তৈমুর খান
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা অস্তিত্ব ঘোষণারই আর এক নাম। যৌবন তরঙ্গের উদ্দাম উত্তাল শক্তি যেভাবে জেগে ওঠে, যেভাবে জীবন চেতনায় তার বর্ণময় যাপন ঘোষণা করে তেমনই স্পর্ধিত এবং প্রদীপ্ত পদসঞ্চার বাংলা সাহিত্যের ভাবোদ্দীপক এক ক্ষেত্রকে নাড়িয়ে দেয়। জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কবিতার আমিত্বময় যৌবনব্যাপ্তির এমন উত্থান পাঠককে সচকিত করে বৈকি। বেঁচে থাকার বাজনার ভেতর এক মননশক্তি যেমন থাকে, তেমনি মানবিক মূল্যবোধও থাকে। এই মানবিক মূল্যবোধ বাঁচার বঞ্চনা সয়ে সয়ে বার বার নবীন যৌবনেরই স্বাক্ষর চায়। যৌবনও এক মানবিক শরীর ধারণ করে, যে শরীরে কাম ও উল্লাস, ইচ্ছা ও সঙ্গম বিরাজ করে। বিধবার গোপন প্রেমিক হয়ে, জীবিকার দাসত্ব ভিখারি হয়ে ক্লান্ত, বিপন্ন সত্তায় বিভ্রান্ত কবি মাংসের শরীরেই বার বার উপনীত হন—’মণ্ডুকের মতো আমি মগ্ন হই যে কন্দর্প-কূপে।’ জীবনের এই উলঙ্গ প্রকাশে বা স্বীকারোক্তিতে কবির রাখ ঢাক নেই। কবির ভেতর এক যুবনায়ক জেগে ওঠে, তার পরিচয় দিয়ে কবি লিখেছেন—
‘একজন যুবক শুধু দূর থেকে হেঁটে এসে ক্লান্ত রুক্ষ দেহে
সিগারেট ঠোঁটে চেপে শব্দ করে বারুদ পোড়ালো
সম্বল সামান্য মুদ্রা করতলে গুনে গুনে দেখলো সস্নেহে
এ-মাসেই চাকরি হবে, হেসে উঠলো, চোখে পড়লো
অলিন্দের আলো।’
(দুপুর: একা এবং কয়েকজন)
এই একজন যুবক ক্লান্ত-রুক্ষ দেহে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগমন সূচিত করলেন। সিগারেট ঠোঁটে, বারুদ পোড়ানো শব্দ করে, সামান্য মুদ্রা সম্বল নিয়ে, চাকরির আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে, অলিন্দের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন। বিষাদ-রোমান্টিকতার ভেতর আলোর ঝলকানিও প্রখর হয়ে উঠল। কুৎসিতের পাশে সুন্দরকে বসালেন, ক্লান্তির পাশে উচ্ছলকে, অন্ধকারের পাশে আলোর বিচ্ছুরণকে এবং অস্থিরকে শান্ত স্থিরতায় দেখতে চাইলেন। তাঁর কবিতায় দেখা গেল—
১. অপরিমেয় জীবনের উচ্ছ্বাস
২. শরীরবাদের স্বীকৃতি
৩. মানবিক বৃত্তের পুনর্জাগরণ
অপরিমেয় জীবনের উচ্ছ্বাস
জীবনের বহুরৈখিক অন্বেষণ থেকেই আসে জৈবিক উত্থানের পর্যায়গুলি। এর সবচেয়ে আদিম অপরিমেয় অপরিহার্য পর্যায় হল যৌবন উচ্ছ্বাস। একদিকে আবেগের প্রবল গতিবাদ, অন্যদিকে জীবন-তৃষ্ণার কাতরতায় অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ, কোনও কিছুকেই আড়াল না করা। অনুমতির অপেক্ষা না করে বীরদর্পে প্রবেশ। যেন এক স্বয়ংক্রিয় চেতনায় ভেসে যাওয়া। জাগতিক পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ গ্রহণ করেই আগে-পিছে ভাবনাহীন এগিয়ে চলার ঝুঁকি নেওয়া। ভালো-মন্দ বিচার নয়, জীবন যা চায়, সেটাই তাঁর পাওনা। ভালোবাসার থেকে দুঃখপাওয়াতেও তাঁর আনন্দ। বিশ্বাস থেকে বিশ্বাস ভঙ্গ পর্যন্ত সে হেঁটে যেতে চায়। বিষ বা অমৃত, শিব বা শয়তান সবাইকেই গ্রহণ করতে চায়। নারী হোক, রমণী হোক সব রূপই তাঁর কাম্য। নিষিদ্ধ বা পরকীয়া, শুদ্ধ বা সহজিয়া যা হবে হোক জীবনের প্রবল স্রোতে সবকিছুই তিনি টেনে নেন। তাই পরাজয়ের কপালেও জয়ের টিকা পরিয়ে দেন। সুন্দরকে দেখতে দেখতে অসুন্দরের উঁকিও দেখতে পান। আকৃষ্ট হয়েও উদ্দাম উদাসীনতায় ছেড়ে চলে যান। মোহ ও নির্মোহ একই সঙ্গে তাঁর আজ্ঞাবহ। যৌবন সংরাগের নানা ইচ্ছা তারুণ্যের দীপ্তি পায়। যৌন ইচ্ছা কাতরতায় ও ভেঙে পড়ে। বিস্ময় ও শিহরনের খেলায় ভুবন ডাঙার মেঘলা আকাশ, বোতাম খোলা জামার ভেতর ফুসফুস ভরা হাসি, জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, জানালার পাশে বালিকার প্রতি বার বার দৃষ্টি ফেরা, দুঃখবিহীন দুঃখ—ক্রোধ শিহরন সবই উচ্ছ্বাসের প্রকাশে ফিরে আসে। আর এই উচ্ছ্বাস তো উত্তরাধিকারে পাওয়া সমূহ জীবন সমন্বয়ের এক অস্থিবাদী দ্রাঘিমা। নিজসত্তাকে ভাগ করে, নিখিলেশ সত্তায় জীবন যাপনের ঘোড় দৌড়কে অনুধাবন করতে চাইলেন—
‘জীবনের তীব্র চুপ, যে রকম মৃতের নিঃশ্বাস,—
লোভ ও শান্তির মুখোমুখি আমার পূজা ও নারীহত্যা
তোর দিকে, রক্ত ও সৃষ্টির মধ্যে আমিও অগত্যা
প্রেমিকার দিকে যাবো, স্তনের ওপরে মুখ,মুখ নয়,
ধ্যান ও অস্থিরতা
এক জীবনে, ঊরুর সামনে ঊরু, ঊরু নয়, যোনির সামনে লিঙ্গ অশরীরী
ঘৃণা ও মমতা,’
(জুয়া: আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি)
‘জীবনের তীব্র চুপ’ তারপরেই ‘মৃতের নিঃশ্বাস’ আর তারপরেই একে একে খুলে যায় প্রবৃত্তির অমোঘ নিসর্গ, স্বীকার ও অদৃশ্য, অস্থি ও শূন্যতার পর্যায়ক্রমিক বিবরণ। অপসারী কুরূপ হলেও মুহূর্তের বৌদ্রে তার বাস্তবতা প্রতিফলিত। তাই অসম্ভব তাণ্ডবের ভেতর ‘তীর চুপ’—দহন ও নির্মাণে এই জীবনের আলো ও অন্ধকার, ঘৃণা ও মমতাকে একই দেহে ধারণ—এর থেকে সত্য আর কী আছে? emotion recollected in tranquillity, তেমনি একজন কবিও too much concerned with the uncertainties of his life. এখানে কোনও দার্শনিকতা নেই। শোভন-অশোভনের প্রশ্ন নেই, শ্লীল-অশ্লীলও নেই। জীবনের ব্যাখ্যায় সবই প্রাচুর্য সংগীতে পরিণত হয়েছে। শরীর ও আবেগ, যৌনতা ও স্তব্ধতা, চঞ্চলতা ও অদৃশ্যতা এবং শরীর ও অশরীর উপস্থিত হয়েছে। মনে রাখা দরকার উচ্ছ্বাসের ভেতর বিষয়ও থাকে না, বাজনাও থাকে, শব্দ থাকে না আবার নিঃশব্দও থাকে, অঙ্গ থাকে না আবার মোহ ও আনন্দ থাকে। ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’ কাব্যেই ‘মহারাজ, আমি তোমার’ কবিতায় ভৃত্য যখন প্রভু হয়ে মনের আনন্দে নৃত্য করে তখন কবি তার মুখে যে শব্দ বসান তা এই জীবন উচ্ছ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র—
‘বিলিবিলি খাণ্ডাগুলু, বুম্ চাক ডবাং ডুলু
হুড়মুড় তা ধিন্ না উসুখুস সাকিনা খিনা।’
এই উচ্ছ্বাস প্রকৃতির অনাবিল ঐশ্বর্যেও প্রকাশিত হয়। পাখির কাকলি, নদীর কুলুকুলু ধ্বনি, মেঘের গর্জন, হাওয়ার স্পর্শে এবং মৌমাছি ও প্রজাপতির উড়ানেও। ঘুম, স্বপ্ন-জাগরণ, কাম-কামনায়, নারী সংসর্গে, যৌন ক্ষমতায়, ভালোবাসায়-ঘৃণায়ও তা একই ভাবে প্রকাশ পায়। জীবনের বহুমুখী পর্যটনকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপলব্ধি করেন, ছাদের উপরে, ছাদের নীচেও, রাস্তায়, মাঠে, পর্বতে, সমুদ্রে, একাকী আবার ভিড়ের মধ্যেও। নীরাকে চুমু খাওয়ার মধ্যে, নীরাকে না-দেখার মধ্যেও। বিরহে এবং পেয়েও, কাছে ও দূরে জীবনের সহাস্য মুখ বা কান্নাঝরা মুখে তিনি এই উচ্ছ্বাসের নিবেদন পাঠ করে চলেন। তাঁর এই প্রতীক্ষা, জন্মান্তর, অমরত্ব তাচ্ছিল্য করা, সিগারেট টানা, কবিতা লিখে রাজপ্রাসাদ বানানো কিংবা পনটিয়াক গাড়ি কেনা সবই উচ্ছ্বাসের গন্ধ আর মোহে ভরপুর জীবনের প্রাগৈতিহাসিক টান। একে তিনি কোনও দিনও অস্বীকার করেননি। কোনও স্থির আদর্শ যেমন তাঁর নেই, তেমনি জীবনটাকে সরলরেখায়ও চালিত করতে চাননি। নস্টালজিক বেদনায় বার বার অতীতে ফিরে গেছেন। শৈশবের চনমনে দুপুর, নদীতীর, শিউলি ফোটা সকাল, মিহিন কাচের মতন জ্যোৎস্না, নীল রঙা হাসি কবির অন্ধকার জীবনেও ভেসে উঠেছে। তবু সেই ঝরনা, শুকনো পাতার নৌকো ভাসানো ঝরনায় কবি স্মৃতির তলোয়ার খুঁজে পেলেন—
‘ঝর্ণায় ডুব দিয়ে দেখি নিচে একটা তলোয়ার
একটুও মর্চে পড়েনি, অতসী ফুলের মতো আভা
আমার হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ ভেঙে গেল তার ঘুম
তুলে নিয়ে উঠে আসি, চুপ করে বসে থাকি কিছুক্ষণ’
(ঝর্ণার পাশে: মন ভালো নেই)
এই ঝরনার পাশে সুনীল নামের ঝরনাটিকে জীবনের দৌড়ে সর্বদা গতিময় দেখতে পাই। যে জীবনকে মৃত্যুও শাসন করতে পারে না, যে জীবন শুধু কবিতার জন্য, মানুষের জন্য, ভালোবাসার জন্য, নীরার (আবহমান নারীর) জন্য—তাই জীবন অস্ত গেলেই বা কী হবে! ‘এসেছি দৈব পিকনিকে’ কাব্যের ‘এই জীবন’ কবিতাতে জীবনকে সূর্যের মতোই ভেবে নিয়ে ঢলে পড়া আকাশের দিকে চেয়ে কবি স্বীকার করে নেন—
‘সূর্যাস্তের অগ্নিপ্রভা লেগে আছে আকাশের গায়
জীবনই জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা।’
এই পৃথিবীর ধুলোমাখা জীবন, নুনভাতের জীবন, ব্যর্থ প্রেমের জীবন, কুকুর হয়ে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়া জীবন, খিদে পাওয়ার তাড়নায় বার বার সাড়া দেওয়ার মধ্যেও কবি জীবনের পদধ্বনি শোনেন। ‘রাত্রির রঁদেভু’ কাব্যের ‘বর্ষণমালা’ লিখতে গিয়েও এই জীবনের ধারাস্নান অব্যাহত থাকে। কবি জানিয়েছেন—
১. এক পশলা বৃষ্টি খেয়ে বেড়াতে বেরুলো ছটফটে কিশোরী নদীটি
২. প্রথম নারী তোমার চাঁদে আমার সেই স্পর্শ
অমৃত নয়, ঘামের নুন, তাই কেঁপেছি হর্ষে
৩. সরস্বতী বন্দনা ছেড়ে সে দেখছে তোমাকে
তোমার ঊরুর ডৌল
সমস্ত বৃষ্টিময় দেশ ভরে গেল রভস গন্ধে
৪. বকুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একা
বকুল ফুলের মতন বৃষ্টি, ঝরেছে বকুল,বৃষ্টি বকুল
ঝাপসা বাতাসে একটি ঝলক অচেনা নিজেকে দেখা
৫. জীবনই জীবন-সত্য,তার ওপারে আর কিছু নেই
ফিরে এসো,হে সন্ন্যাসী,বাসনার মধ্যে ফিরে এসো
শেষ পর্যন্ত এই বাসনাই তো অবধারিত জীবনের আকাশ রচনা করেছে। কাঁদা-হাসা-অভিমানের সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছে। শিশু সন্তান সন্ততির পিতা-মাতা এবং অসংখ্য সম্পর্কের বাঁধন তৈরি করেছে। তাই জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় চাঁদ ডুবে গেলে থুত্থুরে বৃদ্ধ পেঁচা অশ্বথের ডালে বসে যখন বলে—
‘চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার’—
তেমনই জীবনের ভাঁড়ার উজাড় করে মানুষের মুখ দেখে, মানুষীর মুখ দেখে, সন্তানের মুখ দেখে কবি চলে যাবার অঙ্গীকার করেছেন। শিল্প তো ফুরিয়ে যায় না, নীরাও ফুরিয়ে যায় না। আবহমান নারীর তথা রমণীর এবং আবহমান মানুষের এবং আবহমান সন্তানের মুখেই সব জীবনের অফুরান উচ্চারণ বিরাজ করবে।
শারীরবাদের স্বীকৃতি
শরীর আর শরীরের আগুনকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় বার বার ছড়িয়ে দেন। অনুভূতির তীব্রতায় আত্মক্ষরণের বিমোচনে যে শব্দ ও বেদনা তিনি আমদানি করেন তা সবই শরীরবৃত্তীয়। মুখের ভাষা, যৌবনের উত্তেজনা, মোহ মায়া সবই ইন্দ্রিয়জ। অস্তিত্বের নির্মাণে এগুলিও অপরিহার্য বলে তিনি মনে করেন। সুতরাং কামক্রীড়া সৃষ্টিতত্ত্বেরই অঙ্গ। রক্ত-মাংস-হাড়-মজ্জা না থাকলে অনুভূতিই বা কী করে থাকবে? নিজের ইচ্ছা আর অনিচ্ছা, ভোগ ও ত্যাগ সবই নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেন। এ সবই পৌরুষ দৃপ্ত ব্যঞ্জনায় সদর্থক জীবনের উদ্দীপনা আলোক শস্য। কবি বিশ্বাস করেন ইহকালই শেষ কথা, জীবনই জীবনের মধ্যেই নিহিত, তাই বাঁচার মুহূর্তটিই সবচেয়ে মূল্যবান—
‘অন্ধকারে তোমার হাত ছুঁয়ে
যা পেয়েছি, সেইটুকুই তো পাওয়া’
(পাওয়া: সত্যবদ্ধ অভিযান)
এই হাত ছোঁয়ার মধ্যেই পাওয়াটি তো বাস্তব পাওয়া। কুকুরের দাঁত নিয়ে কুমারীর স্তনে কামড়ানো, ভাটফুলের গন্ধমাখা যোনির ঘ্রাণ নেওয়া, অ্যাক্রোপলিসের থামের ঊরুর আকর্ষণ, সূর্যমুখী লঙ্কার মতো হাতের মুঠো পিছলানো স্তনের নিমন্ত্রণ, দুই শঙ্খস্তনের আহ্বান কিছুই তিনি ভুলতে পারেন না। উদাসীন সঙ্গম শেখার কথা বললেও কী করেই বা তিনি শরীর অস্বীকার করবেন? যৌন-ইচ্ছা যে তাঁকে কাতর করে, নির্ঘুম করে আর ঘৃণাও এনে দেয়—এসব তো স্বাভাবিক জৈবিক নিয়মেই চলে। প্রকৃতির যা দান, শরীরবৃত্তীয় যা ক্রিয়া তাকে খুব সরাসরি স্পষ্ট করেই দিতে চান কবি—
‘শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদুর চলে গিয়ে
ফিরে আসি আমি শরীরের কাছে’
‘হিমযুগ’ কবিতায় শরীরের কাছে ফিরে আসাতেই বুঝি ‘পাপ ও দুঃখের কথা’ ছাড়া আর কিছুই থাকে না পৃথিবীতে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেছিলেন—
‘পৃথিবীতে আমরণ প্রেম আর শয়নঘর ছাড়া কিছু নেই’
পাপ ও দুঃখ তো এই প্রেমকে ঘিরেই, পাওয়া ও না পাওয়ার শূন্যতায় তত্ত্ব বা দর্শন নয়, জীবনের মোহ থেকেই তৈরি হয় চিত্র, মানুষ ও প্রকৃতি, প্রাণী ও প্রবৃত্তির অমোঘ নিয়ম—
‘আরো নিচে,পাপোষের নিচে এক আহিরিটোলায়
বৃষ্টি পড়ে,
রোদ আসে,
বিড়ালীর সঙ্গে খেলে
বেজন্মা বালিকা—
ছাদে পায়চারি করে গিরগিটি,
শেয়াল ঢুকেছে নীল আলো-জ্বলা ঘরে
রমণী দমন করে বিশাল পুরুষ তবু কবিতার কাছে অসহায়—
থুতু ও পেচ্ছাপ সেরে নর্দমার পাশে বসে কাঁদে—’
(পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না: আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি)
কবিতা তো সেই সত্য কথাটিই লিখতে চায়, সঙ্গমে ব্যর্থ হোক, প্রেমে ব্যর্থ হোক, সম্পর্ক নিষিদ্ধ হোক সর্বদা এক শরীরীমায়াই শূন্যতা বা অপূর্ণতায় দিগন্ত পরিব্যাপ্ত করতে থাকে। আর অক্ষমতা ও না-পাওয়াগুলি, অচরিতার্থগুলি পাপ ও দুঃখ বলেই মনে হয়।
অরুন্ধতী নাম্নী কোনও নারী কিংবা রমণীর কাছে কবি সর্বস্ব সমর্পণ করতে চান। তার দেহে দেহ, চোখে চোখ, হৃদয়ে হৃদয় রেখে মিশে যেতে চান তার সঙ্গেই। তার ফ্লুরোসেন্ট ঊরুদ্বয় বুকের উপর রেখে জীবনের এই খেলা তো বহুকাল থেকেই চলে আসছে। তাই শরীরী আশ্লেষ কামতাড়িত মদনবাণের মতো মহিষ হয়ে ধেয়ে আসেন তার দিকে। রূপ সচেতন মায়াবী আকর্ষণে কবির প্রশ্ন—
‘কেন এত রূপ? রূপ বুঝি জন্মান্ধের খাদ্য
বুঝি মহিষের টুকরো লাল কাপড়—’
(চোখ বাঁধা: আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি)
রূপজ অনুরাগ তো চিরন্তন নয়, রূপ না থাকলে তো আকর্ষণও থাকে না, আর রূপ শরীরেরই বৈভব। যে কবি ভালোবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধেন, সেই কবিই শরীর পাওয়ার শেষে অনুভব করেন ‘শরীর ছেলেমানুষ’, কারণ তার টুকিটাকি কত লোভ থাকে। আর ভালোবাসা ঘুমোবার বিশ্রামে সর্বদা আশ্রিত করে। স্তব্ধতার দিকে নিয়ে যায়। কবি পুরাণের সেই ব্যাসদেবের জন্ম বৃত্তান্ত ও ঋষি পরাশরের যোজন গন্ধার প্রতি কামমোহিত হবার অনুষঙ্গটি উল্লেখ করে জানান—
‘এখন আমি শরীরবাদী না অশরীরী?
অশরীরী, অশরীরী, তাই তো শরীর ছুঁতে ইচ্ছে হয়,
এসো শরীর, তোমায় আদর করি
এসো শরীর,তোমায় ছাপার অক্ষরের মতো স্পষ্টভাবে
চুম্বন করি
তোমায় সমাজ-সংস্কারের মতন আদর্শভাবে আলিঙ্গণ করি
এসো ভয় নেই, লজ্জা করো না, কেউ দেখবে না—
দেখতে জানে না
সত্যবতী, তোমার দ্বীপের চারপাশে আমি ঢেকে
দেবো
কুয়াশায়
তোমার মীনচিহ্নিত দেহে ছড়িয়ে দেবো যোজনব্যাপী গন্ধ—
(শরীর অশরীরী: বন্দী জেগে আছো)
শরীরের কাছে সন্ন্যাসীতে যোগভ্রষ্ট হয়ে কামমোহিত হয়, তাঁরও খিদে পায়। কবিও শরীরের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ান। পেচ্ছাপ, থুতু, চোখের জল, পায়ের ধুলো সবই শরীর। শিল্পও শরীর। নারীও শরীর। আকাশও শরীর। পৃথিবীও শরীর। যোনিও শরীর। রূপও শরীর। অশরীর হলে কি ছোঁয়া যায়? অশরীর হলে কি বাঁচা যায়? শরীর তো জীবনকেই ঘোষণা করে! আর এই ঘোষণাই সুনীলের কাব্যে Art হিসেবে বার বার প্রমাণিত যা W. S. Landor এর কথায়: ‘That perfectly triangular peak looks like a work of art, Nature. I loved, and, next to Nature, Art.’ সুতরাং প্রকৃতির ভেতরে আরও এক প্রকৃতিকে তিনি দেখালেন যা আবহমান কাল ধরে বিরাজ করছে, যাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না, যাকে সভ্যতার দোহাই দিয়ে ঢেকে রাখাও যাবে না।
‘মন ভালো নেই’ কাব্যের ‘তমসার তীরে নগ্ন শরীরে’ কবিতায় কবি একাকী নিজের কাছে উপনীত হয়ে চির প্রবাহের কাছে বিলীন হবার প্রশ্নে নিবেদিত হয়ে শুধু শরীরকেই উৎসর্গ করতে চান চিরনির্জনের ভেতর। ক্রমান্বয়ে নিজেকে আলাদা করেও অচেনা বিমোহিত কোনও স্পর্শের আয়োজন করেছেন।—
ক.তমসার তীরে নগ্ন শরীরে দাঁড়ালাম আমি
খ.পাশে নেই আর মায়া-সংসার আকাশে অশনি
গ. নদীটি এখন বড় নির্জন
ঘ.মেশাবো এ জলে মন্ত্রের ছলে অতি প্রতিশোধ
ঙ.শরীর জানে না কে-কার অচেনা তাই ছুঁয়ে দেখা
চ.এ অবগাহন শরীর-বাহন চির ভালোবাসা
‘নগ্নশরীর’ প্রকৃতির অনাবিল প্রকাশ ‘তমসা’ অন্ধকার, শরীর আত্মপ্রকাশের মাধ্যম বা সত্তার রূপ, ‘নির্জন’ সম্মোহনের সময়, যেহেতু সময় গতিশীল তাই নদীর ব্যবহার। শরীর মেশানোর প্রক্রিয়ায় ‘অতিপ্রতিশোধ’ যা সমর্পণেরই নামান্তর তবু পরখ করার কৌশলী সচেতন ক্রিয়াটি ‘ছোঁয়া’ রূপে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ‘অবগাহন’ অস্তিত্বের স্বজ্ঞায় ব্রহ্ম জীবনের অন্বয় বা রূপান্তরকেই নির্দেশ। অনুভূতির রূপান্তরকে এভাবেই শিল্পে রূপ দিয়েছেন। অ্যারিস্টটল বলেছেন, শিল্প হল ‘the transformaton of feeling the artist has experienced. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই রূপান্তরের মধ্যে দিয়েই শরীরীকে বোধের সমীহ দান করলেন।
মানবিক বৃত্তের পুনর্জাগরণ
যে প্রেমের ব্যাপ্তি নিয়ে আত্মজাগরণের মন্ত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উচ্চারণ করেন তা বিশ্বব্যাপী—প্রকৃতি ও প্রাণীতে মিশে থাকে। এক দরদি মন নিয়ে তিনি জগৎ-জীবনকে দেখেন। বৃক্ষও তাঁর বন্ধু, মানুষও তাঁর আপন। যদিও মাঝে মাঝে হন্তারক ইচ্ছা সংঘটিত হয় তবুও বিবেক হারান না তিনি। বিবেক হারালেও অনুশোচনার জন্ম হয়। নিসর্গ-নিয়তি, প্রেম ও স্বপ্ন থেকেই বাঁচার আকুতিটি যেমন জেগে ওঠে, তেমনি এক যুদ্ধময় মনন ক্রিয়ায় প্রতিবাদী তেজোদীপ্ত স্ফুলিঙ্গও কবিতার শব্দ হয়ে ওঠে। মানববৃত্তের মধ্যেই দেশপ্রেম, বাংলাভাষাপ্রীতি এবং অতীত ইতিহাসের প্রতি আত্মিক যোগ অনুভব করেন। ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কাব্যের ‘সাবধান’ কবিতায় পুরোপুরি মানবিক বৃত্তের মধ্যে থেকেই লড়াকু মানুষ হিসেবে বৈষম্য দূরে ঠেলে এক সুন্দর সাম্যবাদী পৃথিবীর স্বপ্নকে তুলে ধরেছেন। উপোসী মুখ, দৈন্যের বিজ্ঞাপন হয়ে যাওয়া জীবনযাপন যে কী সাংঘাতিক অন্যায় হত্যাকারী তা বুঝিয়ে দেন ভরপেট খাওয়া ছেলের পেটে লাথি মেরে, বস্তা বস্তা টাকা ঘুষ নেওয়া লোকটিকে হত্যা করে এবং নেহেরুর দেশ ভাগের উইলের কথা শুনে হাসাহাসি করে এবং শবযাত্রা দেখে, মেয়েটির মুখ চুম্বন করে এবং পরদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কবিতায় স্পষ্ট উল্লেখ করেন—
‘আমার গলা পরিস্কার,আমি স্পষ্ট করে কথা বলবো
সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে
একজন মানুষ
ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে শুদ্ধভাবে আমি
আজ উচ্চারণ করবো সেই পরম মন্ত্র
আমাকে বাঁচতে না দিলে এ পৃথিবীও আর বাঁচবে না।’
কতটা মানবিক জোশ অর্জন করলে এ রকম উচ্চারণ করা যায়, কবি তা জানেন। আর জানেন বলেই মানুষের হত্যাকারীর বিরুদ্ধেও গর্জে ওঠেন। শুধু নিজের চোখ দুটিকেই মনে করেন ‘এক পলক সত্যি চোখ’। মানবিক বিশ্বাস আর বাঁচার অধিকারকেই তিনি মান্যতা দেন। শ্রমিকদের শীর্ণ মুখ তাঁকে ব্যথিত করে। ইন্দিরা গান্ধী এরোপ্লেনের উপর থেকে বন্যা দেখলে সাবধান করেন, কেননা ‘মুখ ফস্কে বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ কী সুন্দর।’ শিয়ালদার ফুটপাতে কবি তাঁর দুঃখিনী ধাইমাকে দেখতে পান। স্টেশনে দেখতে পান পোশাকবিহীন উলঙ্গ পাগলকে। অভুক্ত মানুষও কবিকে ব্যথিত করে। চারিদিকে কী ভীষণ শূন্যতার বাজনা আর মানবিক দায় অনবরত হৃদয়ে আঘাত হানে। ঠিক থাকতে পারেন না। বিবেকের দংশন আর শূন্যে পায়চারি বেড়ে যায়। রাষ্ট্র, প্রশাসন, সমাজ আর অন্যায়কারী শোষক শ্রেণিকে সাবধান করে কবি ‘আমার স্বপ্ন’ কাব্যের তিনজন মানুষ কবিতায় লিখলেন—
‘সাবধান!
মানুষ আর ব্যর্থমৃত্যু মেনে নেবে না।
সাবধান! মানুষ আর ব্যর্থমৃত্যু মেনে নেবে না!
বাড়িতে ফিরে ভাতের থালার সামনে আমার গা
গুলিয়ে ওঠে—সারারাত আমার ঘুম আসে না।’
নির্ঘুম কবির কষ্ট তো পাঠক নিশ্চয়ই উপলব্ধি করে থাকবেন। যে কবি নতুন দিন চেয়েছিলেন, স্নানসিক্ত পৃথিবীর নতুন মহিমা জাগাতে চেয়েছিলেন, শ্রেণিহীন-শোষণহীন-স্পর্ধাহীন বিশুদ্ধ সমাজ—তার বদলে দেখলেন কুটিল ও ষড়যন্ত্রী শৃঙ্খলিত দেশ। বিবেকের ঘরে চুরি, স্বপ্নের নতুন দিন ধুলোয় বিলীন, চতুর্দিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। কবি দেখলেন—
ভাই-বন্ধু-আত্মীয়ের ছিন্ন ভিন্ন দেহ পড়ে আছে।
তবে?
কবির সিদ্ধান্ত—
‘রক্তমাখা নোংরা এই সিঁড়ি দিয়ে আমি কোনো
স্বর্গেও যাবো না।’ মানুষ মেরে কিংবা মরা মানুষের লাশের উপর দিয়ে সভ্যতার রথ গেলেও কবি সেই রথের যাত্রী হতে চাননি। বরং ধিক্কার জানিয়েছেন। মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই ধুলোর পৃথিবীতে স্বর্গের ভুবন বানাতে চেয়েছেন। ঠিক তেমনিভাবেই কবি প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্দির-মসজিদ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের হিংসা-বিদ্বেষকেও। ধর্ম যে রূপকথার স্বর্গ-নরক, পৃথিবীতে মানবিক মূল্যবোধই একমাত্র মানুষকে বাঁচাতে পারে সে-কথাও বলেছেন। বিহারের জাতিগত দাঙ্গা, নিরীহ লোকের মৃত্যুতে হাহাকার করেছেন। আর সারাজীবন ধরে কবিকে একটাই কবিতা লিখতে হবে। সে কবিতা এখনো লেখা হয়ে ওঠেনি, কারণ—
১. যজ্ঞ চলেছে সাড়ম্বরে কিন্তু যাজ্ঞসেনী অজ্ঞাতবাসে
২. টলমলে শিশিরের শালুক বনে কখন ঝড় উঠবে তার
ঠিক নেই
সুতরাং আমাদের সুস্থির জীবন আর শান্তশ্রী শিল্পের জন্য প্রেমময় পৃথিবীর জন্য এখনো বহুযুগ অপেক্ষা করতে হবে। সুনীল জানতেন, নীরা শুধু নারী নয়, মানবীও। গাছ যেমন প্রতীক অরণ্যের মায়া, নীরাও বনদেবী। আবার ইতালির শিল্পীর ছবিও নীরা। শিল্প ব্যক্তিগত হয়েও যেমন সর্বজনীন, তেমনি মানুষও মানবিক। ব্যক্তিই ব্যাপ্তির দিকে ধাবিত হয়। সুতরাং কবিতাও আবহমান কালের নীলাকাশ। জীবনের রূপ-রস-রংকে যেমন চিনিয়ে দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তেমনি জীবন যে মানবিক সম্পর্কের দায়কেও অস্বীকার করতে পারে না তা জানিয়ে দিলেন। তিনি শুধু কবিতাই লিখেননি, শিল্পকে জীবনও করে তুলেছেন। তাঁর সম্পর্কে বলা যায়— A true poet is not just a good versifier; he is an artist.