের করে নিতে হয় না। বোধের নির্যাসেই সিক্ত থাকে লোদীর কবিতার শব্দ। ‘এলোমেলো’ কবিতায় তিনি লিখছেন:
ক্রমশ হলুদ হয়ে যাচ্ছে পাতা। ঝরে পড়ছে। উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।
অন্ধকারে কারা যেন হাঁটছে। পা ফেলছে সন্তর্পণে। কারা খুব ফিসফিস
করছে। যেন ষড়যন্ত্র পাক খাচ্ছে বাতাসে।
ওপরের বাক্যগুলো যে ছবি আমাদের চোখের সামনে এঁকে দিচ্ছে সেসব ছবিতে আমাদের জীবনের টুকরো-টুকরো ছবি ধরা রয়েছে। এক-একটি বাক্য যে ছবি আঁকছে সেই ছবি ছাড়াও আমাদের বোধের অন্তর্গত আরও ছবি বাক্যগুলোর বিস্তারে আমরা অন্তর্চোখে দেখতে পাই। মানুষের জীবন বহু বর্ণিল ও বিচিত্র্য বলেই এমনটি ঘটে থাকে। লোদী এটা জানেন বলেই তার কবিতা দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাত্রা করে। সেই যাত্রায় সহযোগী হতে পেরে পাঠকও তাড়িত হয় জীবনের গভীর উপলব্ধিতে। লোদী লেখেন:
বাইরে বাইরে বলছো ভালোবাসি
ভেতরে বলছো খুন
বাইরে বাইরে ঠাণ্ডা জল
ভেতরে জ্বলন্ত আগুন।
কবিতা যে কেবল শব্দের কাঠামো নয়, তার ভেতর বোধের স্ফুরণ থাকতে হয়, শিল্পের এই সারসত্য জেনে ও ধারণ করেই লোদী কবিতা লেখেন। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে দূর্বোধ্য কিছু-একটা লিখলেই যে কবিতা হয়ে ওঠে না, এই সত্য আমাদের অনেক কবিই বুঝতে চান না। কিন্তু লোদী কবিতায় যে বাক্যই লেখেন, তার সচেতন দৃষ্টি থাকে ওই বাক্যটির ভেতর দিয়ে যেন বোধের তাড়নার প্রকাশ ঘটে। জীবনের বহু বর্ণিল বৈচিত্র্যকে পাঠক আত্মস্থ করতে পারে। কেননা, শিল্পের সারাৎসার হচ্ছে মানুষ। মানুষই মানুষকে ভালোবাসবে, আবার মানুষই মানুষকে ঠকাবে। এটাই মানুষের বৈচিত্র্য। তাই তো লোদী লিখেছেন:
মানুষ মানুষের কাছে যায়
প্রীতির জন্য যায়
বিনাশের জন্য যায়
বিনাশ করতেও যায়
তবু মানুষ থাকতে পারে না মানুষ ছাড়া।
দ্যাখা যাচ্ছে, মানুষের মুখ ও মুখোশকে শৈল্পিক উপায়ে চিত্রিত করলেও লোদী শেষপর্যন্ত মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন। মানুষ ছাড়া মানুষের পৃথিবী শূন্য। কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের যোগসূত্র হিসেবে তিনি সত্য ও সুন্দরকে ধারণ করতে উদ্যোগী। প্রমাণ পাওয়া যায় আল কোরআনের কয়েকটি সূরাকে অবলম্বন করে লোদী কবিতা লিখেছেন। আরবি বাক্যরীতি ঠিকঠাক রেখে তিনি সূরার মূল বিষয়কে বাংলা ভাষার সুষমায় অনন্য রূপ দিয়েছেন। সূরা আল হুমাযা অবলম্বনে লোদী লিখেছেন ‘পশ্চাতে পরনিন্দা’ কবিতাটি। পড়া যাক:
দুর্ভোগ তাদের প্রত্যেকের যে আড়ালে ও সম্মুখে মানুষের নিন্দা করে
যে অর্থ-সম্পদ জমায় এবং বারবার তা গণনা করে
সে ধারণা করে যে, তার অর্থ-সম্পদ তাকে অমর করে রাখবে
কখনো নয়, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়
তুমি জানো হুতামা কি?
তা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন
যা হৃদয়কে গ্রাস করবে
নিশ্চয়ই তা তাদেরকে (পাপীদের) পরিবেষ্টন করে রাখবে
যা দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে নির্মিত।