আমিনুল ইসলাম
একটি জনপদে কখনো কখনো মানব-সৃষ্ট দুর্যোগ রচনা করে দুঃসহ দিন, দুর্বিষহ রাত। ধর্মভেদ, জাতভেদ, শ্রেণীভেদ, শিক্ষাভেদ, সম্পদভেদ, বর্ণভেদ-ইত্যকার নানাভেদে বিভক্ত ও বিভাজিত, অত্যাচারিত ও উৎপীড়িত, শাসিত ও শোষিত জনপদ ইতিহাসের মোড়ে মোড়ে অস্থির ও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। একদিকে প্রতিকারহীন শক্তির লোভ , অমানিবকতা, অবিবেচনা, ও অবিচার,- অন্যদিকে পদদলিতদের ব্যাপক বঞ্চনা ও বিক্ষোভ। উচ্চশ্রেণি-গর্ব, অঢেল সম্পদ-গর্ব, অপ্রতিদ্বন্দ্ব রণশক্তি, সাম্রাজ্যবাদী সাফল্য, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। একদিনে দমন ও নিপীড়ন, অন্যদিকে প্রতিবাদ ও আন্দোলন। সে-পথেই নেমে আসে হানাহানি, রক্তপাত, যুদ্ধ। অস্থিতিশীলতার ঢেউয়ে দুলে ওঠে সময়; অস্থিরতা ছুঁয়ে ফেলে গণমানুষের রাতের ঘুম ও দিনের অবসর; উৎকণ্ঠায় বিড়ম্বিত হয়ে ওঠে ‘শুভবাদী অ-সাধারণ’ মানুষের ভাবনা ও চেতনা, সাধনা ও সাধ। যারা অবিচার শাসিত সমাজের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধাভোগী অথচ ধূর্ত ও সুচতুর, তারা কৌশলগত মৌনতা ও নিস্ক্রিয়তা পালন করে সময় পার করে যান। অথবা ‘অন্যত্র’ ব্যস্ত থাকার চতুর অজুহাত সৃষ্টি করে সেভাবেই কাটিয়ে যান তাদের দিনরাত। যারা এসব অন্যায়ের প্রবল বিরোধী- তারা এসবের সাধ্যমতো ও শেষর্যন্ত বিরোধিতা করে যান কথায় ও কাজে, লেখায় ও বক্তৃতায়। আবার একশ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা এসব অন্যায় ও অসংগতি মেনে নিতে পারেন না মন থেকে; কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের প্রবলতায় সক্রিয় বিরোধিতায় সামিল হওয়ার সাহস ও শক্তি তাদের খুবই কম। তারা ন্যায়বাদী-শান্তিবাদী, ন্যায়প্রার্থী-শান্তিপ্রার্থী। কিন্তু সংগ্রামী-সক্রিয়তা তাদের নয়। প্রথম পর্যায়ে তারা ক্ষীণস্বরে প্রতিবাদী হোন, দু’কলম লেখেন প্রতিবাদের ভাষায়। দ্রুত সাফল্য দৃশ্যমান না হলে অতঃপর একসময় হতাশ হয়ে সরে যান অন্যত্র; কেউ সাময়িকভাবে কউবা চিরতরে। ভীষণ যে অস্থিরতা, ভয়ংকর যে হানাহানি, ব্যাপক যে রক্তপাত,- তা সহ্য করার মতো মতো শক্ত নার্ভ তাদের থাকে না। তারা পালিয়ে বাঁচতে চান। অস্থির সময়ে তাদের দরকার হয়ে পড়ে একটু জিরোবার সময়; দগ্ধ ভূগোলের আনাচেকানাচে তার খুঁজে ফেরেন এতটুকু ছায়া-আড়াল ; উন্মত্তার প্লাবনে তারা পেতে চান খুঁজে ছোট একটা জলটুঙি।
প্রেম-সাম্য ও মহামানবাধিকারের সেচ্চারকন্ঠ কাজী নজরুল ইসলামের সমকালে বিংশ শতাব্দীর ভ্রুণ-লগ্নে জীবনানন্দ দাশের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ভারত তখন পরাধীন বৃটিশ-ভারত। হিন্দু মসুলমানের মধ্যে হাজার বছরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ভাঙন ধরেছে। বিভেদের রাজনীতি প্রযোজিত ভয়ংকর হানাহানি সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞে ভেসে গেছে ধর্মীয় শুভবোধ। শাসনের নামে বেড়ে চলেছে বৃটিশদের শোষণ-নির্যাতন । অভাবে-অনটনে মরছে কৃষক ও দিনমজুর। প্রতিবাদ হচ্ছে। আন্দোলন হচ্ছে। চলছে পালটা দমনাভিযান। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাব পড়েছে পরাধীন ভারতীয় উপমহাদেশেও। পরাক্রান্ত পুঁজিবাদ ও অভ্যর্থিত ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রাদের জোয়ারে ইউরোপের সমাজ থেকে ভেসে যাচ্ছে ত্যাগের মন– সহমর্মিতার হৃদয়। সংকীর্ণ স্বার্থপরতা জেঁকে বসছে সর্বত্র। মানুষ হয়ে পড়ছে কেবলই আত্মসর্বস্ব । সামাজিক প্রথায় ভাঙন ধরেছে। বিবাহ, পরিবার, প্রেম, দাম্পত্য, বন্ধুত্ব প্রভৃতি রাহুগ্রস্ত। সমাজ থেকে ‘আমরা, আমাদের’ এই বোধ তিরোহিত হয়ে সেস্থানে জেঁকে বসতে শুরু করেছে ‘আমি, আমার’ এই বোধ। শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকতার নামে শুরু হয়েছে ‘বিমানবিকীকরণ’। এসবকিছুর ঢেউ কমবেশি এসে আছড়ে পড়তে চেয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। তবে সবচেয়ে বড় সংকট এই যে- ভারতীয় উপমহাদেশের সম্ভাব্য স্বাধীনতার ফসল নিজেদের ঘরে তোলা নিয়ে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিযোগিতাজনিত হানাহানি ও রক্তপাত দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর আকার ধারণ করে চলেছে। আধুনিক শিক্ষিতদের একটা বড় অংশ হয়ে উঠেছে প্রকাশ্য বা ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে তলেতলে ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। কিছু কিছু কবি-সাহিত্যিক রচে চলেছেন সুক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতযুক্ত কবিতা-গান-উপন্যাস-নাটক। কেউ কেউ এসবের সাতেপাঁচে না থাকার মন নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসে করে যাচ্ছেন আপন সাধনা। তথাপি নজরুল-সুভাষদের দল মানেনি হার। তাঁরা রেখে চলেছেন হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যকামী শুভবাদী ভূমিকা। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিজীবনের শুরুতেই সেই শুভবাদী প্রয়াসে সামিল হোন। তিনিও হিন্দু মসুলমানদের ঐক্য প্রয়াসে লিখেন-‘হিন্দু মসুলমান’- জাতীয় মানবীয় মহত্বে উজ্জ্বল কবিতা-যা ছিল তাঁরই ভাষায় ‘মহামৈত্রীর গান’। কিন্তু দিন যত যায় – হিন্দু মসুলমানের মধ্যে ফাটল ততো বড় হতে থাকে। ব্যক্তিজীবনে তিনি বহুবিধ অশান্তি ও যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে থাকেন একের পর এক। কোলকাতার নাগরিক জীবন তাঁকে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেয় কিন্তু স্বস্তি দিতে ব্যর্থ হয়। ব্যক্তিজীবনে গোপন প্রেম বা একতরফা ভালোবাসা প্রচলিত অর্থে ব্যর্থ হয়ে তার আন্তরিক বেদনায় নতুন অগ্নিমাত্রা যোগ করে। এধরনের পরিস্থিতিতে গভীরভাবে সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে- যদি উপশমের পথ খুঁজে পাওয়া না যায়। হয়তো-বা সে-কারণেই সংগ্রামী-বিপ্লবী-বিদ্রোহী পুরুষ কবি-শিল্পী-ভাস্কর চিরদিনই কোনো না কোনো নারীর প্রেমের আঁচলতলে কিংবা প্রকৃতির শ্যামলছায়ায় তাদের ব্যক্তিক যন্ত্রণাভরা মুখটি লুকিয়ে রেখে শুশ্রূষা খুঁজে পেতে চেয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্য ‘ঝরা পালক’এর শেষের দিকের কবিতায় একটা মোড় ফেরা মনোভাব লক্ষ করা যায়। ‘ও গো দরদিয়া’ ‘সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়’ কবিতাগুলোতে তাঁর হৃদয়-যাতনার উপশম খোঁজার ইঙ্গিত স্পষ্ট । তিনি ‘ঝরা পালক’ রচনাকালেই তাঁর চোখের সামনে দেখেন যে- শত শুভ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কাজী নজরুল-সুভাষ বসুরা হয়ে পড়েছেন ‘সংখ্যালঘু’ ও ‘কোণঠাসা’। ঐক্যের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রয়াস মার খেয়ে চলেছে অবিরাম। মহামিলনের তরী ডুবুডুবু। ‘কাণ্ডারী বল, ডুবিছে মানুষ-সন্তান মোর মা’র!’-এই আহ্বানে তেমন সাড়া মিলছে না। সম্মিলিত উদ্ধার-অভিযান অনুপস্থিত। জীবনানন্দ দাশের ‘হিন্দু-মুসলমান’ জাতীয় মহামৈত্রীর গানেও কান দিচ্ছে না মূলধারার রাজনীতিকরা। বৃটিশদের বিভাজন-নীতি জয়ী হয়ে চলেছে। বিভাজিতরা আত্মকলহে লিপ্ত, শোষিতরা নিজেদেরই মধ্যে হানাহানিতে উন্মত্ত। ভারত উপমহাদেশের ‘বর্তমান’ বিড়ম্বিত; কিন্তু তারচেয়েও বেশি শঙ্কা-গর্ভ তার ‘নিকট ভবিষ্যৎ’। বর্তমান গতিপথ রক্তাক্ত ; নিকট গন্তব্যস্থল আরেকটি কুরুক্ষেত্র হওয়ায় আশঙ্কায় উত্তেজিত। সংবেদনশীল মানুষের জন্য দেশের আকাশে-বাতাসে-মাটিতে শুধু উৎকণ্ঠা, উৎকণ্ঠা আর উৎকণ্ঠা। ঘরের-বাইরের, সমাজের-ব্যক্তিজীবনের, বর্তমানের-নিকট ভবিষ্যতের এই রক্তাক্ত আবহাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে এসেছিল জীবনানন্দের মতো নিরীহপ্রাণ বিবেকবান অথচ নিবিড়ভাবে সংবেদনশীল মানুষের। জীবনানন্দ দাশ সেই অনিঃশেষ উৎকণ্ঠার ভার সইতে পারছিলেন না। দু’দন্ড শান্তির আড়াল প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তাঁর। সেই আর্তভাবনা থেকেই তিনি লিখেছিলেন ‘সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়’। এই কবিতাই তাঁর প্রথম ‘অবসরের গান’- যেখানে তিনি বলেছেন, ‘ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!/ ফুরায় গিয়েছে যা ছিল গোপন স্বপন কদিন রয়!/ এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,- এ তবু গোধূলি নয়!/ সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়- /আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের পরে।’ এই যে ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে ঝড়কবলিত উটপাখির মতো মাটির বুকের পরে মুখ রেখে সারাটিরাত শান্তি খুঁজে নেয়া,- তার চূড়ান্ত রূপ যে হবে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ – সেটাই অবধারিত ছিল। ‘সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়’- এই হৃদয়-কথন শুনতে শুনতে অবসরের আরো নিবিড়-গভীর আহ্বান নিয়ে এসে গেছে হেমন্তের ভোর। নগরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে,- নাগরিক চক্ষুর আড়ালে,- তিনি চোখ মেলে দেখেছেন—
শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে ;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,- চোখে তার শিশির ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবস্বাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয় ;-
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) ব্যর্থ করে দেবে তার সাধের সময়!
এই কবিতা রচনার মাত্র কিছুদিন আগে এক অনির্বচনীয় অদ্ভুত বোধে আক্রান্ত এবং ক্লান্ত হয়ে তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় আর্ত-উচ্চারণ করেছিলেন: ‘অবসাদ নাই তার? /নাই তার শান্তির সময়? / কোনোদিন ঘুমোবে না? /ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ পাবে না কি?’ (বোধ/ ধসর পাণ্ডুলিপি)। এই অন্তরঙ্গ আত্মজিজ্ঞাসার পথ ধরেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন উত্তর–তাঁর প্রাণেও অবসাদ আছে, তাই দরকার শান্তির সময় ও অবসরের স্থান। অবসর উদযাপনের এক অনন্য অতুলনীয় ভেন্যু নির্বাচন করা হয়েছে এই কবিতায় এবং এটি কবিতার সবচেয়ে বড় সম্পদ। নাগরিক কোলাহল, ট্রাকের হর্ন, বাসের চাকার শব্দ, ট্রেনের হুইসেল, কারখানার ঘণ্টা ও ধোঁয়া, শ্রমিকের আহাজারি, মালিকের আস্ফালন, ড্রেনের পচা গন্ধ, পেট্রোলের ঝাঁঝ, কারখানার বয়লারের দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস,-এসবের কোনোটাই এখানে নেই। নেই- যুদ্ধে-বিগ্রহের ঢাকঢোল, রাজ্যজয়ের আস্ফালন, রাজ্য হারোনো আর্তনাদ। সাম্প্রদায়িক হানাহানি নেই, জাতে জাতে ঘৃণা নেই । বন্ধুত্বের মিথ্যা আশ্বাস নেই, শত্রুতার গোপন ছুরি নেই, বিশ্বাসভঙ্গের অসহ্য বেদনা নেই। মিলনের উত্তেজনা নেই, বিরহের বিষাদ নেই। এখানে নেই দুঃসংবাদে ভরা সংবাদপত্রের শিরোনাম, অফিসে ছুটাছুটি, ব্যাগহাতে কাঁচাবাজারে দৌড়ঝাঁপ, বাস-ট্রাম ধরার প্রাণান্ত, টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার যন্ত্রণা, উৎসরের আনুষ্ঠানিকতা, প্রতিযোগিতায় জেতার উদ্যম, ইঁদুর উৎসাহের ব্যথা। কোনো সৌন্দর্য এসে ধরবে না হাত। কোনো রোমান্টিক চোখ এসে পড়বে না চোখে। আসবে না ভালোবাসা; এবং ‘জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরিয়ে গেছে মাথার ভিতর।’ এখানে মন ভাবনাহীন, মগজ চিন্তাশূন্য, মন উৎকণ্ঠামুক্ত। এখানে সময় রুটিনবিহীন, মন হালকা, হৃদয় জ্বরম্ক্তু । এখানে আছে ক্লেশহীন প্রাণের সামনে বিস্তারিত প্রকৃতির প্রচ্ছদে জীবনের সচ্ছলতায় ভরা সোনালি ধানের ক্ষেত, পেঁচা, ইঁদুর, পাখির গান, বিশুদ্ধ হাওয়ার মাতলামি, নদীর কলতান, শিশুর গালের মতো নরম রোদ, মাছির গানের মতো অলস শব্দ, ভাঁড়ারের রস, রূপশালি ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ, পাকা ধানের স্তন থেকে ঝরে পড়া শিশিরের জল, ভোরের শিশিরের ঘ্রাণ, কাঁচা ঘাসের গন্ধ. মাঠের ঘাসের উপর লেগে থাকা শৈশরের ঘ্রাণ, মাথার উপর রাতের রুপালি চাঁদ। সবার উপর আছে ফসলের মাঠের আহবান । এই মাঠে ঝরে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাঁড়ারের রস। এই মাটির নিচে আছে শীতল মদ অর্থাৎ দহনমুক্তির সুশীতল শান্তি। আলস্যের আমেজভরা সময় ডাকে- কুঁড়েমি করে সময় কাটানোর শৈথিল্য উৎযাপনে যোগ দিতে। এখানে রূপে রসে বর্ণে গন্ধে স্পর্শে স্বাদে দারুণভাবে উপভোগ্য। তবে সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য উৎকণ্ঠাহীন সময়- ‘অবোধের মতো আহলাদে ভরা অবসর’। এই অবসরে দূর হয়ে যায় শরীরের অবসাদ,- ভালো হয় হৃদয়ের জ্বর। অর্থাৎ এই অবসর যাপন অতিষ্ঠ জীবনকে দেয় স্বস্তি ও সুস্থতা। সেই সুস্থ শরীর-প্রাণে নিবিড় ইচ্ছা জাগে এটুকু সময় রূপ আর কামনার গানে কাটিয়ে দিতে ভাবনাহীন। যুদ্ধ-মারি-আগ্রাসন-সাম্রাজ্যবাদিতা-সাম্প্রদায়িক হানাহানি-লোভ-লালসা-অর্থলিপ্সা- -পাশবিকতা-রাজ্যলিপ্সা-উৎকণ্ঠা-উৎসাহ-হৃদয়হীন উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা-ইতর কোলাহলে ভরা আধুনিক জীবনে এমন অনন্য অবসর ভেন্যু জুটে গেলে তখন সঙ্গতভাবেই ‘পৃথিবীকে মায়াবীর পারের নদীর দেশ বলে মনে হয়’। মায়াবী পারের দেশে সবকিছুই মায়াময়-ছায়াময়; আর নদী হচ্ছে শ্রান্তি-হরণিয়া উপশমকেন্দ্র। এমন নিরুপদ্রব অবসর ভেন্যু ছেড়ে কার যেতে ইচ্ছে করবে? অতএব হেমন্ত ফুরোবে- আসবে শীত- আসবে বসন্ত- আসবে গ্রীষ্ম –সকল মৌসুমেই এই স্থান হয়ে থাকবে অবসরের গান গাইবার ও উপভোগের উপযুক্ততম মঞ্চ। তাই এই স্থানে রয়ে যেতে চায় আধুনিক জীবনের দহনে দগ্ধ কবির ইচ্ছা ও অভিলাষ,- মন ও মনন। ‘অবসর’ স্থায়ী কোনো সুযোগ নয় হেতু যতক্ষণ পারা যায়-যতখানি পারা যায়-উপভোগ করতে হবে এই বিরল অনন্য-অবসর।
জীবনানন্দ উপস্থাপিত অবসর-যাপন প্রক্রিয়াটিও অভিনব। সকল উদ্যম ও উত্তেজনা হতে দূরে থেকে নির্ভেজাল বিশুদ্ধ অবসর যাপনে মগ্ন হতে চায় ওষ্ঠাগত প্রাণমন- যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়। এই অবসর হয়তো দীর্ঘজীবী হবে না, হয় না। মিলন যেমন ক্ষণিকের, সুখ যেমন ক্ষণস্থায়ী, বসন্ত যেমন স্বল্পকালীন, জীবন যেমন ক্ষুদ্রসময়ের ফ্রেমে বাঁধা, তেমনি স্বল্পায়ু এই অবসর। বেঁচে থাকতে হলে, টিকে থাকতে হলে- কেবল অবসর যাপন করলেই তো হয় না, কাজ করতে হয়। শুধু থেমে থাকলে চলে না, হাঁটতে হয়- দৌড়াতে হয়। সেজন্যই এই স্বল্পকালীন ও অনিশ্চিত অবসরকে দেখে, শুনে, শুঁকে দেখে, মেখে, চেখে, হাতে নিয়ে, মাথায় নিয়ে, বুকের কাছে নিয়ে, হৃদয়ের মাঝে নিয়ে- উপভোগ করতে হবে। জীবন তো ক্ষণস্থায়ী, ততোধিক ক্ষণস্থায়ী এই হেমন্তের কাঁচারোদমাখা প্রভাত, এই সোনালি গোধূলি, এই সাতটি তারার আলো জ্বলা অন্তরঙ্গ রাত। তাই অবসরটুকু উদ্যাপন করতে হবে নাচে গানে, পানে ও আড্ডায়।
গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া!
তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া,
ভুলে গিয়ে রাজ্য- জয়- সাম্রাজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা,
ডেকে লব আইবুড় মেয়েদের সব;-
মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে;- শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।
হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;
ফলন্ত ধানের গন্ধে রঙে তার স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ;
এই অবসর যাপনকালে রোধ-ক্লেশ-অবরোধ–কোলাহলে সময় দেওয়ার সময় নেই; কোথায় ভেঙে পড়ছে রাজ্য, কোথায় ধ্বংস হচ্ছে প্রাচীন নগর, কোথায় সম্রাট ভাঁড় সেজে রঙ্গ-ব্যঙ্গ করছেন প্রজাদের সঙ্গে-সেসব জানার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই: যুদ্ধগমনরত সৈন্যদের মশালের রঙ দর্শন কিংবা কোনো সাম্রাজ্যের বাদুড়-অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া পর্যবেক্ষণের গরজ নেই মনে। উৎকণ্ঠা নয়, অস্থিরতা নয়, সর্তকতা নয়, বৈষয়িক সচেতনতা নয়, স্মৃতির বেদনা নয়, কর্তব্যবোধের তাড়না নয়,-রূপে-রসে-গন্ধে-স্বাদে-শ্রুতিতে-নৈঃশব্দে শ্রান্তহৃদয় ডুবিয়ে দিয়ে শুধু নিবিড় নির্দোষ নির্মল আনন্দ-অনুভব।
‘গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া!’– উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ‘রুবাইয়াত’-এর বিশ্বখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামের প্রসঙ্গ এসে যায়। ‘ব্যথায় শান্তিলাভের তরে থাকতো যদি কোথাও স্থান/ শ্রান্তপথের পথিক মোরা সেথায় জুড়াতাম এ প্রাণ/শীতজর্জর হাজার বছর পরে নবীন বসন্তে/ফুলের মতো উঠত ফুটে মোদের জীবন-মুকুল ম্লান।’ (অনুবাদ: কাজী নজরুল ইসলাম)-এই গভীর ব্যথা-বিষাদ ভোলার জন্য ওমর খৈয়াম সারাজীবন ছায়া অন্বেষণ করেছেন জীবনের অমীমাংসিত উঠোনে। কখনো জুটেছে কিছু নগদ ছায়া। গাছের ছায়ায় বসে বাম হাতে মদের পাত্র নিয়ে ডানহাতে রচে গেছেন জীবন-দর্শনের রূপরেখা-সমৃদ্ধ হাজারো রুবাইয়াত। বেদনায় ম্লান জীবনের মুকুল সেখানে সুখের বাতাসে সতেজ হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিল কি না জানা নেই, তবে বিশ্ববাসী পেয়েছেন নশ্বর গোলোপের চেয়ে মূল্যবান চিরতাজা কবিতা।
সেই নিরালা পাতায়-ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়!
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর–
সেই তো সখি স্বর্গ আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর!
(অনুবাদ : কান্তি ঘোষ)
রাজ্য নয়, সিংহাসন নয়, অর্থ নয়, সম্পদ নয়, পদ নয়, পদবী নয়,- জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক কিছু রুটি, দুঃখ ভুলে থাকার জন্য কিছু মদ এবং একমাত্র মানবসঙ্গী সাকীকে সঙ্গে নিয়ে কবিতা রচনা করে দিন গুজরান-এর বেশি আর কোনো চাওয়া নেই । সামজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে তাঁর কোনো দাবি নেই। কে সিংহাসনে বসলো আর কে ধনেকুবের হলো-এসব নিয়ে এতটুকু মাথাব্যথা নেই কবির। স্বর্গলাভের লোভে, হুরপরীদের মোহে তিনি ধর্মশালায় কাটাতে চান না তাঁর দিন ও রাত। তিনি কারও ক্ষতিতে নেই; কারও স্বার্থের-সুখের পথে কাঁটা বিছানোও তাঁর কাজ নয়। তিনি কারও মিছিলের অংশীদার হতে চান না; শরীক হতে চান না কোনো যুদ্ধে । কারণ তার রাজ্যলোভ নেই, বীরত্বের খ্যাতিলাভের মোহ নেই। তাঁর প্রয়োজন নেই লোক-লস্কর, পাইক-পেয়াদা, চাকর-ভৃত্য। শুধু নিভৃতে ছায়াযাপন , শুধু একটা নিরীহ কবিজীবন যাপন। তাঁর প্রয়োজন অপ্রচারিত দিন,-অবিজ্ঞাপিত রাত। তাঁর জন্য উৎসব নয়, উদযাপন নয়; উপহার নয়, উপঢৌকন নয়। এককথায় তিনি কোনোভাবেই সেলিব্রেটির জীবন চান না। খৈয়াম নান্দনিক আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে চেয়েছেন কিন্তু মূর্খতায় মাতাল হতে চাননি। জীবনের মদপান করে লাভ করেছেন দিব্যদৃষ্টি; সেই দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন জীবনের ভেতর-বাহির, নশ্বর সভ্যতার অনশ্বর পরম্পরা, মহাকালের স্রোতধারা। তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়েছে যে- আজ যেখানে বাগান, তার নিচে রয়েছে অতীতের মানুষের অস্থি- কংকাল, আজ যেখানে বিরানভূমি-, অতীতে কোনো এক সময় সেখানে ছিল মুখরিত জনপদ, সেখানের মাটিতে-জলে-বাতাসে মিশে আছে অতীতের অজস্র মৃত্যুর ঘ্রাণ, বিষাদ ও বেদনা। আজকের সবুজ নিকুঞ্জ হয়তোবা সেদিনের কোনো সুন্দরীর অচিহ্নিত সমাধি ! জীবনের গহনে কান পেতে তিনি শুনেছেন-বর্তমানের সবুজ বাগান কথা বলে নৈঃশব্দ্যের বর্ণমালায় রচিত মৃতের বর্ণমালায়। আজকের গোলাপফুলের ভিড়ের শেকড়ে রস সরবরাহ করে যাচ্ছে হয়তো-বা কোনো শাহানশার রুধির; আজকের ‘নার্গিস’ আর ‘গুল-বনোসা’ ফুটে উঠেছে হয়তো-বা গালে তিল ছিল অতীতের এমন কোনো সুন্দরীর প্রাণ-সৌন্দর্য নিয়ে। জীবনের সবুজ বাগানে ঢেউ খেলে যায় মৃত্যুর গন্ধবাহী হাওয়া।
জীবনানন্দ দাশের কাব্য-চেতনায় মানবসভ্যতার অতীত ও বর্তমান, ইতিহাস ও কল্পনা, বিশ্বকাব্য-পরম্পরার জ্ঞান, স্বীকরণ ও স্বকীয়তা- সোনায় সোহাগার মতো সংমিশ্রিত ও সংশ্লেষিত হয়েছে। এখানে খৈয়ামের সাথে তাঁর ভাবনার সাদৃশ্য রয়েছে। তাঁর কাব্যিক অভিজ্ঞানে ধরা পড়েছে যে অনেক মৃত্যু, অনেক ত্যাগ, অনেক ঘাম, অনেক শ্রম, অনেক জীবনের বিনিময়ের সুন্দর আমাদের আজকের এই পৃথিবী। শহর, নগর, বন্দর, রাজধানী, শহরতলী, গ্রাম সবকিছু গড়ে উঠেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের ধারাবাহিক শ্রম, ঘাম, মেধা ও প্রাণের দামে। সুউচ্চ প্রাসাদের নিচে চাপা পড়ে আছে নাম-বিস্মৃত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের হাড়; সোনালি ধানখেতের মাটিতে মিশে আছে জঙ্গল ভেঙ্গে তাকে চাষ-উপযোগী ও বাস-উপযোগী করা অতীতের অজস্র ঘাম, রক্ত , অস্থি ও মেধা। আজকের কবি অতীতের কবিদেরই উত্তরাধিকার। আজকের কাব্যভাবনা অতীতের কাব্যকর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আজকের সভ্যতার সোনালি ফসল উপভোগ করতে গিয়ে সভ্যতা-সচেতন কাল-সচেতন কবির মনে ফ্লাশব্যাক হয়ে ভেসে ওঠে সেই পরম্পরা। জীবনানন্দ দাশ হেমন্তের সোনালি ফসলভরা মাঠে অবসর যাপন করতে গিয়ে ইতিহাস-সচেতন ও সভ্যতার-পরম্পরা-সচেতন হয়ে উঠেছেন। কৃষিসভ্যতার সিলসিলা তার মনে অতীতের কৃষিখেতের নিবিড় ঘ্রাণ এনে দিয়েছে। যদিও তিনি বলেছেন যে- অবসরের গান গাইতে গিয়ে- অবসরের নাচ নাচাতে গিয়ে অতীতের রাজা-বাদশাহ-কবি-ভাঁড়-কৃষকদের কথা মনে আনতে চান না, কিন্তু তাঁর সে কথার মধ্যেই বিস্মৃতি রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে সজীব স্মৃতিকাতরায়। কারণ তিনি জানেন, ‘তাদের ফলন্ত দেহ শুষে লয়ে জন্মিয়াছে আজ এই ‘ক্ষেতের ফসল।’ ফলে এসে গেছে তাদের প্রসঙ্গ। এবং প্রবলভাবেই। তাঁর চেতনাকে খুঁটে খেয়েছে অতীতের রাজা-বাদশাহ-কবি-ভাঁড়-কৃষক-প্রেমিকা-যোদ্ধাদের স্মৃতির ঝাঁক। নির্জন অন্ধকারে তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে নানা ফ্লাশব্যাক, বহুবিধ কল্পচিত্র। মনে হয়েছে- অনেক দিনের ঘ্রাণে অভিজ্ঞ অন্ধকার মাঠের ইঁদুর, পেঁচা, নরোম রাতের ঝরা শিশিরের জল জানে তাদের কথা ও কাহিনী। এদের অস্ফুট-অর্ধস্ফুট গুঞ্জনে ব্যঞ্জিত হয়ে উঠেছে আর্ত-আহবান। আর মৃতরাও সাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে লুপ্ত অস্তিত্বের অদৃশ্য অঙিনায়: ‘মাটির নিচের থেকে তারা/মৃতের মাথার স্বপ্নে নড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভুত ইশারা!’
‘অবসরের গানে’ কথার ফাঁকে ফাঁকে কবি এই অবসর যাপনের পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছেন। এই জীবন ক্ষণস্থায়ী। জীবনের অপর পিঠে মৃত্যু। মৃত্যুকে এড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই। অতএব যতটুকু পারা যায়- যতবেশী পারা যায়- ইতিবাচক অর্থে জীবনকে উপভোগ করে যাওয়াই উত্তম এবং সেটাই প্রকৃত জ্ঞানীর কাজ। পৃথিবী তার সকল ঐশ্বর্যের ফসল, সৌন্দর্যের পশরা এবং মাধুর্যের ডালি নিয়ে রয়ে যাবে হয়তোবা বহুকাল, কিন্তু মানুষ তো তার জীবন শেষে চিরতরে ঢলে পড়বে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে। তার এসব উপভোগের আর কোনো সুযোগ থাকবে না। অতীতে যারা কবি ছিলেন- ভাঁড় ছিলেন, রাজা ছিলেন, বাদশাহ ছিলেন, সুন্দরী ছিলেন, প্রেমিক ছিলেন, যোদ্ধা ছিলেন- আজ তারা কেউই নেই। সবাই মাটির খাদ্য হয়ে গেছে। যাপিত জীবনের পুনরাবৃত্তি নেই। অতএব ওয়ানটাইম স্বল্পস্থায়ী জীবনকে ব্যস্ততায় ও বিষাদে, দুর্ভাবনায় ও দুশ্চিন্তায়, আত্মপীড়নে ও শুচিবায়ুগ্রস্ততায়, অতি হিসাবে ও অতিসর্তকতায়- শৃঙ্খলিত, বৃত্তাবদ্ধ এবং নিরানন্দ করে রাখার কোনো মহৎ মানে নেই। জীবনের চেয়েও ক্ষণস্থায়ী সুখের দিন, আনন্দের রাত। প্রতিদিন সামনে এসে দাঁড়ায় অভাব ও অভিযোগ, প্রয়োজন ও প্ররোচনা, রোগ ও মৃত্যু, দুর্ঘটনা ও দুর্ভাবনা এবং অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। অধিকন্তু জীবনের চাহিদা- বহু ও বহুবিধ, অথচ সম্পদ সীমিত,- সুযোগ অনিশ্চিত। ক্ষণিক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে সাধারণত তা আর ফিরে আসে না। ফিরে আসে না চলে যাওয়া শৈশব-বাল্যকাল-যৌবন। উপভোগের ক্ষমতাও হারিয়ে যায় একসময়। সেটাও ফিরে পাওয়া যায় না। অধিকন্তু, ‘আমাদের অবসর বেশি নয়, ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয়।’ জীবনের শুকানো পাতার স্তুপ ধুলে হয়ে উড়ে যায় । তখন থাকে অবসাদ,- থাকে মৃত্যু । অবসর দীর্ঘ হলে তা একঘেঁয়েমিতে পর্যবেসিত হয়; সুখে দীর্ঘস্থায়ী হলে তা অবসাদে রূপান্তরিত হয়। প্রকৃতির রূপঘন চেহারা শীর্ণ হয়ে যায় মৌসুম ফুরালে। বাগান হয়ে পড়ে ঝারাপাতা ও ঝরাফুলের ভাগাড়। হেমন্ত গেলে শীত আসে। হেমন্তের সোনালি ক্ষেত শীতে পর্যবেসিত হয় ধূসর বিরান ভূমিতে। প্রকৃতির শরীর থেকে খসে পড়ে রূপ-লাবণ্য। মৌসুমের আবর্তনে প্রকৃতিতে রূপ-লাবণ্য ও উপভোগের উপকরণ নতুনভাবে সংযোজিত হতে পারে এবং হয়ও , কিন্ত তখন সেসব উপভোগ করার মতো সময় থাকে না, সুযোগ থাকে না, শরীর-মনের যোগ্যতা থাকে না। কাজেই যে ‘রূপশালি ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ’ আজ লেগে আছে ‘পাড়াগাঁর গায়ে’ এবং উপচে পড়ছে পরিপূর্ণতায়- অল্পদিন পরেই ‘শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে!’ মৌসুমের পুনরাগমনে হয়তো প্রকৃতি আবারও সাজবে এই সাজে পরবর্তী অন্য কোনো হেমন্তে, কিন্তু সেদিন যে আজকের এই কবি বেঁচে থাকবেন আর হেমন্তের এই মাঠে আসার আবারও সুযোগ হবে তার,- এর তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। জীবনের নির্মম প্রাত্যহিকতা থেকে একখন্ড অবসর নিয়ে তাই রাজ্যজয়-সাম্রাজ্যপ্রতিষ্ঠা-যুদ্ধবিগ্রহ ভুলে হেমন্তের এই রূপে-রসে গন্ধে-স্পর্শে-স্বাদে-শ্রুতিতে ভরা মাঠে আজ নাচে-গানে-প্রেমে-পাগলামিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠাই কবির পিপাসা ও প্রকল্প, আনন্দ ও আকর্ষণ। এখানে কাব্যভাবনায় খৈয়াম ও জীবনানন্দের মধ্যে একটি পার্থক্য এই যে- খৈয়ামের কবিতায় ইহকাল-পরকাল, পাপ-পুণ্য মিলিয়ে জীবন-দর্শন কেন্দ্রীয় বিষয়; কিন্তু জীবনানন্দের এই কবিতায় জীবন-দর্শন পরিধিমাত্র, কেন্দ্র হচ্ছে দগ্ধ-হৃদয়ের শুশ্রূষা-সন্ধান।
বিষয়-গৌবরের সাথে নির্মিতির অভিনবত্ব ‘অবসরের গান’- কে একটি শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিতে উন্নীত করেছে। এই কবিতায় সৃজিত রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদ-শ্রুতি-নৈঃশব্দ্য-জোছনা-অন্ধকার কবিতাটিকে অনিঃশেষ আকর্ষণ ও সৌন্দয়ের আধার করে তুলেছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার খুঁটিনাটি নিয়ে এক অনির্বচনীয় প্রাণপ্রতিমা হয়ে উঠেছে। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/—–ভাঁড়ারের রস’—-পনেরো লাইনের অনুচ্ছেদটি এই প্রাণপ্রতিমার অনিন্দ্যসুন্দর মুখ। জোছনা, অন্ধকার, নদীর কলতান, বাতাসের গুঞ্জরণ, নক্ষত্রের দ্যুতি, ফসলের সোনালি রূপ, গাছের ছায়া-ইত্যাদি বড়ো আকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি ক্ষুদ-কুঁড়ার উপস্থিতি, অনেক দিনের ঘ্রাণ-অভিজ্ঞ মাঠের ইঁদুরের গুঞ্জন, পেঁচার ডাক, পাড়াগাঁর অলস ভাঁড়ের পদ্য , মশার গান -প্রচলিত অর্থে নেতিবাচক এইসব প্রপঞ্চ অতুলনীয় নান্দনিক ইতিবাচকতায় নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের নিবিড় সৌন্দর্য,- যা বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে এতদিন ছিল অদেখা, অজানা, অশ্রুত এবং অনাস্বাদিত। এই সৌন্দর্যের শরীরে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর গন্ধ, বিষাদের ছায়া, কাল-পরম্পরার ঘ্রাণ ও কল্পনার সুবাস। কার্তিকের ধানখেতের ওপর মাথা রেখে অলস গেঁয়োর মতো হেমন্তপ্রভাতের রোদের শুয়ে পড়া, ফসলের স্তন থেকে ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের জল ঝরে পড়ার দৃশ্য, মাঠ থেকে প্রচুর শস্যের গন্ধ ভেসে আসা,-ইত্যাদি বাংলাদেশের সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছে সূক্ষ্ণ অনন্যতায়। এই সৌন্দর্য দেখে ‘চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায়’; এসকল শব্দ শুনে ‘স্নিগ্ধ হয় কান’; এই গন্ধে-এই আহ্লাদে ‘অবসাদে ভরে যায় শরীর’। ‘পাড়াগাঁর গায়ে আজ লেগে আছে রূপশালি ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ’- এই একটিমাত্র চরণে প্রকৃতি ও মানুষ একাকার সৌন্দর্যে হয়ে উঠেছে জীবন্ত, তাজা এবং সুরভিত। আবার ‘পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে’-এই কয়েকটি শব্দচিত্রে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য এবং উপচানো ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য এবং তাদের পারস্পারিকভাবে নির্ভরশীল সহাবস্থানের ছবি মোহময়ী প্রাণবন্ততায় জীবন্ত সত্য হয়ে উঠেছে। সৌন্দর্যের এমন নির্মিতি জীবনানন্দের হাতেই প্রথম এবং অবশ্যই তা নান্দনিক সাফল্যে অতুলনীয়। কবিতার গায়ে আবহমান বাংলার নিবিড় সৌন্দর্যের এই অভূতপূর্ব সংযোজনই কবিতাটিকে খৈয়ামের প্রভাব কাটিয়ে উঠে নান্দনিক অভিনবত্বে সফল বাংলা কবিতা হয়ে ওঠায় অব্যর্থ সহায়তা প্রদান করেছে।
জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টি-শৈলীর অনন্যতার উজ্জ্বল নজির ‘অবসরের গান’। নজরুলের ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ কিংবা ‘হেমন্ত-গায় হেলান দিয়ে গো রৌদ্র পোহায় শীত’- প্রভৃতি চরণের সৌন্দর্য-অভিনবত্বকে পাশে রেখে জীবনানন্দ বলেছেন, ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে / অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;’ এই উপমাপ্রধান প্রকাশ অধিকতর ব্যঞ্জনাসহ প্রাতিস্বিকতায় ও অভিনবত্বে অতুলনীয় সুন্দর হয়ে উঠেছে। শিশিরের ঘ্রাণ, অবসাদে ধান পেকে ওঠা, শিশুর গালের মতো রোদের নরম রঙ, আহলাদে অবসাদে শরীর ভরে ওঠা, রূপশালি ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ, মাছির গন্ধের মতো অলস সময়, আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের দল, কার্তিকের মিঠা রোদ, অনেক দিনের গন্ধে ভরা ইঁদুর, নরম রাতের হাত, হৃদয়ের জ্বর, অগাধ ধানের রস, পাড়াগাঁর ভাঁড়, অবোধের মতন আহলাদ, পেঁচার পাখার মতো অন্ধকার, উৎসাহের ব্যাথা, উদ্যমের ভাবনা, অলস মাছির শব্দে ভরা সকালের বিষণ্ন সময়,- প্রভৃতি গভীর-নিবিড় ব্যঞ্জনাগর্ভ প্রাণবন্ত উপমা-উৎপ্রেক্ষা-সমাসবদ্ধ শব্দরাজি-পোয়েটিক আইডিয়া ইতোপূর্বে বাংলা কবিতায় দেখা যায়নি। ‘বিয়োবার দেরি নাই’ কিংবা ‘হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির বিছানার পর’-এসকল চরণে ‘বিয়ানো’ এই গেঁয়ো-কথ্য শব্দটির ব্যবহার এবং একইসঙ্গে এমন ব্যঞ্জনাগর্ভ ব্যবহার পাঠকের চোখে এই প্রথম ধরা পড়ে। কিংবা ‘গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া’- এখানে ‘ভাঁড়’ এই নেতিবাচকাতাগর্ভ শব্দটি ইতিহাসের ইঙ্গিতে এবং পরিহাসের তির্যকতায় অনন্য ইতিবাচকতায় ব্যবহৃত হয়ে কবিতাটির সমৃদ্ধি ও উপভোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছে। এই কবিতায় আর্ত-উচ্চারণ প্রাণের স্পর্শে সজীব; এখানে রূপ-বৈচিত্র্য মৃত্যুর ঘ্রাণে নৈসর্গিক; এখানে বাংলার একখণ্ড জমিন বহু দেশ-বিদেশ-নক্ষত্র-আকাশের ছবি বুকে নিয়ে বিস্তারিত পৃথিবী; এখানে দু’দণ্ড বর্তমান ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরায় মহাকাল; এখানে নৈঃশব্দ্য অজস্র শব্দ-গুঞ্জন-উচ্চারণ-শ্রুতির স্মৃতিতে মুখর; এখানে উৎসব অপ্রগলভ হৃদয়ের অংশগ্রহণে নরোম ও অনুদ্ধত; এখানে প্রাণপিপাসা বাংলার শ্যামল মাটির ছোট পেয়ালায় পান করতে প্রস্তুত বিশ্বজীবনের মদ। কবিতাটি দীর্ঘাকৃতির; কিন্তু কোথাও সে বক্তব্যের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েনি। কিছু কিছু পুনরাবৃত্তি ঘটেছে কিন্তু সেসব অনাবশ্যকতার একঘেয়েমি সৃষ্টি না করে কবিতার গঠন ও বাঁধনকে একইসঙ্গে স্থিতিস্থাপক অথচ মজবুত এবং সৌকর্যময় করে তুলেছে।
এই কবিতা প্রতিবাদের নয়, একাত্মতারও নয়; এই কবিতা আত্মপ্রকাশের নয়, আত্মগোপনেরও নয়; এই কবিতা সমষ্টির নয়, ব্যক্তিরও নয় সবখানি। এই কবিতা অবসাদের নয়, আহলাদেরও নয়; এই কবিতা হতাশার নয়, উচ্চকিত আশারও নয়; এই কবিতা স্বপ্নের নয়, দুঃস্বপ্নেরও নয়; এই কবিতা মৃত্যুবান্ধব নয়, মৃত্যুবৈরিতারও নয়; এই কবিতা উৎসরের নয়, উৎসাহেরও নয়; এই কবিতা প্রেমের নয়, প্রত্যাখানের নয়; এই কবিতা প্রকৃতির নয়, নগরেরও নয়; কিন্তু এই কবিতার শরীরে-প্রাণে এসবের সবকিছুরই নিবিড় উপস্থিতি। এই কবিতার মধ্যে সমকাল ও মহাকাল, অতীত ও বর্তমান, নগরের আবহ ও গ্রামীণ প্রচ্ছদ, জীববৈচিত্র্যের সমাহার ও মৃত্যুর ছাপ, মৃত্যুচিন্তা ও বাঁচার আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও প্রেমহীনতা, শরীরের ক্ষুধা ও হৃদয়ের পিপাসা, জীবনের নশ্বরতা ও বাসনার অন্তহীনতা, বাস্তবতা ও স্বপ্ন, নগরকেন্দ্রিক ধূসর আধুনিক জীবনের জ্বর ও প্রকৃতির সবুজ শুশ্রূষা- এসবের সমাহার অতুলনীয় শিল্পসাফল্যে সংশ্লেষিত হয়ে একটি অভিন্ন সৃষ্টিসমগ্রতায় উপস্থাপিত হয়েছে।
আধুনিক নগরজীবনের ফ্রেমে-বাঁধা প্রাত্যহিকতায় অতিষ্ঠ এবং অনির্বচনীয়ভাবে অদ্ভুত এক প্রাতিস্বিক বোধে তাড়িত ও ক্লান্ত জীবনানন্দ দাশের আপন হৃদয়ের সঙ্গে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ একা কথা কওয়ার এবং সেই পথ ধরে অবসাদ-শান্তি-স্বপ্ন-ঘুমানোর পিপাসা নিয়ে প্রকৃতির মাঝে লীন হয়ে থাকার বাসনা-আশ্রয়ী নান্দনিক অভিযাত্রা এই কবিতা। এই অভিযাত্রার পথ কবিতার গতানুগতিক পাহাড়-জঙ্গল-উজান কেটে সৃষ্টি করেছেন তিনি নিজে এবং একলাই। ‘কোনো এক নতুন-কিছুর আছে- প্রয়োজন’- ভেবে তিনি অভূতপূর্ব ছন্দে ও তালে, উপমায় ও উৎপ্রেক্ষায়, বিশেষত্বে ও ব্যঞ্জনায়, শব্দে ও সংকেতে এমন অনুপম কবিতা সৃষ্টি করেছেন। কবিতার ব্যাকরণের গতানুগতিক বাঁধাপাড় ছাপিয়ে উঠে ‘অবসরের গান’ নান্দনিক রসের-আনন্দের-উপভোগের নিবিড় শ্রান্তস্রোতা নদী। কবিতাহাতে এখানে জীবনানন্দ সম্পূর্ণ আলাদা,- তাঁর মতো ‘আর নাই কেউ।’