———————————————
মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ
ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর
———————————————
উপস্থিত সকল বাংলাদেশি, ফরাসি বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি নাগরিক তথা অভিবাসীরা সালাম ও শুভেচ্ছা নিবেন। আপনারা সকলেই জানেন চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এক অভুতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেছে।
দীর্ঘ ৩৬ দিনের লড়াই শেষে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে ফ্যাসিবাদী সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এটি বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সবশেষ তথ্য অনুসারে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের হাতে নিহত হয়েছেন মোট ১,৫৮১ জন। আন্দোলনে নিহতদের বেশির ভাগই তরুণ এবং দরিদ্র পরিবারের। যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এখন পর্যন্ত মোট ২২ হাজার ৯০৭ জন আহতের তথ্য পাওয়া গেছে।
এবারের গণ অভ্যুথানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ার থেকে প্যারিসের রিপাবলিক চত্ত্বর, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে কানাডার ক্যাম্পাসগুলো উত্ত্বাল ছিল বাংলাদেশিদের আন্দোলনের ঝড়ে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ছোট বেলায় দেশপ্রেমের কথা বই পুস্তকে কিঞ্চিৎ পড়ার সুযোগ হলেও ব্যবহারিক জীবনে প্রথমবারের মতো দেশপ্রেমের চেতনা বুঝতে শিখেছি এই আন্দোলনে। দেশ মাতৃকার টানে রাতের পর রাত মোবাইল ফোনে স্ক্রিনে নির্ঘুম কাটিয়েছে লাখো অভিবাসী।
এক পর্যায়ে ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বৈরাচারকে ‘লাল কার্ড’ দেখানোর কর্মসূচী সফল করে আন্দোলনকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এমনকি উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫৭ জন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিককে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
এ অর্জন ঐতিহাসিক! এটি বিষ্ময়কর!
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও বারবার বাংলাদেশের ছাত্র জনতা গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু ২৪ এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ১৮ কোটি মানুষের মনে আলাদা আশার সঞ্চার করেছে।
আমরা জানি, তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় চলমান সংষ্কার প্রক্রিয়া সহজ হবে না। বিশেষ করে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার অর্থ পাচার এবং লুটপাটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। এর থেকে উদ্ধার হয়ে দেশ গঠনের প্রক্রিয়া সহজ কোন কাজ নয়। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, প্রতিবাদ, পরামর্শ এবং গঠণমূলক সমালোচনাই পারে নতুন গণতান্ত্রিক বংলাদেশ বিনির্মাণ করতে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করার মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। মানবাধিকার ইস্যুতে এত বড় অর্জন বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাসে বিরল। পাশপাশি বেশ কিছু নেতিবাচক কাজও ঘটছে। আমরা আশা করছি অন্তর্বর্তী সরকার এসব ভুল শুধরে সংষ্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে একটি সুষ্ট নির্বাচন উপহার দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে দায়িত্ব তুলে দেবে।
প্রিয় উপস্থিতি, এই প্রথমবারের মতো অভিবাসী বাংলাদেশিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষা ভাবে স্টেক হোল্ডারের ভূমিকায় এসেছেন। এ কারণে অভ্যুথান পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনের সময়কালে আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে চারটি মূল দাবি উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
আমাদের প্রথম দাবি হচ্ছে, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোর তত্ত্বাবধানে জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। এক কোটি বাংলাদেশিকে ভোটের বাইরে রেখে সরকার নির্বাচিত হওয়া যৌক্তিক নয়।
দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে, ফ্রান্সসহ সবগুলো দূতাবাসে দ্রুত ই-পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরীর ব্যবস্থা করা।
তৃতীয়ত, জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা। তুরস্ক, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বহু দেশে কয়েক দশক ধরে এ ব্যবস্থা কার্যকর আছে। অভিবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা নির্ধারিত হতে পারে।
চতুর্থ ও শেষ দাবি হচ্ছে, অনিয়মিত অভিবাসীদের লাশ সরকারি খরচে দেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করা। সব অভিবাসীদের লাশের দায়িত্ব নেয়া ব্যয়বহুল হওয়ায় অন্তত ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের অনিয়মিত অভিবাসীদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেয়া উচিৎ বলে আমরা মনে করি।
এছাড়া আজকের সেমিনারের প্যানেল আলোচকগণ বর্তমানে অন্তবর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্র সংষ্কারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একজন সচতেন নাগরিক এবং অভিবাসী হিসেবে বক্তব্য রাখবেন।
মনোযোগ সহকারে শোনার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!