spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্য'হায় রে হৃদয়, জীবনের সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথপ্রান্তে শুধু ফেলে যেতে হয়'

লিখেছেন : আশরাফ আহমেদ

‘হায় রে হৃদয়, জীবনের সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথপ্রান্তে শুধু ফেলে যেতে হয়’

আশরাফ আহমেদ

বয়স হয়েছে। দুনিয়াদারির মায়া ত্যাগ করার ইচ্ছায় পুরনো অনেক লেখা ও কাগজপত্র বেরিয়ে এলো, যা যক্ষের ধনের মতো এতো বছর আগলে রেখেছিলাম। খুব প্রিয় ছিল সেগুলো। কিন্তু আজ সেসব ছিঁড়ে ফেলতে হবে। তেমন একটি ফাইলে জমা ছিল বেশ ক’টি ব্যাংকচেক ও চিঠি, ১৯৯৪ সাল থেকে। এ তো শুধু কাগজ ছিঁড়ে ফেলা নয়। হৃদয়ের এক একটি তন্ত্রীকে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলার মতো!

অধ্যাপক কামাল আহমাদ পাকভারত উপমহাদেশের প্রথম প্রাণরসায়ন বিভাগটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৬ সালে এবং পরবর্তী প্রায় কুড়ি বছর ধরে এর পরিচর্যা করে দেশের একটি অন্যতম প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। এই বিভাগকে সূতিকাগার হিসাবে ব্যবহার করে তিনি ফার্মেসি বিভাগ এবং ইন্সটিটিউশন অব নিউট্রিশন এন্ড ফুড সাইন্স ও গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে এখান থেকেই অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ ও জেনটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগও সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বা বায়োকেমিস্ট্রি সম্পর্কিত যতগুলো বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে সেই সবেরও আঁতুরঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগ বললে অত্যুক্তি করা হবে না।

অধ্যাপক কামাল বাংলাদেশের এবং বহির্বিশ্বের একজন উঁচুমানের বিজ্ঞানীও ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমাণ উন্নয়নের জন্য যে ঐতিহাসিক গবেষণার বিশাল কয়েকটি কাজ করেছিলেন, বলা যায় বাংলাদেশের বর্তমান পুষ্টিজ্ঞানের অনেকটাই তার ওপর ভিত্তি করে রচিত। শিক্ষক এবং প্রশাসক হিসাবে তিনি প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ও মেজাজি ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর ছাত্র হবার।

আমি তাঁর প্রিয় ছাত্র কখনোই ছিলাম না। কখনো কখনো আমাকে পছন্দ করেন মনে হলেও অধিকাংশ সময়েই আমি তাঁর চক্ষুশূল ছিলাম বলেই মনে হতো। তবে ১৯৬৯-৭০ সালের কোনো এক সময়  আন্দোলনের মুখে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্পকালীন উপাচার্যের পদে ইস্তফা দিয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আশরাফ তোমাদের ছেড়ে, এই বিভাগ ছেড়ে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না।  কিন্তু আমাকে অপছন্দ এতোটাই করতেন যে এমএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তিনি আমাকে বাদ দিয়ে প্রথম ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে বিভাগীয় শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দানের পক্ষে ছিলেন। তাঁর অপছন্দের অধ্যাপক আনোয়ার আজিম চৌধুরীর প্রিয় ছাত্র এবং তাঁর অধীনে আমি থিসিস গবেষণা করেছিলাম, সেটিই আপাতদৃষ্টিতে আমার অপরাধ ছিল। সেই বাঁধা কাটিয়ে প্রায় একই সময়ে আমরা তিনজন শিক্ষকতায় যোগদান করার পর কামাল স্যারের সাথে আমার সম্পর্কটি খুব মসৃণ না হলেও দৃষ্টিকটু বৈরীতাও ছিল না। ব্যক্তি হিসাবে যথেষ্ট শ্রদ্ধা না করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ এবং অগণিত ছাত্রছাত্রীর জীবনে তাঁর আকাশচুম্বী অবদানের জন্য তিনি কখনো আমার শ্রদ্ধা হারাননি। বাংলাদেশে এমন মেধার লোক তখন আমার চোখে কেউ ছিলেন না।

মাঝে মাঝে বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে তিনি ভালো ব্যবহার করতেন এবং আমেরিকায় এলে প্রতিবার অবশ্যই ফোন করতেন এবং আমার সাথে এক বা দুদিন কাটাতেন। আমার বাসায় আতিথ্যও গ্রহণ করেছিলেন। ততোদিনে আমি তাঁর কাজের সমালোচনা করার মতো সম্পর্কে পৌঁছে গেছি। বিদেশি সাহায্যে একটি বিশাল দালান নির্মাণ করে অসংখ্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে সাজিয়ে বহু বছরের কঠোর পরিশ্রম করে যে ইন্সটিটিউট অব নিউট্রিশন তিনি স্থাপন করেছিলেন, একসময় অপমান নিয়ে সেখান থেকে বিতাড়িতও হয়েছিলেন। আমেরিকায় সারাদিনের জন্য আমার ল্যাব পরিদর্শনে এলে তাঁকে বলেছিলাম, ব্যক্তিগত ও শর্তহীন আনুগত্য পছন্দ করতেন বলে আপনি মেধাবীদের দূরে সরিয়ে যেসব অযোগ্য লোককে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, তারাই আপনার সাথে শত্রুতা করেছে তা নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পেরেছেন? তিনি বলতেন হ্যাঁ, আমি ভুল করেছিলাম।  

প্রতিবারই তাঁকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, একটি মাত্র জীবনে আপনার মতো বিশাল বিশাল অর্জনকারী মানুষ শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেও খুব বেশি নেই। এখন অবসরকালীন সময়ে আপনি দয়া করে সেসব অভিজ্ঞতা লিখে রাখুন। কী কী ভাবে আপনি সেসব সম্ভব করলেন, কী কী প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে সেসব লিখে রাখুন যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা পড়ে শিক্ষা নিতে পারে। উত্তরে প্রতিবারই  তিনি চেষ্টা করবেন বলে কথা দিতেন।

কিন্তু কথা তিনি রাখতে পারছেন না দেখে আমি ভিন্ন চিন্তা করলাম। আমরা, তাঁর প্রাক্তন ছাত্ররা অধ্যাপক কামাল আহমাদের জীবনীর বিভিন্ন দিককে তুলে ধরে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলে কেমন হয়? লেখা সংগ্রহ ছাড়াও পুস্তিকা প্রকাশ করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন হয়। একটি বিষয় এখানে খোলাসা করে নেয়া ভালো। আমি যখনকার কথা লিখছি বাংলাদেশের তো বটেই বহির্বিশ্বে বাঙালিদের আর্থিক অবস্থাও আজকের তুলনায় ছিল অত্যন্ত করুন! যুক্তরাষ্ট্রে আজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে জনপ্রতি ২৫-১০০ ডলার টিকেট অল্প সময়েই শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকে অনেক অনুনয় বিনয় করেও ২ ডলারের বেশি সবার থেকে আদায় করা যেতো না। কথাটি মোটেই বাড়িয়ে বলছি না। ১৯৯৬ সালের তেমন একটি প্রচারপত্র আমার সংগ্রহে আছে। তা হলে অধ্যাপক কামালের জীবনী সম্বলিত পুস্তিকা প্রকাশের অর্থের জোগান আসবে কীভাবে?

ঠিক করলাম যে বহির্বিশ্বে অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়নবিদদের কাছে আবেদন জানিয়ে একটি চিঠি লিখবো। পাঁচ সন্তানের সবাই যেহেতু আমেরিকায় বাস করে, অধ্যাপক কামাল কয়েক বছর পরপর এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে যান। চিঠিতে পুস্তিকা প্রকাশ উপলক্ষ করে আমেরিকায় অধ্যাপক কামাল আহমাদকে সম্মাননা জানানোর কথাও লিখবো। আশেপাশে অবস্থান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের প্রাক্তন কিছু ছাত্রের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করি। তাঁদের মাঝে অন্যতম ছিলেন এনআইএইচ-এ গবেষণারত আমার ছাত্রসম বর্তমানে প্রয়াত ও অত্যন্ত মেধাবী ডঃ শাহাবুদ্দিন এবং আমার সহপাঠী ও পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।  শেষোক্ত জন বললেন কামাল স্যার যেহেতু প্রাণরসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা, সম্মাননা জানানোটা তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভাগে হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত, যাতে আমি দ্বিমত করলাম না। আনোয়ার ভাই নতুন করে চিঠির মুসাবিদা লিখলেন। তাতে আরো লিখলাম যে পুস্তিকা প্রকাশ ও অভ্যর্থনার স্থান ও ক্ষণ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের পাঠানো ব্যাংক চেক ভাঙ্গানো হবে না। আনোয়ার ভাই এবং আমার সই সহ সেই চিঠি প্রায় ৭০ জনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম, কতোজনের কাছে পৌঁছাবে সে চিন্তা না করেই। বলে রাখা ভালো যে সেই জমানায় ইমেইল খুব অল্প লোকের নাগালে ছিল বিধায় বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করে রাখা ডাকঘরের ঠিকানায় চিঠিগুলো পাঠাতে হয়েছিল।

সেই দিনগুলোতে যেখানে দুই ডলার কারো পকেট থেকে বের করা যেতো না, আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে চিঠির প্রাপকরা ন্যুনতম পঁচিশ থেকে একশত ডলারের পর্যন্ত চেক পাঠিয়ে দিলেন! তাঁদের প্রিয় শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তা করলেও আমাদের আহবানে এতো উদারচিত্তে তাঁরা সাড়া দিয়েছিলেন বলে সবার প্রতি এক গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ করেছিলাম। এঁদের মাঝে ছিলেন আমার শিক্ষক ও প্রয়াত ডঃ এমদাদুল হক, কানাডাবাসী অধ্যাপক একরামুদ্দৌলা, আমার অনুজপ্রতিম খান মোহাম্মদ মুনীর, আবু বকর ও পরিতোষ মজুমদার, আমার ছাত্রী লামিয়া শারমিন ও নাঈমা আহমাদ, নাহিদ বানু এবং আরো কয়েকজন।

মাস কয়েক পর ঢাকায় ফিরে গিয়ে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ভাই জানালেন যে বিভাগীয় শিক্ষকদের মাঝে দলাদলির কারণে সেখানে কামাল স্যারকে সম্মান জানানোর কোনো অনুষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে কামাল স্যারের আর যুক্তরাষ্ট্রেও আসা হয়ে ওঠেনি। ফলে অনেক কিছুর মতো আমার সেই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাঝে দূরত্ব রয়েই গেল। ১৯২৩ সালে চট্টোগ্রামে জন্ম নেয়া অধ্যাপক কামাল আহমাদ ২০০৪ সালে ম্যানিলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।  

বিগত তিরিশ বছর ধরে মাঝে মাঝেই তখন পাঠানো অব্যবহৃত ব্যাংক চেক ও চিঠিগুলো সামনে এসেছে। প্রতিবার চিঠিগুলো পড়েছি এবং চেকগুলো হাতিয়ে হাতিয়ে প্রেরকের শদ্ধা ও ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছি। এঁরা সবাই ছিলেন আমার অতি প্রিয় ব্যক্তি। আজ অধিকাংশের সাথেই কোনো যোগাযোগ না থাকলেও স্মৃতিতে তাঁরা উজ্জ্বল। পৃথিবীর মায়া ত্যাগের প্রস্তুতি হিসেবে অনেক নিদর্শনের মতো আজ তাঁদের সাথে আমার বস্তুগত বাঁধনটুকুও ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এ বড় কষ্টের কাজ।

………

১৬ই অক্টোবর, ২০২৪

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ