spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েসহজ সুন্দর মনের কবি রেজা নুর

লিখেছেন : মাহমুদ নোমান

সহজ সুন্দর মনের কবি রেজা নুর


| মাহমুদ নোমান |

কবিতা বুঝি এমনই যাঁর কাছে যায় তাঁর হয়ে যায়, মাঝেমধ্যে মনে হয় এই কবিতাটি আমার লেখার কথা ছিল। হয়তো আমি সেই কবিতাকে তখন নিজের করে নিতে পারিনি। আফসোস নয়, কবির কাছে কবিতা যখন উপস্থিত হয় কেউ কোনোকালে ছুঁইতে পারেনি তেমন পবিত্র আত্মায় আচ্ছন্নে মহান শক্তির আরাধ্য হয়ে কবির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। উপরোক্ত কথাগুলো জ্ঞানে আলোড়ন তুলেছে সম্প্রতি রেজা নূরের কবিতা পড়ার পরবর্তী পাঠ প্রতিক্রিয়ায়। কেমন এক স্নিগ্ধ শান্তির নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে আটকে পড়ে মায়ার খেয়াল; আন্তরিক বলনে সেই খেয়ালের দারুণ মূর্ছনার মধ্যে বাহিত করে সত্যে উপনীত বোধের কৌমার্য সহজাতভাবে…

সহজ সুন্দর মনের কবি রেজা নূর। অন্তত নিজের কবিতার মধ্যে আলগা ভাব পরিলক্ষিত হয়নি। নিজের যতটুকু আয়োজন সব তাঁর কবিতার জন্য। এমন সৎ ও সততার মধ্যে ফোটে একেক ধাঁচের ফুল যেন – এই এক নির্ভেজাল আকুতি…

শব্দের চমক জাগানিয়া না-ই বা থাকুক, এমনকি নতুন শব্দ তুলে ধরার সেই চেষ্টাটুকুও হয়তো করেননি কিন্তু কেমন জানি রেজা নূরের কবিতা পড়ে মনে হল উনার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলি কবির খুব পরিচিত ও আপনজনের; আবেদনে আর নিবেদনে জড়াজড়ি করে থাকে। ভাষার অতলান্ত জটিল নয় আবার হুট করে বুঝে নিবেন তেমনও নয় অথচ মার্জিত বয়ানে ভাবিত করে, ভাবতে নিয়ে যেতে পারে পাঠককে সঙ্গে নিয়ে –

ক.
অন্য দিনের মতোই লাগছে আজকের সকাল
শুধু সূর্যটা অনেক উঁচু ঘুড়ির মতো চুপ হয়ে আছে
আলোর সুতো নাড়িয়ে দিয়েছে হাওয়া।

কিছুটা দূরের ফুলের মধু খেতে যাবে, ভাবছে প্রজাপতি
ঝুরঝুর আলো ঝেড়ে ফেলছে ব্যস্ত পাখনা থেকে,

পাতার জানালা খুলে দেখছে পাখিরা
কতটা সকাল হলো,কতটুকু শুকালো শিশির…

  • অন্যরকম দিন)

উপরোক্ত কবিতাটি ‘এই জল নদী ছিল’ কবিতা বইয়ের, কী নেই কবিতাটির মধ্যে ভাবতে পারেন চুপচাপ। মাটি সংলগ্ন ভাবের এমন ব্যঞ্জনা এখনকার কবিতায় অনুপস্থিত শুধু নয় তালি জোড়া দিয়ে চালিয়ে দেওয়া কবিতায় মাটিতে শুয়ে পড়ার সেই সুখ কখন কল্পনাও করতে পারে না। সেখানে রেজা নূরের কবিতা মাটিতে গড়াগড়ি দেয়, সবুজানন্দের প্রকৃতির পাঠ নিবিড়ে নিয়ে যায় মায়াবী জাল বুনে; হঠাৎ অল্প সময়ের বৃষ্টি, হালকা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে সেই বৃষ্টি হঠাৎই থেমে গেল, এরপর উঠল সূর্য হেসে এমন মনটানার কবিতা রেজা নূরের, ভেতরকার দাগিয়ে দেয়। রিদমিক দোলা দেওয়া তাল লয়ের চমকে চিকমিকি রোশনাই মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেবে…..

০২.
রেজা নূরের কবিতায় তথাকথিত ছন্দ নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই, তবে ছন্দের সাথে ভাবের গলাগলি বেশ জমিয়ে দেয়। রেজা নুরের কবিতায় হালকার উপর মধুর যাতনা আছে। মিষ্টিমুখ করে পড়ার তাগিদ আছে। ঘোলাটে নদীর মতো বয়ে চলার কলহও আছে। নির্ভেজাল আকুতিভরা টলটলে অশ্রু মুছে দাঁড়াবার প্রণোদনা সত্যিই চমৎকার ; এরপরে বলতে পারেন কবিতা হওয়া আর না- হওয়া ব্যাপারটার সুরাহা করার কেউ আছেন বলে মনে হয় না। আমিও নই…
এক্ষেত্রে একটি জিজ্ঞাসা যে, কবি কী পাঠকের জন্য লিখে?
এই জিজ্ঞাসা নিয়ে তর্কবিতর্ক হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু উভয়পক্ষের কাউকে জয়ী করা যায় না অথচ উভয়পক্ষের যুক্তি তাঁদের কাছে সত্যি! ব্যাপারটা হচ্ছে কবি পাঠকের চিন্তা করে লিখলে নিজের বলাটা থাকে না আবার শুধু নিজের জন্য যদি লেখে তখন পাঠকের মনোস্পেস ধরতে পারে না ; এক্ষেত্রে আরেকটা কথা বলি আপনি লেখাটা যতক্ষণ নিজের কাছে রেখে দিলেন, কাউকে পড়তে দিলেন না এমনকি দেখতেও দিলেন না ততক্ষণ ঠিক আছে যে আপনি নিজের জন্য লিখেন কিন্তু যখনি অন্যজনকে পড়তে দিলেন তখন আলোচনা সমালোচনা দুটোই আশা করা উচিত;

আমি মনে করি, কবিত্ব-কলা বেশ সাধনার শুধু নয় সাধনকে অনুশীলনের ব্যাপারও, নিজের ভাব-বোধ ভেঙে দেওয়ার এই অনুশীলন আর অনুশাসন, এখানেই একেক কবি পৃথক হয়ে যায় একেক কবি থেকে ;
আমি বরাবরই বলি এখনকার কবিতা ঠেঁস( খোঁচা) মারা কবিতা। এক সত্যকে অন্য সত্যের প্রলেপ দিয়ে প্রকাশ করা, এটাকে পরাবাস্তবতা বলে। পরাবাস্তবতার মধ্যেও সহজাত ছন্দের স্পন্দিত মাধ্যম রেজা নূরের কবিতা-

ক.
বনগুলো কেন যে দাঁড়ানো
এখনো বোঝে না
সবুজ কারও প্রিয় নয় আর,
সূর্যাস্তের রঙ দেখে
শিখে নেয় বিনাশের গূঢ়তা।

বৃক্ষের প্রাচীন খোড়লে
বৃষ্টির আশ্রয় ছিল
কোনোকালে

জলে…
নদীরা স্রোত হয়ে পালাল ওই দূরের দক্ষিণে,
সবুজ সিঁথিতে বিলি কাটে মিহিন জলের ঢেউ
হরিণের মতন উদাস ঘোরে-ফেরে নিদ্রালু কেউ।

  • বনকথা;১০পৃ.)

খ.
কথা বলতে ইচ্ছে করে না এখন,
ভালো লাগে চুপ হয়ে থাকতে…

কখনো বারান্দায় বা বাড়ির পেছনে
বিকেলে আলোর সাথে
বসে যাই ঘাসে,
সরু-চোখে দেখি পিঁপড়ের সারি…

পাখিরা হঠাৎ আসে
পাইনের ডালে,
সী-গাল স্নান করে সৈকতে
বালিহাঁস সাঁতরায় বাতাসে…

  • নীরবতা; ১৮পৃ.)

গ.
নীরবতার অর্থ যদি
এখনো না বোঝো
ভোরের কোকিল শান্ত কেন
দুপুর হলেই খোঁজো

  • চূর্ণপদ্য;৭১ পৃ.)

এই জল নদী ছিল কবিতা বইয়ে রেজা নূরের ভাষা গীতল, সুস্থির বক্তব্যে কখনো অন্ত্যমিলে নিজের খেয়ালে কবিতা লিখে গেছেন। চিত্রিত ভাবকল্পে পারদর্শী স্বরে উচাটন মনের নির্ভেজাল আকুতি, সদা ধ্যাণস্থ কবিতার সৃজিত আলয়ে; উপমার বুণনে স্বতস্ফুর্ততা রেজা নূরের কবিতাকে করেছে আরও অর্থবহ, যেমন –

১. মেঘ-শিশুর বুদবুদ হাঁসের ছানার মতো

২. শুধু সূর্যটা অনেক উঁচু ঘুড়ির মতো চুপ হয়ে আছে

চিত্রকল্পের ভাসানে সাঁতরে চলে যাওয়া কবির কবিতা বইয়ের নাম- এই জল নদী ছিল’…কিছু বিশেষ্যের বিশেষণ ও ক্রিয়া বিশেষণ হঠাৎই পুলকসঞ্চার করে আর কিছু শব্দবন্ধনের জনকও হয়ে যায় রেজা নূর। আবার কিছু সমাসসাধিত শব্দ রেজা নূরের কবিতাকে করেছে অনন্য; যেমন-
ছায়াফুল, সূর্য-সুষমা, রোদের ফুটকি, জলজ নিক্কণ, কুমারী জলের বোঁটায়, নিঝুম বৃক্ষের ওম, মেঘের মানচিত্রে, ডালিম চিবুক…

রেজা নুর মূলত রোমান্টিসিজমের মন্ত্র উচ্চারণের কবি। প্রকৃতির সাথে যাঁর সংসারে ছিটকানি টেনে দিয়ে রাখে চঞ্চল বিরহিয়া সুর, লুটিয়ে পড়ে থাকে বোধ-ভাবের সমস্ত আকুলিবিকুলি-

ছোট্ট জলস্রোত
মুখ লুকানো বালুতে,
দু’পাশে গাছপালা বন ঝোঁপঝাড়
এর নাম ব্লাক ব্রুক… কালো নদী।

যাবার সময় নাম আর জলের দিকে তাকাই
মনে হয়, এই জল নদী ছিল কোনোকালে।

পিলগ্রম এসেছিলেন তৃষ্ণার মিঠে জলের খোঁজে
সেই জল ক্লান্ত তরল,
নদী আর নদী নেই, শুধু
ধু-ধু সাদা চর। দুই ধারে উঁচু উঁচু বাতির পিলার।

  • এই জল নদী ছিল;৮০পৃ.)

বইটির শেষ কবিতা নাম কবিতাটি, শেষে এসে বইয়ের মর্মার্থ বুঝিয়ে দিতে এই কবিতাটিই যথেষ্ট। এই জল- যেন হাতে নিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, একদিন নদী ছিল সেই মর্মরিত সত্যে রেজা নূরের রহস্য ঘেরা কবিতার নিদারুণ মুচকি হাসি…

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প