spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধদিলওয়ারের কবিতা : সূর্য অস্ত যায় না কখনো

লিখেছেন : মোস্তাক আহমাদ দীন

দিলওয়ারের কবিতা : সূর্য অস্ত যায় না কখনো


মোস্তাক আহমাদ দীন

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে গত শতকের পঞ্চাশের দশকের কবিদের মেজাজমর্জি ও বিশিষ্টতার চিহ্নগুলো কারও কাছে আর অস্পষ্ট নয়, নানা বিচার-বিবেচনা শেষে সেই দশকের কবি বলতেও এখন হাতে-গোনা–এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় দিলওয়ারের স্থান কোথায়, এই কথা উঠলে পাঠক-সমালোচকদের মধ্যে নানা তর্ক শুরু হতে পারে। সব কবিরই কিছু-না-কিছু ভক্ত-পাঠক/সমালোচক থাকে, এখানে তারা বিবেচ্য নয়, বলছি সময়নির্ধারিত রুচির কথা, বলছি কালোত্তরণের নানা হিসেবনিকেশের পরের কথা–যেখানে দিলওয়ারের কাব্যবৈশিষ্ট্য সদর্থ-নঞর্থ দুই অর্থেই পৃথক। পঞ্চাশের প্রধান কবিদের প্রথম বইয়ের সঙ্গে দিলওয়ারের প্রথম বই জিজ্ঞাসাকে পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে বিষয় ও আঙ্গিক উভয় দিক থেকেই এ-কথার যাথার্থ্য মিলবে, আর এ-জন্যই, পঞ্চাশের দশকের কবিতার অধিকাংশ আলোচনায় বিষয়গত কারণে এবং সময়ের বহুজট যুগ-যন্ত্রণা ধারণ করেনি বলে দিলওয়ারের নামটি রয়ে যায় অনুল্লিখিত।
পঞ্চাশের দশকের কবিরা বিষয় ও আঙ্গিক দুই দিক থেকে জীবনানন্দ ও তিরিশ/চল্লিশ-এর দশকের কবিদের নানা অভিব্যক্তি এবং বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার কাব্যচেতনা থেকে প্রেরণা নিয়ে যে-কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন, দিলওয়ার সে-পথে যাননি। তাই বলে তিরিশের দশকের কবিদের সময়ে বাস করেও যতটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখে নজরুল ও জসীম উদ্দীন কবিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সমকালিকদের সঙ্গে দিলওয়ারের কাব্যচেতনাগত দূরত্ব ততটা নয়। ষোলো বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ জিজ্ঞাসার কথা বাদ দিলে, পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ থেকে অঙ্গিকগত দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে।
তবু দূরত্ব যেটুকু রয়ে গেছে, তা আঙ্গিকগত নয়, বিষয়গত–এবং এই দূরত্ব অচেতন সাহিত্যচর্চার পরিণাম নয়, এই দূরত্ব ইচ্ছাকৃত এবং অবশ্যই কাব্যাদর্শগত। দিলওয়ার নানা চিন্তাভাবনা করে তাঁর লেখার গতিমুখ বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছে লিখেছিলেন :

…একটা কথা বারবার আমাকে তাতিয়ে তুলত। প্রশ্ন জাগত, এখানে কী ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হবে?…
যেহেতু আমার চারদিকের বৃহত্তর মানবতার দারুণ শোকাবহ জীবন আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলত, আমি তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেছি অত্যন্ত সাদামাটা সেই জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ বক্তব্য তুলে ধরতে।

তাঁর এই সাদামাটা জীবনের অন্তরঙ্গ বক্তব্য উপস্থাপনার সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের অন্যান্য কবির বহুজট যুগযন্ত্রণা-ধারণকারী কাব্যচেতনার দূরত্ব চোখে পড়ার মতো। এ-কথার সত্যতা খুঁজে পেতে গেলে দিলওয়ারের প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতার পাশে বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের চার কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতা থেকে কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে :

শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ
অথবা প্রখর ধূ ধূ পিপাসায় আঁজলা ভরানো পানীয়ের খোঁজ
শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্ণের কাছে এসে রোজ
চাইনি তো আমি। দৈনন্দিন পৃথিবীর পথে চাইনি শুধুই
শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল।
[রূপালি স্নান/শামসুর রাহমান]

ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে
আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে
তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায়
নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহূর্তমুকুরে।
[বিষয়ী দর্পণে আমি/আল মাহমুদ]

বৃষ্টি এসে ভেজায় কখন নাগেশ্বরীর মাঠ।
দুরন্ত এক বাতাস নাড়ে বুনো চালতা ফলÑ
হৃদয় যেন। রংগপুরের কনকরঙা মেয়ে
হঠাৎ সাড়া জাগিয়ে দিয়ে লুকোয় পরান পণে।
এই দেখেছি এই দেখিনি বৃষ্টিভেজা মাঠ।
[বুনোবৃষ্টির গান/সৈয়দ শামসুল হক]

সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘরে-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে
যারা ছিলো তন্দ্রালস দিগি¦দিক ছুটলো, চৌদিকে
ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মতো যেনবা মড়কে
শহর উজাড় হবে,–বলে গেল কেউ–শহরের
পরিচিত ঘণ্টা নেড়ে নেড়ে খুব ঠান্ডা এক ভয়াল গলায়
[বৃষ্টি, বৃষ্টি/শহীদ কাদরী]

পৃথিবীতে এসে কেঁদে যায় যারা বেদনার গেয়ে গান;
হতাশার কালো নয়নে মাখিয়া তপ্ত নিশ্বাস ফেলে :
নত করি শির চরণে নিজের দুঃখের পসরা ঠেলে,
মহাজীবনের ললাটে আঁকিয়া তলোয়ার খরশান্
তাদের বিফল জীবনের লাগি, বলো ঠিক দায়ী কারা :
বিধি না জনক? শাক্ত না ধনী? কোথায় জবাব তার
লুকালো কোথায় উত্তরদাতা, সে কোন অন্ধাগার?
নিবিড় আবেগে কাঁপিছে আমার দুইটি আঁখির তারা!
[জিজ্ঞাসা/দিলওয়ার]

আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক ও শহীদ কাদরীর কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশের সঙ্গে দিলওয়ারের জিজ্ঞাসা কাব্যগ্রন্থের নামকবিতার চেতনাগত দূরত্ব অনেক, এমনকি শামসুর রাহমানের কবিতাটির সঙ্গে ছন্দগত সাদৃশ্য সত্ত্বেও এর মধ্যে ফরহাদ মজহার যে ‘কড়া রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রতিজ্ঞা’ খুঁজে পেয়েছেন, তার সঙ্গেও দিলওয়ারের রাজনীতি/গণচেতনার পার্থক্য দুস্তর। এর কারণ, পঞ্চাশের অন্য কবিরা যেখানে তিরিশের প্রধান কবিদের পরম্পরা ধারণ করেছেন, তিনি তা করেননি, এ-দিক থেকে তাঁর পূর্বসূরি নজরুল, সুভাষ ও সুকান্ত। পরবর্তীকালে বাংলা কবিতা নজরুল-সুভাষ-সুকান্ত-এর পথে না এগোলেও, দিলওয়ার সেই পথেই এগিয়েছেন, যে-কারণে বিষয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে তাঁর কবিতা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখলেও, পরবর্তীকালের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের মধ্যে তাঁর লক্ষযোগ্য অনুসারীর খোঁজ পাওয়া যায় না। সময়-রাজনীতি-গণমাধ্যমের নানা প্রভাবে এই বিশেষ মাধ্যমটির এমন ধারার স্বভাবকবিসুলভ উচ্চারণের অর্থ ও অনর্থময়তা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন পঞ্চাশ ও পঞ্চাশ-পরবর্তী কবিদেরকে যুগযন্ত্রণার নানা চাপে চেতনায় সূক্ষ্ম-সংবেদনময় গূঢ় পথ অবলম্বন না করে উপায় ছিল না। ফলে এঁদের চেতনাজগৎ নানা কারণে হয়ে উঠেছিল জটিল : কেউ কেউ সমাজচেতন, কেউ কেউ হতাশাতাড়িত বলে পলায়নবাদী ও ক্ষয়শীল, কেউ কেউ রোমান্টিক ও আত্মপরায়ণ, এর মধ্যে দিলওয়ারের স্বচ্ছ সাদামাটা একমাত্রিক গণচেতনাকেই মনে হয় যেন আরেকরকমের পলায়ন। স্বীকার করা উচিত, এই চেতনার বাইরেও দিলওয়ারের কয়েকটি কবিতা গণচেতনাময় কবিতাগুলোর ফাঁকে-ফোকরে ছাপা হয়েছে, সেগুলোকে দুর্ঘটনা ভাবা মুশকিল, অন্তত ‘দুই বাঁক’(-এর ১ সংখ্যক কবিতা) এবং ‘জনৈক বিত্তবান কথক’, ‘বিধর্মী মোৎয়েমের কবিতা’ এবং ‘প্রেম : নির্ভয়’-এর মতো কবিতা যিনি লিখেছেন, নিশ্চয়ই এই ধারায় তাঁর আরও অনেক বলবার ছিল, কিন্তু সেই আগুন ছাইচাপা রেখে, বলা উচিত অবদমিত রেখে, বৃহত্তর ডাকে নিরন্তর সাড়া দিয়ে গেছেন কবি এবং সেই দায়পালনের চিন্তায় তিনি ছিলেন আমৃত্যু কাতর ও অতৃপ্ত। দিলওয়ারের কবিতা পাঠ ও বিবেচনার ক্ষেত্রে এই কথাটি মনে রাখলে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হবে।


১৯৮৭ সালে দিলওয়ারের জন্মের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত নির্বাচিত কবিতার শেষ প্রচ্ছদে মুদ্রিত মন্তব্যে উল্লিখিত হয়েছে :

সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় অনাচার ও শোষণ তাঁকে পীড়া দেয় এবং তিনি এর বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠকে সোচ্চার করে তুলেছেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পসম্মতভাবে, প্রচারসর্বস্বতাকে পরিহার করে।

কথাটি দিলওয়ারের ক্ষেত্রে আংশিক সত্য, প্রথম কাব্যগ্রন্থ জিজ্ঞাসায় প্রচারসর্বস্বতা প্রকটভাবেই ছিল, নামকবিতাসহ ‘এবার এল’, ‘মাউ মাউ-দেরে’, ‘কোন এক এগারো বৎসরের ধর্ষিতা মেয়েকে’ কবিতাগুলোর বিষয় গণচেতনারই পরিচয়বহ, কিন্তু সেগুলোতে প্রচারের হাওয়া তীব্রতর হওয়ায় শিল্পের দায় অক্ষুণœ থাকেনি।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ঐকতান-এ এই চেতনা পরিশীলিত হয়েছে, কোথাও কোথাও বক্তব্য আরও জোরালো হওয়া সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত উতরে গেছে। বইটির শুরু হয়েছে পরবর্তীকালে বিপুল জনপ্রীতিপ্রাপ্ত ‘কীনব্রীজে সূর্যোদয়’ কবিতাটির মাধ্যমে এবং এ-কবিতাটি তাঁর সমগ্র কাব্যজগতের প্রবেশপথ রূপে বিবেচিত। কবিতাটির ভাষা সাবলীল ও স্বচ্ছ, এতে আছে ‘জনতার চলা’র বর্ণনা, কিন্তু এই গুণটিই শুধু এ-কবিতার বিশেষত্ব নয়, এ-‘চলা’র সঙ্গে আকাশবাতাসসূর্যরাত্রিপাখি এবং নদী সংশ্লিষ্ট হয়ে তার সঙ্গে জীবনব্যাপারের নানা প্রসঙ্গ জড়িত হওয়ায় কবিতাটি সপ্রাণ ও গতিময় হয়েছে–এখানে কবি শোনেন কলকল বেগবতী সুরমার ভাষা, যার গতিবন্ত প্রাণ জীবনের আশা-সম্ভাবনার সমতুল্য, যে-বীজ সৃষ্টিক্ষেত্রে ‘অক্ষয় প্রজ্ঞার’ বীজ বোনে, আর সবচেয়ে বড়ো কথা–যা তার কাব্য-অভিপ্রায়ও বটেÑকরুণ রজনিকে অন্তর্হিত করে বর্শার ফলার মতো সেই সূর্যরশ্মির আবির্ভাব :

ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা
কীন্ব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।

সম্পূর্ণ ব্রীজটি এখানে ইটপাথরসিমেন্টে-বাঁধানো খাঁচার প্রতীক, তার ওপর আঘাত না হানলে, বলা উচিত, না হানালে/না জাগালে ‘জনতার চলা’ শুরু হয় না, অথচ জনতাকে ‘চলা’নো, এগিয়ে-দেওয়াই তো কবির উদ্দেশ্য, আমৃত্যু এই কাজটিই করে যেতে চেয়েছেন দিলওয়ার। অন্যান্য কবিতা বা কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তার রূপ ভাব ও প্রকৃতি হয়তো ভিন্ন, কিন্তু সেখানেও তা-ই করতে চেয়েছেন, কারণ এই ‘চলা’য় পথিক নিজেও তো কবির কাছে প্রতিশ্রুত : ‘মনে রেখো তুমি দিয়েছ আমারে কথা/যেখানে আঁধার সেখানেই তুমি জ্বলবে’ এবং এ-ক্ষেত্রে, এই ‘চলা’য়, তিনি খুবই একাট্টা ও দুঃসাহসী :

মনে রেখো তুমি : পরম দয়ালু বিধি
নরদানবের শিবিরে নিয়েছ ঠাঁই,
বুকে ধরে এই শুভ প্রত্যয় নিধি,
ঈশ্বর হতে আমরা চলেছি তাই।

এই ‘চলা’টা বা ‘চলা’নোটাই এ-ধারার কবিদের সার্থকতা, অন্যভাবে ভোগবৃত্তিতে বা স্থিরশান্ত ঔদাস্যেও তাঁরা সবসময় অতৃপ্ত। তাঁর পূর্বসূরি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো স্পষ্টভাবেই লিখেছিলেন, তাঁকে কেউ কবি বলুক, তিনি তা চান না, তিনি চান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হেঁটে যেতে, এটাই তাঁর লক্ষ্য :

আমি চাই কথাগুলোকে
পায়ের উপর দাঁড় করাতে।
আমি চাই যেন চোখ ফোটে
প্রত্যেকটি ছায়ার।
স্থির ছবিকে আমি চাই হাঁটাতে।

রবীন্দ্রনাথ কবিতাকে যে ‘সবাক ছবি’ বলেছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কিন্তু তাঁর কবিতা যা বলে বা বলতে চায়, তা হল : ছবিকে শুধু বাক্সময় হলে হয় না, তাকে স‘চল’ হতে হয়, হাঁটতে হয়, হাঁটাতে হয়। এর জন্য শক্তি ও গতি দরকার–এই গতি সুভাষ কি সুকান্ত, নজরুল কি দিলওয়ার সংগ্রহ করেছেন নানাবিধ উৎস/নজির থেকে। দেখা গেল ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা চাঁদে গেলে তার সেই গতিকে চলার/ওড়ার প্রেরণারূপে অনায়াসে ব্যবহার করলেন দিলওয়ার : ‘পণ করেছে কাব্য আজ বুঝি/“ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা” হবে,/রইবে না সে গৃহের কোণ খুঁজি/মেলবে ডানা অলৌকিক নভে’। দিলওয়ার তাঁর কবিতায় পথচলার এই প্রেরণা গ্রহণ করেছেন চারপাশের উদাহরণ থেকে, কখনো রাজনীতি-ইতিহাস-পুরাণ-এর নানা চরিত্র ও ঘটনা এবং পূর্বসূরি কবিদের কাছ থেকে।


মার্ক্স, লেনিন, নেলসন মানদেলা, পল রোবসনসহ আরও কিছু ইতিহাসখ্যাত চরিত্রের প্রতি দিলওয়ারের পক্ষপাতের পরিচয় তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোতে রয়েছে। উদ্ভিন্ন উল্লাস কাব্যগ্রন্থের ‘অমোঘ সত্য’ কবিতায় লিখেছিলেন, পৃথিবী এখন অমাবস্যার অন্ধকারে লেনিনের হাত ধরে ‘দীপিত তারা’ খুঁজছে, লিখেছেন : ‘পৃথিবী এখন লেনিনের বুকে পেতেছে আপন কান’; ঐকতান-এর ‘নেলসন মানদেলা : একটি আগ্নেয় স্মরণ’ কবিতায় লিখেছেন, তাঁর বজ্রনাদ শুনে ধবল প্যান্থার ও শ্বেতাঙ্গ অসুরবৃন্দ কীভাবে জ্বরার্ত শিশুর মতো কাঁপছে, একই বইয়ের ‘শেকস্পিয়ার’ কবিতায় অবাক বিস্ময়ে ‘জীবনের রক্তের গভীরে’ শুনেছেন তাঁর কালোত্তীর্ণ কণ্ঠ : ‘কালের নমস্য এই স্মৃতির সুরভি মেখে দেহে/অখণ্ড পৃথিবী চাই কর্মিষ্ঠ বিধির শতো স্নেহে’; আর রক্তে আমার অনাদি অস্থি বইয়ের ‘ফেডিপাইডিসের প্রতি’ কবিতায় উল্লিখিত হয়েছে বিশ শতকের হারকিউলিস এখন শতাব্দীব্যাপী দানব দমনে অস্থিচর্মসার, সে এখন নেড়ি কুকুরের সঙ্গে খাদ্যলাভের চেষ্টায় ব্যস্ত, তাই কবির উক্তি : ‘ফেডিপাইডিস, আমি যন্ত্রণার সমস্ত শাখা প্রশাখা/কেটে ছিন্নভিন্ন করে দেব/যদি তুমি আমাকে আত্মঘাতী আলস্য নাশের মহামন্ত্র দাও’–বিভিন্ন উৎস হতে আহরিত এই প্রেরণা আসলে সমষ্টির চেতনা, কবি যাকে বলছেন ঐকতান। এমনিতে ঐকতান কাব্যগ্রন্থের নামকবিতাটি রচিত হয়েছিল একুশে ফেব্রæয়ারির পটভূমে, এর বিষয় মাকে লক্ষ্য করে সন্তানদের বক্তব্য, তার স্বর উত্তম পুরুষের বহুবচন–শেষ স্তবকে এসে এর স্বর-ব্যঞ্জনা আর ভাষা-পটভূমির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি :

রাতের কপালে দিনের খড়্গাঘাত
আমরণ তাই আমরা চালিয়ে যাবো,
অন্তরে রবে তোমার কমল হাত,
ঐকতানেই নিখিলের প্রাণ পাবো।

এই ঐকতান-এর চেতনাই তার কাব্যচিন্তার মূলাধার, যার প্রমাণ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন উদ্ভিন্ন উল্লাস বইয়ের ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায় :

ঐকতানেই রয়েছে আমার জীবনের শেষ সত্য
দীর্ঘ আয়ুকে করে গেছি তাই শ্রম-সাধনার পথ্য।

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন ‘জীবনদেবতা’, তেমনই তাঁর কবিতায় ‘ঐকতান’–যে-চেতনা ব্যষ্টিচেতনাকে ভুলিয়ে দেয়, এমনকি শয্যাপর্যন্ত যে সেই চেতনা প্রবল হয়ে আছে তার প্রমাণ রয়েছে ঐকতান কাব্যগ্রন্থের ‘একটি প্রশ্ন : বউকে’ কবিতায়। রাতে একটি ছোটো বিছানায় রয়েছেন পাঁচ জন, বাইরে তিমিরে ঘামছে পেঁচা ও ইঁদুর, ওদিকে রাতের বাসরে ক্ষুধার কারণে পাহাড়ি ফুলের গাছে বাঘের শানানো থাবা। কবিতার শেষ দুটি স্তবক পড়লে বোঝা যায় কী কারণে কবির ব্যক্তিগত জীবন নৈর্ব্যক্তিক জীবনচেতনায় একাত্ম হয়ে ঐকতান-এ কণ্ঠ মিলিয়ে স্বস্তি খুঁজেছে :

ছোট্ট ঘরের পরিবেশে নই
আমরা পাঁচ :
শোনো কথা কয় হাজারো জনতা :
ডাঙার মাছ।

গৎবাঁধা এই মঠের জীবন :
রাত্রি বাস,
বলো তো আনছে জীবনে কাদের
সর্বনাশ?

বোঝা যায় তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ-প্রেম প্রভৃতির অনুভব কীভাবে ঐকতানের প্রভাবে আচ্ছন্ন থেকে গেছে সবসময়, কিন্তু এ-নিয়ে তার কোনো খেদ ছিল না। বরং প্রেমের অর্থ যে তাঁর কাছে নরনারীর প্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় সেই মনোভাব স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে অনেক কবিতায়। উদ্ভিন্ন উল্লাস-এর একটি কবিতার শিরোনাম ‘একটি প্রেমের কবিতা’, প্রচলিত ধারণায় মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এখানে থাকবে ব্যক্তিগত প্রেমের প্রসঙ্গ, কিন্তু আসলে তা নয়–সুকান্ত ভট্টাচার্যকে উৎসর্গিত এই কবিতাটিতে রয়েছে সুকান্ত তাঁর জীবনে আদর্শনিষ্ঠার কারণে একান্তভাবে যা যা গ্রহণ করেননি তার তালিকা : কারো খোঁপার ফুলের গন্ধ, রাতুল পায়ের ছন্দ, ব্যাকুল মনের আবেগমুখর দ্বন্দ্ব, যক্ষের মেঘমন্দ্র, অভিসার-রাতের পূর্ণচন্দ্র, অস্থিরতার রন্ধ্র এবং হিংগুল সম্বিৎ প্রভৃতি, কারণ, ‘শ্রমজীবী প্রেমে জাগে সুকান্ত বিশ্ব’। তাঁর একাধিক কবিতার শুরু হয়েছে প্রেমাস্পদকে সম্বোধন করে, কিন্তু তাতেও কোনো ধরনের ভাবাবেগের প্রকাশ নেই। ‘মর্মজ্বালা’ কবিতায় রয়েছে প্রিয়তমার চোখের জলে তার পৌরুষ বিপন্ন হওয়ার কথা, বিবেকের সূচিমুখ দংশনে-দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার কথা; ‘একটি বিনিময়’ কবিতায় রয়েছে জাতিসংঘের সদর দপ্তর ও তার অনন্ত ক্ষমতার জলজ্যান্ত ছায়ার প্রসঙ্গ, যা তাঁর প্রিয়তমা দেখতে চেয়েছিল; তাঁর স্ত্রী আনিসাকে সম্বোধন করে শুরু হয়েছে ‘নেল্সন মানদেলা : একটি আগ্নেয় স্মরণ’ কবিতাটি, কিন্ত সেখানেও নেই কোনো ধরনের ভাবাবেগ :

আনিসা শুন্তে পাও ‘উহুরু’ ‘উহুরু’ সেই ডাক?
অগ্নিগোলকের মতো কৃতঘ্ন আঁধার ভেদ করে
সে ডাক ছুটন্ত দ্যাখো। রৌদ্র নৃত্য কালের অধরে!
কৃষ্ণ সাগরের স্রোতে শ্বেত দৈত্য আতংকে নির্বাক।

দিলওয়ারের কবিতায় এই চেতনা শুরু থেকেই ছিল–১৯৫৩ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে প্রকাশিত জিজ্ঞাসা কাব্যের ‘প্রিয়ার ঠিকানা’ কবিতাটির কথা মনে করা যেতে পারে : ‘যাক তাহা যাক শুনো হে এবার/কোনখানে থাকে প্রেয়সী আমার :/বেদনার যুগছবি,/তাহারে ঘিরিয়া করে জ্বালাতন/ক্ষুধার রুদ্ররবি’ এবং তার পঞ্চাশ বছর পরে সাতষট্টি বছর বয়সে প্রকাশিত সপৃথিবী রইবো সজীব কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন ‘ঝরে যাওয়া যাকে বলো/কুঁড়ি তারে বুকে চায়,/থাকে ফুল সৌরভে/ডাকে কারে–বুকে আয়?/প্রশ্নের উত্তরে ফুটো তুমি অন্তরে,/দ্যুতি তার অগণন নক্ষত্রেই’; এবং ২০০৫ সালে ‘একজন প্রেমিক : কার্ল মার্কস’ কবিতায় লিখেছেন ‘বিশ্বের হৃদয় থেকে অকাল মৃত্যুর দুঃখবোধ/দিগন্তে তাড়িয়ে দিতে প্রেম তার যাত্রা শুরু করে,/রাজকন্যে সঙ্গে ছিল, ছুড়ে মেরে অসাম্য বিবরে।’ দিলওয়ার তাঁর এই ‘প্রেম’-এর ধারণা ‘আমার মৃত্যুর পর’ কবিতায় বহু আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন তাঁর সেই প্রেমিক হৃদয়ের কথা, যে-হৃদয় জন্মান্ধ আবেগ নিয়ে বারবার বাস্তবকে অস্বীকার করেছে, (কিন্তু তা একক কারো জন্য নয়) তাই যখনই বুক খুলে ধরেছেন বীণার জন্য, সেখানেই বেজেছে বন্দুক, বারবার বিদীর্ণ হয়েছে প্রত্যয়, আর সে কারণেই তাঁর প্রেম আর একক কারো সঙ্গে যুক্ত না হয়ে যুক্ত হয়েছে বাংলার সঙ্গে–বাংলার বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে :

আমার মৃত্যুর পরে তাই যদি তুমি
কখনো খুঁজতে যাও এই মর্মভূমি
মনে রেখো তবে :
বাংলার হৃদয় নিয়ে কেটেছে আমার দিন
প্রতীচ্যের যুক্তির রৌরবে।

অন্যত্র, ‘পৃথিবী স্বদেশ যার, আমি তার সঙ্গী চিরদিন’ বলে বৈশ্বিক চেতনার স্পষ্ট ঘোষণা দিলেও তাঁর হৃদয়-মন আজন্ম বাংলার মাটিতেই প্রোথিত : তাঁর রক্তে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা-কর্ণফুলির মিলিত স্রোতের ধারা। এমনিতে তাঁর কবিতায় যে-আশাবাদের কথা উচ্চারিত, তার সঙ্গে শুধু বাংলার নয়, পৃথিবীর বহু মনীষার/বহু মানুষের তানও এসে মিলেছে, যার পরিণামই হলো ‘ঐকতান’-এর এই সবিশেষ চেতনা।
এরপরও কথা থেকে যায়…


দিলওয়ারের শেষদিকের কাব্যগ্রন্থ দুটি সপৃথিবী রইবো সজীব ও দুই মেরু, দুই ডানা প্রকাশিত হয়েছিল যথাক্রমে ২০০৪ ও ২০০৮ সালে এবং দুটি কাব্যগ্রন্থই আমাদের কাছে তাঁর মূল কাব্যচেতনার নিকট-দূর উভয় দৃষ্টান্তের নজির হয়ে আছে। দিলওয়ারের আগের কাব্যগ্রন্থগুলোতে যে-ঐকস্বর ছিল, এমনকি দিলওয়ার রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশকালে রক্তে আমার অনাদি অস্থি কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে কবি যে বলেছিলেন ‘এই কবিতাগ্রন্থে রয়েছে ৪৫টি বিভিন্ন মেজাজের কবিতা’, এই বিভিন্নতার পরও এবং এতে ‘বিধর্মী মোৎয়েমের জন্য কবিতা’র মতো ‘হৃদয়ঘটিত’ স্রোতের ব্যতিক্রম উদাহরণ সত্তে¡ও বইটির ঐকস্বর ক্ষুণ্ণ হয়নি; কিন্তু সপৃথিবী রইবো সজীব বইয়ের ‘মেনে নাও সৌর মৌলবাদ’, ‘চক্ষুষ্মান অন্ধ মানুষের জন্যে’, ‘গালিব আমার গজলে’, ‘অন্য জলে স্নান’, ‘অলৌকিক না হলে মানুষ’, ‘নিঃসঙ্গ শামসুদ্দীনের কথন’ ও ‘মৃত কুকুরের ভাবনায়’ কবিতাগুলোর সূ²গভীর মরমি চেতনা বইয়ের গণমুখী কবিতাগুলোকে আচ্ছন্ন করেছে। দিলওয়ারের কবিতায় গণচেতনা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, অনুরাগীদের কাছে তা কাঙ্ক্ষিতও বটে, কিন্তু তাঁর দীর্ঘ কাব্যযাত্রার কথা বিবেচনায় আনলে এই চেতনা অভাবিত না হলেও দূরভাবিত। অভাবিত নয় এই কারণে যে, আগের কাব্যগ্রন্থগুলোর কিছু কবিতায় এই চেতনা মাঝেমধ্যে উঁকি মেরেছে–যেমন মনে করা যেতে পারে উদ্ভিন্ন উল্লাস-এর ‘বিত্তবান জনৈক কথক’ কবিতাটির কথা, যেখানে ‘বুকের জোড়া ফুল’-এ রসিক বিধাতার ‘অপরূপ প্রমাণ’ আর মদের পেয়ালায় কবি খুঁজে পেয়েছিলেন বিধাতার ‘সরস আসনাই’-এর খোঁজ; আরও কিছু কবিতায়ও এমন পরিচয় রয়েছে, তবু তা কখনো প্রবল হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এই বইয়ে একসঙ্গে এতগুলো কবিতা নতুন পথেরই পরিচয়বহ এবং এই পরিচয়ের কারণে তাঁর কাব্য-ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যে-গণচেতনা, তা যদি ক্ষুণ্ণও হয়, তবু আমাদের কাছে এই নতুনত্ব সাহস ও সদর্থ সফরের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এই কাব্যগ্রন্থের ‘ধর্ম : একটি স্বগতোক্তি’ কবিতাটি পড়ে বোঝা যায় এক নিবিড় আত্মযাত্রা শুরু করেছিলেন কবি–লিখেছিলেন :

বৃথাই খুঁজলাম তোমার অকৃত্রিম মূল
তোমার বিশাল ড্যাবডেবে চোখ
কবে একদিন প্রেমের ভাষায়
কথা বলত–কেহই বলতে পারে না

দেখো, তোমার চিরাচরিতের পথ থেকে
ক্রমশই সরে যাচ্ছি আমি
এই আমি–এক মানুষ,
আমার বুকেই ফিরে যাচ্ছি আমি,
কী মহান আমার অখণ্ড প্রেমাচার

ডাইনে আমি বাঁয়ে আমি
দুই মেরুর মর্মমূলে, দেখো আমার বিপুল জন্মোদয়!

কবিতার শেষ তিনটি স্তবক একসঙ্গে উদ্ধৃত করার কারণ, কবির মরমি সফরের রহস্য/পরিচয় এতে স্পষ্ট। এই চেতনার সবচেয়ে উজ্জ্বল ও মর্মান্তিক উদাহরণ হল ‘অলৌকিক না হলে মানুষ’ এবং ‘নিঃসঙ্গ শামসুদ্দীনের কথন’ কবিতা দুটি। প্রথম কবিতায় রয়েছে শিশুর হাতে ঈশ্বরের অন্তিম আর্তনাদের খবর : ‘যেহেতু এইমাত্র শিশুর নিথর দেহ/শুভ্র কাফনে হলো ঢাকা/বিশ্বময় উপাসকের এই শূন্যস্থান/আর তো কখনো/পূর্ণ হবার নয়’, কারণ, তাঁর মতে, ঈশ্বরের মতো মানুষও অলৌকিক। এই একরূপতা সুফি ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর আগ্রহকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তার প্রমাণ রয়েছে দ্বিতীয় কবিতা ‘নিঃসঙ্গ শামসুদ্দীনের কথন’-এ। সুফি-কবি জালাল উদ্দিন রুমির মুর্শিদ শামসুদ্দীন, যিনি শামস তাবরিজি বা তাবরিজের শামস বলে পরিচিত। কবিতার নিজের-করে-নিয়ে কবি নিজেকে নিজ-অস্তিত্বের পর্যটক রূপে অভিহিত করে জানিয়েছেন নিজের আস্তিত্বিক প্রেম-সফরের কথা, যার ‘অসীম দহনে’ তিনি নিজেই জালাল উদ্দিন রুমির ‘সামা’য় পরিণত। দ্বিতীয় স্তবকে ভাব আর অস্পষ্ট থাকে না, তবে এখানে রুমির মুর্শিদ/বন্ধু শামস তাবরিজির প্রসঙ্গ এনে এমন এক প্রসঙ্গের উল্লেখ করেন, রুমি ও শামসের জীবনের সাক্ষাৎকারপর্ব ও ঘটনাবলি স্মৃতিতে না-থাকলে যা আস্বাদন করা কঠিন। শুরুতে যে-রুমি শরাপন্থী, সেই রুমির সুফি রুমিতে পৌঁছনোর প্রেম-দহন-ক্রন্দন/যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা ও পরিণামের শেষে রুমির যে-অনুভব, ঠিক তাই যেন অনুভব করলেন দিলওয়ার :

শামস তব্রেজির লাশ, মনে হয় আমারই শরীরে
ধারণ করছি আমি
তাই কোনো অন্য প্রিয়তমা
জীবনে আসেনি আজো
বুকে ধরে প্রেমের তর্জমা,
স্বজনেরা ধরে রাখে খোঁজ, আর যারা সুহৃদ রুধিরে!

আমাদের কাছে এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা, পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের ‘খোঁজে আয়ু লাশের ঠিকানা’, ‘শব্দের কফিন এবং’, ‘তৃতীয় বিশ্ব থেকে’ এবং সর্বোপরি ‘মজনুর প্রার্থনা’ পর্যন্ত ঘটেছে যার অর্থময় বিস্তার। ‘মজনুর প্রার্থনা’ কবিতার আগে ‘সর্বোপরি’ এজন্যই ব্যবহার করেছি যে, এই কবিতার শেষ স্তবকেই কবি উচ্চারণ করেছেন এই মরমি পঙ্ক্তিগুলো :

লাইলী, তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবো আমি
সম্পূর্ণ মহাকাশকে জায়নামাজ বানিয়ে
তার অতলগভীর মাঝখানে সেজ্দায় আনত হবো আমি
আর তুমি, আমার রক্তের শারাবান তহুরা,
প্রভুর আনন্দাশ্রু হয়ে ঝরতে থাকবে
আমার ধ্রুপদী উপাসনায়,
আমার মানুষী কামনায়!

সুফি ধারার প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব আর প্রেম না-থাকলে মজনুর মুখে এমন সাহসী কথা তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।
এরপরও বলতে বাধ্য যে, তাঁর কিছু কবিতায় এরকম অসাধারণ কিছু পঙক্তি/চিহ্ন রেখে গেলেও, আয়ুগত কারণে বা অন্য কোনো কারণেই হোক, এ-ছিল তাঁর এক অসমাপ্ত সফর। এতকিছুর পরও দিলওয়ার এই বইয়ের শুরুতে ‘প্রসঙ্গত : আমি’ শিরোনামে যে-কথাগুলো বলেছেন তাতে কারোই বুঝতে বাকি থাকে না যে তিনি নিজেকে ‘গণমানুষের কবি’ বলেই ভাবতে পছন্দ করেন এবং নিজেকে রবীন্দ্রকথিত ‘ঐকতান’ কবিতায় উল্লিখিত ‘মাটির কাছাকাছি’ কবির জায়গায় দাঁড়-করানোর উচ্চাকাক্সক্ষা পোষণ করেন; অথবা, হয়তো একাধিক নিকট-দূর/সুদূর চেতনার ‘তান’-এর সমন্বয়ের ধারণাই তাঁর ‘ঐকতান’-এর দর্শন, কারণ তিনি নিজেই তো বলেছেন : ‘একটি গোলাপ চারা নিরন্তর বলে যায়–/প্রাঙ্গণে কি গোরস্তানে যেখানেই রোপন করো/আমি জন্ম দেবো ফুলের রাণী, গোলাপ’,–দিলওয়ারের নানা ধরনের কবিতার সংগ্রহ ভবিষ্যৎ পাঠকের জন্য সেই বিশেষ চেতনারই উদাহরণ হয়ে থাকবে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ