spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকশেখ হাসিনার পতন হলো যেভাবে

লিখেছেন : রেজা তানভীর

শেখ হাসিনার পতন হলো যেভাবে

     

রেজা তানভীর

২০২৪ এর নির্বাচনের আগে ভয়াবহ একটা অবস্থা ছিলো। তখন আমার এলাকার আওয়ামী বিরোধী লোকজন এলাকায় থাকতে পারে না। আওয়ামী  লীগ যেভাবেই হোক ৭ ই জানুয়ারীর নির্বাচন করে ফেলবে, চাপও তেমন নাই তাদের। কারণ এর আগের বছর ২৮ শে অক্টোবর বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ পণ্ড করে দিতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় সব নেতা জেলে নয়তো আত্মগোপনে।

আমি তখন অনলাইনে পত্রিকা পড়ি, দেশের খবরাখার জানার চেষ্টা করি। মানবজমিন কিছু ভালো প্রতিবেদন করে তখন এন্টি আওয়ামী ঘরনার লোকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। বিএনপি আরো আগে থেকেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলেছে। তবে স্যোশাল মিডিয়ায় কানাঘুষা চলছে বিএনপির অনেক নেতাকে এমপি হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। কিস্তু তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে, দুজনকে আওয়ামী লীগ বাগিয়ে নিতে পেরেছে। একজন শাহজাহান ওমর অন্যজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইব্রাহীম। এ দুজন শেখ হাসিনার কাছে এমপি এবং কিছু সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে নিজেদের বিক্রি করে দেয়।

আওয়ামী লীগ ৭ ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে একটা কৌশল নিয়েছিল, একই সাথে তাদের নৌকার প্রার্থী থাকবে এবং একাধিক ডামি প্রার্থী থাকবে। এতে করে আওয়ামী লীগ জনগণকে বুঝাতে চেয়েছিল একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তবে মানুষ জানে এসব ভুয়া ও লোক দেখানো নির্বাচন।

তখন আমাদের এমন একটা অবস্থা হয়েছিল যে, ফেসবুকে কিছু লেখতে পারতাম না। ফেসবুকে আওয়ামী সরকার বিরোধী কোনো পোস্ট করার সাথে সাথেই আমার বাবা বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের কাছে ফোন চলে আসত, পোস্ট ডিলেট করার জন্য।

৭ ই জানুয়ারির কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, ‘আওয়ামী লীগ প্রার্থী যখন নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ায় তখন চিন্তা করে কীভাবে ভোট ডাকাতি করে নির্বাচনে জিতবে, আবার অন্য আওয়ামী লীগ করা লোক যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ায় তখন চায় ভোট সুষ্ঠু হোক।’

আমার এলাকার সংসদীয় আসনেও তেমনই হয়েছিল। এখানের নৌকার প্রার্থী অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দিয়ে হারিয়ে দেয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীও আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতা কিন্তু প্রশাসন ও নেীকার প্রার্থীর কাছে তিনি ছিলেন রীতিমত অসহায়।

৭ ই জানুয়ারি পর্যন্ত আমি পত্রিকা থেকে আপডেট জানার চেষ্টা করতাম। ওইদিনের পর থেকে নিউজপোর্টালে ঘুরাফেরা বন্ধ করে দিই। পত্রিকা পড়ার কোনো আগ্রহ পাই না। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকি, হয়তো মাঝে মাঝে কোনো ইস্যুতে কথা বলি। কিন্তু আওয়ামী সরকার বিরোধী কোনো কিছু লেখা যায় না। পাছে না আবার ধরে নিয়ে যায়। শুধুমাত্র ফেসবুকে একটা পোস্ট লেখার অপরাধে লেখক মুশতাককে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি পরে নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারে মুত্যুবরণ করেন। এসব ব্যাপার মাঝে মাঝে তাড়া করে বেড়াত। তারপরও কিছু কমন ইস্যুতে মাঝে মাঝে লেখালেখি করি।

ইউটিউবে বিভিন্ন এক্টিভিস্টের কথাবার্তা শুনি। তারাই আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে নানা বয়ান তেরী করত যেটা হয়তো জনগণকে জুলাই আন্দোলনে রাস্তায় নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

৭ ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ পাঁচ বছরের জন্য টিকে গেল। আমার মত বেশিরভাগ মানুষই তাই ধরে নিয়েছিল।

এরপর আরো কয়েক মাস কেটে গেল। জুন মাসে শুনি, হাইকোর্ট সরকারী চাকরিতে কোটা প্রথা আবার বহাল করে। বিচারবিভাগ যে হাসিনার হুকুমে চলে সেটা নতুন করে বলার কিছু নাই। আওয়ামী লীগ যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা ফিরেয়ে এনেছে যেকোনো বিবেকবান মানুষই তা বুঝতে পারে। কোটা সংস্কারের জন্য ২০১৮ সালে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। তবে শিক্ষার্থীরা চেয়েছিল সংস্কার, বাতিল নয়, কিন্তু শেখ হাসিনা সংসদে দাঁঁড়িয়ে মৌখিক এক আদেশে ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিল ঘোষণা করে দেয়। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে সেটা আবার ফিরিয়ে আনার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে!

জুলাই মাসের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আন্দোলন কর্মসূচী শুরু করে। আন্দোলনের কর্মসূচী দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এবার কিছু একটা হতে পারে! ২০১৮ সালে দেখেছি, তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়।

৫ জুলাই আমি কোটা নিয়ে সর্বপ্রথম ফেসবুকে লিখি, ‘একটা পরিবারে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কয় প্রজন্ম ভোগ করবে? নাতির পরে পুতি আসবে? তারপরের প্রজন্ম? এভাবে কী চলতেই থাকবে? রাষ্ট্রের বাকি নাগরিক কী ধইঞ্চা?’

আন্দোলনের গতিবিধি দেখে ৭ ই জুলাই আমি ফেসবুকে লিখি,  ‘১৮ সালের কোটা আন্দোলন থেকে নুরু, রাশেদ, ফারুক এরা উঠে এসেছে। ’২৪ এর কোটা আন্দোলন থেকে কারা উঠে আসে এটা দেখার বিষয়। হয়তো কেউ না-ও উঠে আসতে পারে।’

তবে আমার শেষ কথাটা সঠিক হয়নি। শেখ হাসিনার পতনের পর সমন্বয়করা জাতীয় হিরোতে পরিণত হয়েছিলেন।

১৪ ই জুলাই, শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতিরা কোটা পাবে?’ তিনি এই প্রশ্নের মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি ট্যাগ দেন। শেখ হাসিনা পনের বছর মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার এসব নিয়ে খেলেছে। এগুলোই ছিল তার ক্ষমতায় থাকার মূলধন।

সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ফেসবুকের নিউজফিডে দেখছিলাম, শেখ হাসিনার এই বক্তব্য কেউই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। নিউজফিড উত্তপ্ত।

সে সন্ধ্যায়ই আমি লিখি, ‘আওয়ামী লীগের নীতি কে পরোয়া করল আর কে পরোয়া করল না সেটা এখন আওয়ামী লীগের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাস এখন চরমে। বিএনপি জামাতের মতো দলকে কোণঠাসা করে দেয়ার পর আওয়ামী লীগ কোনো আন্দোলনকেই আর আমলে নিচ্ছে না।’

ওইদিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্লোগান উঠে, ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার সৈ¦রাচার।’ ফেসবুকের নিউজফিডে এসব শ্লোগানের ভিডিওতে ভরে যায়। এই আন্দোলনের দুই কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আগে থেকেই আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকায় আন্দোলনের খবর আরো দ্রুত পাই। মধ্যরাতেই নিউজফিড আরো উত্তপ্ত হয়ে যায় এক্টিভিস্টদের নানা পোস্ট ভিডিওতে। আমি ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের ভিডিওগুলো ফেসবুকে শেয়ার দিই। ফেসবুকেও লিখি, ‘রাজাকার শব্দটাও এখন আর জামাতের নাই, আমজনতার বানিয়ে ফেলেছে আওয়ামী লীগ।’ আরেক পোস্টে লিখি, ‘যখন তখন রাজাকার ট্যাগের বিস্ফোরণ ঘটেছে।’

ওইদিন রাতে ছাত্রলীগও মিছিল বের করে এবং আওয়ামী সরকারের প্রতিমন্ত্রী এম আরাফাতকেও ছাত্রলীগের সাথে মাঠে নামতে দেখা যায়।

পরদিন পনের জুলাই আরো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরী হয়। ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লাঠি ছুরি হাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। একট মেয়েকে মেরে এমন রক্তাক্ত করে ফেলে যে, হিংস্র জানোয়ার না হলে এভাবে একজন নারী শিক্ষার্থীর উপর ঝাপিয়ে পড়া সম্ভব না। আমার ফেসবুক বন্ধুতালিকার একজনকে হাসপতালে নেয়া হয়েছে, তিনি লেখক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তিনি খুব মার খেয়েছেন ছাত্রলীগের হাতে, তিনি নি:শ্বাস নিতে পারছিলেন না, হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে অক্সিজেন দেয়া হয়। তারপর তিনি কিছুটা সুস্থ হন বলে জানতে পারি। তার নাম হাসান ইনাম।

ওইদিন ছাত্রলীগের লাঠি ছুরির সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরস্ত্র হয়ে তা মোকাবেলা করে। অনেকে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে। ফেসবুকে এসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।

ওইদিন রাতেই আমি ফেসবুকে পোস্ট দিই, ‘অনেক বছর ধরে লিস্টে কোনো ধরনের লীগ রাখি না। সে যে-ই হোক না কেন!’

আরেকটা পোস্ট লিখি, ‘ছাত্রলীগ কারা করে, কোনো ভালো পরিবারের ছেলে কী ছাত্রলীগ করতে পারে?’

পরদিন ১৬ ই জুলাই। সকাল থেকেই অনলাইন পোর্টাল ও ফেসবুকের নিউজফিডে চোখ রাখছিলাম। সকাল ১১ টার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ছাত্রলীগের সংঘর্ষের খবর পাচ্ছিলাম। ওইদিন সন্ধ্যার পরই খবর পাই হায়েনাদের হাতে ছয়জন শহীদ হয়েছে। তার মধ্যে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদের বীরত্বের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে পুলিশের গুলির সামনে নিজের বুক পেতে দেন। পুলিশকে হয়তো বলেন, ‘গুলি কর, জীবন দিতে প্রস্তুত আমি।’ আবু সাঈদ নিরস্ত্র ছিলেন, তবুও তাকে কেন গুলি করা হলো? পুলিশ যে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে গুলি করল, পুলিশের কী হাত একটুও কাঁপল না?

চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ওয়াসিমের শহীদ হওয়ার খবর পাই। তিনি চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। মৃত্যুর আগে তিনি লিখেছিলেন, ‘চলে আসুন ষোলশহর।’

ওইদিন রাতেই দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার খবর আসে।

১৬ ই জুলাাই রাতে আমি ফেসবুকে লিখি, ‘আজকে দেশে একটা গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে কোটা ইস্যুতে ছয়জন মানুষকে মারা যেত হতো না।’

সারাদিন ফেসবুকের নিউজফিড রক্ত, হামলা ও আন্দোলনের পোস্ট নিয়ে উত্তপ্ত ছিল। এই উত্তপ্ত অবস্থায় রাতে ঘুমাতে গেলাম।

পরদিন ১৭ ই জুলাই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজপথে জোরদার ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, সাউথ ইস্টের ছেলেমেয়েরা পুলিশের সাথে তুমুলভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এলিট পরিবারের ছেলেমেয়েরাও জীবন দিচ্ছে, আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি কতটা ক্ষোভ জন্মালে তারা রাস্তায় নামতে পারে এটা ভাছিলাম ওইদিন।

ওইদিন দুপুরে আমি ফেসবুকে লিখি, ‘জালিমের চোখে চোখ রেখে শিক্ষাথীরা যে ফাইট দিচ্ছে তাতে আমি বিস্মিত।’

আরো একটা পোস্টে লিখি, ‘ছাত্রলীগের চাইতে সাধারণ শিক্ষাথীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হলে সব ক্যাম্পাস থেকেই ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা সম্ভব। এর জন্য দরকার সাহস ও দৃঢ়চেতা মনোবল।’

আরো একটা পোস্টে লিখি, ‘আওয়ামী লীগের লোক মরলে মানুষ হা হা দেয়, আলহামদুলিল্লাহ বলে কেন? কারণ আওয়ামী লীগ গত পনের বছরে এমন কোনো পাপ নেই করেনি। তারা যদি এক মেয়াদ পরপর ক্ষমতায় আসতো তাহলে এত করুণ অবস্থা হতো না। আওয়ামী লীগকে মানুষ ভয় পায় ও ঘৃণা করে।’

পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয় ১৮ ই জুলাই। সেদিন সারাদেশে ছাত্রদের সাথে পুলিশ ছাত্রলীগ যুবলীগ আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ তুমুল আকার ধারণ করে। সেতু ভবন, বিটিভি ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ছাত্রদের মৃত্যুর সংখ্যা কিছুক্ষণ পরপর বাড়তেই থাকে। ফেসবুকে শিক্ষাথীদের রক্তাক্ত ছবি, আহতদের হাসপাতালে নেয়ার ছবি, কারো শহীদ হওয়ার সংবাদে নিউজফিড শোকে ভারী হয়ে ইঠে।

ওইদিন বিকেলের দিকে টেলিভিশনের খবরে দেখি, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসতে চায় আইনমন্ত্রী। তবে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংগঠন বেষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওইদিন সন্ধ্যার পরপরই সংবাদ পাই সারাদেশে পঞ্চাশ জনেরও বেশি ছাত্র শহীদ হয়। যার মধ্যে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও আছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র যারা হয়তো কখনো সরকারী চাকরির জন্য আবেদনই করবে না, কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি ঘৃণা ও অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়েই তারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছে। এদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের স্বাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মৃত্যু সংবাদ সবাইকে কাঁদিয়েছে। মুগ্ধ আন্দোলনকারী শিক্ষাথীদের মাঝে পানির বোতল বিতরণ করছিল। তার শহীদ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, তিনি বলছিলেন, ‘পানি লাগবে কারো পানি?’ এই পানির বোতল বিতরণের কিছুক্ষণ পরই তিনি ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।

ওইদিন এতবেশি শহীদ ও আহত হয় যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তোলপাড় হয়ে যায়। রাত নয়টার পর অনলাইনে আর প্রবেশ করা যাচ্ছিল না। ওইদিন রাত থেকে কয়েকদিনের জন্য আন্দোলনের সঠিক খবর পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

১৯ জুলাই, ইন্টারনেট আগের রাতেই বন্ধ করে দেয়ায় দেশে আসলে কী ঘটছে তা জানা যাচ্ছিল না। কোনো টিভি চ্যানেল মৃত্যু ও আহতের সঠিক সংবাদ প্রকাশ করে না। আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা স্থাপনা ভাঙচুরের কথা বলে কিন্তু এরমধ্যেই শতশত মানুষকে যে মেরে ফেলল সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নাই। তবে, এদিন তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সাথে আালাচনায় বসে এবং সমন্বয়করা নয় দফা দাবি পেশ করে। কিন্তু মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয় আট দফা দাবি। নয় দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল, শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া এবং দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শাট ডাউন চালিয়ে নেয়ার ঘোষণা করে।

এদিন রাতেই কারফিউ ঘোষণা করা হয়। কারফিউ ঘোষণায় আতঙ্ক আরো বেড়ে গেল। কয়েক মাস আগে থেকেই প্রিন্ট পত্রিকা নেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। ইন্টারনেটবিহীন এই সময়ে নিউজ পাওয়ার একমাত্র সোর্স তাই স্যাটেলাইট টেলিভিশন। তবে, বাজার থেকে দুইদিন পত্রিকা এনেছি। কারফিউর সময়ে ছাপা পত্রিকা নিউজ জানার একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিলো। তবে পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনের নিউজ দেখে মনে হয়েছে কারফিউতে ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। পনের বছরের বঞ্চনা ও ক্ষোভ প্রদর্শনের জন্যই তাদের রাস্তায় নামা। কারফিউতে শত শত নিম্ন আয়ের মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন।

২১ শে জুলাই। সেদিনও কারফিউ। সেদিন সরকার আরেক নাটক করে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ৪ ই জুলাই বলেছিল, ‘রাজপথের আন্দোলন দেখে সুপ্রিমকার্ট হাইকোর্ট রায় পরিবর্তন করে না।

জুলাই ১০ তারিখে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘কোটা নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন তারা কেন নির্বাহী বিভাগের কথা বলে? নির্বাহী বিভাগের যেকোনো সিদ্ধান্ত তো আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।’

কিন্তু প্রধান বিচারপতির সুর আজ পাল্টে যায়। তিনি বলেন, কোটার মতো নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়ে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না, এমনকি নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আদালত কোনো পরামর্শও দিতে পারে না। ফলে হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হলো।

এই কথা শুনে আমার মনে হলো, ‘ওরে বাটপার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ওরে শেখ হাসিনার দালাল। ওরে হারামির বাচ্চা।’

এদিন আদালত ৭% কোটা রাখার পক্ষে রায় দেয়।

এদিনও সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।

২২ শে জুলাই দুপুরবেলা ভাত খেতে খেতে খবর দেখছিলাম। এসময় আমার ভাইয়ের ফোনে একটা কল আসে। তাকে তার এক বন্ধু জানায়, তার নামে মিরসরাই থানায় গাড়ি পোড়ানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বাদী হয়ে আমার ভাইসহ আরো কয়েকজনের নামে মামলা দেয় বলে জানতে পারি। সে সন্ধাবেলায় বাড়ী ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যায়। রাতেই শুনতে পাই এলাকার বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ।

২৩ শে জুলাই রাত থেকে ইন্টারনেটে একটু একটু প্রবেশ করা যাচ্ছিল। তবে, নেট অনেক স্লো। ফেসবুক এবং টেলিগ্রামের কয়েকটা গ্রুপে যা দেখলাম তা এককথায় শিউরে উঠার মতো। কারফিউতে কতশত মানুষকে যে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। একটা ভিডিও দেখলাম, যেখানে কিছু লাশকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় গণকবরের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। কারফিউতেই পরিষ্কার হয়ে যায় এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কার আন্দোলন বা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাঝে সীমাবদ্ধ নাই। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ জনতার মধ্যেও।

তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এই সময় নানরাকম বিতর্কিত কথা বলে। একবার বলে ডাটা সেন্টার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, একবার বলে ইন্টারনেট নিজে নিজে বন্ধ হযে গেছে, আরেকবার বলে, ইন্টারনেট সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।

কারফিউতে যে পরিমাণ প্রাণহানি হয়েছে সেদিকে স্বৈরাচার সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির চেয়েও তাদের শোক বিভিন্ন স্থাপনা কেন ধ্বংস হয়েছে!

২৫ শে জুলাই আমি ফেসবুকে লিখি, ‘আমেরিকার একজন দার্শনিক বলেছেন, এক হাজার বিমানের চেয়েও একজন মানুষের জীবনের মূল্য অনেক।’

২৭ জুলাই পোস্ট দেই, ‘কার্ল মার্কস বলেছেন, গণহত্যার পর লাশের সাগরের দিকে বুর্জোয়া শ্রেণী এক পলকও তাকাবে না। অথচ কিছু ভাঙা ইট, কাঠ আর সিমেন্ট দেখে তাদের কান্নার রোল পড়ে যাবে।’

৩০ শে জুলাই, সারাদেশে আন্দোলনের পক্ষের মানুষ নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল করে অন্যদিকে স্বৈরাচারের পক্ষের লোকেরা তাদের প্রোফাইল কালো করে। তবে, দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল করে, গুটিকয়েক স্বৈরাচারের পক্ষের লোক ছাড়া। তবে, এই প্রোফাইল লাল ও কালো করার মাধ্যমে আন্দোলনের পক্ষ বিপক্ষের মানুষের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যায়।

আগস্টের ২ তারিখ লিখি, ‘হাসিনা গদিতে থাকবে কী থাকবে না এ সপ্তাহে বুঝা যাবে।’

ওইদিন আরো একটা পোস্ট দিই, ‘আওয়ামী লীগ ভেবেছিল, বিএনপি জামাতকে মেরে যেভাবে ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়েছে, সেভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও মেরে ঠাণ্ডা করে দিবে। আওয়ামী লীগের পলিসি ভুল। শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ মানুষও এবার জেগেছে। হাসিনাকে এবার যেতে হবে।’

আগস্ট ৩ তারিখে আমি পোস্ট দিই, ঢাকায় নাকি পুলিশের তেমন অবস্থান নাই, এটা কতটুকু সত্য?

কয়েকজনে কমেন্ট করে জানিয়েছে, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি বনশ্রী, রামপুরায় তারা পুলিশ দেখে নাই।

এদিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা দাবি ঘোষণা করে।

আন্দোলনের গতিবিধি দেখে ৪ আগস্টই আমি পোস্ট দিই, ‘আর্মি ছাত্রদের পক্ষে আছে বিজয় সন্নিকটে।’

আমার এই পোস্টে বেশ কয়েকজন প্রতিক্রিয়া দেখায়, তারা বলে, কীভাবে নিশ্চিত হলেন আার্মি ছাত্রদের পক্ষে আছে! তারা বুঝাতে চেয়েছে, কারফিউতে আর্মি অনেক লোককে মেরেছে। আর্মির গতিবিধি এখনো সন্দেহজনক।

তবে ওইদিন সকাল থেকেই ফেসবুকের নিউজফিডে দেখছিলাম, আর্মি চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় ছাত্রদের শেল্টার দিয়েছে। ছাত্রদের রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছে।

ওইদিন দুপুরের দিকেই এক্টিভিস্ট জুলকারনাইন সায়ের এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করেন, তিনি আর্মির ভেতরের বিশেষ সূত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন, আর্মি অফিসারদের মির্টিংয়ে জুনিয়র অফিসাররা ছাত্র জনতার উপর গুলি চালাতে রাজি নয় মত দিয়েছে।

এদিন সারাদেশে নাগরিকদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো জনতা একত্রিত হয়।

৫ আগস্ট সকাল থেকেই ইন্টারনেটে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না। তাই কারফিউতে কী হচ্ছে তার খবর পাচ্ছিলাম না। টেলিভিশনও দেখতে ইচ্ছে করছিল না।

দুপুরের দিকে আমার এক বন্ধু ফোন দিয়ে জানায়, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ওর কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাই তাড়াহুড়ো করে টেলিভিশন অন করে দেখি, শেখ হাসিনা আসলেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। জনতা গনভবনে ঢুকে পড়েছে। সারাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে ফ্যাসিস্ট পতনের উল্লাস করছে। ব্যাপারটা আমাকে সেদিন খুব আনন্দিত করেছিল।

তবে, সবচেয়ে দু;খজনক ব্যাপার হচ্ছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরও পুলিশ গুলি করে শতশত মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।

১৬ ই জুলাই থেকে ৫ ই আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হাতে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে, লাখ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের কেউই কোনো কিছু পাওয়ার বিনিময়ে আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেনি। জুলাই মাস জুড়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার মানুষ হত্যার হলিখেলায় নেমেছিল। বাংলার মাটিতে হত্যাকারীদের বিচার না হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে না।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প