তাজ ইসলাম
‘মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি,মুগ্ধতা আজ দেশে–/
কোটি মানুষ রুখছে দানব , আবু সাঈদ বেশে! ৩১ জুলাই ২০২৪’
কবিতা অল্প কথায় বিস্তর প্রকাশের অন্যতম শিল্প মাধ্যম। এই দুই লাইন লিখেছেন কবি আবদুল হাই শিকদার। আবদুল হাই শিকদার হলেন বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে অন্যতম সরব কণ্ঠ। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সকল রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে কথা বলে গেছেন। তিনি কথা বলেছেন নানাভাবে। কবিতায়,বক্তৃতায়,সাংবাদিকতায়। তিনি কবি,সাংবাদিক,রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। অল্পকথায় তিনি একটি সময়কে ধারণ করেছেন। প্রকাশ করেছেন ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের ঘটনাবহুল পরিস্থিতি। ২৪ এর বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে একদল তরুণ ছাত্রের সম্মিলিত কণ্ঠে। সে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছেন এদেশের সকল মুক্তিকামী জনতা। তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে মুগ্ধ ও আবু সাঈদ বেশে। হাসিনার ফ্যাসিস্ট বুলেটের সামনে মহানায়ক হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন মুগ্ধ ও আবু সাঈদ। আওয়ামী দুঃশাসন হটাতে তারা বাংলার জমিনে ঢেলে দিয়েছেন বুকের তাজা রক্ত। কবির ভাষায় ‘ আজকের বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের বীর নায়ক শহিদ আবু সাঈদ।’… সাঈদের রক্ত আনে রাহুমুক্ত ঈদ।’ ১৭ জুলাই ২০২৪।
জুলাই বিপ্লবে ভেসে গেছে জালিমের দম্ভ। পালিয়ে গেছে স্বৈর হাসিনা। এসময় সমস্ত ভয়কে উপেক্ষা করে সাহসের ডানা মেলেছেন মুক্তিকামী মানুষ। কথা বলেছেন কবি কবিতায়।গল্পকার গল্পে,রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বক্তব্যে। সোশ্যাল মিডিয়া ছিল কথা বলার নিজস্ব মুক্ত মাধ্যম । অবশ্য সেখানেও পড়েছিল স্বৈর নখরের বিষাক্ত থাবা। উত্তাল সময়ে সারা বাংলায় কবিরা ছিলেন সোচ্চার। তাদের কবিতায় ছিল মুক্তির স্লোগান। ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বজ্র আহবান। তারা সাহস জুগিয়েছেন আন্দোলনের কর্মীদের।বিবৃত করেছেন সমগ্র তপ্ত সময়কে। স্বৈরাচারের দোসর ছিল অগণিত। তার বিপক্ষে সাহসী কবির সংখ্যাও কম না। সেসব সাহসী কবিদের দুঃসাহসী পঙক্তিগুলোর একত্রিত সংকলনের নাম ‘ বৃত্তান্ত’। অগণিত কবিদের কবিতা থেকে অল্প সংখক কবির কবিতা সংকলনই বলা যায়। অল্পের ভিতরও অনেক, প্রায় ১১৮ জন কবির কবিতা সংকলিত হয়েছে বৃত্তান্তে। আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেকের কবিতা লিপিবদ্ধ হওয়ার দাবী রাখে। অন্তত জানবাজ যেসব কবি অসম সাহসে আন্দোলন মুহূর্তে বা তারও আগে সক্রিয় ছিল তাদের কবিতাও গ্রন্থভূক্ত হতে পারতো। হয়তো নানা সীমাবদ্ধতায় আটকে যাওয়ায় কলেবর বৃদ্ধির সুযোগ ছিল না। তবু এটি একটি দালিলিক কাজ হয়েছে। শাদমান শাহিদ শ্রম,মেধা,সময় ব্যায় করে মলাটবদ্ধ করেছেন বিপ্লবী কবিদের কবিতা। সম্পাদক বলেন, এই আশ্চর্য সন্তানদের উদ্দেশে আমাদের এই ক্ষুদ্র আয়োজন।’ আয়োজনের শুরুতেই স্থান পেয়েছে কবি,চিন্তক,রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহারের কবিতা ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘। আলহামদুলিল্লাহ নিয়ে এই আলোচকের আছে আলাদা একটি আলোচনা বা বিশ্লেষণ। যা একটি জনপ্রিয় অনলাইন ওয়েবজিনে প্রচার হয়েছিল।তারপর কবিতা লিখেছেন যথাক্রমে, মাহবুব হাসান, শহীদুুল্লাহ ফরায়জী,রহমান হেনরী,শাহীন রেজা,জগলুল হায়দার, মাসুদ খান,মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন,কাজী জহিরুল ইসলাম।
ফরিদ ভূঁইয়া’র কবিতায় আছে ইতিহাসের পরম্পরা।তিনি লিখেন, ‘ বিংশ শতাব্দীর পরিক্রমা-/
ভাষার বায়ান্ন/ উর্দি ছেঁড়ার উনসত্তর/ স্বাধীনতা সংগ্রামের একাত্তর/ তারপর,আবারও উর্দি ছেঁড়ার নব্বই…/ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেখেছ সবাই/ পর পর গুলিবিদ্ধ, তবু সটান – সাহসে সুঠাম বাংলাদেশ।( তুমি ও বাংলাদেশ)। শান্তা মারিয়া বলেছেন ‘ নতুন ইকারুস আবু সাঈদ ‘। মহিবুর রহিম,মুজতাহিদ ফারুকী,পারভেজ চৌধুরী, মিজানুর রহমান শামীম,শাকিল রিয়াজ,সোহেল হাসান গালিব,সায়ীদ আবুবকর, জুলফিকার শাহাদাৎ, ইমতিয়াজ মাহমুদ,ফজলুল হক তুহিন, আলতাফ শাহনেওয়াজদের কবিতায় সংকলনটি সমৃদ্ধ হয়েছে।
সম্পাদক ছড়া ও কবিতাকে একত্র না করে পৃথক বিন্যাসে গ্রন্থভুক্ত করতে পারতেন। ছড়া মূলত এখন সাহিত্যের সম্পূর্ণ পৃথক শাখা। এক করে দেখার সুযোগ নাই। একই সংকলনে থাকতে সমস্যা নাই। তবে ছড়াকে কবিতার চিপায়চাপায় না রেখে ছড়া আলাদা রাখলে দৃষ্টিনন্দন হত বলে বিশ্বাস।
‘আধিপত্যবাদের জনক প্রতিবেশীর মওকাতে/ বাকশালীদের হুক্কা হুয়া একদলীয় নৌকাতে/(দুঃশাসন: হোসেন জয়দ্রথ)।’
হোসেন জয়দ্রথ র পঙক্তি বিশ্লেষণে গেলে প্রেক্ষিত : ও চরিত্র উন্মোচিত হয়। আধিপত্যবাদের জনকদের মওকা,আশকারা,প্রশ্রয়ে একদলীয় নৌকায় ঝেঁকে বসেছিল বাকশালীদের শেয়ালগুলো। তারা বিগত পনের বছর অবিরাম করে গেছে হুক্কাহুয়া রব।
জব্বার আল নাঈমের কবিতার শিরোনাম ‘ শাহবাগ ‘। শাহবাগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। এর সাথে রাজনীতির অনেক অধ্যায় জড়িয়ে আছে। সাইয়েদ জামিল কবিতায় লিখেছেন বিপ্লবের দিনলিপি। আরও কবিতা লিখেছেন, রাসেল রায়হান,সালেহীন শিপ্রা, আমিনুল ইসলাম মামুন,হিজল জোবায়ের,প্রতীক ওমর,হাসনাইন হীরা,সাম্য শাহ, রফিক লিটন।
আন্দোলনকে পরোয়া করেনি বলেই কবি হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। বেপরোয়া না হলে অদম্য হওয়া যায় না। সাহসী হওয়া যায় না।শামশাম তাজিল কবি।আন্দোলনে সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা কবি। শামশাম তাজিল ২৪ এর মালিকা হামিরাকে লক্ষ করে বলেন, ‘গুলির লক্ষ্যবস্ত যখন আমার মাথা ও বুক– / সিনা টান করে দাঁড়াব/… বন্দুকের নল গুঁড়িয়ে দেব,ঘুরিয়েও দেব।’ আমরা প্রচলিত বয়ানে পাঠ করি বন্দুকের নল পাছায় ঢুকিয়ে দেব।আয় শালারপুত।কবি বলেই বলেছেন শালীন ভাষায়।
এবারের আন্দোলনে কবিদের অংশগ্রহণ ছিল স্মরণ রাখার মতো। তারা যেমন ছিলেন কবিতায়, তেমন সরব ছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।হাজির ছিলেন রাজপথে। পলিয়ার ওয়াহিদ ১৮ জুলাই লিখেন,’ পরিণতি ভাবছো নাকি/ শেখের বেটি আর/ মরণ তোমায় নেবে না গো/ সাঈদে ছারখার/( তোমার সময় শেষ: পলিয়ার ওয়াহিদ)’। ছায়াকারবালা হাসান রোবায়েতের কবিতা।ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিতাই।তবে আন্দোলন শুরুর আগেই লেখা এই কবিতা।এটিও ‘ বৃত্তান্ত’ এ ছাপা হয়েছে। কবিতা লিখেছেন, শোয়েব সাদাব,ফারুক মোহাম্মদ ওমর,রাশিদ খান,মাহবুবা করিম,আবিদ আজম,সাইদ উজ্জ্বল,রিগ্যান এসকান্দার, আকিব শিকদার,আহমদ সাইফ,সিদরাতুল মুনতাহা,লোকমান হোসেন জীবন,বাপ্পা আজিজুল, সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব,খাদিজা ইভ। এই যে আন্দোলন,স্লোগান, বুকের তাজা রক্ত দান! এসবের নায়ক কারা? এমন প্রশ্নের জবাব এসেছে কবি নয়ন আহমেদ এর কবিতায়। কবি সরাসরি লেখেন,’ অগ্নিগর্ভ এই দেশকে জিগ্যেস করো- আমরা কারা।/…. আমরাই মহাকাল।/… আমরাই তিতুমীর। / এই কথা জানে মহামান্য বঙ্গোপসাগর। জানে তার উত্তাল ঢেউ/( আমরা: নয়ন আহমেদ)’। এমন যুগ জিঙ্গাসা, বাস্তবতা,বিষয় নিয়ে কবিতার শরীর তৈরী করেছেন সমকালীন বৈষম্যবিরোধী কবিগণ। এ তালিকায় আরও যারা আছেন তারা হলেন,চঞ্চল বাশার,ফারুক ফরায়েজি,কাদের বাবু,মাসুম আওয়াল, শাদমান শাহিদ প্রমুখ।
২৪ র গণঅভ্যুত্থানে যত স্মৃতি,ঘটনা, পক্ষের সকল তথ্য সংগ্রহ করা সময়ের দাবী। সাহিত্যে যে যা লিখেছেন সেগুলো একত্র করে প্রকাশ করা,প্রচার করা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। শাদমান শাহিদ সে দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা রাখলেন সম্পাদনা করে ‘ বৃত্তান্ত’। যত জনকেই সম্ভব হয়েছে তিনি গ্রন্থিত করেছেন।তাদের সৃষ্টি ও নাম সংরক্ষিত হয়ে গেল বৃত্তান্তের মলাটে। ভবিষ্যতে ‘বৃত্তান্ত’ ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র হিসেবে হাজির হবে। সচেতন সকলের আবশ্যক এই সংখ্যাটি সংগ্রহে রাখা।
‘বৃত্তান্ত ‘ আগস্ট ২০২৪,চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের কবিতা।প্রচ্ছদ : আল নোমান, মূল্য: ২০০ টাকা।সম্পাদক: শাদমান শাহিদ।